শেখ মুজিব যেভাবে ফিরে এলেন by খোমেনী ইহসান
মুসলিম লীগের হাত ধরে বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলমানদের যে শ্রেণী ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, যা পাকিস্তানের ২৪ বছরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ক্ষমতার নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল; তাতে করে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো আন্দোলন বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ জরুরি ছিল না।
যারাই যা কিছু করুক না কেন তার সব ফলাফলেরই একমাত্র অধিকারী হবে এ মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তার দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিব। হয়েছিলও তাই। মুক্তিযুদ্ধের পরে শেখ মুজিব বাংলাদেশের একমাত্র নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগও প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল।
এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একক নেতা হিসাবে মুজিব এবং আওয়ামী লীগ এ আন্দোলন ফলাফলের সবটুকুই নিজের করে নিতে পেরেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, ন্যাপ-মোজাফফর ইত্যাদি দল মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিপদ উত্তরণের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী হিসাবে ভূমিকা রেখেছে মাত্র। মধ্যবিত্তের যে চরিত্র মুজিব ও আওয়ামী লীগের একই চরিত্র। মোটা দাগে মধ্যবিত্ত মুক্তিযুদ্ধ করেনি। অসংখ্য লোক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছিল, তারও চেয়ে অনেক বেশি লোক ইন্ডিয়া আশ্রয় নিয়েছিল। এ মধ্যবিত্তের মধ্যে যুদ্ধে গেছে যারা, তারা নগণ্য সংখ্যকই মাত্র। একই কাজ মুজিবও করেছেন, তিনি যুদ্ধে যোগ দেননি, পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়ে নয় মাস নিরাপদে জেল খেটেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের খুব কমই যুদ্ধ করেছেন। তারা কলকাতা, আগরতলায় নিরাপদ জীবনযাপন করেছে। মাঠে যুদ্ধ করেছে কৃষক, শ্রমিক, স্বশস্ত্র কমিউনিস্ট আদর্শের যোদ্ধারা ও ছাত্ররা, ডাকাত, মাস্তান, লাঠিয়াল এবং বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যরা।
অথচ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রায় সব স্বীকৃতি, সুযোগ-সুবিধার ভাগীদার হয়েছিল এ মধ্যবিত্তরাই। এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ওঠার মাধ্যমে। মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা মতো বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। তাদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার দিকেই মনোযোগ দেয়া হয়েছে সংবিধানে। তাই প্রত্যক্ষ বাধা না আসার আগ পর্যন্ত এ মধ্যবিত্ত মুজিব ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন জুগিয়ে গেছে। কিন্তু আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও রুশিয় সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার ঠাণ্ডা লড়াই চলাকালে শেখ মুজিব নিহত হলেন। আওয়ামী লীগের কিছু লোক খুনিদের সাথে থাকলেও, বেশির ভাগই দিনের আলোতে তারকারাজির থাকার মতো লুকিয়ে থাকলো। মাঝখান থেকে শোকাহত মধ্যবিত্ত বাঙালি ধরেই নিল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুজিবও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
মধ্যবিত্তের এ শোক ব্যর্থ করে দিয়ে মুজিব আবার ফিরে এসেছেন। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হয়ে তিনি ফিরে এসেছেন। যে ফিরে আসাকে পুনরুত্থান বলা যায়। এখানে পাকিস্তান আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও আওয়ামী লীগের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বনে যাওয়ার কারণ স্মরণ করতে হবে। আমেরিকার পুঁজিবাদপন্থি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাসক হয়ে উঠতে স্বংকল্পবদ্ধ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মুরুব্বি খুঁজে পাওয়া প্রচণ্ড দরকার ছিল। এ বিবেচনায় রুশিয় সাম্রাজ্যবাদ ও রুশ ঘেষা ইন্ডিয়ার কংগ্রেসি শাসকরাই ছিল তাদের সামনে একমাত্র বিকল্প। এ বিকল্পের কাছে আস্থাভাজন হওয়ার স্বার্থে তারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিচয় ছেড়ে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নৌকায় চেপেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ দেখলো যে, ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের জাতীয়তাবাদকে জিয়া ও এরশাদ বাংলাদেশে আবারো এমন গণভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন যাকে পরবর্তীতে আর কেউ উপেক্ষা করতে পারেনি এতকাল। এমনকি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগকেও শ্লোগান দিতে হয় ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’ ইত্যাদি।
এ ধর্মীয় জাতীয়তার পরিচয়কে সামনে রেখে রাজনীতির পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার হয়। এ জোটের আরো দুই সহযোগী ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী ঐক্যজোট। মুসলিম জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে এ দলগুলো জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতায় এলেও ততদিনে দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম প্রশ্নে এক নয়া মেরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। নয়-এগারোতে আমেরিকার বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের যমজ দালানে দুই দুইটা যাত্রীবাহী বিমান ‘হামলা’ হলো ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। এ ‘হামলা’র জন্য ‘আল-কায়দা’ বলে এক অদৃশ্য শক্তিকে দায়ী করে, তাদের দমনের নাম করে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকা। আর দুনিয়ার সব মুসলমান শাসকদের মতো বাংলাদেশের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারও এ যুদ্ধকে সমর্থন করে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীসহ গণতন্ত্রপন্থি সব ইসলামী দলও আমেরিকা বর্ণিত অদৃশ্য শক্তি আল-কায়দা ও ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কার্যত এ ‘সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধে’র পক্ষে জোরালো সমর্থন যোগায়।
আমেরিকা সারা দুনিয়াতেই ইসলামকে ‘জঙ্গি ইসলাম’ ও ‘মডারেট ইসলাম’ নামে ভাগ করে। ওয়ার অন টেররকে সমর্থনকারী ইসলামপন্থিরা নিজেদের ‘মডারেট মুসলমান’ তালিকাভুক্ত বলে ঘোষণা দেয়, আর বিরোধিতাকারীদের জঙ্গি মুসলমান বলে আখ্যা করে। বাংলাদেশে মডারেট ইসলামই দৃশ্যমান থাকায় এ দেশটিকে ‘মডারেট মুসলিম কান্টৃ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় আমেরিকা। কিন্তু ততদিনে দেখা গেল ‘জেএমবি’র নামে দেশের উত্তরাঞ্চলের এক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে ‘শায়খ আব্দুর রহমান’ ও ‘বাংলা ভাই’- এর নেতৃত্বে, স্বশস্ত্র কমিউনিস্ট দমনের নামে। ‘জেএমবি’র নামে সারা দেশে একযোগে পাঁচ শতাধিক জায়গারও বেশি জায়গায় হালকা ককটেল কিসিমের বিস্ফোরক ছড়ানো হলো। কিছু ফুটলো, কিছু ফুটলো না। এর আগে ও পরে দেশের কয়েকটি নিম্ন আদালতে বোমা হামলা হলো। কয়েকজন বিচারককে এভাবে খুন করা হলো। তামাম দুনিয়াজুড়ে যখন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলছে সাম্রাজ্যের নেতৃত্বে, তখন জিহাদের নামে এখানে ককটেল-বোমা হামলা হওয়ায় বাংলাদেশ খুব সহজেই এ যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠলো। দেখা গেল জন-চৈতন্যে আলেম-ওলামাদের ব্যাপারে ব্যাপক সন্দেহ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বাস-ট্রেন-লঞ্চে কালো ব্যাগসহ কোনো ‘হুজুর’ যাত্রী হলে তার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তাকে সম্ভাব্য বোমা হামলাকারী হিসেবে ভাবা হচ্ছে। বোমা হামলার জন্য নাগরিকরা দেশে দৃশ্যমান ইসলামপন্থি দলগুলোকে দায়ী মনে করল না। বরং তারা যে ‘জিহাদি ইসলাম’ বিরোধী ‘মডারেট ইসলাম’-এর অনুসারী, এটাই তারা ধরে নিল।
‘জেএমবি’র উত্থানের সঙ্গে বিএনপির কিছু মন্ত্রী-এমপি ও জেলা পর্যায়ের নেতার জড়িত থাকার খবর, তথ্য প্রমাণসহ রটে যাওয়ায় ধারনা তৈরি হলো যে এদের মদদদাতা বিএনপি। এটা মানুষ ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করলো। যে বিশ্বাসের পেছনে কাজ করে কোনো সরকারের সময় ঘটে যাওয়া যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ওই সরকারকেই কর্তা মনে করার প্রবণতা। জেএমবি’র হামলার দায়-দায়িত্ব বিএনপির কাঁধে চাপায় ও ২১ আগস্টের শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার বিষয়ে বিএনপি সরকার স্পষ্টত অবিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করায় আওয়ামী লীগের বাইরের সাধারণ মধ্যবিত্তের মধ্যেও ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতির ব্যাপারে অনিরাপত্তাবোধ তৈরি হতে শুরু করলো সন্ত্রাসবিরোধী চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
এরপর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ঘটে গেল ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ছদ্মবেশের সামরিক অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা এবং শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির অভিযোগে জেলে গেলেন সে সামরিক সরকারের আমলে। তাদের জেলে নিয়ে গেলেও তখনকার কার্যত রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমেদ বুঝতে পারলেন কত বড় বিপদে তারা জড়িয়ে পড়েছেন। অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তার ও তার অধীস্থ সেনা কর্মকর্তাদের জীবনই হুমকিতে পড়ে গেল। যতই ব্যাখ্যা দেয়া হোক, আইনি ব্যবস্থা তাদের জন্য রেহাই পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তখন তারও প্রয়োজন পড়লো শান্তিপূর্ণভাবে রেহাই পাওয়ার অবলম্বন। তার এ অবলম্বন ছিল শেখ মুজিব। তাকে তিনি জাতির পিতা বলে স্বীকার করলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত সাবেক সেনাকর্তাদের তিনি দাওয়াত করে নিয়ে গেলেন সেনানিবাসে। সেখানে শলা-পরামর্শ করে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারকে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত করার দায়িত্ব দিলেন তাদের। সাবেক সেনাকর্তারা দলমত নির্বিশেষে যতই ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচার দাবি করতে শুরু করলেন ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন শেখ মুজিব। এদিকে সামরিক সরকারের কর্মকাণ্ড মানুষকে স্বস্তি লাভের কোনো ব্যবস্থা করতে পারে নাই। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। ছাত্ররা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ করলো ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট। জবাবে ছাত্র-শিক্ষকরা সেনাবাহিনীর হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হলেন।
সবমিলিয়ে যা পরিস্থিতি দাঁড়ালো মানুষের মধ্যে; একটা পরিবর্তন ভাবনা তৈরি হলো। জেএমবি বোমা, ওয়ার অন টেরর, জরুরি অবস্থা, সেনাশাসন ও বেহাল অর্থনীতির অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির একটা উপায় খুঁজতে হলো তাদের। তাদের এ খোঁজাখুঁজির তাগিদ তৈরি করার পরে গণমাধ্যমগুলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী’ ব্যাপারগুলো তুমুল প্রচারণা শুরু করলো। জাতীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো, বিশেষত মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এ দলে যোগ দিল। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রচারণা শুরু হলো। এমন আবহ তৈরি করা হলো যে, স্বাধীনতার পর থেকে এযাবত দেশের যত যে ব্যাথা, যত হতাশা আর সকল দুঃখের কারণ এরা; আর হালের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এর বিহিত করা চাই।
সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও দলটির বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা গণমাধ্যম-কোম্পানি-সাবেক সেনাকর্তাদের প্রচারের ফসল তুলে নেবার ভাণ্ড হিসেবে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শকে জনগণের সামনে বিকল্প হিসেবে হাজির করলো। ঠিক এখানটাতে এসে দেখা যাচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ওপর আওয়ামী লীগের দলের বাইরেও বিএনপি-জামায়াত বা অন্য অন্য দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে- উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানসে প্রচুর সমর্থন তৈরি হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষার ডাক নামে, অন্য নামে কিম্বা বেনামে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র বামপন্থিদের বাইরে বাকিরা এ ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিজ নিজ দলের শ্লোগানে মুড়িয়ে জায়েজ করছেন। নারাজি পোষণ করতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।
তার মানে এ নয় যে; কৌম সমাজের থেকে বেরিয়ে ‘সেকুলার’ (জাগতিক) ও পুঁজির বাজারে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি মানে ভোক্তা হয়ে ওঠার বাসনা থেকে, কিম্বা রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে ‘সেকুলারিজম’ (জাগতিকাবাদ) এর মধ্যে রাষ্ট্র চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবাই। সে সিদ্ধান্ত থেকে এ সমর্থন আসে নাই।
খেয়াল রাখা জরুরি; এ সমর্থন এসেছে এবং আসছে আসলে দুনিয়াজুড়ে ‘সন্ত্রাস’ এর বিরুদ্ধে সাম্রজ্যের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশে কোনো বাঙালি জাতীয়তাবাদী, মুসলিম জাতীয়তাবাদী কিম্বা বামপন্থি বা ইসলামপন্থিরা; কেউই আর সাম্রাজ্যের সামনে কোনো ন্যূনতম ইসলাম বা মুসলিম ডাকনামের পরিচয় নিয়ে থাকতে ইচ্ছুক না। এ অনন্ত যুদ্ধ যাদের বিরুদ্ধে বলে মনে হয় অনেকের, সে ইসলামপন্থি নামওয়ালারাও সাম্রাজ্যের সংজ্ঞায়নের মধ্যে নিরাপদ শ্রেণীতে ‘মডারেট ইসলামপন্থি’ শ্রেণীতে নিজেদের তালিকভুক্ত করতে ব্যস্ত। সাম্রাজ্যের মানদণ্ডের তলায় তারা নিজেরা সমর্পিত হয়েছে। সাম্রাজ্যের এবং সে সুবাদে বাংলাদেশে সাম্রাজ্য স্বার্থের প্রতিনিধি ও দালালদের সামনে কোনো মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানই আর এমন কোনো জীবনযাপন বা রাজনীতি পছন্দ করতে পারছে না; যে জীবনযাপন ও রাজনীতি সাম্রাজ্যপসন্দ সংজ্ঞার বাইরে যায়।
ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এ সুযোগ নিচ্ছে। জঙ্গিদের বোমা হামলার মধ্যে জনপরিসরে এ কেন্দ্রীক সক্রিয়তা শুরু করেছিল দলটি। শেখ হাসিনা তার পিতার ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গাটাকে কায়দা করে ওয়ার অন টেররের মডারেট ইসলামের সাথে জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রায় পুরো সময়টা ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নানা সুবিধা তৈরি করে দিয়ে আসতে থাকা বামপন্থিরা তো বটেই, বাংলাদেশে যারা নিজেদের নাস্তিক বলে প্রচার করতেন তারাও ‘জঙ্গি ইসলামে’র বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ‘শান্তির ইসলাম’র পক্ষে কথা বলে চলেছেন। ইসলাম ও মুসলিম ডাকনামের বিপদ থেকে বাঁচতে শেখ মুজিবের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র একুশ শতকের হাসিনা-সংস্করণ এখন বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তদের বেশ কাজে আসছে। যাদের জীবনধারা, নাগরিকতা, সামাজিক সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার মধ্যে শেখ মুজিবই হয়ে উঠেছেন প্রকৃত নায়ক।
খোমেনী ইহসান: সাংবাদিক
ইমেইল: khomenee.ehsan@gmail.com
No comments