৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আসল বিজয়ী বিএনপি by আনিসুর রহমান @সুইডেন থেকে
শিরোনামটা দেখে অনেকেই দেখে চমকে উঠবেন
কিংবা ভ্র-কুঁচকাবেন। এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী খোলসে বাকশালী জোট ৫ই
জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতা দখল করে যেখানে সরকার
পর্যন্ত গঠন করে ফেলেছে সেখানে বিএনপি এতে বিজয়ী হয়েছে বললে কারও কারও কাছে
তা হাস্যকরও মনে হতে পারে।
কিন্তু এটিই নিরেট সত্য। একটু
ব্যাখ্যা করা যাক। ৫ই জানয়ারির নির্বাচনটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে
হয়তো জেলে যেতে হবে। কিন্তু এর নৈতিক বৈধতা যে প্রায় শূন্যের কোঠায় তা নিয়ে
দ্বিমতের বিশেষ অবকাশ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের
অধীনে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনটিকে বর্জন ও প্রতিহত করার জন্য ১৮ দলীয়
জোট নেত্রী খালেদা জিয়া জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। আসলে ৫ই জানুয়ারি
এ ব্যাপারে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এতে কে বিজয়ী হয়েছে? ৩০০টি
আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে কোন নির্বাচনই হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
হওয়ার অর্থ হচ্ছে ওখানে অন্য সবাই তা বর্জন করেছে। ওই অর্থে আওয়ামী লীগ
১০০ ভাগ হেরেছে। বাকি আসনগুলোতে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার যে প্রহসনমূলক
ও তথাকথিত নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হয়েছে তাতে কত ভাগ ভোট পড়েছে? বিভিন্ন
টিভি চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচারে দেশবাসীর তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ
হয়েছে। কোথাও ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে ভোটারের পরিবর্তে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি
চরে বেড়াতে দেখা গেছে। কোথাওবা দু’-চার ঘণ্টায় ২/৩ জন ভোটারকে ভোট দিতে
দেখা গেছে। এমনকি শতাধিক কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এটা কি ওইসব কেন্দ্রে
বিএনপি জোটের পক্ষে ১০০% ভাগ হ্যাঁ এবং আওয়ামী জোটকে জনগণের ১০০% ভাগ না
বলা নয়? গোলাম মওলা রনি দেশে যে একমাত্র পবিত্র মুখটি আবিষ্কার করতে
পেরেছেন সেটি হলো আমাদের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী
রকিবউদ্দিনের। কাজীর গরু কেতাবে থাকে, গোয়ালে থাকে না প্রবাদটিকে সার্থক
প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন ১৪৭টি আসনে ৪০% ভাগ ভোট পড়েছে বললেও কেউই তা
বিশ্বাস করেন না। যারা এই পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে ওপর থেকে নির্দেশ দিয়েছেন
তারাও জানেন এর ধারে কাছেও ভোট পড়েনি। এমনকি তাদের দেয়া তথ্য তর্কের খাতিরে
মেনে নিলেও ৩০০ আসনের হিসেবে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২০% ভাগেরও
কম। আসলে ভোট দিয়েছেন বড় জোড় ১০% ভাগ মানুষ। দেশের ৯০% ভাগ মানুষই এবারের
সংসদ নির্বাচনটাকে বর্জন করেছেন। সারা দেশে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীগুলো দিয়ে নিরাপত্তার চাদর দেয়া হলেও এবং সেই সঙ্গে সরকারি
লাঠিয়াল ও পেটোয়া বাহিনীকে নামিয়েও জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আনা যায়নি। ভয়ে
কিছু লোক আসেননি বটে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তামাশার এই
নির্বাচনটিকে স্বেচ্ছায় বর্জন করেছেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেয়ার সরকারি
আহ্বানটি মাঠে মারা গেছে। বরং সকলেই ছিলেন নিরানন্দ।
কাজী রকিব উদ্দিনের নির্বাচন কমিশন যে মেরুদণ্ডহীন এবং সরকারের আজ্ঞাবহ মাত্র এবং তাদের দ্বারা যে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের এই দাবিটি ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে দিবালোকের মতো পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নইলে বড়জোর ১০% ভাগ লোকের অংশগ্রহণকে তারা কোনমতেই ৪০% দেখাতে পারতো না। এর মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দিন নিজেকে এমএ আজিজের চেয়েও নিচে নামিয়ে এনেছেন। আগের কথা ভুলে গিয়ে লোকে এখন রকিবউদ্দিন মার্কা নির্বাচনের উদাহরণ দেবে।
ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে বর্তমান বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন হতে পারে না বলে বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলগুলো যে কথা বলে আসছেন, জানুয়ারির ৫ তারিখের নির্বাচনে তাও পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সংশোধন করে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা ফিরিয়ে আনা ছাড়া পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাংলাদেশী রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গর্ব করে বলতেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ ভোটের অধিকার ফিরে পায়। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সেই গর্ব এখন তাদের লজ্জায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য সে লজ্জাবোধ যদি আওয়ামী লীগারদের থেকে থাকে।
আওয়ামী ঘরানার বাকচতুর লোকজন বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার দলবাজ কলমজীবীরা খুব উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, এবারের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট, বিশেষ করে খালেদা জিয়া একূল-ওকূল দু’কূলই হারিয়েছেন। না পেরেছেন তিনি সরকার গঠন করতে, না পেরেছেন বিরোধী নেত্রী থাকতে। আসল তত্ত্ব এখানেই নিহীত। ওদের আশা ছিল ভুলিয়ে-ভালিয়ে, ছল-চাতুরিতে কিংবা জোর জবরদস্তিতে যে কোন উপায়ে বিএনপি এবং ১৮-দলীয় জোটকে নির্বাচনে আনা। তারপরে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে হারিয়ে দেয়া। এটি করতে পারলে আওয়ামী জোট সরকারি দল হিসেবে এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যেতো। কিন্তু খালেদা জিয়া তাতে রাজি হবেন কেন? নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিজয় যেখানে তাদের অবধারিত ছিল সেখানে আওয়ামী লীগের কূটচালে পা দিয়ে তারা বিরোধী দলে গিয়ে কেন দেশটাকে আরও ৫ বছরের জন্য গণতন্ত্রের মেকী আবরণে দুর্নীতি-দুঃশাসন-অপশাসন এবং ফ্যাসিবাদের কাছে সঁপে দেবেন? বিএনপি তো আর জাতীয় পার্টি নয়। বেগম খালেদা জিয়া আর যাই হোন, এরশাদ নন। তিনি ভাঙবেন তো নাই-ই, মচকাবেনও না। আপসহীন নেত্রীর অভিধায় তিনি এমনিতে ভূষিত হননি। দীর্ঘমেয়াদি এবং গুণগত বিজয়ের জন্য এমন আপসহীনতার দরকার আছে।
এদের আরেকটি প্রচারণা লক্ষ্যণীয়। তারা বলছেন, খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন তার ডাকে নির্বাচন ঠেকাতে রাস্তায় হাজার হাজার লোক নেমে আসবে। কিন্তু তিনি তা পারেননি। এই প্রচারণাটিও আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। উটপাখি নীতি গ্রহণ করে তারা আসল বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তারা কি অস্বীকার করবেন যে গত কয়েক বছরে খালেদা জিয়ার ডাকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, রোডমার্চে দেশের সর্বত্র লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়েছেন? স্মরণকালের কয়েকটি বৃহত্তম সমাবেশ তার ডাকেই অনুষ্ঠিত হয়েছে? সরকারি দল তার প্রশাসন যন্ত্র, দেদার অর্থ এবং ক্যাডার ব্যবহার করে হাসিনার জনসভায় যে পরিমাণ জনসমাবেশ করতে সমর্থ হয়েছে তার চেয়ে খালেদার সমাবেশ অনেক বেশি লোক হয়েছে। এই দেখেই আওয়ামী লীগ সরকার ভয় পেয়ে যায় এবং নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারটাকেও রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগের মাধ্যমে কেড়ে নেয়। আমরা পাকিস্তান আমলে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামল দেখেছি। ’৭১-এর দখলদার আমলের কথা বাদ দিলে এমন হিংস্র সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগ তখনও দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে হাসিনা সরকার আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। এর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে বাকশাল গঠন করার অব্যবহিত আগের এবং বাকশালের সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার। বাকশাল কী ভয়াবহ ব্যবস্থা ছিল তা বোঝাতে বিরোধী দল অনেক কথা বলেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে নতুন প্রজন্ম তার কিছুটা নিজ চোখে দেখেছে, যে জন্য তাদের অধিকাংশই আর ওইমুখো হবে বলে মনে হয় না। এটাও বিএনপির জন্য বড় লাভ হয়েছে। গেস্টাপো বাহিনীর কথা জানতে হলে ফ্যাসিবাদের ইতিহাস পড়তে হয়। গত পাঁচ বছরের আওয়ামী শাসনামলে এবং বিশেষ করে ২০১৩ সালের নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশের মানুষ নিজেরা সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছে। গেস্টাপোর বাংলাদেশী সংস্করণ যারা চালু করেছে মানুষ তাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে ত্যাগ করবে।
দেশটিকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করায় মানুষজন আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তায় জমায়েত হতে পারেননি বটে। কিন্তু তামাশার নির্বাচনটিকে বর্জন করে নীরবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নীরব প্রতিবাদ যে এতো সরব ও ব্যঙ্গময় হতে পারে সেটি জনগণ এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
পাতানো নির্বাচনটি বর্জন করে বিএনপি এবং তার মিত্ররা আওয়ামী লীগকে সারা বিশ্ব থেকে একঘরে করে ফেলতে পেরেছে। এটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে দিল্লি-ওয়াশিংটনের আশীর্বাদে। এবারের নির্বাচনী তামাশায় সেই ওয়াশিংটনের বোধোদয় হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে আওয়ামী লীগের বাকশালী চরিত্র বদলায়নি। শুধু ওয়াশিংটন নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, মধ্যপ্রাচ্য কোথাও এই নির্বাচন প্রকৃত বৈধতা পায়নি। যে জন্য তারা প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে অনতিবিলম্বে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ মূলত একটি ভারত-নির্ভর দল, এবারের নির্বাচনে আরেকবার তা প্রমাণিত হয়েছে। এটা এখানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। ভারতের ব্লাঙ্ক চেক ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কখনও নির্বাচনটি অনুষ্ঠান করা সম্ভব ছিল না। আশার কথা, নির্বাচনের পরে ভারতেও এ নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা শুরু হয়েছে। সেখানকার থিংক ট্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে তা ভারতের জন্য লাভজনক হবে কিনা সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা শুরু করেছে। দি হিন্দু, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, স্ট্যাটসম্যানস-এর মতো প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো জনসমর্থনহীন একটি দলকে একতরফা সমর্থন দিয়ে যাবার বিষয়টি নতুন করে চিন্তা করার পাশাপাশি অবাধ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিজয়ী অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। এটি ভারতীয়দের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত বিএনপির অনুকূলে যেতে পারে। মোদ্দা কথা, নির্বাচনটি বর্জন করলেও দীর্ঘ মেয়াদে এতে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি এবং বিরোধী জোট।
Email : deshbidesh@hotmail.com
No comments