আওয়ামী রাজনীতির স্বরূপ by শিমুল বিশ্বাস
আসন্ন
নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রাখতে চায় যে কোনো পন্থায়।
তাদের ধারণা, রাজপথ দখলে রেখে নির্বাচনে কারচুপি করলে তা নিয়ে কোনো
প্রতিবাদ হবে না। আওয়ামী লীগ পেশিশক্তির বলে নির্বাচনী জয় ও ক্ষমতায় থাকা
নিরাপদ মনে করে। এটি আওয়ামী লীগের অতি সনাতন স্ট্র্যাটেজি। রাজপথ দখলে
রাখতে আওয়ামী লীগ সব সময় দলীয় গুন্ডাবাহিনী দিয়ে অন্য দলের সমাবেশ ও
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভণ্ডুল করে। মুজিব আমলে ১৯৭৩ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল,
সে নির্বাচনেও বিরোধী দলগুলোকে রাজপথে নামতে দেয়া হয়নি, এমনকি নমিনেশন
পেপারও জমা দিতে দেয়া হয়নি। বিরোধী দলের প্রার্থীকে ঘরে বন্দি রেখে আওয়ামী
লীগের অনেক প্রার্থীকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জয়ের জন্য রাজপথের দখলদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকলে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজপথ দখলে নেয়া
সম্ভব হয় না। ফলে আওয়ামী লীগের বিপদ বাড়ে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থা বিদায় করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল
করে আওয়ামী লীগ বলছে, জনগণের ভোটের অধিকার পুরুজ্জীবিত করা হয়েছে। ২০০৯-এর
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির অগ্রাধিকার
তালিকায় ছিল পাঁচটি বিষয়- ১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং অর্থনৈতিক
স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা ৩.
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মোকাবেলা ৪. দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূর করা
এবং ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা। নির্বাচনী ইশতেহারে ‘কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’তে
ছিল- ১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ ২. রাজনৈতিক কাঠামো,
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণঅংশায়ন ৩. সুশাসনের জন্য আইনের শাসন ও দলীয়করণ
প্রতিরোধ ৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ৫. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন ৬.
নারীর ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়,
প্রতিশ্র“তিগুলো রক্ষায় আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
অতীতের কিছু ঘটনাবলি
অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হয়। এটা মনে রাখা জরুরি, আওয়ামী লীগ একা দেশ স্বাধীন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্ব ছিল ভারতে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ছাত্র-জনতা বাঙালি সৈনিক সে ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলেছেন, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমি ইমাম মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেজর জিয়ার ডাকে। বাংলাদেশের মানুষের একটাই ভাবনা ছিল তখন- কী করে তারা শত্র“কে বিতাড়িত করবে, দেশ স্বাধীন করবে। সেটাই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তারা স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নয়।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী ব্যক্তি, রাজনীতিক, প্রতিষ্ঠান ও দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয় এককভাবে আওয়ামী লীগ। অতঃপর শুরু হয় বাংলাদেশের মানুষের ওপর অপ্রত্যাশিত এক তাণ্ডব। শুরু হয় লুটপাট, হত্যা, গুম, খুন, মজুদদারি, চোরাকারবারি, হাইজ্যাক ও খোলা সীমান্ত দিয়ে দেশের সম্পদ পাচার এবং বিদেশী নিুমানের পণ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাজার দখলের খেলা।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ১১ জানুয়ারি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় আদেশ জারি শেষে ১২ তারিখ থেকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে করেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রার প্রায় শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের আশা ভঙ্গ ঘটে। প্রশাসন ও আইন-শৃংখলায় এবং দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা বিরাজ করতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি হাল ধরতে পারেননি। সব ব্যর্থতার সঙ্গে এসে যোগ হয় চরম দুর্নীতি। সেই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্মৃত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজ পরিবার-পরিজনদের ভেতরে। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জনগণ আশাহত হতে থাকে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এমন এক পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বছর খানেকের মধ্যেই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। তার স্থলে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি সরকারপ্রধানের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশ [প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার (পিও)] বলে নতুন নতুন আইন জারি করতে কোনো দ্বিধা করেননি। বছর দুয়েকের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
১৯৭২ সালে একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ব্যাপক চোরাচালান ও লুটপাটের ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম মূল্যবৃদ্ধি পায়। চাল ডাল, পরিধানের বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুদদারি ও সমাজবিরোধীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। দুর্নীতি ও সরকারি নিপীড়নের ব্যাপকতায় ১৯৭৪ সাল নাগাদ দেশে এক গুরুতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশে আইন-শৃংখলা ব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুই ছিল না, ছিল চরম নৈরাজ্য। সরকারি ও বেসরকারি বাহিনী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চালায় ডাকাতি, রাহাজানি, হাইজ্যাক, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি। ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চালায় অবাধ লুটপাট। সরকার ও তার প্রশাসনযন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ একেবারেই প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বরকন্দাজ বাহিনীতে পরিণত হয়।
১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ জনগণের রায় বিশ্বাস করে না, তাই তারা নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ব্যাপক কারচুপি করে। এমনকি সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপিতে অংশগ্রহণ করে। ভোটগণনা শেষে ফলাফল ঘোষণাকালেও শাসক দলের পক্ষে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চট্টগ্রাম থেকে একটি আসনে মোজাফ্ফর ন্যাপের একজন প্রার্থীকে রাতে নির্বাচনে জয়ী ঘোষণা করা হলেও পরদিন সকালে তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা করা হয়। জাসদ সভাপতি মেজর জলিল, ন্যাপের রাশেদ খান মেনন, ড. আলীম আল রাজী, অলি আহাদসহ ৮ জনের বিজয় নাকচ করে দেয়া হয়।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অপশাসন
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের জন্য এককভাবে দায়ী আওয়ামী লীগের দুঃশাসন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কারণসমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল : ১. দুর্নীতি ২. স্বজনপ্রীতি ৩. চোরাচালান ৪. বর্ডার ট্রেড ৫. রিলিফ আত্মসাৎ ইত্যাদি। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সেসব কলংকিত ইতিহাসের দিনগুলোর কথা জানে কি? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সেগুলো জানার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি।
১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
স্বাধীনতার পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। এর মধ্যে ১৯৫ জনকে গুরুতর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে ৩৭ হাজার এ দেশীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় এবং দালাল আইনে বিচার শুরু হয়। বিচার চলার মাঝামাঝি অবস্থায়ই ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়াদিল্লিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ। এই চুক্তির বলেই বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, ২ জুলাই, ১৯৭২ পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করে। পরে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত ছাড়া ২৬ হাজার ব্যক্তি (যারা রাজাকার-আলবদর-আল শামস, পিস কমিটির সদস্য) সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পান।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নতুন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২৫ মার্চ, ২০০৯ জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হয়, সরকার ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধনপূর্বক যুদ্ধাপরাধীদের ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় বিচার করবে। আইনমন্ত্রী কর্তৃক উত্থপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৬ মে, ১৯৭৩ এবং ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৩ অপরাধ মার্জনা সংক্রান্ত ঘোষণা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনটি বাতিল করেন। এর ফলে দণ্ডিত ব্যক্তিরা ব্যতীত অন্যরা পর্যায়ক্রমে খালাস পায়। আওয়ামী লীগ নেতারা সব জানা সত্ত্বেও দেশবাসীকে সেই সত্য জানাননি।
সরকার পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে মুজিব আমলের শেষ সময়ে ভারত ব্যতীত আন্তর্জাতিক দুনিয়ার প্রায় সব দেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার ইস্যু, আওয়ামী লীগের কয়েক বছরের অপশাসনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। দুর্নীতির কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়ে অচল। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হয় দ্রুত নিুগামী।
ক্ষুধার্ত দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত বিপুল ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তের ওপারে অবাধ লুণ্ঠনের বস্তুতে পরিণত হয়। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। অতীতের দুর্ভিক্ষের ন্যায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষও খাদ্যশস্যের অভাবের জন্য হয়নি। দুর্ভিক্ষের সময় দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ ছিল বলে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে লাখ লাখ লোক মারা যায়। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ গ্রন্থে লিখেছেন : বাংলাদেশে তখন যথেষ্ট খাদ্য মজুদ ছিল কিন্তু প্রশাসনিক ত্র“টি ও বণ্টনের সুব্যবস্থার অভাবে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ হয়।
১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার জানান, দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২০,৫০০। বেসরকারি সূত্র মতে এ সংখ্যা ছয় লাখ। সরকার সে সময় ৫,৮৬২টি লঙ্গরখানা খোলে। সে সময় নারীর লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্রের অভাবে বাসন্তী-দুর্গাদের মাছ ধরার জাল পরার চিত্র বিশ্ব-বিবেককে স্তম্ভিত করে। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা মুড়ে লাশ দাফন ছিল তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ওপর চতুর্থ সংবিধান সংশোধনী বিল চাপিয়ে দেন। সে সংশোধনী কোনো আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। সেই বিলে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। সংশোধনীটি আইনগতভাবে ছিল অবৈধ এবং রাজনৈতিকভাবে ছিল দেশে গণতন্ত্র হত্যার শামিল। পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংশোধনী বিলটি ফার্স্ট রিডিং বা প্রথম পাঠে সংসদে উত্থাপন, দ্বিতীয় পাঠে আলোচনা এবং তৃতীয় পাঠে ভোট গ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া অগ্রাহ্য করে শুধু সংসদ সদস্যদের টেবিলে দিয়ে পাঠ বা আলোচনা ছাড়াই সরাসরি কণ্ঠ ভোটে পাস করানোর ফলে সংশোধনীটি হয়ে পড়ে অবৈধ। কিন্তু স্পিকার মালেক উকিল আইন, বিধি সব ভুলে বিলের পক্ষে কাজ করে যান। সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নজির স্থাপিত হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে এভাবেই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা হয়। এজন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে।
২০১৩ সালে ক্ষমতার শেষ বেলায় এসে বাকশালের নব প্রজন্মওয়ালারা আবার আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী পথে ধাবিত করতে তৎপর হয়েছে।
আওয়ামী-জামায়াত সখ্য
আওয়ামী লীগ তাদের নিজস্বার্থে সব কিছুই করতে পারে। যে জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য আজ তারা উঠেপড়ে লেগেছে, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই জামায়াতের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সময় গভীর সখ্যের প্রমাণ রয়েছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং যথারীতি সংসদেও যোগ দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয় জামায়াতের ওপর। এরপরও রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের সমর্থন লাভের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সমর্থন আদায় এবং জামায়াতকে তাদের পক্ষে আনার জন্য আওয়ামী লীগ আপ্রাণ চেষ্টা করে। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণআদালত বসে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে সুকৌশলে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ আবদুর রাজ্জাককে দিয়ে কুক্ষিগত করে। আওয়ামী লীগের নির্দেশে তাদের নেতাকর্মীরা গোলাম আযমের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসির রায় কার্যকর করার ঘোষণা দেয় এবং গোলাম আযমের বাড়ি ঘেরাও করতে মিছিল করে। বিএনপি সরকার গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। ফলে বিএনপির ওপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয় এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সে সুযোগে আবার জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে। ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। সে সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সুসম্পর্ক দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলনের নামে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মাগুরা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই জোট নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। ২৪ ফেব্র“য়ারি, ১৯৯৪ শেখ হাসিনা সংসদের সব বিরোধী দল ও গ্র“পের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেন। সে সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যৌথ আন্দোলন করতে তারা ঐকমত্যে পৌঁছায়। ২৭ জুন ১৯৯৪ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করে যৌথ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা শুরু করে ভয়াবহ আন্দোলন ও পরিকল্পিত নাশকতামূলক কার্যকলাপ। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং শেষ পর্যন্ত জনতার মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে আমলা বিদ্রোহের মতো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে প্রকাশ্যে মদদ দেয়। ১২ জুন, ১৯৯৬ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সহায়তায় আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে এবং মিত্রদের সমর্থনে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬-২০০১ সময়কালে আওয়ামী লীগ একটিবারের জন্যও জামায়াতের নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী ভাবেনি বা তাদের বিচারের জন্য টুঁ-শব্দটিও করেনি। তখন জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের মহান বন্ধু। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্র“তির বরখেলাপ, দুর্নীতি, অবাধ লুটপাট, হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির কারণে ১৯৯৯ সালে যখন তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামে, সে পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৯ বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে গঠিত হয় চারদলীয় জোট। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে চাপে ফেলে জোট থেকে বের করে নিতে পারলেও জামায়াতকে পারেনি।
তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের চার বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুতের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি দলের ক্যাডারদের হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, শেয়ারবাজার থেকে লাখো কোটি টাকা লুণ্ঠন করে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে সর্বঃস্বান্তকরণ, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে-টু নামক ভূঁইফোড় সংগঠনের নামে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, পদ্মা সেতুর নামে লুটপাট এবং সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুম-খুনের কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে।
কোনো পরিবর্তন নেই
আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনকাল, দ্বিতীয় শাসনকাল এবং তৃতীয় শাসনকালের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ একই ধারাবাহিকতায় চরম নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে দেশ শাসন করে। বিরোধী দলের মতামতকে কখনোই তারা সহ্য করতে পারে না। আওয়ামী লীগের নিষ্ঠুরতা ও ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ জাসদ ও বামপন্থীদের একাংশ তাদের নিজস্ব রাজনীতি ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমবেত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মহা গুণগান করছে। তাদের দলের নিজস্ব নির্বাচনী প্রতীক ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের প্রতীক গ্রহণ করে নির্বাচন করেছে। তারা এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন। এটা জাসদ ও বামপন্থীদের জন্য কতটুকু সম্মানজনক?
যে আওয়ামী লীগ ’৭২-’৭৫ সময়কালে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, জামায়াতকে নিরাপদ রেখে জাসদ, বামপন্থীদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ ২০১৩ সালে এসে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং ১৮ দলভুক্ত জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, জাগপা, এলডিপি ও অন্য সমমনাদের নির্মূল করতে গোপনে, প্রকাশ্যে হত্যার কৌশল নিয়েছে। আওয়ামী লীগের এই দ্বিমুখী নীতি ও আদর্শ বিচ্যুতির কারণেই ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে দল ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন।
নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবের দুঃখজনক মৃত্যু ও বাকশাল সরকারের পতন হয়। তখন বিএনপি নামে কোনো দলই ছিল না। বিএনপি গঠিত হয়েছিল জাতির এমন এক ক্রান্তিলগ্নে যখন বাকশাল সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও জাতিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সামরিক শাসনের বদলে জাতিকে উপহার দেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। সংবিধানে ৫ম সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্ট জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন এবং সব সংবাদপত্রের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে মানুষের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। রাজনীতিশূন্য বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় বাংলাদেশের জনগণ। জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত যে গণতন্ত্র তা মুক্তি পায় রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতে।
আসুন আমরা সব ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করি। বিভেদ আর হানাহানির রাজনীতিকে পরাজিত করি। প্রভাবমুক্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বীকৃত ব্যবস্থা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি’ ফিরিয়ে আনি। আমরা সবাই মিলেমিশে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একুশ শতকের উপযোগী মডেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলি। রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনি দেশপ্রেম, সততা, সহমর্মিতা, শৃংখলা এবং গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার।
শিমুল বিশ্বাস : বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান; বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ সহকারী
অতীতের কিছু ঘটনাবলি
অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হয়। এটা মনে রাখা জরুরি, আওয়ামী লীগ একা দেশ স্বাধীন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্ব ছিল ভারতে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ছাত্র-জনতা বাঙালি সৈনিক সে ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলেছেন, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমি ইমাম মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেজর জিয়ার ডাকে। বাংলাদেশের মানুষের একটাই ভাবনা ছিল তখন- কী করে তারা শত্র“কে বিতাড়িত করবে, দেশ স্বাধীন করবে। সেটাই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তারা স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নয়।
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী ব্যক্তি, রাজনীতিক, প্রতিষ্ঠান ও দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয় এককভাবে আওয়ামী লীগ। অতঃপর শুরু হয় বাংলাদেশের মানুষের ওপর অপ্রত্যাশিত এক তাণ্ডব। শুরু হয় লুটপাট, হত্যা, গুম, খুন, মজুদদারি, চোরাকারবারি, হাইজ্যাক ও খোলা সীমান্ত দিয়ে দেশের সম্পদ পাচার এবং বিদেশী নিুমানের পণ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাজার দখলের খেলা।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ১১ জানুয়ারি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় আদেশ জারি শেষে ১২ তারিখ থেকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে করেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রার প্রায় শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের আশা ভঙ্গ ঘটে। প্রশাসন ও আইন-শৃংখলায় এবং দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা বিরাজ করতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি হাল ধরতে পারেননি। সব ব্যর্থতার সঙ্গে এসে যোগ হয় চরম দুর্নীতি। সেই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্মৃত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজ পরিবার-পরিজনদের ভেতরে। শাসক দল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জনগণ আশাহত হতে থাকে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এমন এক পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বছর খানেকের মধ্যেই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। তার স্থলে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি সরকারপ্রধানের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশ [প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার (পিও)] বলে নতুন নতুন আইন জারি করতে কোনো দ্বিধা করেননি। বছর দুয়েকের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
১৯৭২ সালে একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ব্যাপক চোরাচালান ও লুটপাটের ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম মূল্যবৃদ্ধি পায়। চাল ডাল, পরিধানের বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুদদারি ও সমাজবিরোধীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। দুর্নীতি ও সরকারি নিপীড়নের ব্যাপকতায় ১৯৭৪ সাল নাগাদ দেশে এক গুরুতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশে আইন-শৃংখলা ব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুই ছিল না, ছিল চরম নৈরাজ্য। সরকারি ও বেসরকারি বাহিনী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চালায় ডাকাতি, রাহাজানি, হাইজ্যাক, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি। ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চালায় অবাধ লুটপাট। সরকার ও তার প্রশাসনযন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ একেবারেই প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বরকন্দাজ বাহিনীতে পরিণত হয়।
১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ জনগণের রায় বিশ্বাস করে না, তাই তারা নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ব্যাপক কারচুপি করে। এমনকি সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপিতে অংশগ্রহণ করে। ভোটগণনা শেষে ফলাফল ঘোষণাকালেও শাসক দলের পক্ষে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চট্টগ্রাম থেকে একটি আসনে মোজাফ্ফর ন্যাপের একজন প্রার্থীকে রাতে নির্বাচনে জয়ী ঘোষণা করা হলেও পরদিন সকালে তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা করা হয়। জাসদ সভাপতি মেজর জলিল, ন্যাপের রাশেদ খান মেনন, ড. আলীম আল রাজী, অলি আহাদসহ ৮ জনের বিজয় নাকচ করে দেয়া হয়।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অপশাসন
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের জন্য এককভাবে দায়ী আওয়ামী লীগের দুঃশাসন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কারণসমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল : ১. দুর্নীতি ২. স্বজনপ্রীতি ৩. চোরাচালান ৪. বর্ডার ট্রেড ৫. রিলিফ আত্মসাৎ ইত্যাদি। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সেসব কলংকিত ইতিহাসের দিনগুলোর কথা জানে কি? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সেগুলো জানার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি।
১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা
স্বাধীনতার পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। এর মধ্যে ১৯৫ জনকে গুরুতর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে ৩৭ হাজার এ দেশীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় এবং দালাল আইনে বিচার শুরু হয়। বিচার চলার মাঝামাঝি অবস্থায়ই ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়াদিল্লিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ। এই চুক্তির বলেই বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, ২ জুলাই, ১৯৭২ পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করে। পরে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত ছাড়া ২৬ হাজার ব্যক্তি (যারা রাজাকার-আলবদর-আল শামস, পিস কমিটির সদস্য) সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পান।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নতুন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২৫ মার্চ, ২০০৯ জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হয়, সরকার ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধনপূর্বক যুদ্ধাপরাধীদের ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় বিচার করবে। আইনমন্ত্রী কর্তৃক উত্থপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৬ মে, ১৯৭৩ এবং ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৩ অপরাধ মার্জনা সংক্রান্ত ঘোষণা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনটি বাতিল করেন। এর ফলে দণ্ডিত ব্যক্তিরা ব্যতীত অন্যরা পর্যায়ক্রমে খালাস পায়। আওয়ামী লীগ নেতারা সব জানা সত্ত্বেও দেশবাসীকে সেই সত্য জানাননি।
সরকার পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে মুজিব আমলের শেষ সময়ে ভারত ব্যতীত আন্তর্জাতিক দুনিয়ার প্রায় সব দেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার ইস্যু, আওয়ামী লীগের কয়েক বছরের অপশাসনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। দুর্নীতির কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়ে অচল। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হয় দ্রুত নিুগামী।
ক্ষুধার্ত দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত বিপুল ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তের ওপারে অবাধ লুণ্ঠনের বস্তুতে পরিণত হয়। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। অতীতের দুর্ভিক্ষের ন্যায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষও খাদ্যশস্যের অভাবের জন্য হয়নি। দুর্ভিক্ষের সময় দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ ছিল বলে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে লাখ লাখ লোক মারা যায়। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ গ্রন্থে লিখেছেন : বাংলাদেশে তখন যথেষ্ট খাদ্য মজুদ ছিল কিন্তু প্রশাসনিক ত্র“টি ও বণ্টনের সুব্যবস্থার অভাবে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ হয়।
১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার জানান, দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২০,৫০০। বেসরকারি সূত্র মতে এ সংখ্যা ছয় লাখ। সরকার সে সময় ৫,৮৬২টি লঙ্গরখানা খোলে। সে সময় নারীর লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্রের অভাবে বাসন্তী-দুর্গাদের মাছ ধরার জাল পরার চিত্র বিশ্ব-বিবেককে স্তম্ভিত করে। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা মুড়ে লাশ দাফন ছিল তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ওপর চতুর্থ সংবিধান সংশোধনী বিল চাপিয়ে দেন। সে সংশোধনী কোনো আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। সেই বিলে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। সংশোধনীটি আইনগতভাবে ছিল অবৈধ এবং রাজনৈতিকভাবে ছিল দেশে গণতন্ত্র হত্যার শামিল। পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংশোধনী বিলটি ফার্স্ট রিডিং বা প্রথম পাঠে সংসদে উত্থাপন, দ্বিতীয় পাঠে আলোচনা এবং তৃতীয় পাঠে ভোট গ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া অগ্রাহ্য করে শুধু সংসদ সদস্যদের টেবিলে দিয়ে পাঠ বা আলোচনা ছাড়াই সরাসরি কণ্ঠ ভোটে পাস করানোর ফলে সংশোধনীটি হয়ে পড়ে অবৈধ। কিন্তু স্পিকার মালেক উকিল আইন, বিধি সব ভুলে বিলের পক্ষে কাজ করে যান। সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নজির স্থাপিত হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে এভাবেই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা হয়। এজন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে।
২০১৩ সালে ক্ষমতার শেষ বেলায় এসে বাকশালের নব প্রজন্মওয়ালারা আবার আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী পথে ধাবিত করতে তৎপর হয়েছে।
আওয়ামী-জামায়াত সখ্য
আওয়ামী লীগ তাদের নিজস্বার্থে সব কিছুই করতে পারে। যে জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য আজ তারা উঠেপড়ে লেগেছে, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেই জামায়াতের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সময় গভীর সখ্যের প্রমাণ রয়েছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত একসঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং যথারীতি সংসদেও যোগ দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলে আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয় জামায়াতের ওপর। এরপরও রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের সমর্থন লাভের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সমর্থন আদায় এবং জামায়াতকে তাদের পক্ষে আনার জন্য আওয়ামী লীগ আপ্রাণ চেষ্টা করে। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে গণআদালত বসে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে সুকৌশলে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ আবদুর রাজ্জাককে দিয়ে কুক্ষিগত করে। আওয়ামী লীগের নির্দেশে তাদের নেতাকর্মীরা গোলাম আযমের বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসির রায় কার্যকর করার ঘোষণা দেয় এবং গোলাম আযমের বাড়ি ঘেরাও করতে মিছিল করে। বিএনপি সরকার গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে। ফলে বিএনপির ওপর জামায়াত ক্ষুব্ধ হয় এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সে সুযোগে আবার জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে। ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। সে সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সুসম্পর্ক দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যুগপৎ আন্দোলনের নামে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। মাগুরা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই জোট নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। ২৪ ফেব্র“য়ারি, ১৯৯৪ শেখ হাসিনা সংসদের সব বিরোধী দল ও গ্র“পের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেন। সে সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যৌথ আন্দোলন করতে তারা ঐকমত্যে পৌঁছায়। ২৭ জুন ১৯৯৪ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করে যৌথ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা শুরু করে ভয়াবহ আন্দোলন ও পরিকল্পিত নাশকতামূলক কার্যকলাপ। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং শেষ পর্যন্ত জনতার মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে আমলা বিদ্রোহের মতো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে প্রকাশ্যে মদদ দেয়। ১২ জুন, ১৯৯৬ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সহায়তায় আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে এবং মিত্রদের সমর্থনে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬-২০০১ সময়কালে আওয়ামী লীগ একটিবারের জন্যও জামায়াতের নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধী ভাবেনি বা তাদের বিচারের জন্য টুঁ-শব্দটিও করেনি। তখন জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের মহান বন্ধু। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিশ্র“তির বরখেলাপ, দুর্নীতি, অবাধ লুটপাট, হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির কারণে ১৯৯৯ সালে যখন তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামে, সে পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৯ বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে গঠিত হয় চারদলীয় জোট। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে চাপে ফেলে জোট থেকে বের করে নিতে পারলেও জামায়াতকে পারেনি।
তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের চার বছরের শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুতের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি দলের ক্যাডারদের হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, শেয়ারবাজার থেকে লাখো কোটি টাকা লুণ্ঠন করে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে সর্বঃস্বান্তকরণ, হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপে-টু নামক ভূঁইফোড় সংগঠনের নামে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, পদ্মা সেতুর নামে লুটপাট এবং সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুম-খুনের কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে।
কোনো পরিবর্তন নেই
আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনকাল, দ্বিতীয় শাসনকাল এবং তৃতীয় শাসনকালের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ একই ধারাবাহিকতায় চরম নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে দেশ শাসন করে। বিরোধী দলের মতামতকে কখনোই তারা সহ্য করতে পারে না। আওয়ামী লীগের নিষ্ঠুরতা ও ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ জাসদ ও বামপন্থীদের একাংশ তাদের নিজস্ব রাজনীতি ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমবেত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মহা গুণগান করছে। তাদের দলের নিজস্ব নির্বাচনী প্রতীক ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের প্রতীক গ্রহণ করে নির্বাচন করেছে। তারা এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন। এটা জাসদ ও বামপন্থীদের জন্য কতটুকু সম্মানজনক?
যে আওয়ামী লীগ ’৭২-’৭৫ সময়কালে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, জামায়াতকে নিরাপদ রেখে জাসদ, বামপন্থীদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ ২০১৩ সালে এসে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং ১৮ দলভুক্ত জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, জাগপা, এলডিপি ও অন্য সমমনাদের নির্মূল করতে গোপনে, প্রকাশ্যে হত্যার কৌশল নিয়েছে। আওয়ামী লীগের এই দ্বিমুখী নীতি ও আদর্শ বিচ্যুতির কারণেই ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে দল ত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন।
নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবের দুঃখজনক মৃত্যু ও বাকশাল সরকারের পতন হয়। তখন বিএনপি নামে কোনো দলই ছিল না। বিএনপি গঠিত হয়েছিল জাতির এমন এক ক্রান্তিলগ্নে যখন বাকশাল সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও জাতিকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সামরিক শাসনের বদলে জাতিকে উপহার দেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। সংবিধানে ৫ম সংশোধনী এনে প্রেসিডেন্ট জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন এবং সব সংবাদপত্রের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে মানুষের বাক স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। রাজনীতিশূন্য বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় বাংলাদেশের জনগণ। জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত যে গণতন্ত্র তা মুক্তি পায় রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতে।
আসুন আমরা সব ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করি। বিভেদ আর হানাহানির রাজনীতিকে পরাজিত করি। প্রভাবমুক্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বীকৃত ব্যবস্থা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি’ ফিরিয়ে আনি। আমরা সবাই মিলেমিশে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একুশ শতকের উপযোগী মডেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলি। রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনি দেশপ্রেম, সততা, সহমর্মিতা, শৃংখলা এবং গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার।
শিমুল বিশ্বাস : বিআইডব্লিউটিসির সাবেক চেয়ারম্যান; বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ সহকারী
No comments