সাংবাদিকদের বধ্যভূমি? by মশিউল আলম
বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়ে হইচই ফেলে
দিয়েছিলেন পাকিস্তানের হামিদ মির। সেই থেকে বিখ্যাত সাংবাদিক। দুদিন আগে
তিনি সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন, তবে পাকিস্তানের অনেক সাংবাদিকের
তুলনায় তাঁর ভাগ্য ভালো। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে গেছেন।
এর মাত্র কিছুদিন আগেই অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জগতে আরেক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব রাজা রুমি। এক্সপ্রেস টিভি নামে এক বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, কলামিস্ট, ব্লগার ও উদার গণতন্ত্রী লেখক হিসেবে পরিচিত রাজা রুমিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গত ২৮ মার্চ কয়েকজন বন্দুকধারী তাঁর গাড়িতে গুলি চালিয়েছিল। তাঁর গাড়িচালক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, দেহরক্ষী গুরুতর আহত হয়েছেন।
হামিদ মির ও রাজা রুমি পাকিস্তানে বিখ্যাত সাংবাদিক বলে তাঁদের ওপর আক্রমণে দেশটিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তথ্যমন্ত্রী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন সংগঠন নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। হামিদ মিরের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু স্বল্প পরিচিত কিংবা অপরিচিত আঞ্চলিক সাংবাদিকেরা খুন হলে দেশটিতে এমন শোরগোল ওঠে না। সাংবাদিক হত্যা পাকিস্তানে একটা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ বছর গত তিন মাসেই দেশটিতে খুন হয়েছেন তিনজন সাংবাদিক। গত বছর খুন হয়েছিলেন সাতজন। তার আগের বছর নয়জন। রিপোর্টার্স সান ফ্রন্টিয়ার্সের হিসাবে পাকিস্তান সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর সারিতে দ্বিতীয়, এক নম্বরে আছে যুদ্ধজর্জরিত সিরিয়া।
হামিদ মিরের ওপর হামলা চালিয়েছে কারা? কী কারণে? কেউ জানে না। তবে পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকমের সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ বলছেন, হামিদ মির বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বড্ড বেশি সোচ্চার। এটা তার মাশুল। কেউ বলছেন, তিনি তালেবানকে আর পাত্তা দিচ্ছেন না; কিন্তু তালেবান সংবাদমাধ্যমে জায়গা চায়। আগে তিনি তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাদের কথা লিখতেন। আল-কায়েদা ও তালেবানের সঙ্গে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তাই তালেবান তাঁকে খতম করতে চেয়েছে। আর কিছু লোক বলছে, এই কর্ম করেছে অন্য কোনো পক্ষ, যারা সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের চলমান বিচার-প্রক্রিয়ার ওপর থেকে সংবাদমাধ্যম ও দেশবাসীর দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চায়। হামিদ মিরের ওপর হামলার ফলে সংবাদমাধ্যমে যে হইচই শুরু হবে, সেই ফাঁকে মোশাররফ পাকিস্তানের বাইরে চলে যাবেন। আরও কিছু লোকের সন্দেহ, হামিদ মির নিজেই সাজিয়েছেন তাঁর ওপর হামলার এই ‘নাটক’। তাঁর উদ্দেশ্য আরও প্রচার পাওয়া, আরও বিখ্যাত হওয়া।
তবে হামিদ মির নিজে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাঁর ওপর এই হামলার পেছনে আছে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। সন্দেহের কারণ অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু কিছু লোক এটা বিশ্বাস করে। আইএসআইয়ের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থের লোক আছে, তাদের কোনো একটি গ্রুপ এই কাজ করে থাকতেও পারে।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের অবস্থা দেশটির সামগ্রিক পরিস্থিতির মতোই ঘোলাটে। দেশটি সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনেকগুলো কারণে। বেলুচিস্তান কিংবা খাইবার পাখতুনখাওয়া, ইসলামাবাদ, করাচি কিংবা লাহোর—কোথায় কী কারণে কোন সাংবাদিক কোন গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হবেন, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বেলুচিস্তানে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সাংবাদিকদের হত্যা করছে তাঁদের সরকারের চর মনে করে। আবার সেখানকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল সাংবাদিকেরা খুন কিংবা গুম হয়ে যাচ্ছেন সরকারি এজেন্সির লোকদের দ্বারা। কোনো কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী নিষিদ্ধ গোষ্ঠী সাংবাদিক হত্যার পর নিজেরাই ঘোষণা করে যে তারা ওই সাংবাদিককে হত্যা করেছে, কারণ তিনি সরকারের চর ছিলেন। আফগান-সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে তালেবানের পাশাপাশি আছে মাদক চোরাকারবারিদের উপদ্রব। ওই সব অঞ্চলের অনেক সাংবাদিক মাদক ব্যবসায়ীদের হাতেও খুন হয়েছেন। এ ছাড়া, স্থানীয় রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি, বিশেষত আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশ করার কারণেও অনেক সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এমনকি দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য দেওয়া ওষুধ বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে—এ রকম প্রামাণ্য টিভি প্রতিবেদন প্রচার করার কারণেও গত বছর হত্যা করা হয়েছে একজন টিভি সাংবাদিককে। বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়, পাকিস্তানে টিভি সাংবাদিকদের ওপরই আক্রমণ হয় বেশি। হামিদ মির ও রাজা রুমিও টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বেশি পরিচিত।
পাকিস্তান সাংবাদিকদের ‘বধ্যভূমি’ হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ সে দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। সাংবাদিকদের কোনো নিরাপত্তা নেই; বস্তুত কোনো নাগরিকেরই কোনো নিরাপত্তা নেই। পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা রাষ্ট্রের কাছে আলাদা করে নিজেদের নিরাপত্তা দাবি করেন না। রাজা রুমির মতো সাংবাদিকেরা ব্যক্তিগত দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন। পাকিস্তানে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার দাবির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে সাংবাদিক হত্যার ক্ষেত্রে যে ‘কালচার অব ইমপিউনিটি’ বা বিচার না করার সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। পেশোয়ারের সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা তাই একটা সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার লক্ষ্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করা। তাঁরা রাষ্ট্রকে বলছেন: তুমি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, ঠিক আছে। কিন্তু সাংবাদিক খুন হলে তার বিচারও করবে না, এটা তো চলবে না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments