রোগীরা কষ্ট পাচ্ছেন চিকিৎসকদের হাতে!
দেশের তিনটি বড় হাসপাতালে চিকিৎসকদের
ধর্মঘটে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগীরা। ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা গতকাল মঙ্গলবারও কাজে
যোগ দেননি। ধর্মঘট চলছে রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল
কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে। আরেক বড় হাসপাতাল বারডেমের চিকিৎসকেরা
প্রতিদিনের মতো গতকালও এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন।
মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইলিয়াছ মোল্লা জানান, তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। গতকাল সকালে চোখ পরিষ্কার করার কথা ছিল। কিন্তু বেলা দুইটা পর্যন্ত কেউ করেনি। তিনি আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছি, তারাই যদি কষ্ট দেয়, কই যাব?’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং গণসংহতি আন্দোলন হাসপাতালগুলোতে অস্থিরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম কথায় কথায় ধর্মঘট না ডাকার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এই তিন হাসপাতালের ঘটনা তদন্তে তিনটি কমিটিও করেছে মন্ত্রণালয়।
রোগী আটক হাসপাতালে, ভাই পুলিশের কাছে: রাজশাহী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল নগরের সাগরপাড়া এলাকার স্কুলছাত্র আবিদ হোসেন ওরফে আকাশকে। তাকে সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগে তার ভাই আক্তার হোসেন একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের দিকে তেড়ে যান। এরপর শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা মিলে আক্তারকে বেদম পেটান। ওই সংবাদ সংগ্রহ করতে সাংবাদিকেরা হাসপাতালে গেলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হামলার শিকার হন ১০ সাংবাদিক। আবিদ পুলিশ পাহারায় অনেকটা বন্দী হয়ে আছে হাসপাতালে। আর তার বড় ভাই আক্তারকে দুই দিন ধরে আটকে রেখেছে পুলিশ।
আক্তারের স্ত্রী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ডাক্তাররা তাঁর স্বামীকে মেরে নাক-মুখ ফাটিয়ে দেন। এরপর তাঁর বুকে-পিঠে প্রচণ্ড আঘাত করেন। তিনি অনেকক্ষণ পড়ে থেকে গোঙাচ্ছিলেন। তাঁকে চিকিৎসা তো দূরের কথা, তাঁর মুখের রক্ত মোছার জন্য চিকিৎসকেরা এক টুকরা তুলাও দেননি। রাত আড়াইটা পর্যন্ত তাঁদের জিম্মি করে রাখা হয়। পরে তাঁকে এবং তাঁর মেয়েকে মহিলা পুলিশ সদস্যরা বাসায় দিয়ে যান। আর তাঁর স্বামীকে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। গতকাল পর্যন্ত তাঁর স্বামী ফিরে আসেননি। তবে গতকাল দুপুরে তাঁর স্বামী একজন পুলিশের মোবাইল ফোন থেকে ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁকে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
মামলা ছাড়াই একজন আহত মানুষকে বিনা চিকিৎসায় কেন আটকে রাখা হয়েছে—জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আক্তার হোসেন আসল প্রত্যক্ষদর্শী। কমিটি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এ জন্য তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে।
আক্তারের স্ত্রী জানান, তাঁর দেবর আবিদ রাজশাহী মডেল স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সোমবার রাতে তার হাত-পা শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা মনে করেছিলেন, সে হয়তো আর বেঁচে নেই। তাঁরা বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাত ১০টায় তাকে হাসপাতালে আনা হলেও কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তাঁর স্বামীকে মারধরেরও অনেক পরে আবিদকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন বলেন, আবিদ এখন মোটামুটি সুস্থ। তাকে দু-এক দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের ধর্মঘট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা ধর্মঘট করলেও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে না।
এদিকে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় গত সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে দুটি মামলা হয়। দুটি মামলাতেই সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১৫০ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
রাজশাহীতে কর্মরত সাংবাদিকেরা গতকাল বেলা ১১টায় তাঁদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহী নগরের সাহেব বাজার এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন। পরে রাজশাহী টেলিভিশন রিপোর্টারস ইউনিটির সভাপতি স ম শাজুকে আহ্বায়ক এবং রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মামুন-অর-রশিদ মামনুকে সদস্যসচিব করে ১১ সদস্যের সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছে।
সনদ নয়: প্রথম আলোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধর্মঘটে জড়িত শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের সনদ ইস্যু না করাসহ তিন দফা দাবিতে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কাছে সঞ্চারকলিপি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশন। এ সময় উপাচার্য মুহমঞ্চদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখে আসছি, ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা প্রায়ই ধর্মঘট করেন। চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। জনস্বাস্থ্য বা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সনদ ইস্যু বন্ধ করা হবে।’
মিটফোর্ডে রোগীদের দুর্ভোগ: প্রথম আলোর কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, মিটফোর্ড হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। গাইনি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা সীমা বেগম (৩০) জানান, গতকাল সকাল থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা চিকিৎসাসেবা দিতে আসেননি। এতে অনেক রোগী সমস্যায় পড়েছেন বলে জানান তিনি।
কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকা থেকে আসা ইন্দ্রলাল হাসপাতালে জরুরি বিভাগে সেবা না পেয়ে অন্য হাসপাতালে চলে যান। মিরপুর পল্লবী এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নাসিমা বেগমের (৪৫) ভাতিজা মেয়াজ উদ্দিন মিয়া বলেন, তাঁর ফুফু হার্ট অ্যাটাক করেছে। কিন্তু মিটফোর্ড হাসপাতালে এসে শুনেন ধর্মঘট চলছে। তাঁরা ছুটছেন ঢাকা মেডিকেলের দিকে।
শরীয়তপুর থেকে কিডনির সমস্যা নিয়ে মিটফোর্ডে এসেছিলেন আখি আক্তার। তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররাও যদি ধর্মঘট করে আমাদের জিম্মি করেন, তাহলে আমরা আর কই যাব?’
শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা সকাল থেকে হাসপাতাল এলাকায় বেসরকারি একুশে টিভির সাংবাদিকদের শাস্তি চেয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শোয়াইব-উল-ইসলাম বলেন, ‘সাংবাদিকেরা অহেতুক আমাদের ও শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন। এই মামলা প্রত্যাহার ও কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে আমরা আলোচনার মাধ্যমে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করব।’
গতকাল বেলা একটার দিকে স্থানীয় সাংসদ হাজি মো. সেলিম হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। তিনি রোগীদের স্বার্থে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার করারও অনুরোধ জানান।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হাসান সাংবাদিকদের জানান, গত রোববারের ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আশা করছি, ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কাজে যোগদান করবেন।’
অভিযোগ আছে, সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের হামলার শিকার হন একুশে টিভির কয়েকজন সাংবাদিক। একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় একটি মামলা করে। সোমবার দুপুর থেকে কর্মবিরতিতে যান শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা।
বারডেম হাসপাতাল: ১৫ এপ্রিলের হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা গতকালও দুপুর ১২টা থেকে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন। এ সময় রোগীরা দীর্ঘ সারিতে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা একটার পর চিকিৎসকেরা কাজে যোগ দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
তবে বারডেম হাসপাতালের উপপরিচালক মো. নাজিমুল ইসলাম দাবি করেন, কর্মবিরতির সময় অধিকাংশ চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করায় রোগীর চিকিৎসায় তেমন ব্যাঘাত ঘটেনি।
১৩ এপ্রিল রাতে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাতীয় প্রেসক্লাবের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম মারা যান। চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে সিরাজুলের স্বজনদের সঙ্গে প্রথমে কথা-কাটাকাটি ও পরে চিকিৎসকদের হাতাহাতি হয়। সিরাজুল ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেনের আত্মীয়। মাসুদ হোসেন হাসপাতালে উপস্থিত থেকে তাঁর স্বজনদের দিয়ে চিকিৎসকদের ওপর হামলা করিয়েছেন অভিযোগে ওই পুলিশ কর্মকর্তাসহ স্বজনদের বিচারের দাবিতে ১৫ ও ১৬ এপ্রিল ধর্মঘট পালন করেন চিকিৎসকেরা। পরে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ হোসেনকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরপর চিকিৎসকেরা অন্যদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে ১৭ এপ্রিল থেকে দুপুর ১২টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করে আসছেন।
এর মধ্যে গত রোববার রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন। দুটি মামলায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে আগামী ২৮ মের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
তিন কমিটি: মিটফোর্ড হাসপাতালের ঘটনা তদন্তে সৈয়দা ফিরোজা বেগম, রাজশাহীর ঘটনা তদন্তে আনোয়ার হোসেন ও বারডেমের ঘটনা তদন্তে গৌতম আইচ সরকারকে প্রধান করে পৃথক তিনটি কমিটি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তিনজনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। প্রতিটি কমিটিতেই চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের প্রতিনিধি রয়েছেন। কমিটিগুলোকে আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতারা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের এক বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই কমিটি গঠনের তথ্য জানান। মিটফোর্ড ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ওই দুটি ঘটনায় আহত সাংবাদিকদের চিকিৎসা ব্যয় ও ক্যামেরা ভাঙার ক্ষতিপূরণ সরকার দেবে বলে জানান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ সময় চিকিৎসকদের কথায় কথায় ধর্মঘট না ডাকার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বলেছেন, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে ধর্মঘট না ডেকে সেটি মীমাংসার সুযোগ দেওয়া উচিত।
বৈঠক সূত্র জানায়, গতকালের বৈঠকে দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে শিগগির একটি তথ্য ডেস্ক চালুর সিদ্ধান্ত হয়। যেকোনো ঘটনা ঘটলে ওই ডেস্ক সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহ করবে। এ ছাড়া রোগী, চিকিৎসক ও হাসপাতালের সুরক্ষায় দুটি পৃথক আইন করার কথাও জানান মন্ত্রী।
No comments