মূল প্রতিবেদন- শিশুদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কম by মোছাব্বের হোসেন
দেশের
প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি
করে। এসব ইশতেহারে শিশুদের উন্নয়ন, কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে
নানা অঙ্গীকার করা হলেও এর বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম।
আমাদের
দেশের শিশুরা এখনো তাদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেক শিশু জানেই না
তাদের কী কী অধিকার রয়েছে। এ নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন...
ঢাকার হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প
এলাকায় ছুটা চামড়া কুড়িয়ে তা রোদে শুকিয়ে বিক্রি করে সাত বছরের শিশু
রবিউল ও তার পাঁচ বছর বয়সী ভাই আলমগীর। এই কাজ করতে গিয়ে দুই ভাইয়ের
হাতের তালুতে কালো দাগ হয়ে গেছে। তারা চর্মরোগে ভুগছে। তাদের বাবা দেশের
বাইরে যাওয়ার নাম করে কোথায় গেছে তা তারা জানে না। মা মোহসেনা বেগম
দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে গেছেন। তারা দুই ভাই আরও কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে
রাতে ফুটপাতে ঘুমায়। রবিউল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী
পর্যন্ত পড়েছে। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। তখন থেকেই সে কাজ করে
হাজারীবাগে। পরে তার কাজের সঙ্গী হয়েছে একমাত্র ছোট ভাইটিও। ছুটা চামড়া
বিক্রি করা ছাড়াও তারা চামড়াবোঝাই ঠেলাগাড়িও ঠেলে বেড়ায়।
রবিউল জানায়, ‘বাবা বিদেশ গেছে, আর আহে না। মায় আরেকটা বিয়া করছে, আমাগো দেখার লোক নাই। তাই আমরা এইখানে কাম করি।’
রবিউল বা আলমগীরের মতো এমন অনেক শিশুই আছে আমাদের দেশে, যারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্টদের মতে, আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ছাড়াও ভিক্ষাবৃত্তি, রাজনৈতিক কাজে শিশুর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও এখনো শতভাগ শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু অকালে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ছে। বিভিন্ন কারণে শিশুমৃত্যুও থেমে নেই।
শিশু বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, শিশুদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়েছে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার শিশুদের বিষয়ে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অনেকাংশ পূরণ হয়নি। দলটির ইশতেহারে পর্যায়ক্রমে সর্বক্ষেত্রে শিশুশ্রম বন্ধ করা, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রলোভন বা জোর করে জড়িত না করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার সংরক্ষণ, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ১৯৯৪ সালের শিশুনীতি পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করার কথা বলা হয়। আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে আরও বলেছিল, ক্ষমতায় এলে তারা শিশুদের শারীরিক, মানসিক বিকাশে পুষ্টি, শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত, শিশু নির্যাতন বিশেষ করে কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ও পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করবে। একই সঙ্গে দলটি ইশতেহারে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির হার হবে ১০০ শতাংশ। এ ছাড়া শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এর আগে ২০০১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতায় আসার আগে দলটি নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের বিষয়টি বিবেচনা করে। এ সময় তারা ইশতেহারে শিশু-কিশোর অধিকার সংরক্ষণ, মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা উৎসাহিত ও সম্প্রসারিত করা এবং সুস্থ, সবল শিশু গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়। ‘সবার আগে শিশু’ ও ‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন’ এই অঙ্গীকার করা হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা, শিশুর অপুষ্টি দূর করা, শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। বিএনপি ইশতেহারে শিগগিরই শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে। প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা, শিশু নির্যাতনবিরোধী আইনগুলো সমন্বিত করে আরও দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছিল।
দুই দলই পালাবদল করে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউিট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনসেফ) গত ২৩ জুন ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘শিশু সমতা মানচিত্র: সামাজিক বঞ্চনার ক্ষেত্রসমূহ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনটি বলছে, দেশে এখনো প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন বিদ্যালয়ে যায় না। প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন শিশু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় ২৩ শতাংশ শিশু এখনো স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, ভালো কাজ করার সুনাম আছে এ ধরনের উপজেলাগুলোতেও ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন শিশু স্কুলে যায় না। খুব বেশি কাজ হয়নি এমন উপজলোগুলোতে ১০০ জনের মধ্যে ৪৫ জন শিশু স্কুলে যায় না।
প্রতিবেদন অনুসারে প্রকৃত শিশু শ্রমিকের (১০-১৪ বছর বয়সী এবং স্কুলে যায় না এমন শিশু) সংখ্যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। ২০০১-এ ছিল ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেশি। একইভাবে গ্রামের চেয়ে শহরে এই শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।
শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নবজাতকের মৃত্যু। জাতীয় অর্জন ভালো হলেও শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এখনো পিছিয়ে আছে। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ৬০ শতাংশ কমলেও তা পুরোপুরি দূর করা যায়নি।
বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দেশে মেয়েশিশুরা ছেলেশিশুদের চেয়ে বেশি মারা যেত। তবে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ছেলেশিশুদের চেয়ে ১২ শতাংশ কম মেয়েশিশু মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের সেভিং নিউবর্ন লাইভস কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো প্রতি হাজারে ৩২ জন নবজাতক মারা যাচ্ছে। বর্তমানে ডায়রিয়ার কারণে মারা যাচ্ছে এই বয়সী মোট শিশুর মাত্র ২ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বিষয়টি যোগ হয়েছে অনেকটা মহামারি হিসেবেই। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। দুই বছর বয়সী শিশুরা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১২ সালে পানিতে ডুবে মারা যায় ১৩৫ জন শিশু। তবে শিশুমৃত্যুর এ কারণটি প্রতিরোধে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই দেশে। অপুষ্টির কারণে দেশে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪০টি, অর্থাৎ ঘণ্টায় ১০টি শিশু মারা যাচ্ছে। বিডিএইচএসের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ৪১ শতাংশ শিশু খাটো, ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন কম এবং ১৬ শতাংশ শিশু রোগা।
জুলাই মাসে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট (মাতৃ ও শিশুপুষ্টিবিষয়ক সংখ্যা) বলছে, ১০টি পরীক্ষিত কর্মপন্থার বিস্তার ঘটালে বাংলাদেশসহ ৩৪টি উচ্চ অপুষ্টির দেশে বছরে নয় লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব। পাঁচ বছরের কম বয়সী পৃথিবীর মোট খর্বকায় শিশুর ৯০ শতাংশ এসব দেশে বাস করে।
বিডিএইচএসের ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে নবজাতক ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি পর্যায়ে উদ্যোগ বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে সে ধরনের তেমন কিছু নেওয়া হয়নি।
জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে বিশেষ নবজাতক ইউনিট গঠন করার কথা থাকলেও তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
দেশে দক্ষ প্রসব সহায়তাকারী (এসবিএ) আছে ১৬ হাজার, ২০১৬ সালের মধ্যে তা ২৫ হাজার করার কথা। জন্মের পর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দেওয়ার হার ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে সঠিকভাবে বাড়তি খাবার পাচ্ছে মাত্র ২১ শতাংশ শিশু।
দুই সরকারের আমলের বাজেট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত দুই আমলের সরকারের সময় শিশুদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাজেট এলেই দেখা গেছে শিশুখাদ্যের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বাজেটে শিশুদের বিনোদনের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ রাখা হয়নি। গত কয়েক বছরে শিশুদের বিনোদনের জন্য বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করছে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, দুই সরকারের আমলে নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে শাসনামলে শিশুদের উন্নয়নে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার একটি রাজনৈতিক দলের দর্শনের প্রতিফলন ঘটায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের সার্বিক সুরক্ষার প্রতিফলন অনেক কম। তাঁরা শিশুদের উন্নয়নে যেমন প্রতিশ্রুতি কম দেয়, তেমনি এর বাস্তবায়নও কম হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাবে শিশুদের উন্নতির যে প্রতিশ্রুতি দেন তা বাস্তবে করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বছরে একটি শিশুর পেছনে তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলার খরচ করে। আর আমাদের দেশের শিশুর পেছনে তা ৩০ থেকে ৩৫ ডলারের বেশি নয়। শিশুর সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের প্রতি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ দেন।
রবিউল জানায়, ‘বাবা বিদেশ গেছে, আর আহে না। মায় আরেকটা বিয়া করছে, আমাগো দেখার লোক নাই। তাই আমরা এইখানে কাম করি।’
রবিউল বা আলমগীরের মতো এমন অনেক শিশুই আছে আমাদের দেশে, যারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্টদের মতে, আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ছাড়াও ভিক্ষাবৃত্তি, রাজনৈতিক কাজে শিশুর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও এখনো শতভাগ শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু অকালে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ছে। বিভিন্ন কারণে শিশুমৃত্যুও থেমে নেই।
শিশু বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, শিশুদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়েছে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার শিশুদের বিষয়ে বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অনেকাংশ পূরণ হয়নি। দলটির ইশতেহারে পর্যায়ক্রমে সর্বক্ষেত্রে শিশুশ্রম বন্ধ করা, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রলোভন বা জোর করে জড়িত না করার কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার সংরক্ষণ, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ১৯৯৪ সালের শিশুনীতি পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করার কথা বলা হয়। আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে আরও বলেছিল, ক্ষমতায় এলে তারা শিশুদের শারীরিক, মানসিক বিকাশে পুষ্টি, শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত, শিশু নির্যাতন বিশেষ করে কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ও পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করবে। একই সঙ্গে দলটি ইশতেহারে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির হার হবে ১০০ শতাংশ। এ ছাড়া শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এর আগে ২০০১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতায় আসার আগে দলটি নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের বিষয়টি বিবেচনা করে। এ সময় তারা ইশতেহারে শিশু-কিশোর অধিকার সংরক্ষণ, মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা উৎসাহিত ও সম্প্রসারিত করা এবং সুস্থ, সবল শিশু গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়। ‘সবার আগে শিশু’ ও ‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন’ এই অঙ্গীকার করা হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনা, শিশুর অপুষ্টি দূর করা, শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। বিএনপি ইশতেহারে শিগগিরই শিশুশ্রম বন্ধের কথা বলে। প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা, শিশু নির্যাতনবিরোধী আইনগুলো সমন্বিত করে আরও দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছিল।
দুই দলই পালাবদল করে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কেবল কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউিট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনসেফ) গত ২৩ জুন ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘শিশু সমতা মানচিত্র: সামাজিক বঞ্চনার ক্ষেত্রসমূহ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনটি বলছে, দেশে এখনো প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন বিদ্যালয়ে যায় না। প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন শিশু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় ২৩ শতাংশ শিশু এখনো স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, ভালো কাজ করার সুনাম আছে এ ধরনের উপজেলাগুলোতেও ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন শিশু স্কুলে যায় না। খুব বেশি কাজ হয়নি এমন উপজলোগুলোতে ১০০ জনের মধ্যে ৪৫ জন শিশু স্কুলে যায় না।
প্রতিবেদন অনুসারে প্রকৃত শিশু শ্রমিকের (১০-১৪ বছর বয়সী এবং স্কুলে যায় না এমন শিশু) সংখ্যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। ২০০১-এ ছিল ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেশি। একইভাবে গ্রামের চেয়ে শহরে এই শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।
শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নবজাতকের মৃত্যু। জাতীয় অর্জন ভালো হলেও শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এখনো পিছিয়ে আছে। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ৬০ শতাংশ কমলেও তা পুরোপুরি দূর করা যায়নি।
বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দেশে মেয়েশিশুরা ছেলেশিশুদের চেয়ে বেশি মারা যেত। তবে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ছেলেশিশুদের চেয়ে ১২ শতাংশ কম মেয়েশিশু মারা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের সেভিং নিউবর্ন লাইভস কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো প্রতি হাজারে ৩২ জন নবজাতক মারা যাচ্ছে। বর্তমানে ডায়রিয়ার কারণে মারা যাচ্ছে এই বয়সী মোট শিশুর মাত্র ২ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বিষয়টি যোগ হয়েছে অনেকটা মহামারি হিসেবেই। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। দুই বছর বয়সী শিশুরা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১২ সালে পানিতে ডুবে মারা যায় ১৩৫ জন শিশু। তবে শিশুমৃত্যুর এ কারণটি প্রতিরোধে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই দেশে। অপুষ্টির কারণে দেশে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪০টি, অর্থাৎ ঘণ্টায় ১০টি শিশু মারা যাচ্ছে। বিডিএইচএসের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ৪১ শতাংশ শিশু খাটো, ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন কম এবং ১৬ শতাংশ শিশু রোগা।
জুলাই মাসে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট (মাতৃ ও শিশুপুষ্টিবিষয়ক সংখ্যা) বলছে, ১০টি পরীক্ষিত কর্মপন্থার বিস্তার ঘটালে বাংলাদেশসহ ৩৪টি উচ্চ অপুষ্টির দেশে বছরে নয় লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব। পাঁচ বছরের কম বয়সী পৃথিবীর মোট খর্বকায় শিশুর ৯০ শতাংশ এসব দেশে বাস করে।
বিডিএইচএসের ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে নবজাতক ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি পর্যায়ে উদ্যোগ বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে সে ধরনের তেমন কিছু নেওয়া হয়নি।
জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে বিশেষ নবজাতক ইউনিট গঠন করার কথা থাকলেও তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
দেশে দক্ষ প্রসব সহায়তাকারী (এসবিএ) আছে ১৬ হাজার, ২০১৬ সালের মধ্যে তা ২৫ হাজার করার কথা। জন্মের পর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দেওয়ার হার ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে সঠিকভাবে বাড়তি খাবার পাচ্ছে মাত্র ২১ শতাংশ শিশু।
দুই সরকারের আমলের বাজেট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত দুই আমলের সরকারের সময় শিশুদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাজেট এলেই দেখা গেছে শিশুখাদ্যের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বাজেটে শিশুদের বিনোদনের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ রাখা হয়নি। গত কয়েক বছরে শিশুদের বিনোদনের জন্য বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করছে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, দুই সরকারের আমলে নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে শাসনামলে শিশুদের উন্নয়নে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার একটি রাজনৈতিক দলের দর্শনের প্রতিফলন ঘটায়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের সার্বিক সুরক্ষার প্রতিফলন অনেক কম। তাঁরা শিশুদের উন্নয়নে যেমন প্রতিশ্রুতি কম দেয়, তেমনি এর বাস্তবায়নও কম হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাবে শিশুদের উন্নতির যে প্রতিশ্রুতি দেন তা বাস্তবে করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বছরে একটি শিশুর পেছনে তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলার খরচ করে। আর আমাদের দেশের শিশুর পেছনে তা ৩০ থেকে ৩৫ ডলারের বেশি নয়। শিশুর সার্বিক উন্নয়নের জন্য তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে শিশুদের প্রতি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ দেন।
No comments