অনিশ্চিত স্বদেশ
বাংলাদেশের মানুষ এখন উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। উৎকণ্ঠার কমতি নেই আমরা যারা প্রবাসী, তাদেরও। কী হবে, কী হতে পারে—সে রকম প্রশ্নে চলছে নানা রকম জল্পনা। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এজাতীয় সংকট ও সংঘাত কতটা গণতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, আমরা যারা বিদেশে থিতু হয়ে আছি, এখনকার গণতান্ত্রিক কাঠামোর আলোকে তা বিচার করে দেখতেই অভ্যস্ত। তাই দেশের রাজনীতিবিদদের, বিশেষত রাজনীতির ময়দানের প্রধান দুই শক্তি এবং তাদের দোসরদের কীর্তিকলাপকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, সুস্থ গণতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় নয়। সহনশীলতা হচ্ছে গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যা বরাবর অনুপস্থিত। ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গণতন্ত্রের দ্বিদলীয় ব্যবস্থাই এর কারণ। যা কিনা আমাদের পরোক্ষভাবে বেঁধে রেখেছে সামন্ততান্ত্রিক গোলকধাঁধায়। আর সে সামন্ততান্ত্রিক আবহই যে তৈরি করে দিচ্ছে চূড়ান্ত অসহনীয় পরিবেশ, তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে এই লাঠিয়ালি গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে বের হয়ে না আসা পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গর্ব করার মতো আমাদের কিছুই থাকবে না। গত দুই দশকের গণতন্ত্রচর্চায় যে ভুল শিক্ষা আমাদের রাজনীতিবিদেরা নিয়েছেন তা হলো, গণতান্ত্রিক কাঠামো হচ্ছে নিজের আর অনুসারীদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জুতসই পথ। আর এ কারণেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর থেকে সদর্পে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কতিপয় ভবন কিংবা লাঠিয়াল সর্দারের মতো দানবীয় মানুষ।
বাংলাদেশের জনগণের সামনে ভোটাধিকারের মুলো ঝুলিয়ে রেখে যাবতীয় অপশাসন তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হয়তো এ কারণেই পচনধরা সেই কাঠামো থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। উত্তরণের একটি পথ অবশ্যই নির্ধারিত আছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী কাঠামোতে, যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিবিশেষকে নয়, বরং দলকে ভোট দেওয়ার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল দেশজুড়ে কয়েক লাখ ভোট পাওয়া সত্ত্বেও সংসদে নিজেদের উপস্থিত করতে পারছে না। শুধু তা-ই নয়, যে লাখ লাখ ভোটদাতা এলাকাভিত্তিক এঁদেরকে ভোট দিচ্ছেন, তাঁদের আশাও হচ্ছে পদদলিত। অন্যদিকে বিরাটসংখ্যক ভোটারের সেই বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে বড় দুটি দল কায়েম রাখছে ক্ষমতার ওপর মৌরসি পাট্টা। আমাদের সংকটের মূলে অনেকাংশে এই নির্বাচনপদ্ধতি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বড় দুই দলের কেউই তাদের অবস্থান হাতছাড়া করতে রাজি হবে না। তারা ভালোভাবেই অবগত যে পাঁচ-বছর মেয়াদি প্রতিটি ব্যবস্থায় ক্ষমতা ঘুরেফিরে তাদের হাতেই চলে আসবে। নীতির পার্থক্য লক্ষ করা গেলেও রাজনীতিচর্চার গুণগত বিচারে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যনেই। অর্থাৎ, তোমার যদি থাকে হাওয়া ভবন, আমার থাকবে শামীম ওসমান; তোমার যদি থাকে ছাত্রদল আর যুবদল, তবে আমার থাকবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় যে দলের যতটা অর্জন, তার প্রায় সবটাই দলীয় ক্যাডারদের দুরন্ত আচরণে ম্লান হয়ে যায়। এ কারণেই সাফল্য থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মন্দের ভালো হিসেবে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো আগের দলকেই বেছে নেওয়া ছাড়া জনগণের সামনে কোনো পথ খোলা থাকে না।
অন্য যে বিষয়ে দুই দলের মধ্যে বিস্ময়কর মিল তা হলো, কথায় কথায় গণতন্ত্র আর সংবিধানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও দেশ শাসনের চাবিকাঠি তুলে দেওয়া হয় কিছু অগণতান্ত্রিক ব্যক্তি কিংবা পরিবারের লোকজনের হাতে। ফলে জবাবদিহির সুযোগ যেমন রহিত হয়ে যায়, তেমনি ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ হয় উন্মুক্ত। দুই দলের লাগামহীন আচরণ, যার আরেকটি নগ্ন প্রকাশ জনগণ সম্প্রতি দেখতে পেল টেলিফোন-নাটকের মধ্য দিয়ে। এই বৈরিতা দেশকে চূড়ান্তভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। কোনো একটি দল যখন ক্ষমতায় বসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, ক্ষমতা লাভের সেই স্বপ্নে বিভোর থেকে কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হচ্ছে, সেই চিন্তা তখন তাদের মোটেই বিচলিত করে না। আর এ কারণেই আমাদের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় যে প্রতীকী স্থাপনা, সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা গেল স্বাধীনতাবিরোধীদের সদর্প পদচারণ। স্বাধীনতাবিরোধী সেই শক্তি সাম্প্রতিক কালে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, আমরা প্রবাসীরা অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি। দেশ যখন সংকটের মুখে, আমরা তখন দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হই। বাংলাদেশের সুনাম যেমন আমাদের আনন্দিত করে, তেমনি সংঘাত-সংঘর্ষ কিংবা মৌলবাদী শক্তির উত্থান হতাশা জাগায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কীভাবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা যায়, সে ব্যাপারে রাজনীতিকদেরই ভাবতে হবে। সবকিছু দলীয় দৃষ্টিতে দেখার নাম গণতন্ত্র নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে দেশের মানুষের কল্যাণে আইন প্রণয়ন করা, নিজের নির্বাচনী এলাকায় কতজনের চাকরি নিশ্চিত করা গেল কিংবা কত টন চাল বা গম এলাকার জন্য বরাদ্দ করিয়ে নেওয়া গেল, তা নয়। সামষ্টিকভাবে সারা দেশের দেখভাল করার দায়িত্ব সাংসদদের ওপর ন্যস্ত, নিজের গ্রাম কিংবা মহল্লার দেখভাল নয়। ফলে সংসদে যাঁরা বসবেন, তাঁদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা আবশ্যকীয়। আমরা যদি সরকারি অফিসের কেরানি নিয়োগের বেলায় স্নাতক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করে দিই, তবে কেরানির চেয়ে অনেক গুণ বেশি দায়িত্বপূর্ণ পদ সংসদ সদস্যের বেলায় কেন আমরা লাগাম ছেড়ে দেব?
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments