দুধ দিয়ে অনেক ভাত by মন্জুরুল ইসলাম
‘এত ভাত দুধ দিয়া খায় না’- কথাটি
গ্রামেগঞ্জে অনেক বেশি প্রচলিত হলেও রাজনীতির মাঠে কথাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার। তিনি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন তিনি এটা অত্যন্ত মজা করে বলতেন।
প্রধানমন্ত্রী
হওয়ার পর কখনও কোথাও বলেছেন কিনা তা শোনার বা জানার সুযোগ হয়নি। আন্দোলন
বেগবান করতে ও তৎকালীন সরকারকে উদ্দেশ্য করেই তিনি এ কথাটি বলতেন। নবম
জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮। বলা হয়ে থাকে সেনাসমর্থিত
সরকারের অধীনে হয়েছিল সেই নির্বাচনটি। সে সময়ের সরকারকে
মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার বলা হতো। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা আজকের
প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলছিলেন, ওই সরকার তারই আন্দোলনের ফসল।
যদিও ওই সরকারই তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। যা হোক, আপনজনেরা অন্যায় করলেও শেষ
পর্যন্ত আপন বিবেচনায় মার্জনা করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে
তিনি আন্দোলন শুরু করেছিলেন ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর নির্বাচনের পর থেকেই।
প্রথমে শপথ না নেয়ার চিন্তা, পরে শপথ নিলেও সংসদে না যাওয়া, পরে ৩০শে
এপ্রিলের ট্রাম্পকার্ডসহ অনেক কিছুই হয়েছিল। একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচি
ধারাবাহিকভাবে চলছিল। একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে সে সব আন্দোলনের
প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই আন্দোলনে রাজপথে, পল্টন
ময়দানে, দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সমাবেশের খবর সংগ্রহ করেছি।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডি ৩/এ সড়কের বাড়ির কার্যালয় ও ধানমন্ডি ৫
নম্বর সড়কের বাস ভবনে অনুষ্ঠিত অনেক আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক রাজনৈতিক বা
সামাজিক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার বক্তব্য শোনার এবং রিপোর্টিং করার সুযোগ
আমার হয়েছিল। তাঁর অনেক বক্তব্যই আমার মনে আছে। অনেকদিন আওয়ামী লীগ বিট
কভার করার কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, দলের অনেক সিনিয়র-জুনিয়র
নেতার সঙ্গে অনেক স্মৃতিও আছে। অনেক কিছু জানার ও দেখার সুযোগও আমার
হয়েছে। ইদানীং সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য বার বার
আমার মনে কড়া নাড়ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী
বেগম খালেদা জিয়া, হাওয়া ভবনকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই তিনি বলতেন, ‘এত ভাত
দুধ দিয়া খায় না।’ এই বক্তব্যটি নিয়ে আমরা যারা আওয়ামী লীগ বিট করতাম তাদের
মধ্যে অনেক আলোচনাও হতো। তবে অনুষ্ঠান শেষে বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রদীপ
কুমার সিংহ রায় (সে সময় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন) যখন বলতেন,
‘এত ভাত দুধ দিয়া খায় না’- এর ইংরেজি কি লিখবো, তখন আমরা সবাই হাসতাম। ২০০১
সালের ১লা অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনেক সময়। বাংলাদেশে অনেক
ঘটনা ঘটেছে। এক ঘাটের পানি অনেক ঘাটে গড়িয়েছে। তৃতীয়বারের মতো
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যাত্রা শুরু করেছেন। এই
সময়ের মধ্যে তিনি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। যারা এক সময় বঙ্গবন্ধুর
চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করতে
গণবাহিনী গঠন করেছিলেন, তাদের হাতে জপমালা ধরিয়ে দিয়েছেন। তারা এখন
সারাক্ষণ শুধু বঙ্গবন্ধুর নাম জপছে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলকে তিনবার
রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে দলের সিনিয়র
নেতাদের নিয়ে সরকার চালিয়েছেন এবং সবার পরামর্শ নিয়ে রাজনীতিও করেছেন।
২০০৮-এর নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে একটি চমক মন্ত্রিসভা গঠন করেন
এবং রাজনীতিটা এককভাবে করেন। দলের সিনিয়র নেতাদের রাখেন বাউন্ডারির বাইরে।
অন্য সময়ের তুলনায় এবার তিনি অনেক বেশি দক্ষ, অভিজ্ঞ, সাহসী ও
আত্মবিশ্বাসী। কারণ, টার্গেট ২০২১। তাই রাজনীতির খেলাটা খেলেছেনও অত্যন্ত
সাহসিকতার সঙ্গে। শক্ত প্রতিপক্ষকে রাজনীতির খেলার মাঠের বাইরে রাখার
ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কল্পনাবিলাসীদের মতো ভবিষ্যতে কি
হবে বা হতে পারে তা ভেবে সময় নষ্ট না করে বর্তমানকে নিয়েই তিনি ভেবেছেন। আর
সে কারণেই নিজের পছন্দমতো প্রতিপক্ষ তৈরি করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ২৩১ আসন জিতে নিলেন। তিন শ’ আসনের মধ্যে বাকি
যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাও শেখ হাসিনারই কৃপাধন্য। আস্থার ছাই দিয়ে যাকে
ধরা যায়নি তাকে তিনি করেছেন বিশেষ দূত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে
সরকার গঠনের সুন্দর সমাপ্তি তিনি টেনেছেন। আর নতুন টার্গেট ২০৪১ ঘোষণা
দিলেন। সে কারণেই আমার বার বার মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা এবার অনেক ভাত দুধ
দিয়ে খেয়েছেন।
No comments