‘কোনঠে আছেন দেশদরদি, হামাক বাঁচান’
তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। জীবনরেখা বলার কারণ হচ্ছে, তিস্তার দান করা জলদুগ্ধে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে উত্তরের মানুষ। সে জীবনরেখা এখন মৃতপ্রায়। জলদুগ্ধশূন্য তিস্তা। ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে তিস্তা সেচ প্রকল্পের উজানের অংশে পানির প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের নিচ থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত যে তিস্তা নদী, সেখানে চিকন নালাটিও নেই, একেবারেই মৃত। তিস্তার এই মৃত্যু উত্তরের জনপদের জন্য নিশ্চিত অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসবে। সন্দেহ নেই, এই অভিশাপে পুড়তে হবে গোটা দেশকে। কারণ, তিস্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশ্রয়ে রংপুর বিভাগ এবং তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা মিলে প্রায় দুই কোটি মানুষ বেঁচে আছে। শুধু যে দুই কোটি মানুষ বাঁচে তা নয়, এই অঞ্চলে যে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়, তা প্রায় চার কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে থাকে। দেশের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ অঞ্চল থেকে উৎপাদিত খাদ্যশস্য সারা দেশের চার ভাগের এক ভাগ জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। যদি এই তিস্তাকে বাঁচানো না যায়, তাহলে এই চার কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন বন্ধ হবে। ২০১৩ সালে তিস্তায় প্রায় সর্বোচ্চ তিন হাজার কিউসেক এবং সর্বনিম্ন দেড় হাজার কিউসেক পানি ছিল। সেই বিবেচনায় এ বছর ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালের শুরুতেই দুই হাজার ৭০০ কিউসেক পানি থাকলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৩০০ কিউসেকে। হঠাৎ করে এই পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় দুর্বিপাকে পড়েছেন সেচ প্রকল্পের অধীন চাষিরা। সে কারণে ১০-১২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ শুরু করা হয়;
কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন, তা না থাকায় এগুলোরও অনেক জমি নষ্ট হয়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমি হলেও চাষাবাদ শুরু হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। পানি কমে আসার কারণে অন্যান্য বছর চাষ হচ্ছিল প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এবারে সেই পরিমাণ নেমে আসে ১০-১২ হাজারে। আমাদের সেচ প্রকল্পের শুধু প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রায় ছয় হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩০০ কিউসেক। গত মাসে বাসদের রোডমার্চের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রিভারাইন পিপলের পক্ষে আমিও গিয়েছিলাম তিস্তার দোয়ানি বাজারে। যাত্রাপথের বিভিন্ন পয়েন্টে পথসভা হচ্ছিল। একটি পয়েন্টে পথসভা চলাকালে হাত-পায়ে কাদামাখা ও কণ্ঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে এক বৃদ্ধ অনর্গল বলতে শুরু করলেন, ‘কোনঠে আছেন দেশদরদি ভাই, কোনঠে আছেন ভোট চাওনেওয়ালা। আইসো, হামাক বাঁচান। হামার জমিত পানি নাই। হামরা মরি যামো।’ সত্যি সত্যি এই বৃদ্ধের কণ্ঠে যে আহাজারি, এটাই তিস্তাপারের মানুষের প্রকৃত অবস্থা। অশীতিপর এক বৃদ্ধ তিস্তার কোল ঘেঁষে দোয়ানি বাজারে বসে জনসভা শুনছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চাচা, আপনার তো অনেক বয়স, আপনি কি কখনো তিস্তায় এত কম পানি দেখেছেন?’ চাচা কিছুটা মলিন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে ডানে-বাঁয়ে কয়েকবার মাথা নাড়লেন। মনে হলো, তাঁর চোখের কোনায় জল জমেছে। তিস্তার ধু ধু বালুচরে দাঁড়িয়ে যখন একে বাঁচানোর প্রত্যয়ে শপথ হচ্ছিল, তার একটু পরেই মধ্যবয়সী স্থানীয় এক নারী আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন,
‘সরকার কী কয়?’ আমি বললাম, ‘সরকার তো চুপ আছে, চাচি।’ ‘ছাওয়া না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না’—এ কথা বলতে বলতে তিনি চলে যান। চাচির কথা ধরে বলা যায়, ছাওয়া (বাচ্চা) কাঁদতে শুরু করেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সংগঠিত হচ্ছে। প্রতিদিন নদী নিয়ে কোনো না কোনো কর্মসূচি থাকছে। রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক রোডমার্চ, লংমার্চ, তিস্তা মার্চ করছে। লক্ষ্য একটাই, তিস্তায় পানি চাই। স্লোগান চলছে, ‘আর কোনো দাবি নাই—তিস্তায় পানি চাই। দাবি মোদের একটাই—তিস্তায় পানি চাই’। বাসদ কনভেনশনের রোডমার্চের পর, বাম মোর্চা লংমার্চ করেছে, এরপর বাসদ-সিপিবি লংমার্চ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার লংমার্চ করল বিএনপি। যেসব রাজনৈতিক দল তিস্তার পানির দাবিতে আন্দোলন করছে, এখন সেই দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে এখনই অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন: নদীসংলগ্ন যে জমিতে একবার ফসল হতো, এখন আর তাও হচ্ছে না। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। যখন পানির স্তর নিচে নেমে যায়, তখন কৃষকেরা আরও গভীর থেকে পানি উত্তোলন করে জমিতে সেচ দেন। এতে করে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর আরও নিচে নেমে যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে পানির স্তর আরও অনেক নিচে নেমে যাবে। ভূমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তখন ভূমি মরুভূমি হবে। কয়েক দিন আগে তিস্তা নদী রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ফরিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে আবহাওয়ার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলছিলেন, গরু ও ছাগলের শরীর থেকে অনেকখানি করে চামড়া উঠে যাচ্ছে। এটার জন্য তিনি তিস্তার পানি না থাকাকেই দায়ী করছেন।
তিস্তার পানি না থাকার কারণে এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আহাওয়া বদলে যেতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মে এখন দিন-রাতে দুই ধরনের আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়। দিনের বেলা প্রচুর গরম এবং রাতের শেষভাগে অধিকাংশ রাতে ঠান্ডা নামে। আবহাওয়ার দুই রকম অবস্থা আগে ছিল না। রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম-এর সমন্বয়ক নাহিদ নলেজ বলেন, ‘তিস্তা আমাদের জীবন, তিস্তা নাই তো জীবন নাই। জীবন বাঁচাতেই তিস্তা বাঁচানো অপরিহার্য।’ সাংবাদিক শাহাজাদা মিয়া তিস্তার পানি না থাকার ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, ‘জলঢাকা এলাকার শলেয়াহ শাহ এলাকায় হাঁটু পরিমাণ ধুলো জমেছে। মরুভূমি হতে আর বেশি দিন লাগবে না।’ তাঁর ৫০ বছর বয়সে কখনোই এ রকম দেখেননি। পরিবেশবাদী সংস্থা সবুজ পাতার উদ্যোক্তা শাহেদ আলম বলেন, বাংলাদেশর উন্নয়নের বড় সূচক একেকটি প্রবহমান নদী। সেই বিচেনায় উন্নয়নের বড় সূচক তিস্তার প্রমত্তা যৌবন ফিরিয়ে আনা ভীষণ জরুরি। বর্তমানে তিস্তার পানি না থাকার কারণে মরুকরণের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কেন গবাদিপশুর চামড়া উঠে যাচ্ছে, কেন দিনে প্রচণ্ড গরম, ভোররাতে ঠান্ডা। কেন হাঁটু পরিমাণ ধুলোর স্তর তৈরি হচ্ছে; এমনকি তিস্তার পানি যদি আমরা না পাই, তাহলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কী উপায়, তাও গবেষণায় আনা প্রয়োজন। যেভাবে পানির স্তর নিচে নামছে, এতে করে উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হতে কত বছর লাগবে। এই সময়ে আমাদের প্রস্তুতি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কেও আলোকপাত করা প্রয়োজন। যদি আমাদের নদী খনন করে, প্রচুর গাছ লাগিয়ে, একসময়ের জালের মতো ছড়ানো শাখানদীগুলোকে বাঁচিয়ে মরুকরণ থেকে উত্তরের জনপদকে বাঁচানো যায়, তাহলে সে ব্যবস্থাও এখনই গ্রহণ করতে হবে। নয়তো ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
wadudtuhin@gmail.com
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও সিনেটর, রিভারাইন পিপল।
wadudtuhin@gmail.com
No comments