বঞ্চিত বীরাঙ্গনারা! by মাজেদুল নয়ন

বিজয়ের বেয়াল্লিশ বছর পার হলেও বীরাঙ্গনাদের অন্ধকার কাটেনি। সম্মান দিয়ে বীরের মর্যাদা দিতে পারেনি রাষ্ট্র। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে থাকতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের এ তরুণীরা সবার অগোচরে এখন বৃদ্ধা।
তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও স্বার্থপর দেশ তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদানে ব্যার্থ হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের ভাতা পেলেও বীরাঙ্গনাদের নেই কোনো সরকারি সাহায্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুবেলা খাবারের জন্যে হাত পাততে হচ্ছে তাদের। এমনকি সামাজিক স্বীকৃতিটিও হারিয়ে গেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর।
মুক্তিযুদ্ধে কতজন নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং কতজন গর্ভবতী হয়েছিলেন তা অনির্ধারিত। জানা যায়, সামাজিক অপবাদের হাত থেকে বাঁচতে অনেক নারীই আত্মহত্যা করেন। অসংখ্য গর্ভবতী নারী চলে যান ভারতে বা অন্য কোথাও গোপনে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য।

বিভিন্ন সময়ে বাংলানিউজের নেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে এসেছে বীরাঙ্গনাদের দুর্গতির কথা। বেসরকারি উদ্যেগে এবং ব্যাক্তিগত পর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের পাশে অনেকে দাড়ালেও সরকারিভাবে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেই।
বাংলানিউজের ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পূর্ব চন্ডিগ্রামে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা আলিফজান বিবির কথায় উঠে আসে হাহাকার।

সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবিরা আসি বেকত লাইন ধরি দাঁড় করায়, কুত্তা আসি তাগড় কামড় দিবার ধরে, ঠুস ঠাস গুলি করে...আমার মুই আসি চিক্কার দিলে তানারেও গুলি করে।’ সাচ্চা মুসলামান পরিচয় দিয়ে অন্যরা ছাড়া পেলেও আলিফজানকে ধরে রাখে হানাদাররা। এরপর আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় তাকে। বললেন, ‘যুদ্ধের পর মানুষ ছি ছি দিছে, আমার কি দোষ আছিলনি?’ নিজ ভাই-মাও তাকে লুকিয়ে লাখতেন। কারো সামনে আসতে দিতেন না।

ছোট মাটির ঘরে একা একা দিন কাটে এই বীরাঙ্গনার। শরীরে যতদিন শক্তি ছিল মানুষের বাড়ি কাজ করে খেত। কিন্তু এখন আর তাও পারেন না। ‘মাইনষ্যে যা-তা কইত, কাম দিত না।’

ওই প্রতিবেদনের পর নিয়মিত প্রতি মাসে এক মহানুভব ব্যাক্তির দেয়া আর্থিক সাহায্যে এখন কিছুটা স্বচ্ছল এ বীরাঙ্গণার জীবন।

এভাবেই কিছু কিছু ব্যাক্তিগত উদ্যেগে অভাবের তাড়নার মুখ ফোটা গুটিকয়েক বীরাঙ্গণা সাহায্য পাচ্ছে। কিন্তু সরকার দাড়ায়নি বীরাঙ্গণাদের পাশে।

একই বছরের ৯ ডিসেম্বর বাংলানিউজের কাছে একাত্তরের দূর্বিষহ স্মৃতিচারণ করেন সিরাজগঞ্জের আরেক বীরাঙ্গনা রাজু বালা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পাইছে। আমাদের জন্যে কে কি করছে?’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তার প্রশ্ন।

আরেক বীরাঙ্গনা রাজশাহীর সুফিয়া জানিয়েছিলেন, কিভাবে পাক সেনারা তার আট মাসের পেটের সন্তানকে হত্যা করেছে।


বাংলানিউজে ২০১২ সালের ২৮ মার্চের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে হাহাকার আর আতঙ্ক নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার দুর গ্রামে পড়ে থাকা ৯ জন বীরাঙ্গনার জীবন যাপনের কথা। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও জেলার অসীম সাহসী বীরাঙ্গনারা স্থানীয় প্রভাবশালী আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রোষের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন তারা।

শুধুই কি অভাব, ভিক্ষা করে জীবন চালায় তাদের অনেকে। সেই সঙ্গে রয়েছে অপমান আর লাঞ্চনা।

সামজিক সংগঠন নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪০ বছর হয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি সম্মান দেওয়ার কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যেগ নেওয়া হয়নি।’ মুক্তিযুদ্ধে নারী ধর্ষণকারী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব ছিল। কিন্তু এতো বছরেও করেনি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রকল্প ব্যবস্থাপক রণজিৎ কুমার বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেক বীরাঙ্গনা নারী। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত হয়েছিলেন পাকবাহিনী হাতে।
বিবাহিত মেয়েদের তাদের স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন তুলে নেয়নি। আবার যারা অবিবাহিত ছিল তাদের ভাগ্যে জোটে ‘মিলিটারির বৌ’-এর খেতাব।

তিনি বলেন, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় এ বীরাঙ্গনারা। মাসিক কিছু টাকা পেলে তারা অন্তত নিজেরা চলতে পারতো বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পরিবার হারা এসব বীরাঙ্গনাদের বয়স এখন বেড়েছে। লজ্জা ভেঙে এখন একটু সাহায্যের আশায় তারা মুখ খুলছে। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বা সংগঠন হয়তো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাদের কিছু সাহায্য করে। এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পাওয়া ‘ডাকটার: ডিপ্লোম্যাট ইন বাংলাদেশ বাই ড. ভিগো ওলসেন’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘যদিও হাজার হাজার হিন্দু নারীদের ধর্ষণের পরপরই হত্যা করা হয়েছিল, তবে কিছু সংখ্যক সুশ্রী রমণীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে । যদি কেউ পরনের কাপড় ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করত, তাহলে তাকে উলঙ্গ করে ফেলা হতো। কেউ যদি তাদের লম্বা চুল পেচিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করত, তবে তাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হতো।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত।কেননা দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাঁদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, “আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।”


১৯৭২ সালে বীরাঙ্গনাদের জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যেগে গঠন করা হয়েছিল ‘নারী পুর্নবাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’। কিন্তু জাতির জনকের হত্যার পর তা হারিয়ে গেছে।

৭২ সালে গঠিত নারী পুর্নবাসন বোর্ডের সদস্য লেখিকা নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটিতে বীরাঙ্গনা রীনার উক্তিতে বেরিয়ে আসে বিজয়ের সময় বীরাঙ্গনাদের অবস্থান।

বইটিতে নীলিমা ইব্রাহিমের বলেন, ‘বাংকার থেকে আমাকে যখন ভারতীয় বাহিনীর এক সদস্য অর্ধ উলঙ্গ এবং অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে তোলে তখন আশেপাশের দেশবাসীর চোখে মুখে যে ঘৃণা ও বঞ্চনা আমি দেখেছিলাম তাতে দ্বিতীয়বার আর চোখ তুলতে পারিনি। জঘন্য ভাষায় আমার দিকে তারা মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল।‘

বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে সরকারের কি পদক্ষেপ রয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবির আহাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘কারা করবে তাদের জন্যে? করার কথা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের, কিন্তু সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা কি আছে! সেখানে মন্ত্রী কিছুই জানেন না। মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে না থাকলে যা হয় আর কি!’

No comments

Powered by Blogger.