আন্দোলন- অহিংস হরতালের সহিংস রূপান্তর by আলী ইমাম মজুমদার
হরতাল শব্দটি গুজরাটি ভাষার। প্রবল
রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে নিরস্ত্র মানুষের দাবি আদায়ের পন্থা হিসেবে
উপমহাদেশে এর সূচনা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
তবে সেই
হরতালগুলো ছিল সম্পূর্ণ অহিংস। হরতালের আগে পিকেটিং তখনো হতো। কিন্তু
বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটত বলে জানা যায় না। সেই অহিংস হরতালও হামেশাই পুলিশি
হামলার শিকার হতো। কিন্তু হরতালকারীরা পুলিশের ওপর হামলা করেনি, দু-একটি
ব্যতিক্রমহীন ক্ষেত্র ব্যতীত। লবণ সত্যাগ্রহের সময় চৌড়িচূড়ায় জনতা
সংহিস হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে মহাত্মা গান্ধী ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন
স্থগিত করে দেন। তাঁর বিবেচনায় সেই সহিংসতা অহিংস আন্দোলনের মূল চেতনার
পরিপন্থী। যা-ই হোক, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার ছিল অহিংস
অসহযোগ ও সময়ে সময়ে হরতাল। এই অহিংস আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ রাজশক্তি
ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানের সময়কালেও হরতাল হয়েছে। এগুলোও সহিংস ছিল না। আর এসব হরতাল ডাকা হতো খুব বিরল ক্ষেত্রে। প্রবল জনসমর্থন থাকত এসব হরতালের পেছনে। আগের দিন সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বা এ ধরনের কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে অহিংস পিকেটিং হতো। গুটি কয়েক হরতালই স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের গদি কাঁপিয়ে দেয়। এই হরতালগুলো কালানুক্রমিকভাবে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। আর একপর্যায়ে আসে একাত্তরের
মার্চে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালি জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট এই আন্দোলনে সাধারণ লোকজন যাতে কষ্ট ভোগ না করে, তার নিশ্চয়তার বিধান করা হয়, জনজীবনের অনেকগুলো ক্ষেত্রকে সচল রেখে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর হরতাল একটু ভিন্নরূপ পেতে থাকল। তবু কিছুটা নিয়মকানুন উভয় পক্ষই মেনে চলত। সবকিছু উল্টে যায় আশির দশকে। তখন থেকে হরতালে সহিংসতা, বিশেষ করে গাড়ি ভাঙা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়। হরতাল কার্যকর করতে বলপ্রয়োগের কৌশল অনেকটা তখন থেকেই লক্ষণীয় হয়। তখনকার আন্দোলনরত দলগুলোর কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন থাকলেও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ জনসমর্থন পায়নি তখনো। অফিসগামী কর্মকর্তাদের বাধা দেওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে নাজেহাল করার বহু কদর্য নজির তখন সৃজন করা হয়। লক্ষ করা যায় আমাদের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক মূল্যবোধ। যা-ই হোক, ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা পেল ১৯৯১-এর শুরুর দিকে।
আশা করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক মূল্যবোধকে পুনরুদ্ধার করায় সচেষ্ট হবে সব রাজনৈতিক দল। তারা সবাই গণতান্ত্রিক শক্তির দাবিদার। এটা সত্যি, তাঁরাই ঘুরেফিরে সংসদে নির্বাচিত হয়ে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ঘনীভূত হলো। আরও নিম্নমুখী হলো; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতার বাইরে থাকা সবার কাছেই। তাঁরা তাঁদের অবস্থানে অটল থাকছেন। মাশুল দিচ্ছে দেশের অগণিত মানুষ। অথচ তাঁরাই আমাদের নেতা। তাঁরাই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় যান। বিরোধী দলের সাংসদ হয়ে রাষ্ট্রীয় সুযোগ কিছুটা হলেও উপভোগ করেন। তাঁরা যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে হরতাল ডাকছেন বা অতীতে ডেকেছেন, সেগুলোর কোনোটির পেছনে কী পরিমাণ জনসমর্থন আছে বা ছিল, সে আলোচনা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। তবে প্রতিটি হরতালেই মাশুল দেয় সাধারণ মানুষ। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি। দিনের পর দিন বিপর্যস্ত হয়েছে জনজীবন। জেদাজেদিটা একটু ছেড়ে জনস্বার্থে কিছুটা আলাপ-আলোচনা করে অনেক বড় বিষয়ই নিষ্পত্তি করা যায়। চলমান আন্দোলনে দাবিগুলোর কয়েকটি ক্ষেত্রেও তাই। এখানে নিজ অবস্থানে অটল থেকে সুফল কি কখনো এসেছে?
হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। তেমনি একে মানা বা না মানাও যেকোনো ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার। না মানার অধিকারটি সম্ভবত আমরা বাস্তবে হারিয়ে ফেলেছি। হরতালে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের প্রধান শিকার যানবাহন। তাই দূরপাল্লার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধই হয়ে যায়। রেলপথও ইদানীং হরতালকালে নাশকতামূলক কাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নৌপথে পিকেটিং সম্ভব নয়। তবে নৌপথের যাত্রীরা নদীবন্দরে যেতে আর গন্তব্য বন্দরে পৌঁছানোর পর প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছাতেও সড়ক ব্যবহার করতে হয় প্রায় ক্ষেত্রেই। তাই নৌপথে নৌযান চলাচল সীমিত হয়ে যায় হরতালের সময়। কিন্তু হরতালের নির্ধারিত দিনের আগের দিন গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কী কারণ, তা কি হরতালকারীরা ব্যাখ্যা করতে পারবেন? সেদিন তো হরতাল নেই। প্রকৃতপক্ষে হরতালের আগের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় হরতালকারীদের তৎপরতা। এতে হয় জনজীবন বিপর্যস্ত। জনগণ থাকে শঙ্কিত। তারপর থাকছে আকস্মিক হরতাল। ছুটিতে কেউ কোথাও বেড়াতে গেলে হঠাৎ জানল, পরদিন থেকে হরতাল। তাও দিবা-রাত্রি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তিন-চার দিন। পকেটে খুব কম লোকেরই অফুরন্ত টাকা থাকে। গুনতি টাকা নিয়ে তারা বাসা থেকে বেরিয়েছিল। বিভিন্নভাবে নাজেহাল হয়ে তবে ঘরে ফেরে। বিদেশ থেকে এসে বিমানবন্দরে আটকা পড়ে কয়েক হাজার যাত্রী। এর মধ্যে বিদেশিও থাকে। অথচ প্রতিবেশী নেপালে পর্যটক লেখা গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত। তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কিন্তু আমাদের চেয়ে দীর্ঘ নয়। আমাদের তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। হরতাল যেসব দাবিতে হয়, সেসবের পক্ষে বা বিপক্ষের জনমত এই নিবন্ধে বিবেচ্য বিষয় নয়। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য হরতাল করে অন্যদের জীবন দুর্বিষহ করার অধিকার কারও আছে বলে তো মনে হয় না। এগুলো তো হরতালের প্রচলিত নিয়মকানুনের মধ্যেও পড়ে না। আমাদের সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারের মধ্যে সভা, সমাবেশ, মিছিল, সংগঠন ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে। তবে সেই অধিকারগুলো কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়। আইনের দ্বারা যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে এগুলো ভোগ করার কথা।
যা-ই হোক, যাঁরা হরতাল ডাকছেন, তাঁরা তো বিষয়টিকে জনগণের জন্য সহনশীল করতে কিছুটা উদ্যোগ নিতে পারেন। বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন বিভাগের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স কখনোই হরতালের আওতায় ছিল না। থাকার কথাও নয়। অথচ এখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ক্ষেত্রবিশেষে হরতালকারীদের হামলার শিকার হচ্ছে। চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গাড়িগুলোও হরতালের আওতামুক্ত থাকার কথা। কিন্তু তাও কি থাকছে? তিন-চার দিন একটানা দিবা-রাত্রি হরতাল দিলে দেড় কোটি লোকের জনপদ ঢাকার বাজারে খাদ্যপণ্য আসবে কীভাবে? খাবারের দোকান যেমন হরতালের আওতামুক্ত, তেমনি খাদ্যপণ্য বহনকারী পরিবহনকে হরতালের আওতামুক্ত রাখার দাবিও তো নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য। তাদের অন্যতম আয়ের উৎস বলে নেপালে যদি পর্যটকদের ভ্রমণসহ সবকিছু হরতালের আওতামুক্ত থাকে; সেখানে আমাদের ৩৬ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানতম উৎস তৈরি পোশাকশিল্পের সব ধরনের পণ্য পরিবহন হরতালের আওতামুক্ত রাখা যায় না কেন?
এমনিতেই অন্তত গত দুই যুগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে হরতাল সাধারণ জনগণের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নয়। বিরোধী দল সরকারের সঙ্গে দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য দর-কষাকষি করতে অন্য প্রক্রিয়া নিতে পারে। আর সরকারও অকারণ ইন্ধন না জুগিয়ে বিরোধী দলকে হরতালের সুযোগ না দিতে সচেষ্ট থাকতে পারে। এমনিতেই যখন যারা বিরোধী দলে থাকছে, তখন তারাই যেকোনো ইস্যুতে যখন-তখন হরতাল ডেকে বসছে। আর তা কার্যকর করা শুরু করছে আগের দিন মধ্যাহ্ন থেকে।
আমরা যা-ই বলি না কেন, প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হরতাল দেশ থেকে শিগগিরই যাচ্ছে বলে মনে হয় না। তবে সেই কর্মসূচিটিও কিছু নিয়মাবলি মানবে না কেন? হরতালের দিনই গাড়ি ভাঙচুর ও নাশকতা বেআইনি। আর হরতালের আগের দিন গাড়ি ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ হবে কেন? আর কেনই বা আকস্মিক হরতাল ডেকে কারও বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা কুলখানি—সবই লন্ডভন্ড করে দেবে? বিমানবন্দরে আটকে থাকতে বাধ্য করবে কয়েক হাজার আগত যাত্রীকে? কোন বিবেচনায় হাজার হাজার পর্যটক আটকা পড়বে এ ধরনের সিদ্ধান্তে? হরতাল বন্ধ না-ই বা করলেন, অন্তত বিষয়গুলো ভেবে দেখুন; এ দাবি তো আমরা করতে পারি। ঠিক তেমনি যেকোনো কাজকর্মের জন্য কিছু নিয়মাবলি থাকে। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনও নিয়মকানুনের আওতাতেই পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র আর সমাজ তো বটেই। সেগুলো চলে সংবিধান ও আইনের আওতায়। রাজনীতি এগুলোর নিয়ন্ত্রক। আর রাজনীতিও নিয়ম মেনেই চলার কথা। হরতাল রাজনীতিরই একটি কর্মকাণ্ড। তাই সেই কর্মকাণ্ডও নিয়মের বাইরে চলতে পারে না। তারও নিয়ম থাকবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments