উপাচার্য পদটি মর্যাদা হারাচ্ছে by মেজর সুধীর সাহা (অ ব.)
উপাচার্য
হলেন গুরুর গুরু। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু সম্মানের পদটি
উপাচার্যের। যে কোনো দেশে শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, জাতীয় সব ক্ষেত্রেই
উপাচার্যদের জন্য বিশেষ একটি সম্মানের জায়গা রক্ষিত থাকে। বাংলাদেশেও তা
বহাল আছে কি-না, তা নিয়েই আজ লিখব। কোনোদিনই ভাবিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য নিয়ে লিখব। তারপরও বাধ্য হয়ে লিখছি। শুনেছিলাম, কলিতে নাকি সবই
উল্টো ঘটবে। ঘাট অঘাট হবে, আবার অঘাট ঘাট হবে। রাজনীতিতেও তো এই ঘাট-অঘাটের
বিস্তর নিদর্শন দেখছি। যার হওয়ার কথা ছোট্ট একটি মুদি দোকানের দোকানদার,
তাকেই হয়তো দেখা যাচ্ছে মস্ত বড় একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে। তাই বলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ে তো আর তেমন কোনো অসম্ভবের কথা ভাবা যায় না।
সমাজে তাদের সম্মানের জায়গাটি অত্যন্ত শক্ত হাতে গড়া। শুধু চাকরির সময়টিতে
নয়, বরং অবসরের পরও তাদের থাকে একটি স্থায়ী সম্মানের জায়গা।
সম্ভবত তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। শিক্ষক দত্ত বাবু আমার পাশে বসা ছাত্রটিকে বেত্রাঘাত করছিলেন। শিক্ষকের ভাষায়, ছেলেটি ভুল উত্তর দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, ছাত্রটি সঠিক উত্তর দিয়েছে। তাই শিক্ষক দত্ত বাবুকে কথাটা বলেছিলাম। ব্যস, সমস্ত রাগ এবার পড়ল আমার ওপর। বেদম বেত্রাঘাত করলেন আমাকে। রীতিমতো রক্ত বের হচ্ছিল। মনে মনে খুব রেগে গিয়েছিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বড় হয়ে শিক্ষক হব এবং স্যারের ছেলেকে পিটিয়ে এর বদলা নেব। সেই সময়ের একটি ছাত্রের জন্য এর বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। শিক্ষকের প্রতি সম্মান থেকেই এ পদ্ধতি সেই সময়ে ছিল। যখন আরেকটু বড় হয়েছি, তখন বন্ধু মোতালেব দুঃখ করে বলেছিল, অংকের শিক্ষক হালদার স্যার তাকে অংকে ফেল করিয়ে দিচ্ছেন বারবার। তাই মোতালেব ’আদু ভাই’। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গেও ছিল, আবার এখন আমার সঙ্গেও আছে। হয়তো এরপরও সে একই ক্লাসে থাকবে। মোতালেব হালদার স্যারকে রাস্তায় একা পেয়ে ধরবে এবং অপমান করবে- এমন আস্ফালন করেছিল আমার কাছে অনেকবার। প্রস্তুতিও নিয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু হালদার স্যারের কাছাকাছি গিয়ে একটি সালাম দিয়ে দ্রুত সরে পড়েছিল প্রতিবারই।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় হিন্দু হোস্টেলে সরস্বতী পূজার চাঁদা তোলার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর ধানমণ্ডি অঞ্চলে। অন্য দু’জন ছাত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একসময় গিয়েছিলাম তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায়। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে স্যারকে চাঁদার কথা বলাতে স্যার জানালেন, স্যরি, তোমরা এসেছ কিন্তু আমি তো ধর্মীয় কারণে পূজার জন্য চাঁদা দিতে পারব না। আমরা রীতিমতো লজ্জা পেয়ে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন স্যার আবার আমাদের ডাকলেন এবং বললেন, পূজার জন্য নয় বরং তোমাদের ওই উপলক্ষে আনন্দ করার জন্য আমি চাঁদা দিচ্ছি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর একদল মুক্তিযোদ্ধা কোনো এক উপাচার্যকে রাস্তায় পেয়ে অপমান করেছিল। ওই উপাচার্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তার এক মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র তাকে একটি থাপ্পড় মেরেছিল। বিষয়টি ছিল সে সময়ের টক অব দ্য টাউন এবং বিষয়টি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে পর্যন্ত রিপোর্ট করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ঢাকার অদূরের একটি স্কুলের শিক্ষককে জাসদের লোকজন গুলি করে হত্যা করেছিল। ওই শিক্ষকের জন্য সেই স্কুলের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় গড়াগড়ি করে কেঁদেছিল। প্রথম তিনদিন অনেক ছাত্রছাত্রী অভুক্তও ছিল।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই শিক্ষক নিয়ে এমন ধরনের গল্প ছড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের একটি বিশেষ সম্মানের স্থান স্বীকৃত ছিল সর্বত্র। সেই সম্মানের স্থানটি ধরে রাখতে শিক্ষকদেরও ছিল আন্তরিক প্রচেষ্টা। একজন সত্যিকারের শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানোর বিষয় ছাড়া আর কোনো অভিযোগ প্রদানের সুযোগ ছিল না। সেই শিক্ষকের মর্যাদা আজ আর সেই জায়গায় নেই। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরিতে আজ তারাই যাচ্ছে, যারা অন্যত্র কোনো চাকরি পাচ্ছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগে ঘটছে অপরিসীম দুর্নীতি। ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই আজ প্রবেশ করছে শিক্ষকের মতো একটি সম্মানের পেশায়। অযোগ্যতার কারণে শিক্ষকরা আজ ধরে রাখতে পারছে না তাদের সম্মানটুকু। অধিকাংশ শিক্ষক হয়ে পড়ছে রাজনীতির শিকার। রাজনীতিতে প্রবেশ করে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার মহান পেশায় কম সময় দিয়ে দলীয় রাজনীতির চর্চায় বেশি সময় দিচ্ছে।
২.
উপাচার্যের পদ সম্পর্কে পাঠকের কোনো ভুল ধারণা থাকার সুযোগ নেই। মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিক, চেয়ারম্যান-মেম্বার, ব্যবসায়ী যে কেউ হতে পারলেও উপাচার্য হতে হলে প্রয়োজন পড়ে একটি বিশেষ গুণের। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সেই গুণের বদৌলতে কেউ পেতে পারেন উপাচার্যের মতো এমন একটি সম্মানজনক পদ। কিন্তু সেই পদটির বর্তমান অবস্থা কী? পত্রপত্রিকার বদৌলতে পাঠকদের ধারণা আছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উপাচার্যের কী অবস্থা এখন। আজ একজন উপাচার্যকে গৃহে আটকে রাখা হচ্ছে, আগামীকাল অন্য একজন উপাচার্যকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা হবে, কোনো উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে, কোনো উপাচার্যকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে ইত্যাদি ঘটনা আজ আমাদের দেশের অসংখ্য খারাপ খবরের অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছে- ‘উপাচার্যের অপসারণ চাই’। শিক্ষকরা স্লোগান দিচ্ছে- ‘উপাচার্যের দুর্নীতি বা অপকর্মের শাস্তি চাই’। আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে, বিশৃংখলাকারী একদল উপাচার্যের পক্ষের লোক, অন্যদল অন্য শিক্ষকদের লোক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের কথাই বলছি। তারা সুখে নেই। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো না কোনো ঝামেলার শিকার হচ্ছেন।
কেন এমনটা হচ্ছে? শিক্ষকরা তাদের গুরুকে মানছে না কেন? ছাত্ররা তাদের শিক্ষকের ওপর মারমুখী কেন? সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনিই নিয়োগ দেন উপাচার্যদের। তবে কি সেখানেই গলদ? ভুল ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে? তারা কি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন? শিক্ষক বা ছাত্ররা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে? হয়তো সবক’টি প্রশ্নের উত্তরই ‘হ্যা’ হয়ে যাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে। একদল নিয়োগ পাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, আর অন্যদল তাদের বিরুদ্ধাচারণও করছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। খেলাটির শুরু ও শেষ দুটোই রাজনীতির কালচারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। উপাচার্যের মতো একটি সম্মানজনক পদে রাজনীতির বিবেচনায় নিয়োগ দিলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে- এটা সম্ভবত অন্য সবাই বুঝলেও দেশের রাজনৈতিক মহল বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। শিক্ষক হোক, সরকারি কর্মকর্তা হোক, সবাইকেই তাদের দলীয় লোক হতে হবে- এমন একটি অপরাজনীতির ধারণা থেকে এদেশের রাজনীতি বের হয়ে আসতে পারছে না।
যে কোনো দেশেই কতগুলো জায়গা থাকে যা বিতর্কের উর্ধ্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটিও তেমন একটি সম্মানজনক পদ, যা কোনো বিতর্ক কিংবা রাজনীতির ছোবলে পড়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আজ আমাদের দেশের অন্য সব জায়গার মতো এ পদটিও সম্মান ধরে রাখার মতো অবস্থান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যখন শুনি উপাচার্যকে আটকে রাখা হয়েছে, যখন শুনি উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন, যখন শুনি উপাচার্যের অপসারণে ছাত্র-শিক্ষক একজোট হয়ে তুলকালাম কাণ্ড করছে, তখন আর যা-ই হোক, কোনো পক্ষের ওপরই সম্মান ধরে রাখার ধৈর্য্য ধারণ করতে পারি না।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
সম্ভবত তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। শিক্ষক দত্ত বাবু আমার পাশে বসা ছাত্রটিকে বেত্রাঘাত করছিলেন। শিক্ষকের ভাষায়, ছেলেটি ভুল উত্তর দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, ছাত্রটি সঠিক উত্তর দিয়েছে। তাই শিক্ষক দত্ত বাবুকে কথাটা বলেছিলাম। ব্যস, সমস্ত রাগ এবার পড়ল আমার ওপর। বেদম বেত্রাঘাত করলেন আমাকে। রীতিমতো রক্ত বের হচ্ছিল। মনে মনে খুব রেগে গিয়েছিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বড় হয়ে শিক্ষক হব এবং স্যারের ছেলেকে পিটিয়ে এর বদলা নেব। সেই সময়ের একটি ছাত্রের জন্য এর বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। শিক্ষকের প্রতি সম্মান থেকেই এ পদ্ধতি সেই সময়ে ছিল। যখন আরেকটু বড় হয়েছি, তখন বন্ধু মোতালেব দুঃখ করে বলেছিল, অংকের শিক্ষক হালদার স্যার তাকে অংকে ফেল করিয়ে দিচ্ছেন বারবার। তাই মোতালেব ’আদু ভাই’। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গেও ছিল, আবার এখন আমার সঙ্গেও আছে। হয়তো এরপরও সে একই ক্লাসে থাকবে। মোতালেব হালদার স্যারকে রাস্তায় একা পেয়ে ধরবে এবং অপমান করবে- এমন আস্ফালন করেছিল আমার কাছে অনেকবার। প্রস্তুতিও নিয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু হালদার স্যারের কাছাকাছি গিয়ে একটি সালাম দিয়ে দ্রুত সরে পড়েছিল প্রতিবারই।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় হিন্দু হোস্টেলে সরস্বতী পূজার চাঁদা তোলার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর ধানমণ্ডি অঞ্চলে। অন্য দু’জন ছাত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে একসময় গিয়েছিলাম তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায়। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে স্যারকে চাঁদার কথা বলাতে স্যার জানালেন, স্যরি, তোমরা এসেছ কিন্তু আমি তো ধর্মীয় কারণে পূজার জন্য চাঁদা দিতে পারব না। আমরা রীতিমতো লজ্জা পেয়ে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন স্যার আবার আমাদের ডাকলেন এবং বললেন, পূজার জন্য নয় বরং তোমাদের ওই উপলক্ষে আনন্দ করার জন্য আমি চাঁদা দিচ্ছি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর একদল মুক্তিযোদ্ধা কোনো এক উপাচার্যকে রাস্তায় পেয়ে অপমান করেছিল। ওই উপাচার্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। তার এক মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র তাকে একটি থাপ্পড় মেরেছিল। বিষয়টি ছিল সে সময়ের টক অব দ্য টাউন এবং বিষয়টি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে পর্যন্ত রিপোর্ট করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ঢাকার অদূরের একটি স্কুলের শিক্ষককে জাসদের লোকজন গুলি করে হত্যা করেছিল। ওই শিক্ষকের জন্য সেই স্কুলের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় গড়াগড়ি করে কেঁদেছিল। প্রথম তিনদিন অনেক ছাত্রছাত্রী অভুক্তও ছিল।
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই শিক্ষক নিয়ে এমন ধরনের গল্প ছড়িয়ে আছে। শিক্ষকদের একটি বিশেষ সম্মানের স্থান স্বীকৃত ছিল সর্বত্র। সেই সম্মানের স্থানটি ধরে রাখতে শিক্ষকদেরও ছিল আন্তরিক প্রচেষ্টা। একজন সত্যিকারের শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানোর বিষয় ছাড়া আর কোনো অভিযোগ প্রদানের সুযোগ ছিল না। সেই শিক্ষকের মর্যাদা আজ আর সেই জায়গায় নেই। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের চাকরিতে আজ তারাই যাচ্ছে, যারা অন্যত্র কোনো চাকরি পাচ্ছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগে ঘটছে অপরিসীম দুর্নীতি। ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই আজ প্রবেশ করছে শিক্ষকের মতো একটি সম্মানের পেশায়। অযোগ্যতার কারণে শিক্ষকরা আজ ধরে রাখতে পারছে না তাদের সম্মানটুকু। অধিকাংশ শিক্ষক হয়ে পড়ছে রাজনীতির শিকার। রাজনীতিতে প্রবেশ করে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার মহান পেশায় কম সময় দিয়ে দলীয় রাজনীতির চর্চায় বেশি সময় দিচ্ছে।
২.
উপাচার্যের পদ সম্পর্কে পাঠকের কোনো ভুল ধারণা থাকার সুযোগ নেই। মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিক, চেয়ারম্যান-মেম্বার, ব্যবসায়ী যে কেউ হতে পারলেও উপাচার্য হতে হলে প্রয়োজন পড়ে একটি বিশেষ গুণের। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সেই গুণের বদৌলতে কেউ পেতে পারেন উপাচার্যের মতো এমন একটি সম্মানজনক পদ। কিন্তু সেই পদটির বর্তমান অবস্থা কী? পত্রপত্রিকার বদৌলতে পাঠকদের ধারণা আছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন উপাচার্যের কী অবস্থা এখন। আজ একজন উপাচার্যকে গৃহে আটকে রাখা হচ্ছে, আগামীকাল অন্য একজন উপাচার্যকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা হবে, কোনো উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে, কোনো উপাচার্যকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে ইত্যাদি ঘটনা আজ আমাদের দেশের অসংখ্য খারাপ খবরের অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছে- ‘উপাচার্যের অপসারণ চাই’। শিক্ষকরা স্লোগান দিচ্ছে- ‘উপাচার্যের দুর্নীতি বা অপকর্মের শাস্তি চাই’। আবার কোথাও দেখা যাচ্ছে, বিশৃংখলাকারী একদল উপাচার্যের পক্ষের লোক, অন্যদল অন্য শিক্ষকদের লোক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের কথাই বলছি। তারা সুখে নেই। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো না কোনো ঝামেলার শিকার হচ্ছেন।
কেন এমনটা হচ্ছে? শিক্ষকরা তাদের গুরুকে মানছে না কেন? ছাত্ররা তাদের শিক্ষকের ওপর মারমুখী কেন? সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনিই নিয়োগ দেন উপাচার্যদের। তবে কি সেখানেই গলদ? ভুল ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে? তারা কি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন? শিক্ষক বা ছাত্ররা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে? হয়তো সবক’টি প্রশ্নের উত্তরই ‘হ্যা’ হয়ে যাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে। একদল নিয়োগ পাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়, আর অন্যদল তাদের বিরুদ্ধাচারণও করছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। খেলাটির শুরু ও শেষ দুটোই রাজনীতির কালচারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। উপাচার্যের মতো একটি সম্মানজনক পদে রাজনীতির বিবেচনায় নিয়োগ দিলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে- এটা সম্ভবত অন্য সবাই বুঝলেও দেশের রাজনৈতিক মহল বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। শিক্ষক হোক, সরকারি কর্মকর্তা হোক, সবাইকেই তাদের দলীয় লোক হতে হবে- এমন একটি অপরাজনীতির ধারণা থেকে এদেশের রাজনীতি বের হয়ে আসতে পারছে না।
যে কোনো দেশেই কতগুলো জায়গা থাকে যা বিতর্কের উর্ধ্বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটিও তেমন একটি সম্মানজনক পদ, যা কোনো বিতর্ক কিংবা রাজনীতির ছোবলে পড়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আজ আমাদের দেশের অন্য সব জায়গার মতো এ পদটিও সম্মান ধরে রাখার মতো অবস্থান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যখন শুনি উপাচার্যকে আটকে রাখা হয়েছে, যখন শুনি উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন, যখন শুনি উপাচার্যের অপসারণে ছাত্র-শিক্ষক একজোট হয়ে তুলকালাম কাণ্ড করছে, তখন আর যা-ই হোক, কোনো পক্ষের ওপরই সম্মান ধরে রাখার ধৈর্য্য ধারণ করতে পারি না।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলামিস্ট
No comments