পোকাবৃত্তান্ত by সৈয়দ আবুল মকসুদ
পোকায় আক্রান্ত আজ বাংলার মাটি। শুধু বাংলার মাটি হলে কথা ছিল না,
বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানা গেছে, পোকা কয়েক
সপ্তাহ ধরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক
সৃষ্টি করেছে। কলেজের বিশাল রেইনট্রিগাছ সম্পূর্ণ তাদের দখলে। সেখান থেকে
ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসে। কামড়ায় না কাউকে, তবে পোকার গায়ে লেগে থাকা
পাউডারের মতো একধরনের ধুলায় চুলকানি, ফোসকা পড়া, অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্ট
হয়। পোকার আতঙ্কে ছুটি হয়ে গেছে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ। [সমকাল, ২০
এপ্রিল]
সংবাদ
পত্রিকায় প্রকাশের পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কলেজ পরিদর্শন
করেছেন। পোকা প্রতিরোধে তিনি বিশেষজ্ঞ টিম গঠনের উদ্যোগ নেন।
শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীটতত্ত্ব
বিভাগের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ টিম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ময়মনসিংহ থেকে কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট
আরেকটি টিম কাজ শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগও বসে
নেই। ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।’ পুলিশ, র্যাবকে
অবশ্য এখনো পোকা দমনে অপারেশনে যাওয়ার কথা বলা হয়নি।
আমাদের আলোচ্য পোকা কোনো বঙ্গীয় পোকা নয়। এরা আফ্রিকান পোকা। একটা নামও আছে: জায়ান্ট মিলিবাগ। ‘পোকাগুলো দুই-তিন সেন্টিমিটার লম্বা, সাদাটে রং, অনেক পা আছে। পোকাগুলো উড়তে পারে না।’ পোকাকে ভয় পায় না, এমন মানুষ বিরল। আমিও পোকাকে ভয় পাই। তবু ওই পোকাকে স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তার মধ্যে একটি ছেলে আমাকে কয়েকটি পোকা এনে দেখায়। কিলবিল করতে দেখলে গা শিরশির করে।
প্রাণী দুই রকম। দুই পা-বিশিষ্ট এবং অনেক পা-বিশিষ্ট। পোকাগুলোর যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, তাহলে বিশেষজ্ঞ টিমের কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে পারত। প্রথম প্রশ্ন, দেশের এত শিক্ষাঙ্গন থাকতে তোমরা এই কলেজে কেন? পোকার মুখপাত্রের জবাব হতো:
আমরা বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে প্রথমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসেই যাই। খুবই চমৎকার ক্যাম্পাস। আমাদের বিচরণের জন্য খুবই উপযুক্ত। ইতিউতি তাকাতেই দেখতে পাই, দুই পা দুই হাতবিশিষ্ট একরকম পোকা। তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি ছিল না। আমাদের বিচরণ গাছে ও মাটিতে। হঠাৎ শুনি স্লোগান: জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো।
আমরা পোকা হতে পারি, কিন্তু নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা আছে। সন্ত্রাস থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাই। খুঁজতে থাকি এমন একটি শিক্ষাঙ্গন, যার ছাত্রীরা শান্তিপ্রিয়। তাই আজ এখানে।
তা স্লোগান শুনেই এত ঘাবড়ে গেলে কেন?
ক্যাম্পাসে কাটারাইফেল, পিস্তল, বোমা, চাপাতি, রামদার এস্তেমাল হলে আমাদের বিশেষ ক্ষতি ছিল না। আগুন জ্বালালে গাছপালা, ঝোপঝাড় দাউ দাউ করে জ্বলবে। তাতে দুই পা-বিশিষ্ট পোকার চেয়ে বহু পা-বিশিষ্ট আমরাই জ্বলেপুড়ে মরব।
বিশেষজ্ঞ দলের নেতার প্রশ্ন, তোমাদের কোনো সংগঠন আছে কি না?
প্রত্যুত্তরে পোকার মুখপাত্র বলে, আমরা পোকারা দল বেঁধে থাকি বটে কিন্তু লীগ, দল, শিবির—কোনো নামেই আমাদের কোনো সংগঠন নেই। আমরা হিংস্র না। দুই পা-ওয়ালাদের মতো সহপাঠীদের কুপিয়ে, পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যা করি না। আমাদের কারণে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার কোনো দেশেই কোনো দিন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। আমাদের ভয়ে কলেজ বন্ধ থাকবে, ছাত্রীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে—তা মোটেই কাম্য নয়। তবে আমাদের উপলক্ষেই কপাল খুলতে পারে অনেকের। আমাদের জন্মবেত্তান্ত জানতে কাউকে পাঠানো হতে পারে আফ্রিকায়, আমাদের জন্মভিটায়, কেউ বা যেতে পারেন লন্ডন, নিউইয়র্ক বড় বড় স্যুটকেস নিয়ে।
পোকা প্রতিনিধি বলে: ইতিহাস গড়ার দেশ এই বাংলা। আমাদের কারণেও এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো। এই প্রথম আমাদের নিয়ে কোনো দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রেস কনফারেন্স হলো। সিদ্ধান্ত হয়েছে, দুই ফুট গর্ত খুঁড়ে আমাদের জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। অথচ দুই পা-বিশিষ্ট পোকাদের যারা সহপাঠীদের পিটিয়ে মারে, তাদের শাস্তি সাময়িক বহিষ্কার। সাময়িক বহিষ্কার অবকাশ যাপনের মতো। দুই মাস পরেই তাদের সদর্প প্রত্যাবর্তন ক্যাম্পাসে। বরণ করে ধ্বনিত হয় স্লোগান: অমুক ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।
বিশেষজ্ঞ দলনেতাদের প্রতি পোকাদের শেষ বক্তব্য: আমাদের মতো নিরীহ পোকাদের নিয়ে পেরেশান না হয়ে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
আমাদের আলোচ্য পোকা কোনো বঙ্গীয় পোকা নয়। এরা আফ্রিকান পোকা। একটা নামও আছে: জায়ান্ট মিলিবাগ। ‘পোকাগুলো দুই-তিন সেন্টিমিটার লম্বা, সাদাটে রং, অনেক পা আছে। পোকাগুলো উড়তে পারে না।’ পোকাকে ভয় পায় না, এমন মানুষ বিরল। আমিও পোকাকে ভয় পাই। তবু ওই পোকাকে স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তার মধ্যে একটি ছেলে আমাকে কয়েকটি পোকা এনে দেখায়। কিলবিল করতে দেখলে গা শিরশির করে।
প্রাণী দুই রকম। দুই পা-বিশিষ্ট এবং অনেক পা-বিশিষ্ট। পোকাগুলোর যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, তাহলে বিশেষজ্ঞ টিমের কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে পারত। প্রথম প্রশ্ন, দেশের এত শিক্ষাঙ্গন থাকতে তোমরা এই কলেজে কেন? পোকার মুখপাত্রের জবাব হতো:
আমরা বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে প্রথমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসেই যাই। খুবই চমৎকার ক্যাম্পাস। আমাদের বিচরণের জন্য খুবই উপযুক্ত। ইতিউতি তাকাতেই দেখতে পাই, দুই পা দুই হাতবিশিষ্ট একরকম পোকা। তাতে আমাদের কোনো ক্ষতি ছিল না। আমাদের বিচরণ গাছে ও মাটিতে। হঠাৎ শুনি স্লোগান: জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো।
আমরা পোকা হতে পারি, কিন্তু নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা আছে। সন্ত্রাস থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাই। খুঁজতে থাকি এমন একটি শিক্ষাঙ্গন, যার ছাত্রীরা শান্তিপ্রিয়। তাই আজ এখানে।
তা স্লোগান শুনেই এত ঘাবড়ে গেলে কেন?
ক্যাম্পাসে কাটারাইফেল, পিস্তল, বোমা, চাপাতি, রামদার এস্তেমাল হলে আমাদের বিশেষ ক্ষতি ছিল না। আগুন জ্বালালে গাছপালা, ঝোপঝাড় দাউ দাউ করে জ্বলবে। তাতে দুই পা-বিশিষ্ট পোকার চেয়ে বহু পা-বিশিষ্ট আমরাই জ্বলেপুড়ে মরব।
বিশেষজ্ঞ দলের নেতার প্রশ্ন, তোমাদের কোনো সংগঠন আছে কি না?
প্রত্যুত্তরে পোকার মুখপাত্র বলে, আমরা পোকারা দল বেঁধে থাকি বটে কিন্তু লীগ, দল, শিবির—কোনো নামেই আমাদের কোনো সংগঠন নেই। আমরা হিংস্র না। দুই পা-ওয়ালাদের মতো সহপাঠীদের কুপিয়ে, পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যা করি না। আমাদের কারণে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার কোনো দেশেই কোনো দিন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। আমাদের ভয়ে কলেজ বন্ধ থাকবে, ছাত্রীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে—তা মোটেই কাম্য নয়। তবে আমাদের উপলক্ষেই কপাল খুলতে পারে অনেকের। আমাদের জন্মবেত্তান্ত জানতে কাউকে পাঠানো হতে পারে আফ্রিকায়, আমাদের জন্মভিটায়, কেউ বা যেতে পারেন লন্ডন, নিউইয়র্ক বড় বড় স্যুটকেস নিয়ে।
পোকা প্রতিনিধি বলে: ইতিহাস গড়ার দেশ এই বাংলা। আমাদের কারণেও এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো। এই প্রথম আমাদের নিয়ে কোনো দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রেস কনফারেন্স হলো। সিদ্ধান্ত হয়েছে, দুই ফুট গর্ত খুঁড়ে আমাদের জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। অথচ দুই পা-বিশিষ্ট পোকাদের যারা সহপাঠীদের পিটিয়ে মারে, তাদের শাস্তি সাময়িক বহিষ্কার। সাময়িক বহিষ্কার অবকাশ যাপনের মতো। দুই মাস পরেই তাদের সদর্প প্রত্যাবর্তন ক্যাম্পাসে। বরণ করে ধ্বনিত হয় স্লোগান: অমুক ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।
বিশেষজ্ঞ দলনেতাদের প্রতি পোকাদের শেষ বক্তব্য: আমাদের মতো নিরীহ পোকাদের নিয়ে পেরেশান না হয়ে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments