আমাকে এখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সংবাদটি জানাতে হবে by মোকাম্মেল হোসেন
রাস্তায়
কোনো যানজট নেই। যানজট না থাকলে চলাফেরায় খুব আরাম। আরাম পাচ্ছি- পাশাপাশি
টেনশনও হচ্ছে। শুনেছি, বিষের কঠিন জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে তবেই দেবতারা
অমৃত পেয়েছিলেন। হরতালের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া আরামের জন্যও চড়া মূল্য দেয়ার
ভয় আছে। ডানে-বাঁয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হচ্ছি- একটা মিছিল আসতে দেখে
রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। রিকশা থামতে না থামতেই পরপর কয়েকটা ককটেল
বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। লোকজনের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হতেই রিকশা থেকে
লাফ দিয়ে তাদের সঙ্গে শামিল হলাম। কিছুটা পথ পাড়ি দেয়ার পর সামনে একটা জটলা
চোখে পড়ল। ওদিক থেকে আসা এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম-
: ওইখানে কী হইছে ভাই!
-কুত্তার বাচ্চা।
লোকটার মুখের ভাষা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তথ্য প্রদানে বাঙালির অসহযোগিতার বদনাম আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গালি-গালাজের নজিরও আছে। আমি এমন কোনো তথ্য জানতে চাইনি যার জন্য এ রকম জঘন্য একটা গালি শুনতে হবে। লোকটার নাক বরাবর নিশানা ঠিক করে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করতেই সে বলে উঠল-
: খন্দকের মধ্যে একটা কুত্তার বাচ্চা পইড়া গেছে। মানুষ গোল হইয়া তামাশা দেখবার লাগছে।
মানুষের মুখের কথা কখনও কখনও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আরেকটু হলেই কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটত, ভেবে জিহ্বায় কামড় দিলাম। যাক, শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি- এ জন্য আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।
জটলার কাছে গিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতেই দেখলাম- ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ চলছে। এর নিচে স্যুয়ারেজ লাইন বসানোর জন্য জায়গায় জায়গায় গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ রকম একটা গর্তের মধ্যেই কুকুরছানাটা পড়ে গেছে। এক লোক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কুকুরছানাকে উপরে উঠানোর চেষ্টা করছিল। এ ব্যাপারে দু’একজন তাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছিল। গর্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হল- গর্তে কুকুরছানা নয়, বাংলাদেশ পড়ে আছে। কিছু লোক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছে। কিছু লোক নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে। আর কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াতেই পাশে একটা বিলবোর্ড নজরে এলো। ফুটপাত উন্নয়নের রূপকার এক প্রতিমন্ত্রী নিজের ছবি-সংবলিত বিলবোর্ডে তার দ্বারা সম্পাদিত উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয় ডান হাতের বুড়া আঙুল থুঁতনির নিচে রেখে মিটিমিটি হাসছেন। হাতের তিন আঙুলে পাথর বসানো তিনটি আংটি শোভা পাচ্ছে। আঙুলের চাপে তার থুতনিতে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। এ মন্ত্রীকে আমি চিনি। পাঁচ বছর আগে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করার সময় তার শরীর ছিল পাতাকাঠির মতো। এ পাঁচ বছর হাফমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি থুতনিতেই যদি আধা কেজি চর্বি জমিয়ে ফেলেন, তাহলে তার সারা শরীরে কতটুকু চর্বি জমেছে, তা বের করতে হলে খাতা-কলম নিয়ে বসতে হবে।
বোমা বিস্ফোরণের পর রাস্তায় পুলিশের আনাগোনা বাড়লেও খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না। হরতালের সময় পিকেটারদের হাতে পুলিশের ছেঁচা খাওয়ার ছবি প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। যারা নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম, তারা অন্যদের সুরক্ষা দেবে কীভাবে? সাবধানে পা ফেলছি- হঠাৎ দ্রুতগতির একটা সিএনজি অটোরিকশা পাক খেতে খেতে আমার সামনে উল্টে গেল। দৌড়ে সেটার কাছে গেলাম। আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন ছুটে এলো। সবাই মিলে সেটাকে টেনে উঠালাম। ভেতর থেকে রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে ড্রাইভার বের হয়ে এলেও পেছনে থাকা যাত্রীর কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ড্রাইভারকে বললাম-
: আপনের প্যাসেঞ্জার তো মনে হয় জ্ঞান হারাইয়া ফেলছে, কী করবেন?
ড্রাইভার কোনো কথা না বলে হাতের তালু দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে লাগল। তার উদ্দেশে পুনরায় বললাম-
: আপনার নিজেরও তো চিকিৎসা দরকার। দুইজন একসঙ্গে হাসপাতালে চইল্যা যান।
ড্রাইভার রাজি হল না। মাথা নেড়ে বলল-
: সামনেই আমার গ্যারেজ। গ্যারেজে গাড়ি জমা দিয়া আমি বাসায় চইল্যা যামু।
লোকটার স্বার্থপরতা দেখে খুবই কষ্ট পেলাম। রেগে গিয়ে বললাম-
: অ্যাক্সিডেন্ট আপনে ঘটাইছেন। এই ব্যাপারে অবশ্যই আপনের একটা দায়িত্ব আছে!
ড্রাইভার চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকাল। চেহারায় অবাক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল-
: আপনে এসব কী বলতেছেন! কেউ কি ইচ্ছা কইরা অ্যাক্সিডেন্ট করে?
: তাইলে কী কইরা করে?
-হরতালকারীরা যেভাবে চারপাশ থেইক্যা ঘিরা ধরছিল, জোরে টান না দিলে এতক্ষণে উনার শরীর পুইড়া কয়লা হইয়া যাইত!
: কয়লা যখন হয় নাই, তখন উনারে একটু হাসপাতালে পৌঁছাইয়া দেন। কোনো সমস্যা নাই, আপনের সঙ্গে আমিও যাব।
-ভাই, আমারে মাফ কইরা দেন।
পাশ দিয়ে একটা ভ্যান যাচ্ছিল। সেটাকে দাঁড় করালাম। অচেতন হয়ে পড়ে থাকা যাত্রী ভদ্রলোককে ধরাধরি করে ভ্যানের উপর শুইয়ে দিয়ে ভ্যানচালককে বললাম-
: ঢাকা মেডিকেলে চল।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার হচ্ছি- ভদ্রলোকের পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তার কী পরিচয়- কোথায় যাচ্ছিল, কিছুই জানি না। মোবাইল ফোন একটা যোগসূত্র হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ জানতে চাইল-
: রূপার আব্বু, তুমি কোথায়?
বোঝা গেল, রূপা নামে ভদ্রলোকের একটা মেয়ে আছে। আমার কানে যার কণ্ঠস্বর বাজছে, তিনি কি রূপার মা? ফোন করে স্বামীর খোঁজখবর নিচ্ছেন? কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। এপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভদ্রমহিলার উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এলো-
: কী হইল! কথা বলতেছ না কেন? তুমি এখন কোথায়?
দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। ঠিক করলাম- আগে হাসপাতালে যাই। তারপর ওখান থেকে ভদ্রমহিলার নম্বরে কল ব্যাক করে সবকিছু জানালেই হবে। তার আগ পর্যন্ত হা-হু করে যেতে হবে। আমি আস্তে করে বললাম-
: রাস্তায়।
-এখনও রাস্তায়! অফিসে পৌঁছাইতে আর কতক্ষণ লাগবে?
ভদ্রলোক তাহলে অফিসে যাচ্ছিলেন? আমি আগের মতোই আস্তে করে বললাম-
: এই তো...
ভদ্রমহিলা এবার জানতে চাইলেন-
: কীসে কইরা যাইতেছ?
উত্তর দেয়ার আগে ভদ্রলোকের জ্ঞানহীন নিথর শরীরের ওপর চোখ রাখলাম। তারপর কোনোমতে উচ্চারণ করলাম-
: ভ্যানে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর চিকিৎসক এগিয়ে এলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: পেশেন্ট আপনার কী হন?
-কেন?
: প্লিজ, আপনি মন শক্ত করুন।
-কেন?
: আই অ্যাম স্যরি টু ছে- হি হ্যাজ অলরেডি এক্সপায়ার্ড। এখানে আনার আগেই ওনার মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালে কেউ মারা গেলে নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার থাকে। এলোমেলো পা ফেলে বাইরে চলে এলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আমি যার মৃত্যু ঘটনার সঙ্গী হয়ে রইলাম, তার জন্য এদেশে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হবে না। জাতিও তার কথা মনে রাখবে না। পকেট থেকে ভদ্রলোকের মোবাইল ফোন বের করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল। একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সংবাদগুলোর একটি। আমাকে এখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম এ সংবাদটি জানাতে হবে। আমি শহীদ মিনারের সিঁড়ির ওপর বসে পড়লাম। আগের সেই নম্বরে কল ব্যাক করতেই একটা বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল-
: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আপনি কে বলছেন!
-আমি তোমার এক আংকেল। তুমি কি রূপা?
: জি।
-রূপা তুমি কোন ক্লাসে পড়?
: ক্লাস থ্রি।
-তোমার আম্মু কোথায়?
: আম্মু তো ছাদে গেছে আচার রোদে দিতে। আপনি আমাকে বলুন।
ছোট্ট মেয়েটিকে আমি কীভাবে তার বাবার মৃত্যুসংবাদ দেব? কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চারপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ওপাশ থেকে রূপা হ্যালো হ্যালো করছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনো কথা বলতে পারছি না। চোখের পানিতে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: ওইখানে কী হইছে ভাই!
-কুত্তার বাচ্চা।
লোকটার মুখের ভাষা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তথ্য প্রদানে বাঙালির অসহযোগিতার বদনাম আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গালি-গালাজের নজিরও আছে। আমি এমন কোনো তথ্য জানতে চাইনি যার জন্য এ রকম জঘন্য একটা গালি শুনতে হবে। লোকটার নাক বরাবর নিশানা ঠিক করে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করতেই সে বলে উঠল-
: খন্দকের মধ্যে একটা কুত্তার বাচ্চা পইড়া গেছে। মানুষ গোল হইয়া তামাশা দেখবার লাগছে।
মানুষের মুখের কথা কখনও কখনও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আরেকটু হলেই কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটত, ভেবে জিহ্বায় কামড় দিলাম। যাক, শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি- এ জন্য আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।
জটলার কাছে গিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতেই দেখলাম- ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ চলছে। এর নিচে স্যুয়ারেজ লাইন বসানোর জন্য জায়গায় জায়গায় গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ রকম একটা গর্তের মধ্যেই কুকুরছানাটা পড়ে গেছে। এক লোক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কুকুরছানাকে উপরে উঠানোর চেষ্টা করছিল। এ ব্যাপারে দু’একজন তাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছিল। গর্তের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হল- গর্তে কুকুরছানা নয়, বাংলাদেশ পড়ে আছে। কিছু লোক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছে। কিছু লোক নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে। আর কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াতেই পাশে একটা বিলবোর্ড নজরে এলো। ফুটপাত উন্নয়নের রূপকার এক প্রতিমন্ত্রী নিজের ছবি-সংবলিত বিলবোর্ডে তার দ্বারা সম্পাদিত উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়েছেন। মন্ত্রী মহোদয় ডান হাতের বুড়া আঙুল থুঁতনির নিচে রেখে মিটিমিটি হাসছেন। হাতের তিন আঙুলে পাথর বসানো তিনটি আংটি শোভা পাচ্ছে। আঙুলের চাপে তার থুতনিতে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। এ মন্ত্রীকে আমি চিনি। পাঁচ বছর আগে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা করার সময় তার শরীর ছিল পাতাকাঠির মতো। এ পাঁচ বছর হাফমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি থুতনিতেই যদি আধা কেজি চর্বি জমিয়ে ফেলেন, তাহলে তার সারা শরীরে কতটুকু চর্বি জমেছে, তা বের করতে হলে খাতা-কলম নিয়ে বসতে হবে।
বোমা বিস্ফোরণের পর রাস্তায় পুলিশের আনাগোনা বাড়লেও খুব একটা ভরসা পাচ্ছি না। হরতালের সময় পিকেটারদের হাতে পুলিশের ছেঁচা খাওয়ার ছবি প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। যারা নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম, তারা অন্যদের সুরক্ষা দেবে কীভাবে? সাবধানে পা ফেলছি- হঠাৎ দ্রুতগতির একটা সিএনজি অটোরিকশা পাক খেতে খেতে আমার সামনে উল্টে গেল। দৌড়ে সেটার কাছে গেলাম। আশপাশ থেকে আরও কয়েকজন ছুটে এলো। সবাই মিলে সেটাকে টেনে উঠালাম। ভেতর থেকে রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে ড্রাইভার বের হয়ে এলেও পেছনে থাকা যাত্রীর কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ড্রাইভারকে বললাম-
: আপনের প্যাসেঞ্জার তো মনে হয় জ্ঞান হারাইয়া ফেলছে, কী করবেন?
ড্রাইভার কোনো কথা না বলে হাতের তালু দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে লাগল। তার উদ্দেশে পুনরায় বললাম-
: আপনার নিজেরও তো চিকিৎসা দরকার। দুইজন একসঙ্গে হাসপাতালে চইল্যা যান।
ড্রাইভার রাজি হল না। মাথা নেড়ে বলল-
: সামনেই আমার গ্যারেজ। গ্যারেজে গাড়ি জমা দিয়া আমি বাসায় চইল্যা যামু।
লোকটার স্বার্থপরতা দেখে খুবই কষ্ট পেলাম। রেগে গিয়ে বললাম-
: অ্যাক্সিডেন্ট আপনে ঘটাইছেন। এই ব্যাপারে অবশ্যই আপনের একটা দায়িত্ব আছে!
ড্রাইভার চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকাল। চেহারায় অবাক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল-
: আপনে এসব কী বলতেছেন! কেউ কি ইচ্ছা কইরা অ্যাক্সিডেন্ট করে?
: তাইলে কী কইরা করে?
-হরতালকারীরা যেভাবে চারপাশ থেইক্যা ঘিরা ধরছিল, জোরে টান না দিলে এতক্ষণে উনার শরীর পুইড়া কয়লা হইয়া যাইত!
: কয়লা যখন হয় নাই, তখন উনারে একটু হাসপাতালে পৌঁছাইয়া দেন। কোনো সমস্যা নাই, আপনের সঙ্গে আমিও যাব।
-ভাই, আমারে মাফ কইরা দেন।
পাশ দিয়ে একটা ভ্যান যাচ্ছিল। সেটাকে দাঁড় করালাম। অচেতন হয়ে পড়ে থাকা যাত্রী ভদ্রলোককে ধরাধরি করে ভ্যানের উপর শুইয়ে দিয়ে ভ্যানচালককে বললাম-
: ঢাকা মেডিকেলে চল।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার হচ্ছি- ভদ্রলোকের পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তার কী পরিচয়- কোথায় যাচ্ছিল, কিছুই জানি না। মোবাইল ফোন একটা যোগসূত্র হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ জানতে চাইল-
: রূপার আব্বু, তুমি কোথায়?
বোঝা গেল, রূপা নামে ভদ্রলোকের একটা মেয়ে আছে। আমার কানে যার কণ্ঠস্বর বাজছে, তিনি কি রূপার মা? ফোন করে স্বামীর খোঁজখবর নিচ্ছেন? কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। এপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভদ্রমহিলার উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এলো-
: কী হইল! কথা বলতেছ না কেন? তুমি এখন কোথায়?
দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। ঠিক করলাম- আগে হাসপাতালে যাই। তারপর ওখান থেকে ভদ্রমহিলার নম্বরে কল ব্যাক করে সবকিছু জানালেই হবে। তার আগ পর্যন্ত হা-হু করে যেতে হবে। আমি আস্তে করে বললাম-
: রাস্তায়।
-এখনও রাস্তায়! অফিসে পৌঁছাইতে আর কতক্ষণ লাগবে?
ভদ্রলোক তাহলে অফিসে যাচ্ছিলেন? আমি আগের মতোই আস্তে করে বললাম-
: এই তো...
ভদ্রমহিলা এবার জানতে চাইলেন-
: কীসে কইরা যাইতেছ?
উত্তর দেয়ার আগে ভদ্রলোকের জ্ঞানহীন নিথর শরীরের ওপর চোখ রাখলাম। তারপর কোনোমতে উচ্চারণ করলাম-
: ভ্যানে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর চিকিৎসক এগিয়ে এলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: পেশেন্ট আপনার কী হন?
-কেন?
: প্লিজ, আপনি মন শক্ত করুন।
-কেন?
: আই অ্যাম স্যরি টু ছে- হি হ্যাজ অলরেডি এক্সপায়ার্ড। এখানে আনার আগেই ওনার মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালে কেউ মারা গেলে নানা আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার থাকে। এলোমেলো পা ফেলে বাইরে চলে এলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। আমি যার মৃত্যু ঘটনার সঙ্গী হয়ে রইলাম, তার জন্য এদেশে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হবে না। জাতিও তার কথা মনে রাখবে না। পকেট থেকে ভদ্রলোকের মোবাইল ফোন বের করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল। একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সংবাদগুলোর একটি। আমাকে এখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম এ সংবাদটি জানাতে হবে। আমি শহীদ মিনারের সিঁড়ির ওপর বসে পড়লাম। আগের সেই নম্বরে কল ব্যাক করতেই একটা বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল-
: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আপনি কে বলছেন!
-আমি তোমার এক আংকেল। তুমি কি রূপা?
: জি।
-রূপা তুমি কোন ক্লাসে পড়?
: ক্লাস থ্রি।
-তোমার আম্মু কোথায়?
: আম্মু তো ছাদে গেছে আচার রোদে দিতে। আপনি আমাকে বলুন।
ছোট্ট মেয়েটিকে আমি কীভাবে তার বাবার মৃত্যুসংবাদ দেব? কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, চারপাশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে।
ওপাশ থেকে রূপা হ্যালো হ্যালো করছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনো কথা বলতে পারছি না। চোখের পানিতে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments