সহজিয়া কড়চা- যদি এমন হতো দশম জাতীয় সংসদ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
মহা
ধুমধামের সঙ্গে সদ্য উদ্যাপিত হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। এক দিন পরেই ঈদুল
আজহা। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। মাস তিনেকের মধ্যে, আশা করি, দশম
জাতীয় সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
গঠিত হবে নতুন সরকার।
যাঁরা সরকার গঠন করবেন এবং যাঁরা প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন
করবেন—তাঁদের প্রত্যেকেরই একটি পরিকল্পনা বা নীলনকশা রয়েছে। যেকোনো সরকারের
খারাপ দিকগুলো নিয়ে পত্রিকাতে লেখায় একধরনের নির্মল আনন্দ রয়েছে, যে আনন্দ
উপভোগের মানুষ গণতান্ত্রিক দেশে ক্রমাগত বাড়ছে। দুর্গাপূজা ও ঈদের উৎসবের
মধ্যে অনাগত সংসদ ও সরকারের বিরূপ সমালোচনা করে কিছু লেখা খুবই অশোভন।
উৎসবের আনন্দ মাটি। দুই প্রধান উৎসবের আনন্দের দিনে দশম সংসদ এবং নতুন
সরকার ও বিরোধী দলের আচরণ কেমনটি প্রত্যাশিত—তার একটি গোলাপি চিত্র আমরা
আঁকতে পারি।
স্রেফ
অনুমান, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি ও তার মিত্ররা পেল ২১২ আসন। স্বতন্ত্রসহ প্রধান
বিরোধী দলে অবশিষ্ট আসন। সেই সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনও আছে আনুপাতিক হারে
দুপক্ষেই। ফলে সংসদে বিরোধী দলও খুব দুর্বল হবে না। সংসদের উদ্বোধনী
অধিবেশনে যোগ দিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা লুই কানের ডিজাইন করা ভবনটির
টানেলের নিচে গাড়ি থেকে নামলেন। নেমে তিনি দলীয় সমর্থকদের করতালির ভেতর
দিয়ে ভবনে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি লক্ষ করেন, প্রধান বিরোধী দলের
নেতাও গাড়ি থেকে নামলেন। দলীয় প্রিয়ভাজনদের করতালি উপেক্ষা করে সঙ্গে সঙ্গে
তিনি পেছনে ফিরে এসে সহাস্যে বিরোধী দলের নেতার হাত ধরলেন। তবে বিরোধী
দলের নেতার মুখে হাসির রেখা কম। তা সত্ত্বেও দুজন হাত ধরে সংসদ ভবনে
ঢুকলেন। একই লিফটে উঠলেন। সামান্য কিছু কথা হলো।
সংসদ ভবনের বাইরে দুই পক্ষের কর্মীবাহিনীর স্লোগান শোনা গেল: দুই নেতার আগমন—শুভেচ্ছা স্বাগত। (এর মধ্যে স্লোগান দেওয়া নিয়ে দুপক্ষের কয়েকজনের মধ্যে মৃদু হাতাহাতি হয়ে যায়। নিরাপত্তার লোকেরা তাদের দু-চার ঘা দিয়ে মিরপুর রোডের দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেন।)
লিফট থেকে নামার সময় বিরোধী দলের নেতা স্বগতোক্তির মতো বলেন, তাড়াহুড়ার মধ্যে চাও শেষ করে আসতে পারিনি।
থমকে দাঁড়ান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। বলেন, আপনি আপনার কক্ষে গিয়ে একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
‘মেনি থ্যাঙ্কস। এখন আর সময় নেই। বিরতির সময় খাবক্ষণ’, বলতে বলতে বিরোধী দলের নেতা হনহন করে হাঁটা দেন।
কিছু সৌজন্য বিনিময় ও মৃদু হাস্যরসের ভেতর দিয়ে স্পিকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা মাঝে মাঝে টেবিল চাপড়ান। রাষ্ট্রপতির ভাষণে—যদিও তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কারও রচনা—কোনো প্রয়াত নেতার স্তুতি নেই। তাতে রয়েছে অনাগত দিনগুলোর জন্য জাতির দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর অধিবেশন মুলতবি হলে আবার লবিতে হাসি-আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
পরবর্তী মিটিংগুলোতে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। বর্তমান কঠিন সময়ে হাস্যরস জিনিসটি দুর্লভ হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও মাস খানেকের প্রথম অধিবেশনটিতে কোনো কোনো সদস্য বঙ্গীয় হাস্যরস পরিবেশন করেন। তাতে কেউ না বুঝে হাসেন, কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কোনো কোনো মাননীয়ের কোনো দিকেই খেয়াল নেই। তাঁদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তাঁদের ফ্যাক্টরির মাল শিপমেন্টের চিন্তা।
দেখতে দেখতে নতুন সরকারের প্রথম বাজেট দেওয়ার সময় এসে যায়। বসে বাজেট অধিবেশন। এই অধিবেশনে বিরোধী দল কিছু তিক্ততার সৃষ্টি করে। ওয়াকআউটও হয়। তবে তা কিছুক্ষণের জন্য। এলাকার মানুষকে খুশি করতে কিছু গরম কথা বলতেই হয়। তবে কেউ কোনো রকম চুদুরবুদুর করেন কি না তা জনগণ বুঝতে পারে।
এর মধ্যে এক দলীয় কর্মীর জালে কংশ নদে দুটো মহাশোল ধরা পড়ে। তিনি মস্ত বড় মাটির পাত্রে মাছ দুটো জ্যান্ত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পাঠিয়ে দেন। অফিস থেকে ফিরে মহাশোল দেখে মহাখুশি প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তিনি বিখ্যাত মহাশোল খাননি। ওগুলো নাকি গারো পাহাড় থেকে নেমে আসে। সংসদ নেতা তাঁর বিশেষ সহকারীকে নির্দেশ দেন কংশ নদের একটি মহাশোল বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে।
ডিনারের পরে বিরোধীদলীয় নেতা ফোনে সংসদ নেতাকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, মহাশোলে যে এত তেল জানতাম না। শুনেছি পাহাড়ি নদীর পাথর খেয়ে নাকি এ মাছ বড় হয়। ভেরি ডেলিশাস।
আর একদিন কিশোরগঞ্জের হাওরের দশাসই সরপুঁটি, পাবদা ও টাটকিনি এক ঝুড়ি পাঠায় কেউ বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িতে। এসব বাঙালি মাছ এখন ঢাকার বাজারে দুষ্প্রাপ্য। তিনি তৎক্ষণাৎ তার অর্ধেক পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। এই যে একে অপরের বাড়িতে পছন্দের জিনিসটি পাঠানো—এ কোনো অস্বাভাবিক বা নতুন ব্যাপার নয়। এই তো ছিল বাঙালির জীবন! এসবই বাঙালির ঐতিহ্য। চিরকাল বাঙালির চরিত্রে যেমন প্রবল বিদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা ছিল, তেমনি অকৃত্রিম আতিথেয়তা ও ভালোবাসাও ছিল।
যাক গে! প্রথম দিকের কোনো অধিবেশনেই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সরকারি দলের এক সাংসদ যিনি অতীতে মার্ক্স-লেনিন-মাওবাদী বিপ্লবী ছিলেন, এখন আশুলিয়া-সাভার-জয়দেবপুরে অনেকগুলো ফ্যাক্টরির মালিক, শুধু বাড়িতেই তাঁর ব্যবহূত হয় চারটি গাড়ি, বললেন—মাননীয় স্পিকার, আমরা জনগণের প্রতিনিধি। তাদের দ্বারা নির্বাচিত। জনগণকে যা দিতে পারি আমরা সাংসদেরা শুধু তা-ই নেব। তার বেশি কিছু নেওয়ার নৈতিক অধিকার আমাদের নেই। তাদের দিনরাত সেবা করি বলে তাদের পকেট কাটতে পারি না। তা ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার আগে আমরা কেউ পথের মানুষ ছিলাম না। রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতাম না। আমাদের শুল্কমুক্ত গাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের মধ্যে যদি কেউ নির্বাচনের আগে নসিমন-করিমনে যাতায়াত করে থাকেন, এখনো তা-ই করবেন। যদি রিকশা-সিএনজিতে ঘুরে থাকেন, এখনো তা-ই ঘুরবেন। যদি তাঁরা আগে বাসে ঝুলে যাতায়াত করে থাকেন, এখনো তা-ই করবেন। যদি তাঁরা আগে নিজের গাড়িতে চড়ে থাকেন, সে গাড়ি বিক্রি করে দেননি, এখনো সেই গাড়িটিই ব্যবহার করবেন। নতুন গাড়ির দরকার নেই।
মাঝের সারির কোনো আসন থেকে কেউ একজন তাঁর বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে শুধু ‘মাননীয়’ ‘মাননীয়’ করলেন। কিছু শোনা গেল না। সমস্বরে সবাই টেবিল চাপড়াতে লাগলেন। সমর্থন এল সরকারি ও বিরোধী দলের থেকে। এই নৈতিক ও শুভবুদ্ধির প্রস্তাবে কে না সমর্থন দেবে? হাউসের শেষের সারির এক কোনায় পাগড়ি পরা দুই সাংসদ বসে ছিলেন। তাঁরা বললেন, মারহাবা, মারহাবা!
সাংসদদের কোটি কোটি টাকা দামের শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার বিধান দশম সংসদে বাতিল হয়ে গেল। সারা দেশের মানুষ খুশি। একেই বলে জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের সেবক। তবে এবারই যাঁরা প্রথম নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীদের মনের অবস্থা কী তা বিধাতা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। কারও কারও শালা তার বোনকে বলল, বড়াপা/ছোড়দি, তোমার কপাল খারাপ। দুলাভাই/জামাইবাবু যদি নবম সংসদের এমপি হইতেন? আপা/দিদি বলেন, চিন্তা করিস না ঝন্টু, কত পথ খোলা আছে। তোর যে ঘন ঘন বেনাপোল আর বাংলাবান্ধা যাওয়া লাগে কী বিজনেসের কারণে, তোর কোনো সমস্যা হইব না। কান্তার বাবার নতুন গাড়ি নিয়াই যাইতে পারবি। কাস্টমসের লোকেরাও দেখবি তোরে এবার কেমন খাতির করে।
তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের বুক ভেঙে যায়। মুখে কিছু বলতে পারেন না, মনে মনে মাইকেলকে স্মরণ করেন—আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়!
বাংলার মাটি লোভ-লালসার লীলাভূমি। লোভে লোভে কলঙ্কিত জাতি। কলঙ্কিত অতীত নিয়ে দশম সংসদের সদস্যরা বড়ই বিব্রত। কারণ তাঁরা এবার অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো হয়ে গেছেন। এক অধিবেশনে ফ্লোর নিয়ে এক সাংসদ বলেন, মাননীয় স্পিকার, বাবা-মা, নিজের বা স্বামী-স্ত্রীর নামে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও আমাদের অনেক মাননীয়/মাননীয়া তথ্য গোপন করে ডিআইটির প্লট নিয়েছেন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পুরস্কার। এভাবে প্লট নেওয়া রাজউকের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এই সংসদের এমপি-মন্ত্রীরা কেউ সরকারি প্লট নেব না। এমপি হিসেবে সরকারি জমি নেওয়া ভূমি দখলেরই নামান্তর। আমাদের কেউ আইন প্রণয়নকারী ভূমিদস্য বলুক তা চাই না।
এই প্রস্তাবে নিঃসীম নীরবতা নেমে আসে গোটা হাউসে। আজিমপুর, মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা ও বনানীর বিশেষ জায়গার নীরবতা। বিষাদের ছায়া নামে সবার চোখে-মুখে। যিনি প্রস্তাব করছিলেন তিনি তা লক্ষ করেন। সহকর্মীদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, মাননীয় স্পিকার, আপনি জানেন যে পৌনে দুই বছর ধরে বলা হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ যেভাবে চলে বাংলাদেশও সেভাবেই চলবে। সেভাবেই সংসদ নির্বাচন হবে। তাই আমার অনুরোধ আপনি নিজে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, বেনেলুক্স দেশসমূহ এবং স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশ ও জাপানে ফোন করে জানুন তাদের এমপিরা সরকারি জমি উপহার পান কি না। যদি তাঁরা পান আমরাও নেব। যদি তাঁরা না পান তাহলে রাজউকের চেয়ারম্যান যদি পীড়াপীড়িও করেন তবু নেব না। দেশের বারো আনা মানুষ ভূমিহীন, গৃহহীন। আমরা পূর্বাচলেই হোক বা দক্ষিণাঞ্চলেই হোক কোনো প্লট নেব না।
হাউসের সবার চোখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে স্পিকার অধিবেশন পরদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত মুলতবি করেন।
পরদিনের অধিবেশনে কোরাম তো বটেই দেখা গেল সমস্ত হাউস পরিপূর্ণ। কী সিদ্ধান্ত হয় তা আমরা অগ্রিম এই কলামে লিখতে পারব না। ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের একটি বড় সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে সফরের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ থেকে আমন্ত্রণ এসেছে। সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা ২১২। সংসদ নেতা এবং স্পিকার ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করেন। তার অর্ধেক সরকারি দল থেকে, অর্ধেক বিরোধী দল থেকে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিরোধী দলের নেতাকে। অন্যান্য দেশের মতো অপজিশনের নেতাই পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানও।
পার্লামেন্টের সদস্যরা সব দেশেই অতি সম্মানের পাত্র। এলাকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, পাবলিক টয়লেট কমিটির চেয়ারম্যান হওয়া তাঁদের জন্য শোভন নয়। খাই খাই ভাবটা ভালো নয়। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের উপদেষ্টা হয়ে তাঁদের ওপরে ছড়ি ঘোরানোতে তাঁদের মর্যাদা বাড়ে না। স্কুল-কলেজ কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য এলাকাতেই বহু শিক্ষাবিদ আছেন। তাই দশম সংসদের এমপিরা শুধু আইনই প্রণয়ন করবেন, ছেলেমেয়েদের ভর্তি নিয়ে মাথাও ঘামাবেন না, টাকাও কামাই করবেন না।
যাঁরা খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পাতায় রচনা লেখেন, তাঁরা কখনো কোনো বিষয় খুঁজে না পেলে কত কী আবোলতাবোল চিন্তা করেন। ধারণা করছি দেশ সংবিধান অনুযায়ী রেলগাড়ির মতো দুর্বার গতিতেই ছুটে চলবে। তবে যা লিখলাম এ রকমই যদি হতো আমাদের দশম জাতীয় সংসদ!
সৈয়দ আবুল মকসুদঃ গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সংসদ ভবনের বাইরে দুই পক্ষের কর্মীবাহিনীর স্লোগান শোনা গেল: দুই নেতার আগমন—শুভেচ্ছা স্বাগত। (এর মধ্যে স্লোগান দেওয়া নিয়ে দুপক্ষের কয়েকজনের মধ্যে মৃদু হাতাহাতি হয়ে যায়। নিরাপত্তার লোকেরা তাদের দু-চার ঘা দিয়ে মিরপুর রোডের দিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেন।)
লিফট থেকে নামার সময় বিরোধী দলের নেতা স্বগতোক্তির মতো বলেন, তাড়াহুড়ার মধ্যে চাও শেষ করে আসতে পারিনি।
থমকে দাঁড়ান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। বলেন, আপনি আপনার কক্ষে গিয়ে একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুনি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
‘মেনি থ্যাঙ্কস। এখন আর সময় নেই। বিরতির সময় খাবক্ষণ’, বলতে বলতে বিরোধী দলের নেতা হনহন করে হাঁটা দেন।
কিছু সৌজন্য বিনিময় ও মৃদু হাস্যরসের ভেতর দিয়ে স্পিকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা মাঝে মাঝে টেবিল চাপড়ান। রাষ্ট্রপতির ভাষণে—যদিও তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কারও রচনা—কোনো প্রয়াত নেতার স্তুতি নেই। তাতে রয়েছে অনাগত দিনগুলোর জন্য জাতির দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর অধিবেশন মুলতবি হলে আবার লবিতে হাসি-আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
পরবর্তী মিটিংগুলোতে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। বর্তমান কঠিন সময়ে হাস্যরস জিনিসটি দুর্লভ হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও মাস খানেকের প্রথম অধিবেশনটিতে কোনো কোনো সদস্য বঙ্গীয় হাস্যরস পরিবেশন করেন। তাতে কেউ না বুঝে হাসেন, কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কোনো কোনো মাননীয়ের কোনো দিকেই খেয়াল নেই। তাঁদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তাঁদের ফ্যাক্টরির মাল শিপমেন্টের চিন্তা।
দেখতে দেখতে নতুন সরকারের প্রথম বাজেট দেওয়ার সময় এসে যায়। বসে বাজেট অধিবেশন। এই অধিবেশনে বিরোধী দল কিছু তিক্ততার সৃষ্টি করে। ওয়াকআউটও হয়। তবে তা কিছুক্ষণের জন্য। এলাকার মানুষকে খুশি করতে কিছু গরম কথা বলতেই হয়। তবে কেউ কোনো রকম চুদুরবুদুর করেন কি না তা জনগণ বুঝতে পারে।
এর মধ্যে এক দলীয় কর্মীর জালে কংশ নদে দুটো মহাশোল ধরা পড়ে। তিনি মস্ত বড় মাটির পাত্রে মাছ দুটো জ্যান্ত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পাঠিয়ে দেন। অফিস থেকে ফিরে মহাশোল দেখে মহাখুশি প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তিনি বিখ্যাত মহাশোল খাননি। ওগুলো নাকি গারো পাহাড় থেকে নেমে আসে। সংসদ নেতা তাঁর বিশেষ সহকারীকে নির্দেশ দেন কংশ নদের একটি মহাশোল বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে।
ডিনারের পরে বিরোধীদলীয় নেতা ফোনে সংসদ নেতাকে ধন্যবাদ জানান। বলেন, মহাশোলে যে এত তেল জানতাম না। শুনেছি পাহাড়ি নদীর পাথর খেয়ে নাকি এ মাছ বড় হয়। ভেরি ডেলিশাস।
আর একদিন কিশোরগঞ্জের হাওরের দশাসই সরপুঁটি, পাবদা ও টাটকিনি এক ঝুড়ি পাঠায় কেউ বিরোধীদলীয় নেতার বাড়িতে। এসব বাঙালি মাছ এখন ঢাকার বাজারে দুষ্প্রাপ্য। তিনি তৎক্ষণাৎ তার অর্ধেক পাঠিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। এই যে একে অপরের বাড়িতে পছন্দের জিনিসটি পাঠানো—এ কোনো অস্বাভাবিক বা নতুন ব্যাপার নয়। এই তো ছিল বাঙালির জীবন! এসবই বাঙালির ঐতিহ্য। চিরকাল বাঙালির চরিত্রে যেমন প্রবল বিদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা ছিল, তেমনি অকৃত্রিম আতিথেয়তা ও ভালোবাসাও ছিল।
যাক গে! প্রথম দিকের কোনো অধিবেশনেই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সরকারি দলের এক সাংসদ যিনি অতীতে মার্ক্স-লেনিন-মাওবাদী বিপ্লবী ছিলেন, এখন আশুলিয়া-সাভার-জয়দেবপুরে অনেকগুলো ফ্যাক্টরির মালিক, শুধু বাড়িতেই তাঁর ব্যবহূত হয় চারটি গাড়ি, বললেন—মাননীয় স্পিকার, আমরা জনগণের প্রতিনিধি। তাদের দ্বারা নির্বাচিত। জনগণকে যা দিতে পারি আমরা সাংসদেরা শুধু তা-ই নেব। তার বেশি কিছু নেওয়ার নৈতিক অধিকার আমাদের নেই। তাদের দিনরাত সেবা করি বলে তাদের পকেট কাটতে পারি না। তা ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার আগে আমরা কেউ পথের মানুষ ছিলাম না। রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতাম না। আমাদের শুল্কমুক্ত গাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের মধ্যে যদি কেউ নির্বাচনের আগে নসিমন-করিমনে যাতায়াত করে থাকেন, এখনো তা-ই করবেন। যদি রিকশা-সিএনজিতে ঘুরে থাকেন, এখনো তা-ই ঘুরবেন। যদি তাঁরা আগে বাসে ঝুলে যাতায়াত করে থাকেন, এখনো তা-ই করবেন। যদি তাঁরা আগে নিজের গাড়িতে চড়ে থাকেন, সে গাড়ি বিক্রি করে দেননি, এখনো সেই গাড়িটিই ব্যবহার করবেন। নতুন গাড়ির দরকার নেই।
মাঝের সারির কোনো আসন থেকে কেউ একজন তাঁর বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে শুধু ‘মাননীয়’ ‘মাননীয়’ করলেন। কিছু শোনা গেল না। সমস্বরে সবাই টেবিল চাপড়াতে লাগলেন। সমর্থন এল সরকারি ও বিরোধী দলের থেকে। এই নৈতিক ও শুভবুদ্ধির প্রস্তাবে কে না সমর্থন দেবে? হাউসের শেষের সারির এক কোনায় পাগড়ি পরা দুই সাংসদ বসে ছিলেন। তাঁরা বললেন, মারহাবা, মারহাবা!
সাংসদদের কোটি কোটি টাকা দামের শুল্কমুক্ত গাড়ি পাওয়ার বিধান দশম সংসদে বাতিল হয়ে গেল। সারা দেশের মানুষ খুশি। একেই বলে জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের সেবক। তবে এবারই যাঁরা প্রথম নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীদের মনের অবস্থা কী তা বিধাতা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। কারও কারও শালা তার বোনকে বলল, বড়াপা/ছোড়দি, তোমার কপাল খারাপ। দুলাভাই/জামাইবাবু যদি নবম সংসদের এমপি হইতেন? আপা/দিদি বলেন, চিন্তা করিস না ঝন্টু, কত পথ খোলা আছে। তোর যে ঘন ঘন বেনাপোল আর বাংলাবান্ধা যাওয়া লাগে কী বিজনেসের কারণে, তোর কোনো সমস্যা হইব না। কান্তার বাবার নতুন গাড়ি নিয়াই যাইতে পারবি। কাস্টমসের লোকেরাও দেখবি তোরে এবার কেমন খাতির করে।
তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের বুক ভেঙে যায়। মুখে কিছু বলতে পারেন না, মনে মনে মাইকেলকে স্মরণ করেন—আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়!
বাংলার মাটি লোভ-লালসার লীলাভূমি। লোভে লোভে কলঙ্কিত জাতি। কলঙ্কিত অতীত নিয়ে দশম সংসদের সদস্যরা বড়ই বিব্রত। কারণ তাঁরা এবার অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো হয়ে গেছেন। এক অধিবেশনে ফ্লোর নিয়ে এক সাংসদ বলেন, মাননীয় স্পিকার, বাবা-মা, নিজের বা স্বামী-স্ত্রীর নামে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও আমাদের অনেক মাননীয়/মাননীয়া তথ্য গোপন করে ডিআইটির প্লট নিয়েছেন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পুরস্কার। এভাবে প্লট নেওয়া রাজউকের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এই সংসদের এমপি-মন্ত্রীরা কেউ সরকারি প্লট নেব না। এমপি হিসেবে সরকারি জমি নেওয়া ভূমি দখলেরই নামান্তর। আমাদের কেউ আইন প্রণয়নকারী ভূমিদস্য বলুক তা চাই না।
এই প্রস্তাবে নিঃসীম নীরবতা নেমে আসে গোটা হাউসে। আজিমপুর, মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা ও বনানীর বিশেষ জায়গার নীরবতা। বিষাদের ছায়া নামে সবার চোখে-মুখে। যিনি প্রস্তাব করছিলেন তিনি তা লক্ষ করেন। সহকর্মীদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, মাননীয় স্পিকার, আপনি জানেন যে পৌনে দুই বছর ধরে বলা হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ যেভাবে চলে বাংলাদেশও সেভাবেই চলবে। সেভাবেই সংসদ নির্বাচন হবে। তাই আমার অনুরোধ আপনি নিজে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, বেনেলুক্স দেশসমূহ এবং স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশ ও জাপানে ফোন করে জানুন তাদের এমপিরা সরকারি জমি উপহার পান কি না। যদি তাঁরা পান আমরাও নেব। যদি তাঁরা না পান তাহলে রাজউকের চেয়ারম্যান যদি পীড়াপীড়িও করেন তবু নেব না। দেশের বারো আনা মানুষ ভূমিহীন, গৃহহীন। আমরা পূর্বাচলেই হোক বা দক্ষিণাঞ্চলেই হোক কোনো প্লট নেব না।
হাউসের সবার চোখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে স্পিকার অধিবেশন পরদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত মুলতবি করেন।
পরদিনের অধিবেশনে কোরাম তো বটেই দেখা গেল সমস্ত হাউস পরিপূর্ণ। কী সিদ্ধান্ত হয় তা আমরা অগ্রিম এই কলামে লিখতে পারব না। ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের একটি বড় সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে সফরের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ থেকে আমন্ত্রণ এসেছে। সরকারি দলের সদস্যসংখ্যা ২১২। সংসদ নেতা এবং স্পিকার ২২ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করেন। তার অর্ধেক সরকারি দল থেকে, অর্ধেক বিরোধী দল থেকে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিরোধী দলের নেতাকে। অন্যান্য দেশের মতো অপজিশনের নেতাই পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানও।
পার্লামেন্টের সদস্যরা সব দেশেই অতি সম্মানের পাত্র। এলাকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, পাবলিক টয়লেট কমিটির চেয়ারম্যান হওয়া তাঁদের জন্য শোভন নয়। খাই খাই ভাবটা ভালো নয়। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের উপদেষ্টা হয়ে তাঁদের ওপরে ছড়ি ঘোরানোতে তাঁদের মর্যাদা বাড়ে না। স্কুল-কলেজ কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য এলাকাতেই বহু শিক্ষাবিদ আছেন। তাই দশম সংসদের এমপিরা শুধু আইনই প্রণয়ন করবেন, ছেলেমেয়েদের ভর্তি নিয়ে মাথাও ঘামাবেন না, টাকাও কামাই করবেন না।
যাঁরা খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পাতায় রচনা লেখেন, তাঁরা কখনো কোনো বিষয় খুঁজে না পেলে কত কী আবোলতাবোল চিন্তা করেন। ধারণা করছি দেশ সংবিধান অনুযায়ী রেলগাড়ির মতো দুর্বার গতিতেই ছুটে চলবে। তবে যা লিখলাম এ রকমই যদি হতো আমাদের দশম জাতীয় সংসদ!
সৈয়দ আবুল মকসুদঃ গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments