আশার দোলাচলে by ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া
বাংলাদেশের
রাজনীতির আকাশে আলোছায়ার খেলা চলছে। এ ধরনের খেলা আমরা দেখেছিলাম বিগত
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে
মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে। চুড়ান্ত পর্যায়ে কাজের কাজ কিছুই
হয়নি, মাঝখান থেকে এসেছিল অসামরিক চেহারায় সামরিক প্রভাবাধীন সরকার। এবারও
বক্তৃতা-বিবৃতি সর্বশেষ টেলিফোনে আশা-নিরাশার দোলাচলে জনগণ। প্রশ্ন উঠেছে
আন্তরিকতা নিয়ে। আসলেই কি ফোনের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল নাকি সবই লোক দেখানো,
জনগণকে বোকা বানানো? লাল টেলিফোন নষ্ট থাকলে সরকারের তো জানার কথা। তাহলে
আগের দিন অথবা ওই দিন দুপুরে কেন ফোন করা গেল না? তাহলে তো জোট সদস্যদের
সঙ্গে যে আলোচনার কথা বিরোধীদলীয় নেতা হরতাল প্রত্যাহার প্রসঙ্গে বললেন,
সেটির সুযোগ থাকত না। দু’নেতাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন কয়েকবার,
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। তাদের জীবনে এসেছে নানা
চরাই-উৎরাই। দু’জনেই হারিয়েছেন প্রিয়জন। দু’জনেই সাত বছর আগে কারাভোগ
করেছেন। আরও আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গৃহবন্দি-নজরবন্দি থেকেছেন।
দেশের উন্নয়নে রয়েছে দু’জনেরই ভূমিকা। একজনের পিতা স্বাধীনতার মহান স্থপতি,
আরেকজনের স্বামী সেক্টর-কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক। মূল কথা, দু’জনেরই
দেশের উন্নতিতে রয়েছে ভূমিকা। ফলে তাদের কাছে জাতির আশা-আকাক্সক্ষাও অনেক।
দেশ আর রক্তপাত চায় না। জনগণ, দলীয় কর্মী, কিংবা পুলিশ সবাই এদেশের সন্তান-
কারও মৃত্যুই কাম্য নয়।
নির্বাচন নিয়ে যে কালবৈশাখীর আভাস দেখা দিয়েছে তা ফোনালাপের মাধ্যমে একেবারে কেটে গেছে বলে মনে করলে ভুল হবে। তবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং গত শুক্রবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্য ও পরবর্তী ফোনালাপ একটু হলেও অগ্রগতির ইঙ্গিত। কারণ আলোচনার বল গড়াতে শুরু করেছে। ভয় থাকত যদি বলটি থেমে যেত। দু’জনই অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলে আপাত প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও চাপ প্রয়োগের কৌশল রাজনীতিরই অংশ আর সেটা একে অপরের ওপর প্রয়োগ করেছেন, এখনও করে চলেছেন। সেটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমার মনে হয়, দু’জনই বুঝতে পারছেন তৃতীয় শক্তির সমর্থনে আসা সরকার নিশ্চিতভাবেই দেশ-জাতিসহ দু’নেতার ব্যক্তিগত মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ, দু’জনই তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও বিরোধীদলীয় নেতার পরিবারের ওপর খড়গ ব্যাপকভাবে নেমে এসেছিল। তার কারণ বোধহয়, তিনি ছিলেন সদ্য ক্ষমতাহারা- এ ঘটনা প্রধানমন্ত্রীরও মনে রাখা জরুরি। কারণ উর্দি সমর্থিত সরকারের চেয়ে দু’পক্ষের সমঝোতায় আসা যে কোনো নামের সরকারই ভালো। অন্যথায় কোনো সেটআপই কাজ করবে না। ক্ষমতা ভিন্ন জিনিস, বিএনপির মনোনীত বাহিনী প্রধানের ইঙ্গিতেই বিএনপি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তার অনমনীয় মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং দেরিতে হলেও ফোন করেছেন। এটি আলোচনার বন্ধ-কপাট খোলার স্পষ্ট ইঙ্গিত। যদিও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেননি সেই সরকারের রূপরেখা। নিজে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান থাকবেন কি-না সেটাও বলেননি। আর যেহেতু বলেননি, তাহলে বোঝা যায় তিনি সে পদে নাও থাকতে পারেন। যদিও দলীয় কিংবা মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন তিনিই থাকবেন, তবে এটি চাপে রাখার কৌশল হতে পারে, যা খুব একটা দোষণীয় নয়। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার বলটি গড়িয়ে দিয়েছেন, তবে মাঝখানে একটু গোল বাধাল সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা। একটি টকশোতে সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া গেল, এগুলো হয়তো অতি উৎসাহী কোনো না কোনো এজেন্সির পরামর্শে ঘটেছে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা নিশ্চয়ই খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ ক্ষমতায় কোনো সামরিক সরকার নেই, রয়েছে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। আর গণতন্ত্রের মূল কথাই হল সবাইকে বলতে দেয়ার অধিকারে বাধা না দেয়া। কিছুদিন আগের সম্মিলিত পেশাজীবী কনভেনশন নিয়ে আরেক অনিশ্চয়তা আলোচনা ও সমাধানের পথকে আরেক দফা আহত করতে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষবেলায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছায় সুন্দরভাবে কনভেনশনটি সম্পন্ন হয়েছে। এটাও কিছুটা অগ্রগতির লক্ষণ। কারণ, সুচিন্তা-বিবেচনার জয় হয়েছে।
বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরই কোনো বক্তব্য না দিয়ে ধৈর্য নিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে ধীরে এগিয়েছে। মনে হয় বিএনপিও আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহর বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। অর্থাৎ, তারা তার নমনীয় অবস্থানকে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিরোধীদলীয় নেতা যথেষ্ট মার্জিত ও রুচিশীল বক্তব্য দিয়েছেন। অনেকের আশংকাকে দূরে ঠেলে রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন এবং পথ বাতলে দিয়েছেন। যদিও কেউ কেউ বলেছেন, এটি সম্ভব নয়। তবে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ তৈরি করতে হবে। উভয় পক্ষ ‘তালগাছ’ চাইলে হবে না। একটি বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আলোচনার বিষয়টি যেমন প্রধানমন্ত্রী উড়িয়ে দেননি, তেমনি বেগম খালেদা জিয়াও বাতিল করেননি। তবে তিনদিনের হরতাল কর্মসূচি একটি রাজনৈতিক চাপ সরকারি দলের ওপর। মনে রাখা দরকার, এতে জানমালের ক্ষতি হয় এবং ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মীসহ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সব দলকে নিয়ে আলোচনার যে রেওয়াজ রয়েছে, সেটি আমাদের দেশের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে।
সংবিধান কোনো ঐশী গ্রন্থ নয়। অতীতে পরিবর্তিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও পরিবর্তিত হবে- জনআকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা সম্প্রতি লিখেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী হতে পারলে জাতির স্বার্থে কেন ষষ্ঠদশ সংশোধনী নয়? আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রায়ই ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেন, কিন্তু তারা কি জানেন ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই- সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় প্রথা, রীতি-নীতির ওপর ভিত্তি করে। জনগণকে আস্থায় রাখতে হবে। কারণ জনরায় ছাড়া বিকল্প পথে ক্ষমতায় যাওয়া বাংলাদেশে এখন অসম্ভব। কেউ কেউ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বানিয়ে নির্বাচন করার বিকল্প চিন্তার কথা বলছেন। তবে মনে রাখা উচিত ১৯৮৬ সালে এ ধরনের সরকার বেশিদিন টিকে থাকেনি। জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান রেখে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল। আর বিএনপি তো নির্বাচনেই যায়নি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। আজ এই ২৩ বছর পর ইলেক্ট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়া, ফেসবুক-টুইটারের যুগে এ ধরনের নির্বাচন একেবারে অসম্ভব। কাজেই এসব ভাবনাকে পেছনে ফেলে প্রধানমন্ত্রী দেশনায়কোচিত ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করি। কোনো গোষ্ঠীর লাভালাভ নিয়ে না ভেবে দেশের কথা ভাববেন। কারণ সরকারপ্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব বেশি। বিরোধী দলের নেতাকে দেয়া তার আমন্ত্রণ বহাল থাকবে এবং আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বেরিয়ে আসবে। আর দ্রুত সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে পরিবেশ তৈরি করে নজির স্থাপন করবেন। কারণ, যে কোনো স্বাভাবিক রীতিকে বাধাগ্রস্ত করলে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং ঘোলাপানির মাছ শিকারিদের শিকারের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে- যা দু’দলের কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে, তাহলে পক্ষপাতহীন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সাধারণ মানুষ গুমোট পরিবেশ চাই না। হত্যা, নারকীয় পাশবিকতা দেখতে চাই না। চাই হানাহানিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে জনগণ দেখে-শুনে-বুঝে ভোট দেয়ার অধিকার পাবে।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচন নিয়ে যে কালবৈশাখীর আভাস দেখা দিয়েছে তা ফোনালাপের মাধ্যমে একেবারে কেটে গেছে বলে মনে করলে ভুল হবে। তবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং গত শুক্রবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্য ও পরবর্তী ফোনালাপ একটু হলেও অগ্রগতির ইঙ্গিত। কারণ আলোচনার বল গড়াতে শুরু করেছে। ভয় থাকত যদি বলটি থেমে যেত। দু’জনই অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বলে আপাত প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও চাপ প্রয়োগের কৌশল রাজনীতিরই অংশ আর সেটা একে অপরের ওপর প্রয়োগ করেছেন, এখনও করে চলেছেন। সেটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমার মনে হয়, দু’জনই বুঝতে পারছেন তৃতীয় শক্তির সমর্থনে আসা সরকার নিশ্চিতভাবেই দেশ-জাতিসহ দু’নেতার ব্যক্তিগত মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ, দু’জনই তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও বিরোধীদলীয় নেতার পরিবারের ওপর খড়গ ব্যাপকভাবে নেমে এসেছিল। তার কারণ বোধহয়, তিনি ছিলেন সদ্য ক্ষমতাহারা- এ ঘটনা প্রধানমন্ত্রীরও মনে রাখা জরুরি। কারণ উর্দি সমর্থিত সরকারের চেয়ে দু’পক্ষের সমঝোতায় আসা যে কোনো নামের সরকারই ভালো। অন্যথায় কোনো সেটআপই কাজ করবে না। ক্ষমতা ভিন্ন জিনিস, বিএনপির মনোনীত বাহিনী প্রধানের ইঙ্গিতেই বিএনপি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তার অনমনীয় মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং দেরিতে হলেও ফোন করেছেন। এটি আলোচনার বন্ধ-কপাট খোলার স্পষ্ট ইঙ্গিত। যদিও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেননি সেই সরকারের রূপরেখা। নিজে সর্বদলীয় সরকারের প্রধান থাকবেন কি-না সেটাও বলেননি। আর যেহেতু বলেননি, তাহলে বোঝা যায় তিনি সে পদে নাও থাকতে পারেন। যদিও দলীয় কিংবা মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন তিনিই থাকবেন, তবে এটি চাপে রাখার কৌশল হতে পারে, যা খুব একটা দোষণীয় নয়। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার বলটি গড়িয়ে দিয়েছেন, তবে মাঝখানে একটু গোল বাধাল সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা। একটি টকশোতে সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া গেল, এগুলো হয়তো অতি উৎসাহী কোনো না কোনো এজেন্সির পরামর্শে ঘটেছে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা নিশ্চয়ই খুব একটা মঙ্গল বয়ে আনবে না। কারণ ক্ষমতায় কোনো সামরিক সরকার নেই, রয়েছে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। আর গণতন্ত্রের মূল কথাই হল সবাইকে বলতে দেয়ার অধিকারে বাধা না দেয়া। কিছুদিন আগের সম্মিলিত পেশাজীবী কনভেনশন নিয়ে আরেক অনিশ্চয়তা আলোচনা ও সমাধানের পথকে আরেক দফা আহত করতে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষবেলায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছায় সুন্দরভাবে কনভেনশনটি সম্পন্ন হয়েছে। এটাও কিছুটা অগ্রগতির লক্ষণ। কারণ, সুচিন্তা-বিবেচনার জয় হয়েছে।
বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরপরই কোনো বক্তব্য না দিয়ে ধৈর্য নিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে ধীরে এগিয়েছে। মনে হয় বিএনপিও আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহর বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। অর্থাৎ, তারা তার নমনীয় অবস্থানকে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিরোধীদলীয় নেতা যথেষ্ট মার্জিত ও রুচিশীল বক্তব্য দিয়েছেন। অনেকের আশংকাকে দূরে ঠেলে রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন এবং পথ বাতলে দিয়েছেন। যদিও কেউ কেউ বলেছেন, এটি সম্ভব নয়। তবে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ তৈরি করতে হবে। উভয় পক্ষ ‘তালগাছ’ চাইলে হবে না। একটি বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আলোচনার বিষয়টি যেমন প্রধানমন্ত্রী উড়িয়ে দেননি, তেমনি বেগম খালেদা জিয়াও বাতিল করেননি। তবে তিনদিনের হরতাল কর্মসূচি একটি রাজনৈতিক চাপ সরকারি দলের ওপর। মনে রাখা দরকার, এতে জানমালের ক্ষতি হয় এবং ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মীসহ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সব দলকে নিয়ে আলোচনার যে রেওয়াজ রয়েছে, সেটি আমাদের দেশের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে।
সংবিধান কোনো ঐশী গ্রন্থ নয়। অতীতে পরিবর্তিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও পরিবর্তিত হবে- জনআকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা সম্প্রতি লিখেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী হতে পারলে জাতির স্বার্থে কেন ষষ্ঠদশ সংশোধনী নয়? আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রায়ই ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেন, কিন্তু তারা কি জানেন ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই- সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় প্রথা, রীতি-নীতির ওপর ভিত্তি করে। জনগণকে আস্থায় রাখতে হবে। কারণ জনরায় ছাড়া বিকল্প পথে ক্ষমতায় যাওয়া বাংলাদেশে এখন অসম্ভব। কেউ কেউ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বানিয়ে নির্বাচন করার বিকল্প চিন্তার কথা বলছেন। তবে মনে রাখা উচিত ১৯৮৬ সালে এ ধরনের সরকার বেশিদিন টিকে থাকেনি। জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান রেখে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিল। আর বিএনপি তো নির্বাচনেই যায়নি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। আজ এই ২৩ বছর পর ইলেক্ট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়া, ফেসবুক-টুইটারের যুগে এ ধরনের নির্বাচন একেবারে অসম্ভব। কাজেই এসব ভাবনাকে পেছনে ফেলে প্রধানমন্ত্রী দেশনায়কোচিত ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করি। কোনো গোষ্ঠীর লাভালাভ নিয়ে না ভেবে দেশের কথা ভাববেন। কারণ সরকারপ্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব বেশি। বিরোধী দলের নেতাকে দেয়া তার আমন্ত্রণ বহাল থাকবে এবং আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বেরিয়ে আসবে। আর দ্রুত সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে পরিবেশ তৈরি করে নজির স্থাপন করবেন। কারণ, যে কোনো স্বাভাবিক রীতিকে বাধাগ্রস্ত করলে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং ঘোলাপানির মাছ শিকারিদের শিকারের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে- যা দু’দলের কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে, তাহলে পক্ষপাতহীন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সাধারণ মানুষ গুমোট পরিবেশ চাই না। হত্যা, নারকীয় পাশবিকতা দেখতে চাই না। চাই হানাহানিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে জনগণ দেখে-শুনে-বুঝে ভোট দেয়ার অধিকার পাবে।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments