খ্রিস্ট জন্মোৎসবের আহ্বান by ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা
বড়দিনের
তাৎপর্য উপলব্ধি ও প্রকাশ করার জন্য বিচিত্র ভাব-ভাবনা, ভাষা, প্রতীক ও
ভঙ্গিমা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে আনন্দ, শান্তি, আলো, জীবন,
ভালোবাসা, সত্য, সুখ, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন, ক্ষমা, নিরাময়, অলৌকিক কাজ বা
আশ্চর্যকাজ, স্বর্গসুখ ইত্যাদি। সংক্ষেপে এগুলোকে বলা যায় মানবমনের গভীরতম
আকাক্সক্ষা। মানুষের চেষ্টার ত্র“টি নেই। স্বজ্ঞানে-অজ্ঞানে, জেনে-না-জেনে
মানুষ এগুলোর সন্ধান করছে। পূজা-পার্বণের মধ্য দিয়ে মানুষ আসলে সেই সত্যটাই
প্রকাশ করছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলোর জন্যই জীবনভর মানুষের সব পরিশ্রম ও
সাধনা। কেননা এ জগতে মানুষের জীবন নানাবিধ বাধা-বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধন
থেকে সে মুক্ত হতে চায়, আর সেই মুক্তির পথ সন্ধান করেই মানুষ জীবনের
পথপরিক্রমায় অগ্রসর হয়। বাইবেলের দর্শন হচ্ছে : মানুষকে ঈশ্বর অসীম মর্যাদা
দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু শয়তানের প্রলোভনে পড়ে মানুষ তার মানবীয়
অবস্থাকে গ্রহণ না করে বরং অহংকারী হয়ে ওঠে। শয়তানেরই প্ররোচনায় সে ঈশ্বরের
সমকক্ষ হতে চায়। এই অহংকার ও অবাধ্যতার কারণেই তার পতন ঘটেছে। ঈশ্বরের
আদেশ অমান্য করার ফলে শুধু ঈশ্বরের সঙ্গেই নয় বরং মানুষের পরস্পরের মধ্যেও
সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে; ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে মানুষ
পরস্পরের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে তার নিজের অন্তরের পরিবেশও
কলুষিত হয়ে পড়েছে। সেই কলুষ-কালিমা বা পাপময়তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সর্বত্র :
মানুষের মাঝে ঘৃণা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অমিল, দলাদলি, কলহ-বিবাদ,
মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি এর প্রমাণ। গোটা পৃথিবীই হয়ে
পড়েছে অশান্ত। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তিলাভের জন্য মানুষ চিরদিনই ব্যাকুল।
মানুষ চায় শান্তি- তার অন্তরের গভীরতম আকাক্সক্ষাই হচ্ছে শান্তির জন্য।
কিন্তু এই শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায্যতা, লোভ-লালসার বেড়াজাল থেকে
মুক্তি, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমা দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে ভগ্ন
সম্পর্কের নিরাময়, পুনর্মিলন ও সম্প্রীতি স্থাপন। এ জন্যই যুগে যুগে
প্রবক্তা ও মহর্ষিগণ ভাবী ত্রাণকর্তাকে শান্তিরাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং
মানুষের মনে তাকে বরণ করার প্রত্যাশা জাগিয়েছেন।
যিশুর জন্ম হয়েছিল একটি গোশালায়, দীনবেশে। জীবনভর তিনি দরিদ্র জীবনযাপন করেছেন এবং দরিদ্রদের ধন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই দীনতার জীবনটাই ছিল মানুষের কাছে সুখবর। ‘প্রভুর আত্মা আমার উপর অধিষ্ঠিত, কেননা তিনি দীনদুঃখীদের কাছে শুভসংবাদ দেয়ার জন্য আমাকে অভিষিক্ত করেছেন’ (লুক ৪:১৮)। দীনদরিদ্রদের সঙ্গেই তিনি একাত্ম হয়েছেন। এ কারণে তিনি বলেছেন : অন্তিম বিচারের দিনে মানুষের মূল্যায়নের মাপকাঠি হবে ক্ষুদ্রতম ভাইবোনদের প্রতি আমাদের আচরণ। তিনি নিজেই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আশ্রয়হীন প্রবাসী, বস্ত্রহীন, পীড়িত ও কারারুদ্ধ মানুষ- অর্থাৎ ক্ষুদ্রতমদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা এই ক্ষুদ্রতম মানুষদের একজনের প্রতি যা কিছু করেছ, তা আমারই প্রতি করেছ। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আত্মায় দীনহীন যারা, তারাই সুখী, কারণ স্বর্গরাজ্য তাদেরই’ (মথি ৫:৩)। তিনি গরিবের বন্ধু। দীনদুঃখীদের ভালোবাসা ছিল তার জীবনের ব্রত। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে ঈশ্বরকে জীবনের একমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে জানার ও পাওয়ার সাধনা করার আহ্বান।
যিশু জন্ম নিয়েছিলেন ছোট্ট শিশু হয়ে। এটি নম্রতার প্রতীক। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যদি মন পরিবর্তন না হয় ও তোমরা শিশুদের মতো না হয়ে ওঠো, তবে স্বর্গরাজ্যে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না’ (মথি ১৮:৩)। ‘যে কেউ শিশুরই মতো ঈশ্বরের রাজ্য গ্রহণ না করে, সে তার মধ্যে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না’ (মার্ক ১০:১৫)। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে শিশুর মতো হওয়ার আহ্বান। সেই শিশু যিশুরই প্রতীক হচ্ছে গোশালায় যাবপাত্রে শায়িত শিশুটি।
প্রবক্তা যিশাইয়া যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৭৪০ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘‘একটি শিশু আমাদের জন্য আজ জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তার স্কন্ধের ওপর ন্যস্ত রয়েছে সবকিছুর আধিপত্যভার। তার নাম :‘অনন্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিমান ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ!’ এবার শুরু হবে... অন্তবিহীন শান্তির যুগ!... ন্যায় ও ধর্মিষ্ঠতার ভিত্তিতে, আজ থেকে চিরকালের মতো” (যিশাইয়া ৯:৬-৭)। প্রবক্তা যিশাইয়া আরও বলেছিলেন, “শোন, কুমারী কন্যাটি হবে গর্ভবতী; সে এক পুত্র-সন্তানের জন্ম দেবে। একদিন সবাই তাকে ইম্মানুয়েল নামে ডাকবে (নামটির অর্থ হল : ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন’।” (যিশাইয়া ৭:১৪)। যিশুখ্রিস্টের মধ্যে এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। যিশুর জন্মের আগে মহাদূত গাব্রিয়েল মারিয়ার কাছে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তার নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাকে দান করবেন তার পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন’ (লুক ১:৩০-৩২। যিশুর জন্মের পর স্বর্গদূত রাখালদের কাছে দেখা দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না! আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন- তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু। এই চিহ্নে তোমরা তাকে চিনতে পারবে : দেখতে পাবে কাপড়ে জড়ানো, যাবপাত্রে শোয়ানো এক শিশুকে’ (লুক ২:১০-১২)। যিশুতে ঐশ-প্রতিশ্র“তির এই বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বড়দিনের উৎসব পালিত হয়। প্রতীকী ভাষায় ঘটনার নাটকীয় বর্ণনার অন্তর্নিহিত এই ভাব ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করাই বড়দিন উৎসব পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যিশু নিজেই আনন্দ। যিশুর জন্মলগ্নে স্বর্গদূত বললেন, ‘আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে’ (লুক ২:১০)। বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হয় যখন আমরা শুধু মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে নয়, বরং অপরের সঙ্গে সহভাগিতার মাধ্যমে তা প্রচার করি। যিশু বলেন, ‘পিতা যেমন আমাকে ভালোবেসেছেন, আমিও তেমনি তোমাদের ভালোবেসেছি। তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থেক। যদি আমার সমস্ত আদেশ পালন করো, তবেই তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থাকবে, আমিও যেমন পিতার সমস্ত আদেশ পালন করেছি আর আছি তার ভালোবাসার আশ্রয়ে। এসব কথা তোমাদের বললাম, যাতে আমার আনন্দ তোমাদের অন্তরে থাকতে পারে এবং তোমাদের আনন্দ যেন পরিপূর্ণ হতে পারে’ (যোহন ১৫:৯-১১)। এ জগতে মানুষ মাত্রই সুখ ও আনন্দ পেতে চায়, কিন্তু প্রকৃত ও স্থায়ী আনন্দের উৎস একমাত্র ঈশ্বর। তিনি মানুষকে সুখ ও আনন্দের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অপরকে কষ্ট দিয়ে, অপরকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আমার পক্ষে প্রকৃত আনন্দ লাভ করা সম্ভব নয়। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে প্রতিদিনের যাত্রায় জীবন-সহভাগিতার মাধ্যমে সেই অকৃত্রিম ও অকপট আনন্দ আস্বাদন করার।
যিশুই শান্তি। যিশু ঈশ্বরের প্রতিশ্র“তি ‘শান্তিরাজ’ (যিশাইয়া ৯:৬)। যিশুর জন্মের রাতে স্বর্গের দূতবাহিনী গেয়ে উঠেছিল : ‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে’ (লুক ২:১৪)। ঈশ্বর প্রদত্ত এই শান্তি অন্তরে গ্রহণ করতে পারলেই মানুষের মন থেকে সব রকম ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর হতে পারে। যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ মানুষের একান্ত কাম্য, তা-ই বড়দিন উৎসবের অন্যতম প্রধান আশীর্বাদ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের পরে শিষ্যদের দেখা দিয়ে যিশু দু’বার বলেছিলেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক’ (যোহন ২০:১৯-২১)। তবে যিশুর দেয়া শান্তি আর মানুষের দেয়া শান্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যিশু বলেন, ‘তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি; অবশ্য এ সংসার যেভাবে শান্তি দেয়, সেভাবে আমি তোমাদের তা দিয়ে যাচ্ছি না’ (যোহন ১৪:২৭)। যিশুর দেয়া শান্তি হচ্ছে পবিত্র আত্মা বা পাক্ রুহের বশে চলার ফল (গালাতীয় ৫:২২)। এর বিপরীতে হচ্ছে রিপু বা পাপ-স্বভাবের বশে চলা। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজে নেমে আসে অশান্তি ও অরাজকতা। বড়দিন উৎসবে শান্তি-শুভেচ্ছা বিনিময় যদি কেবল মৌখিক শিষ্টাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত শান্তি-আশীর্বাদ পেতে পারি না। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে সেই প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তি লাভ করার আহ্বান।
মঙ্গলসমাচারে যিশুর জন্মকাহিনীর বর্ণনায় অনেক প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। বড়দিন উৎসবের সময় এই প্রতীকগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আকাশে উদিত উজ্জ্বল তারকা প্রকাশ করে যে যিশু হচ্ছেন জগতের আলো। জগতের অন্ধকার দূর করতেই তিনি ইম্মানুয়েল বা আমাদের নিত্যসঙ্গী ঈশ্বর। পূর্বাদেশের তিন পণ্ডিত বলতে বোঝায় অযিহুদি। অর্থাৎ যিশু কেবল কোনো এক জাতি বা গোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা নন, তিনি সব মানুষেরই মুক্তিদাতা। বেথলেহেমের গোশালায় দীনবেশে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, ‘তিনি তো স্বরূপে ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরের সঙ্গে তার সমতুল্যতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেন না; বরং নিজেকে তিনি রিক্ত করলেন; দাসের স্বরূপ গ্রহণ করে তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন’ (ফিলিপ্পীয় ২:৬-৭)। কোনো রাজনৈতিক কূটচাল, তরবারি, অস্ত্রবল, সৈন্যবল বা অশ্বারোহী সেনাবাহিনী দিয়ে প্রকৃত শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে কষ্টভোগী সেবক যিশুর মতো পরার্থে সম্পূর্ণ আÍদানের মাধ্যমেই প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। প্রেম-প্রসূত এই নম্রতা বা দীনতার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের সর্বময় ঐশ-ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। খ্রিস্ট জন্মোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সবার মাঝে প্রতিষ্ঠিত হোক সেই অক্ষয় ও প্রকৃত শান্তি, সুখ ও আনন্দ।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সিএসসি : উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত), নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
যিশুর জন্ম হয়েছিল একটি গোশালায়, দীনবেশে। জীবনভর তিনি দরিদ্র জীবনযাপন করেছেন এবং দরিদ্রদের ধন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই দীনতার জীবনটাই ছিল মানুষের কাছে সুখবর। ‘প্রভুর আত্মা আমার উপর অধিষ্ঠিত, কেননা তিনি দীনদুঃখীদের কাছে শুভসংবাদ দেয়ার জন্য আমাকে অভিষিক্ত করেছেন’ (লুক ৪:১৮)। দীনদরিদ্রদের সঙ্গেই তিনি একাত্ম হয়েছেন। এ কারণে তিনি বলেছেন : অন্তিম বিচারের দিনে মানুষের মূল্যায়নের মাপকাঠি হবে ক্ষুদ্রতম ভাইবোনদের প্রতি আমাদের আচরণ। তিনি নিজেই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, আশ্রয়হীন প্রবাসী, বস্ত্রহীন, পীড়িত ও কারারুদ্ধ মানুষ- অর্থাৎ ক্ষুদ্রতমদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা এই ক্ষুদ্রতম মানুষদের একজনের প্রতি যা কিছু করেছ, তা আমারই প্রতি করেছ। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আত্মায় দীনহীন যারা, তারাই সুখী, কারণ স্বর্গরাজ্য তাদেরই’ (মথি ৫:৩)। তিনি গরিবের বন্ধু। দীনদুঃখীদের ভালোবাসা ছিল তার জীবনের ব্রত। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে ঈশ্বরকে জীবনের একমাত্র অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে জানার ও পাওয়ার সাধনা করার আহ্বান।
যিশু জন্ম নিয়েছিলেন ছোট্ট শিশু হয়ে। এটি নম্রতার প্রতীক। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যদি মন পরিবর্তন না হয় ও তোমরা শিশুদের মতো না হয়ে ওঠো, তবে স্বর্গরাজ্যে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না’ (মথি ১৮:৩)। ‘যে কেউ শিশুরই মতো ঈশ্বরের রাজ্য গ্রহণ না করে, সে তার মধ্যে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না’ (মার্ক ১০:১৫)। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে শিশুর মতো হওয়ার আহ্বান। সেই শিশু যিশুরই প্রতীক হচ্ছে গোশালায় যাবপাত্রে শায়িত শিশুটি।
প্রবক্তা যিশাইয়া যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৭৪০ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: ‘‘একটি শিশু আমাদের জন্য আজ জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তার স্কন্ধের ওপর ন্যস্ত রয়েছে সবকিছুর আধিপত্যভার। তার নাম :‘অনন্য মন্ত্রণাদাতা, শক্তিমান ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা, শান্তিরাজ!’ এবার শুরু হবে... অন্তবিহীন শান্তির যুগ!... ন্যায় ও ধর্মিষ্ঠতার ভিত্তিতে, আজ থেকে চিরকালের মতো” (যিশাইয়া ৯:৬-৭)। প্রবক্তা যিশাইয়া আরও বলেছিলেন, “শোন, কুমারী কন্যাটি হবে গর্ভবতী; সে এক পুত্র-সন্তানের জন্ম দেবে। একদিন সবাই তাকে ইম্মানুয়েল নামে ডাকবে (নামটির অর্থ হল : ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন’।” (যিশাইয়া ৭:১৪)। যিশুখ্রিস্টের মধ্যে এই ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন বলে খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। যিশুর জন্মের আগে মহাদূত গাব্রিয়েল মারিয়ার কাছে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তার নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাকে দান করবেন তার পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন’ (লুক ১:৩০-৩২। যিশুর জন্মের পর স্বর্গদূত রাখালদের কাছে দেখা দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না! আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ-নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন- তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু। এই চিহ্নে তোমরা তাকে চিনতে পারবে : দেখতে পাবে কাপড়ে জড়ানো, যাবপাত্রে শোয়ানো এক শিশুকে’ (লুক ২:১০-১২)। যিশুতে ঐশ-প্রতিশ্র“তির এই বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বড়দিনের উৎসব পালিত হয়। প্রতীকী ভাষায় ঘটনার নাটকীয় বর্ণনার অন্তর্নিহিত এই ভাব ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করাই বড়দিন উৎসব পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যিশু নিজেই আনন্দ। যিশুর জন্মলগ্নে স্বর্গদূত বললেন, ‘আমি এক আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি। এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে’ (লুক ২:১০)। বড়দিনের আনন্দ তখনই সার্থক হয় যখন আমরা শুধু মৌখিক প্রচারের মাধ্যমে নয়, বরং অপরের সঙ্গে সহভাগিতার মাধ্যমে তা প্রচার করি। যিশু বলেন, ‘পিতা যেমন আমাকে ভালোবেসেছেন, আমিও তেমনি তোমাদের ভালোবেসেছি। তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থেক। যদি আমার সমস্ত আদেশ পালন করো, তবেই তোমরা আমার ভালোবাসার আশ্রয়ে থাকবে, আমিও যেমন পিতার সমস্ত আদেশ পালন করেছি আর আছি তার ভালোবাসার আশ্রয়ে। এসব কথা তোমাদের বললাম, যাতে আমার আনন্দ তোমাদের অন্তরে থাকতে পারে এবং তোমাদের আনন্দ যেন পরিপূর্ণ হতে পারে’ (যোহন ১৫:৯-১১)। এ জগতে মানুষ মাত্রই সুখ ও আনন্দ পেতে চায়, কিন্তু প্রকৃত ও স্থায়ী আনন্দের উৎস একমাত্র ঈশ্বর। তিনি মানুষকে সুখ ও আনন্দের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অপরকে কষ্ট দিয়ে, অপরকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আমার পক্ষে প্রকৃত আনন্দ লাভ করা সম্ভব নয়। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে প্রতিদিনের যাত্রায় জীবন-সহভাগিতার মাধ্যমে সেই অকৃত্রিম ও অকপট আনন্দ আস্বাদন করার।
যিশুই শান্তি। যিশু ঈশ্বরের প্রতিশ্র“তি ‘শান্তিরাজ’ (যিশাইয়া ৯:৬)। যিশুর জন্মের রাতে স্বর্গের দূতবাহিনী গেয়ে উঠেছিল : ‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়! ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে’ (লুক ২:১৪)। ঈশ্বর প্রদত্ত এই শান্তি অন্তরে গ্রহণ করতে পারলেই মানুষের মন থেকে সব রকম ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর হতে পারে। যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ মানুষের একান্ত কাম্য, তা-ই বড়দিন উৎসবের অন্যতম প্রধান আশীর্বাদ। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের পরে শিষ্যদের দেখা দিয়ে যিশু দু’বার বলেছিলেন, ‘তোমাদের শান্তি হোক’ (যোহন ২০:১৯-২১)। তবে যিশুর দেয়া শান্তি আর মানুষের দেয়া শান্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য। যিশু বলেন, ‘তোমাদের জন্য শান্তি রেখে যাচ্ছি, তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি আমারই শান্তি; অবশ্য এ সংসার যেভাবে শান্তি দেয়, সেভাবে আমি তোমাদের তা দিয়ে যাচ্ছি না’ (যোহন ১৪:২৭)। যিশুর দেয়া শান্তি হচ্ছে পবিত্র আত্মা বা পাক্ রুহের বশে চলার ফল (গালাতীয় ৫:২২)। এর বিপরীতে হচ্ছে রিপু বা পাপ-স্বভাবের বশে চলা। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজে নেমে আসে অশান্তি ও অরাজকতা। বড়দিন উৎসবে শান্তি-শুভেচ্ছা বিনিময় যদি কেবল মৌখিক শিষ্টাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত শান্তি-আশীর্বাদ পেতে পারি না। বড়দিনের আহ্বান হচ্ছে সেই প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তি লাভ করার আহ্বান।
মঙ্গলসমাচারে যিশুর জন্মকাহিনীর বর্ণনায় অনেক প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। বড়দিন উৎসবের সময় এই প্রতীকগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আকাশে উদিত উজ্জ্বল তারকা প্রকাশ করে যে যিশু হচ্ছেন জগতের আলো। জগতের অন্ধকার দূর করতেই তিনি ইম্মানুয়েল বা আমাদের নিত্যসঙ্গী ঈশ্বর। পূর্বাদেশের তিন পণ্ডিত বলতে বোঝায় অযিহুদি। অর্থাৎ যিশু কেবল কোনো এক জাতি বা গোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা নন, তিনি সব মানুষেরই মুক্তিদাতা। বেথলেহেমের গোশালায় দীনবেশে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, ‘তিনি তো স্বরূপে ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরের সঙ্গে তার সমতুল্যতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেন না; বরং নিজেকে তিনি রিক্ত করলেন; দাসের স্বরূপ গ্রহণ করে তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন’ (ফিলিপ্পীয় ২:৬-৭)। কোনো রাজনৈতিক কূটচাল, তরবারি, অস্ত্রবল, সৈন্যবল বা অশ্বারোহী সেনাবাহিনী দিয়ে প্রকৃত শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা কখনও সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে কষ্টভোগী সেবক যিশুর মতো পরার্থে সম্পূর্ণ আÍদানের মাধ্যমেই প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। প্রেম-প্রসূত এই নম্রতা বা দীনতার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের সর্বময় ঐশ-ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। খ্রিস্ট জন্মোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সবার মাঝে প্রতিষ্ঠিত হোক সেই অক্ষয় ও প্রকৃত শান্তি, সুখ ও আনন্দ।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা সিএসসি : উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত), নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
No comments