কমনসের বাংলাদেশ বিতর্ক
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচন ইতিবাচক বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দাবি সংসদে করেছেন, তা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশে যখনই বৈধতার সংকট নিয়ে কেউ সরকারে বসেন, তখন তাঁরাই বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হন। বিভিন্ন সরকারের আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন বার্তাবিষয়ক তথ্য এবং সেসব দেশের পার্লামেন্টের নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন ও সরকার সম্পর্কে যে অভিমত দিচ্ছেন, তার মধ্যে পার্থক্য আসমান ও জমিনের। বিদেশি সাংসদেরা সংসদের ফ্লোরে কীভাবে দেখছেন তা আজ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হবে এই নিবন্ধে। আজ হাউস অব কমনস। কাল ইইউ পার্লামেন্টের ভাষ্য। হাউস অব কমনসে তিন সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে তিন দফা আলোচনা হয়েছে। মার্কিন সিনেটেও অল্পসময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের ওপর তৃতীয় শুনানি হচ্ছে। বাংলাদেশবিষয়ক প্রস্তাব আনার কারণটা চিহ্নিত করে সাইমন ড্যানজুক বলেন, অবশ্যই এমন উদ্বেগ রয়েছে যে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে এবং কালক্রমে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটতে পারে। মিসেস মেইন বলেন, আমাদের ভাবতে হবে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ব্রিটিশ সাহায্য দেশটিতে কী কাজে লাগবে। প্রকৃত সুফল দেবে কি দেবে না। আমার মনে হয় মার্কিন সিনেটে ১১ ফেব্রুয়ারির শুনানিতে একই প্রশ্ন আলোচিত হবে। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নতুন ইউএসএইড প্রধান ইয়ানিনা ইয়ারুজেলস্কি বলেছেন, ‘মার্কিন সহায়তা চলতে থাকবে।’ আমরাও তা চাই। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখব, বহু দেশের ঘোর অমানিশাতেও তারা এমনটাই বলে থাকে। তবে একই সঙ্গে তিনি প্রকারান্তরে গণতন্ত্র ও সুশাসন কর্মসূচির অর্থ প্রত্যাহারের ঘোষণাও দিয়েছেন।
ইয়ানিনা সৌজন্য করে বলেছেন, ওই কর্মসূচির টাকা না কমিয়ে অন্য কর্মসূচিতে সমন্বয় করবেন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের চেয়ারম্যান চিঠি লিখে সরকারের প্রতি পরোক্ষ অথচ স্পষ্ট অনাস্থা ব্যক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটেনের দুই প্রধান দলের প্রতিনিধি মিসেস মেইন ও সাইমন কমনসে যৌথভাবে প্রস্তাব আনেন। রানা প্লাজা ধসের পরে তাঁরা সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। ১৪ জানুয়ারিতে ঠিক হয়, ১৬ জানুয়ারির ব্যাকবেঞ্চ প্রহরে বাংলাদেশ আলোচিত হবে। এই আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বেশ ভালোই তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে একা মিসেস মেইনই যুক্তি দিয়েছিলেন। তবু তাঁর মন্তব্য, ‘দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ একধরনের তলাবিহীন ঝুড়িতে রূপান্তরিত হতে চলেছে।’ বহু বছর বাদে কিসিঞ্জারের এই বিষাদগ্রস্ত উক্তিটির প্রতিধ্বনি কানে এল। এই যখন অবস্থা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে বলেন, ‘অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন।’ আমরা সংসদ ও সরকারের পার্থক্য রাখি না, বুঝতেও চাই না। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিশ্ব তো পার্থক্য বজায় রাখে। এটাই ওদের গৌরব। দীর্ঘকাল ধরে দেশে দেশে চোখে পড়ে অগণতান্ত্রিক বা জবরদখলকারী সরকারের তোয়াজকারী আমলারা ‘অভিনন্দন’ জোগাড় করতে উতলা হন। দেখলাম ওআইসির মতো অগণতান্ত্রিক ক্লাবের মহাসচিবের অভিনন্দনও ঘটা করে রটানো হচ্ছে। বিশ্বের তিনটি বিশিষ্ট পার্লামেন্টের (মার্কিন কংগ্রেস, ব্রিটেনের হাউস অব কমনস ও ইইউ) পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে না বলা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দল ও তার মিত্ররা ‘হাই হ্যালো’ ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচারমণ্ডিত অভিনন্দনে পুলকিত হবেন নাকি জনগণের নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের দ্বারা সংসদের ফ্লোরে সরাসরি তিরস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। ১৬ জানুয়ারি মিসেস মেইন অকপটে বলেন, আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি যে ২০০৬ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো উন্নতি ঘটেনি। কিন্তু তিনি বা তাদের কেউ সেদিনের বিতর্কে ভেঙে বলেননি, ’৯০-এ সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পরে কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করা হয়নি। প্রায় সব কটি প্রতিষ্ঠান সুনামি কি সিডরের শিকার। গত ১১ জানুয়ারি গণতন্ত্র খাতে ৬৭ মিলিয়ন পাউন্ডের সাহায্য বন্ধের খবর দিয়েছিল টেলিগ্রাফ। একে অযথাযথ খবর চিহ্নিত করে মেইন বলেন, প্রায় ৭০ ভাগ ব্রিটিশ সাহায্য এনজিওর মাধ্যমে খরচ হয়। তবে বাকি যে ৩০ ভাগ সরকারের হাতে দেওয়া হয়, সেটা ‘যে সরকার জনগণের সব অংশকে আস্থায় নেয় না, তাকে ওই সাহায্য দেওয়া উচিত নয়’ বলে তিনি সাফ সুপারিশ করেন। এ ধরনের মন্তব্যে বিএনপি খুশি হবে। কারণ, তারা বিদেশিদের কাছে কেবল তেমন চাপই আশা করে। বিরোধী দল এতে অপমান দেখে না, সার্বভৌমত্বের হানি দেখে না, কমনস যদি বাংলাদেশ শাসকদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপশাসনের জাঁতাকলটি ভাগাড়ে ফেলার শর্ত দিত, তাতে তাদের মন ভরত না। ১৬ জানুয়ারি রক্ষণশীল এমপি মার্ক ফিল্ড সোজা কথা সোজা করে বললেন, সাত বছর ধরে দেশটিতে এই লক্ষণই ফুটে উঠেছিল যে এটি সামরিক শাসনের কবলে পড়ে কি না। একাত্তরে পাকিস্তান ভাগ থেকে এ পর্যন্ত অস্থিতিশীলতার জন্য ‘বর্তমানের বাংলাদেশি রাজনীতিকদের দায়দায়িত্ব’ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত প্রকাশ পেলেও মিশ্র মতামতও এসেছে।
রক্ষণশীল এমপি রেহমান চিশতী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রতি গভীর আস্থা ব্যক্ত করে বলেন যে, পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশে এটা ভালোভাবে কাজ করছে। এটা বাতিল করা ‘সম্পূর্ণ ও গুরুতর ভুল’। মিসেস মেইন অবশ্য মনে করেন, এটা সঠিক পদ্ধতি ছিল না। তাঁর যুক্তি, এটা বদলে ফেলতে সংবিধানের আওতায় আওয়ামী সরকারের অধিকার ছিল এবং তারা সেটা করেছে। আমরা মেইনের কোনটা নেব? ম্যান্ডেট তত্ত্ব নাকি তলাবিহীন ঝুড়ি বলাটা? কমনস কার্যবিবরণীতে লেখা আছে, বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় গ্রুপকে বলেছেন, ‘আমি এটাকে মর্মভেদী মনে করেছি। একটাই বড় সত্য যে রক্তপাত ও বিরোধ ছাড়া বাংলাদেশ কখনো নির্বাচন দেখেনি।’ তার মানে কি ওটা ফেলে দেওয়ার দর্শন ছিল এই যে, রক্তই যখন ঝরবে তখন ঝরুক! ওই প্রশ্নে বাংলাদেশি রুশনারা আলী সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, কমনসের উভয় পক্ষের সদস্যরা সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন, এই ব্যবস্থা অতীতে সুফল দিয়েছে। লিবারেল ডেমোক্র্যাটদলীয় মার্টিন হরউড উল্লেখ করেছেন, শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বহু বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার রয়েছে। তবে তিনি নিরেট সত্যটা বলেননি যে, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের কৈফিয়তের ঊর্ধ্বে তুলেছে। মার্টিনের কথায়, ওই ব্যবস্থা বাতিল টেকনিক্যালি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ, সেখানে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থিত একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওটা বাতিল করায় স্পষ্টতই নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবাধ নির্বাচনে আস্থা নষ্ট হয়েছে। মার্টিনের এই মন্তব্য খুবই যুক্তিসংগত। কারণ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট নিরঙ্কুশভাবে টেকনিক্যালটির ওপর দাঁড়িয়ে ওটা বাতিল করেন। কিন্তু রাজনীতি টেকনিক্যাল নয়।
রেহমান চিশতী মার্টিনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ওই ব্যবস্থা যদি পাকিস্তানে চলে, বাংলাদেশেও চলতে পারে? তখন মার্টিন যথার্থ মন্তব্য করেন, এটা ‘টেকনিক্যাল মেরিটের’ প্রশ্ন নয়। অথচ আমাদের সরকার ও তার মিত্ররা ওই ব্যবস্থা বাতিল প্রশ্নে যে আদর্শগত ভুয়োদর্শন তুলেছেন, তা শতকরা ১০০ ভাগই টেকনিক্যাল মেরিটের। মার্টিন চমৎকার যুক্তি দেন, এটা হলো রাজনৈতিক দলব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি ও মতৈক্য সৃষ্টি করার বিষয়। একজন বাংলাদেশি আজ সকালেই আমাকে একটি মিষ্টি উপমা দিলেন। বললেন, ওই ব্যবস্থা থাকল বা গেল, তা কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দুই নারীর হাতেই বাঁধা। সাইমন ড্যানজুক এ সময় বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা উচিত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এটা বলেছিলাম। কিন্তু স্পষ্টতই তিনি এটাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। গত ২৩ বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশটির সংসদে কোনো রাজনৈতিক বিরোধী দল নেই।’ রক্ষণশীল রিচার্ড ফুলারের কাণ্ডজ্ঞান প্রখর। কমনসের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া, এই মন্তব্যের পর তিনি বলেন, এটা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য যথার্থই বৈধ যে, তারাই ঠিক করবে কীভাবে তারা তাদের নির্বাচন করবে। তাই কমনসের এটা অন্য কোনো দেশকে বলা উচিত হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি যা বলেন, সেটা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের বুঝতে হবে। ফুলারের কথায়, ‘এ কথা বলা হাউস অব কমনসের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যে গণতন্ত্র উন্নয়নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কতটা কার্যকর।
কারণ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী আমাদের স্বার্থ রয়েছে।’ বাংলাদেশ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল হোক—এ রকম প্রস্তাব কমনসে পাস হয়নি, পাস হওয়ার কথা নয়। তবে ফুলার তথ্য প্রকাশ করেন যে ব্রিটেনের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বলেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করতে। কিন্তু একগুঁয়েভাবে সরকারি দল তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ফুলারের সঙ্গে দ্বিমত করা যায় না, যখন তিনি বলেন, দুই বছর আগেই বোঝা গেছে, বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে। সুতরাং দায়টা বর্তমান সরকারের কাঁধেই বর্তায়। লিবারেল ডেমোক্র্যাট জন হ্যামিং ফুলারের কাছে প্রশ্ন রাখেন, তাহলে আপনি একমত যে অবাধ নির্বাচন চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবেই? এর উত্তরে জিম ফিটজপ্যাটরিক বলেন, নতুন নির্বাচনের কথা বলা এখন অপরিপক্ব। তাড়াতাড়ি নির্বাচন হওয়া মানেই গত নির্বাচনে যারা নাশকতা করেছে, তাদের হাত লম্বা করা। তবে জিমের মতো অনেকেই বলবেন, ‘আমি মনে করি আওয়ামী লীগ পুরো পাঁচ বছর মেয়াদে সরকারে থাকতে পারবে না। কারণ, সেটা হবে কমনসের উচ্চারিত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধাচরণ।’ কমনস যা কিছু আলোচনা করেছে তা আমার বিচারে বাংলাদেশিদের প্রয়োজনের তুলনায় অন্তঃসারশূন্য না হলেও গতানুগতিক ও আনুষ্ঠানিক। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যে ভেঙে পড়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনই তা নিরাময়ের একমাত্র ধনন্তরি চিকিৎসা নয়, কমনসের, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সেটা স্বীকার করা।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments