নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- আওয়ামী লীগে এলে তিন খুন মাফ? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

একসঙ্গে একই পরিবারের তিনজনকে হত্যার ঘটনা তখন তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল চট্টগ্রামে। সেটা ২০০৪ সাল। সে বছর ২৯ জুন রাতে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে খুন হন শিবির ক্যাডার সাইফুল আলম,
তাঁর বড় ভাই মো. আলমগীর ও বোন মনোয়ারা বেগম। এই হত্যার জন্য অভিযোগের আঙুল ওঠে শিবিরেরই ক্যাডার আবুল কাশেম, মোহাম্মদ ইউসুফ, নাছির উদ্দিন (গিট্টু নাছির নামে পরিচিত) ও ফয়েজ মুন্নার দিকে। ঘটনার পরদিনই নিহত সাইফুলের স্ত্রী আয়েশা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন এই চারজনের বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এজাহারভুক্ত চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। এর মধ্যে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান দুই আসামি নাছির উদ্দিন ও ফয়েজ মুন্না।

২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আবুল কাশেম ও মোহাম্মদ ইউসুফ। এই যোগদানের ঘটনা সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল জানি না, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই শিবির ক্যাডার ও হত্যা মামলার আসামি আবুল কাশেম ‘অলংকৃত’ করেছেন জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ।
জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও নাশকতার বিরুদ্ধে অবিরাম গলা ফাটাচ্ছেন যে দলের নেতা-কর্মীরা, সেই দলে যোগ দিয়েই যেন ‘পরশ পাথরের’ ছোঁয়া পেলেন শিবিরের এসব ক্যাডার। সব গরল রূপান্তরিত হলো অমৃতে। আবুল কাশেম তাঁর ও সহকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেই আবেদনে সুপারিশ করেন তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কাজী ইনামুল হক। এখন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ মামলাটি প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে আসা এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি আদালতে দেওয়া হয়েছে।
মামলার সরকারি কৌঁসুলি অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অশোক কুমার দাশ কয়েক দিন আগে পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, শিবির ক্যাডার কর্তৃক তিনজনকে খুনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর গত ২৫ অক্টোবর আদালতে আবেদন করা হয়। গত ৫ নভেম্বর আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুনানি হয়নি। পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য তারিখে আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আদেশ দিতে পারেন।
মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ৩১তম বৈঠকে শিবিরের তিন খুনের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে একই কমিটির ১৭তম বৈঠকেও একবার মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে বিষয়টি সমালোচিত হলে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে জাতীয় কমিটি।
দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছিলেন সাইফুল ও তাঁর ভাইবোনেরা। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম রব্বানী হত্যা মামলায় শিবির ক্যাডার নাছির ও তাঁর ভাই মনছুরকে আসামি করা হলে শিবিরের একটি পক্ষ সন্দেহ করেছিল সাইফুলকে। ধারণা করা হয়, সাইফুল তাঁদের ফাঁসিয়েছেন—এমন সন্দেহের কারণেই ভাইবোনসহ প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ভোল পাল্টানোর নজির এ দেশে কম নেই। ‘আল্লাহর আইন’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘শহীদ’ হওয়ার অঙ্গীকার করা নেতা-কর্মীর ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকে’ রূপান্তরিত হওয়ার নজিরও কম নয়। কিন্তু নতুন দলীয় পরিচয়ের সুবাদে এই আসামিরা অব্যাহতি পেলে মামলার বাদী আয়েশা আক্তার ও তাঁর দুই সন্তানের জীবন কতটা সংশয়মুক্ত থাকবে, কিংবা ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন সাক্ষীর মধ্যে যে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তাই বা নিশ্চিত করবে কে? এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কেউ নেই।
একই ধরনের ঘটনা ঘটতে চলেছে ফটিকছড়িতেও। এই উপজেলার বহুল আলোচিত ‘ভুজপুর ট্র্যাজেডি’র মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের তিন নেতাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। এই ঘটনায় ভুজপুর থানায় যে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তার কোনোটিতে ২ নম্বর, কোনোটিতে ৩ নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত এই তিন নেতা।
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় যে ভয়াবহ রক্তাক্ত তাণ্ডবটি ঘটেছিল, যাদের স্মৃতিতে নেই, তাদের জন্য ঘটনাটি পূর্বাপর উল্লেখ করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুদকের মামলা থাকার কারণে ফটিকছড়ি আসনে প্রার্থী হতে পারেননি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ রফিকুল আনোয়ার। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। ওই নির্বাচনের পর থেকে সাকা চৌধুরীর ক্যাডারদের সন্ত্রাসের মুখে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে হতোদ্যম স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এর মধ্যে রফিকুল আনোয়ারের আকস্মিক মৃত্যুতে আরও অগোছালো হয়ে পড়ে দল।
নির্বাচনের প্রস্তুতি ও দলকে পুনর্গঠিত করার জন্য ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল বড় ধরনের শোডাউনের আয়োজন করেন এখানকার নেতা-কর্মীরা। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে সেদিন দু-তিন হাজার নেতা-কর্মী এক মিছিলে অংশ নেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সেদিন মসজিদের মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে এই মিছিলে হামলা চালালে এক নারকীয় তাণ্ডবের সাক্ষী হয় ভুজপুর এলাকাবাসী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফটিকছড়ির এই সংবাদ পড়ে ও দেখে শিউরে ওঠে দেশের মানুষ। যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মী বিপুল, রুবেল ও ফেরকানকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এ ঘটনায় আহত অনেক নেতা-কর্মী। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মাইক্রোবাস, জিপ, ব্যক্তিগত মোটরযান ও দুই শতাধিক মোটরসাইকেল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ সরকারের কোটি টাকার সম্পদ।
সেই রক্তাক্ত স্মৃতি, কর্মী-সমর্থকদের ওপর নেমে আসা সেই বীভৎসতা আজ ভুলে যেতে চান আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। অভিযোগপত্র থেকে তাঁরা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছেন জামায়াতের নেতা নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী, ইকবাল চৌধুরী ও শহীদুল আজমকে। তাঁরা তিনজনই ফটিকছড়ির তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, তৃণমূলের এই জনপ্রতিনিধিদের দলে টানতে পারলে ভবিষ্যতে নির্বাচন বা অন্যান্য দলীয় কর্মকাণ্ডে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের রক্তে যে এলাকাটি এখনো সিক্ত, এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন দলের যে পঙ্গু নেতা-কর্মীরা, তাঁরা কীভাবে মেনে নেবেন আইনের নিজস্ব গতিকে রুদ্ধ করার এই উদ্যোগ!
এই মামলার অন্যতম বাদী জামাল পাশা শওকতের মুখে আমরা শুনি সেই ক্ষোভ। তিনি বলেন, অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করার আগে যাতে কোনো নিরীহ লোকের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত না হয়, তা যাচাই-বাছাই করার জন্য দলীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অথচ অন্যতম বাদী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সেই কমিটিতেও রাখা হয়নি। অভিযোগপত্র থেকে জামায়াতের নেতাদের বাদ দেওয়ার খবর শুনে তিনি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আবারও ভুজপুরের মতো ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করবে।
ভুজপুর থানার কর্মকর্তারাও এই অযৌক্তিক উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলেছেন, পুরো তদন্ত যেখানে শেষ হয়নি, সেখানে অভিযোগপত্র থেকে কারও নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ কোথায়, কারণই বা কী?
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা না জানলেও আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারি। হত্যা, সন্ত্রাস ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এখন চাইবেন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে আইনের হাত থেকে বাঁচতে। আওয়ামী লীগের স্বার্থান্বেষী নেতারা সেই সমঝোতার পথে নিজের স্বার্থ হাসিলের স্বপ্ন দেখছেন। এতে আইনের হাত অকেজো হয়ে পড়বে আর নিহত ব্যক্তিদের পরিবার বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও দেখবেন, কীভাবে ‘বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে’!
যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা এককাট্টা হয়েছেন—এমন সংবাদ আমরা দেখেছি পত্রপত্রিকায়। সেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সহিংসতার অভিযোগে জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো তিনি প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য জানি না, তবে এটা তো এখন সহজেই অনুমেয়, সারা দেশে এ রকম অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়বে। তাতে মামলার দায় থেকে হয়তো রক্ষাও পাবেন অনেকে। কিন্তু আইনের ওপর ক্ষমতাসীনদের এই হস্তক্ষেপ খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.