যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অশনি সংকেত by তারেক শামসুর রেহমান
যুক্তরাষ্ট্রের
ইতিহাসে শাট ডাউনের ঘটনা দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়াল। নতুন অর্থবছরে বাজেট
বরাদ্দ ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার (ওবামা কেয়ার) নিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক
ওবামার সঙ্গে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের কোনো
সমঝোতা না হওয়ায় ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা
নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওয়াশিংটনের এই শাট ডাউনের ঘটনা বিশ্ব
অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশংকা করেছেন।
চীনের ডেপুটি অর্থনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রী এই শাট ডাউনের ঘটনায় উদ্বেগ
প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বিনিয়োগের ব্যাপারে নিশ্চয়তা
চেয়েছেন। ১০ অক্টোবর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের স্পিকার ও রিপাবলিকান দলীয়
নেতা বয়েইনারের নেতৃত্বাধীন ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট
ওবামার সঙ্গে দেখা করলেও তাতে জট খোলেনি। প্রতিনিধি দলটি মধ্য নভেম্বর
পর্যন্ত একটা ‘শর্ট-টার্ম’ সমাধানের প্রস্তাব দিলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা তাতে
রাজি হননি। ওবামা চাচ্ছেন আরও ঋণ গ্রহণ করে সরকারের ব্যয়ভার মেটাতে।
রিপাবলিকানদের তাতে আপত্তি। এই ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ১৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন
ডলার (এক হাজার বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন)।
ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় ওয়াশিংটনে ফেডারেল সরকারের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বেতন দিতে না পারায় ৮ লাখ কর্মচারীকে, যারা ফেডারেল সরকারের বেতনভুক্ত, তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ওবামা স্বাস্থ্যসেবায় যে সংস্কার আনতে চান, তাতেও আপত্তি রিপাবলিকানদের। তারা স্বাস্থ্যসেবায় ফেডারেল সরকারের বরাদ্দে আরও কাটছাঁট করতে চান। ইতিমধ্যে অনেক স্বাস্থ্যসেবা সংকুচিত করা হয়েছে। অনেক বাংলাদেশীও এখন আর স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় রাষ্ট্রের তহবিল শূন্য হতে চলেছে। সরকারের প্রতিদিনের খরচ ৬ হাজার কোটি ডলার। ১৭ অক্টোবরের পর সরকারের হাতে থাকবে মাত্র ৩ হাজার কোটি ডলার। অথচ ১ নভেম্বর রাজস্ব বিভাগকে স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের ৬ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। রাজস্ব খাতে সে পরিমাণ টাকা আসছে না। বিনিয়োগকারীদের সুদের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল ১ দশমিক ২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে যত বিনিয়োগ হয়েছে তার ২৩ ভাগ এককভাবে চীনের।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতিতে মন্দাবস্থাই প্রমাণ করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক ৭ জন নাগরিকের মধ্যে একজন ‘ফুড স্টাম্প’ গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানেন না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবেন। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই ফুড স্টাম্পের পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি অর্থ পাওয়া না যায় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মাঝে এই হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২ কোটি মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০-রও বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র তিন তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর টাইমস ম্যাগাজিনের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে আত্মঘাতী বোমাবাজির প্রবণতা বেড়েছে। ইরাক এখন সিয়া, সুন্নি ও কুর্দি- এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়াতে কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়াতে এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়দা উৎখাত হয়নি, বরং আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাবে বিশাল অর্থের প্রশ্নটি।
তবে শুধু অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই যে ওবামা প্রশাসন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেনি, তেমনটি নয়। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু না করার কারণ অন্য। এখন অর্থনৈতিক সংকট ওবামার হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। ওবামা সামাজিক খাতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের দিকে নজর দিলে এবং তাতে রিপাবলিকানদের সমর্থন না পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বৈষম্য বাড়বেই। অর্থাৎ ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠী, যাদের একটা বড় অংশের কোনো চাকরি নেই, বাসস্থান নেই। এদের অনেকেই ফুড স্টাম্পের ওপর নির্ভরশীল। এখন টাকার অভাবে এই ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতা আরও বাড়বে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হলেও সাধারণ মানুষের ন্যূনতম যে সামাজিক অধিকার, তার একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। চাকচিক্যময় এ দেশে দরিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, সম্পদ একশ্রেণীর মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশের জন্য দুঃখজনক সংবাদ। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব হয়নি। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মাঝে কৃষ্ণাঙ্গরা যেখানে ছিল শতকরা ১১ ভাগ, এখন তা বেড়েছে ১৪ ভাগে। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মিলিয়ন, এখন ২৪১ মিলিয়ন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্র“প নয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে ল্যাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গের হার যেখানে ছিল শতকরা ২৯ ভাগ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ ভাগে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুলত্যাগের হার ছিল ১৫ ভাগ (১৯৬৭)। আর এখন তা ৫ ভাগ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীদের হার ছিল ৪ ভাগ (শ্বেতাঙ্গ ৮ ভাগ)। ২০১২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের বেড়েছে ২১ ভাগে, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ ভাগ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) শতকরা ৩২ ভাগ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার কিছুটা কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার যেখানে ছিল শতকরা ৪১ ভাগ, সেখানে বর্তমানে এই হার শতকরা ২১ ভাগ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মাঝে মেইন-এ কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারদের হার বেশি, শতকরা ২১ ভাগ, আর দরিদ্রতার হারও বেশি, শতকরা ৪৬ ভাগ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। অথচ এখানে শতকরা ৫৭ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এ সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৩২। আয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেখানে শতকরা ৭ জন শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে এই হার শতকরা ১৫ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মাঝে বেকারত্বের হার শতকরা ১৩ ভাগ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারত্বের হার ২৩ ভাগ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ৯ ভাগ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা তিনগুণ বেশি ছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে। শাট ডাউনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকানদের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে। এনবিসি ও ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ মনে করে শাট ডাউনের ঘটনার জন্য রিপাবলিকানরা দায়ী। সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থা বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র অ্যাপেক সম্মেলনেও যোগ দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনগুলো তাই সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় ওয়াশিংটনে ফেডারেল সরকারের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বেতন দিতে না পারায় ৮ লাখ কর্মচারীকে, যারা ফেডারেল সরকারের বেতনভুক্ত, তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ওবামা স্বাস্থ্যসেবায় যে সংস্কার আনতে চান, তাতেও আপত্তি রিপাবলিকানদের। তারা স্বাস্থ্যসেবায় ফেডারেল সরকারের বরাদ্দে আরও কাটছাঁট করতে চান। ইতিমধ্যে অনেক স্বাস্থ্যসেবা সংকুচিত করা হয়েছে। অনেক বাংলাদেশীও এখন আর স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। ফেডারেল সরকার ঋণ গ্রহণ করতে না পারায় রাষ্ট্রের তহবিল শূন্য হতে চলেছে। সরকারের প্রতিদিনের খরচ ৬ হাজার কোটি ডলার। ১৭ অক্টোবরের পর সরকারের হাতে থাকবে মাত্র ৩ হাজার কোটি ডলার। অথচ ১ নভেম্বর রাজস্ব বিভাগকে স্বাস্থ্য খাতের কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের ৬ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। রাজস্ব খাতে সে পরিমাণ টাকা আসছে না। বিনিয়োগকারীদের সুদের অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না। বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল ১ দশমিক ২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে যত বিনিয়োগ হয়েছে তার ২৩ ভাগ এককভাবে চীনের।
যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতিতে মন্দাবস্থাই প্রমাণ করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক ৭ জন নাগরিকের মধ্যে একজন ‘ফুড স্টাম্প’ গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকেন। ১৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ৪৯ মিলিয়ন মানুষ জানেন না পরের বেলার খাদ্য তারা কোত্থেকে জোগাড় করবেন। ফেডারেল সরকার প্রতি বছর ৭৮ বিলিয়ন ডলার এই ফুড স্টাম্পের পেছনে ব্যয় করে। অর্থাৎ গরিব জনগোষ্ঠী খাদ্য সহায়তা পায়। এখন যদি অর্থ পাওয়া না যায় তাহলে নির্দ্বিধায় এই খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে গরিব মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা ব্যাহত হবে। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবী জনশক্তির শতকরা ৭ ভাগ এখন বেকার। আফ্রো-আমেরিকানদের মাঝে এই হার ১৩ ভাগ। প্রায় ২ কোটি মানুষের কোনো কাজ নেই। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আবার যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ আর বাড়বে না। স্মরণ থাকার কথা, আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। আর সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ১০০-রও বেশি। একমাত্র ইরাকে ৪ থেকে ৯ লাখ মানুষ হয় মারা গেছে, নতুবা স্থানচ্যুত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে আফগানিস্তান ও ইরাকে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ওবামাকে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে এবং এর পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র তিন তিনটি দেশে (আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া) যুদ্ধ শুরু করলেও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা তো স্বপ্নই থেকে গেছে। আফগানিস্তান এখন বাহ্যত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে কারজাইকেও দেশ ত্যাগ করতে হবে। আর টাইমস ম্যাগাজিনের খবর অনুযায়ী (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩) গত কয়েক মাসে ইরাকে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইরাকে আত্মঘাতী বোমাবাজির প্রবণতা বেড়েছে। ইরাক এখন সিয়া, সুন্নি ও কুর্দি- এই তিন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছে। লিবিয়াতে কোনো স্থিতিশীল সরকার নেই। অস্ত্রবাজরা আজ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। ইরাক ও লিবিয়াতে এরা শক্তিশালী হয়েছে। সিরিয়ায় আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্ট ও ইরাকের ইসলামিক স্টেট অব ইরাক সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধে আল-কায়দা উৎখাত হয়নি, বরং আল-কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান, লেবানন ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাবে বিশাল অর্থের প্রশ্নটি।
তবে শুধু অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই যে ওবামা প্রশাসন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু করেনি, তেমনটি নয়। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু না করার কারণ অন্য। এখন অর্থনৈতিক সংকট ওবামার হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। ওবামা সামাজিক খাতে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতের দিকে নজর দিলে এবং তাতে রিপাবলিকানদের সমর্থন না পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বৈষম্য বাড়বেই। অর্থাৎ ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠী, যাদের একটা বড় অংশের কোনো চাকরি নেই, বাসস্থান নেই। এদের অনেকেই ফুড স্টাম্পের ওপর নির্ভরশীল। এখন টাকার অভাবে এই ফুড স্টাম্প বন্ধ হয়ে গেলে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতা আরও বাড়বে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হলেও সাধারণ মানুষের ন্যূনতম যে সামাজিক অধিকার, তার একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। চাকচিক্যময় এ দেশে দরিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, সম্পদ একশ্রেণীর মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় গণতান্ত্রিক দেশের জন্য দুঃখজনক সংবাদ। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব হয়নি। ১৯৬০ সালে মোট জনগোষ্ঠীর মাঝে কৃষ্ণাঙ্গরা যেখানে ছিল শতকরা ১১ ভাগ, এখন তা বেড়েছে ১৪ ভাগে। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মিলিয়ন, এখন ২৪১ মিলিয়ন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ৪৫ মিলিয়ন। তারা সবচেয়ে বড় এথনিক গ্র“প নয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ হচ্ছে ল্যাতিনো অথবা হিসপানিক, ৫৪ মিলিয়ন। শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৯৬৭ সালে স্কুল ত্যাগকারী কৃষ্ণাঙ্গের হার যেখানে ছিল শতকরা ২৯ ভাগ, ২০১১ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৭ ভাগে। অথচ একই সময় শ্বেতাঙ্গদের স্কুলত্যাগের হার ছিল ১৫ ভাগ (১৯৬৭)। আর এখন তা ৫ ভাগ। ১৯৬০ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণকারীদের হার ছিল ৪ ভাগ (শ্বেতাঙ্গ ৮ ভাগ)। ২০১২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের বেড়েছে ২১ ভাগে, আর শ্বেতাঙ্গদের এ হার ৩৫ ভাগ। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। পরিসংখ্যান বলে, কারাগারে অবস্থানকারী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর হার ৩৭ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ আবার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। কিশোর অপরাধীর হার (কৃষ্ণাঙ্গ) শতকরা ৩২ ভাগ। পরিসংখ্যান বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার কিছুটা কমেছে। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে দরিদ্রতার হার যেখানে ছিল শতকরা ৪১ ভাগ, সেখানে বর্তমানে এই হার শতকরা ২১ ভাগ। অঙ্গরাজ্যগুলোর মাঝে মেইন-এ কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারদের হার বেশি, শতকরা ২১ ভাগ, আর দরিদ্রতার হারও বেশি, শতকরা ৪৬ ভাগ। মিসিসিপি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। অথচ এখানে শতকরা ৫৭ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এ সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৩২। আয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের গড় আয় যেখানে বছরে ২১ হাজার ডলার, সেখানে শ্বেতাঙ্গদের আয় ২৭ হাজার ডলার। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও পিছিয়ে আছে। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যেখানে শতকরা ৭ জন শ্বেতাঙ্গ বেকার, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে এই হার শতকরা ১৫ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু পুরুষদের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মাঝে বেকারত্বের হার শতকরা ১৩ ভাগ। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বেকারত্বের হার ২৩ ভাগ। আর ৬০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার মাত্র ৯ ভাগ। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শতকরা মাত্র ৭ ভাগ ব্যবসা রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে (২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী)। যদিও ১৯৬৭ সালের হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা তিনগুণ বেশি ছিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা অর্থনৈতিক অব্যবস্থা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে। শাট ডাউনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকানদের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে। এনবিসি ও ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ মনে করে শাট ডাউনের ঘটনার জন্য রিপাবলিকানরা দায়ী। সত্যিকার অর্থেই যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থা বিশ্ব নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র অ্যাপেক সম্মেলনেও যোগ দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনগুলো তাই সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments