তিন সংস্থার সোর্স এই মোস্তাফিজঃ আমিনুলকে ডেকে নেওয়া মোস্তাফিজেরও খোঁজ নেই by গোলাম মর্তুজা
মোস্তাফিজুর রহমানকে সবাই শ্রমিক হিসেবে জানলেও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, তিনি ছিলেন একাধারে তিনটি সংস্থার সোর্স। শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার পর থেকেই তাঁর সহকর্মীরা বলে আসছেন, মোস্তাফিজ তাঁকে ডেকে নিয়ে গেছেন। আর আমিনুলের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মোস্তাফিজের খোঁজ নেই।
টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বর্তমানে আমিনুল হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আমিনুল হত্যার আগে-পরে মোস্তাফিজুরের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ হয়েছিল, তাঁদের অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), শিল্প পুলিশ ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু মোস্তাফিজুরকে না পাওয়ায় তদন্ত থমকে আছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সংগঠক এবং শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের নেতা আমিনুল ইসলাম গত ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হন। পরদিন পুলিশ তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ পায় টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ঘাটাইল থানা এলাকায়। ৭ এপ্রিল পরিবার পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করে। কিন্তু ততক্ষণে বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কবরস্থানে লাশ দাফন হয়ে গেছে। ৯ এপ্রিল তাঁর লাশ কবর থেকে তুলে বসতবাড়ির আঙিনায় আবার দাফন করা হয়।
মোস্তাফিজ যোগসূত্র: আমিনুলের সহকর্মী ও তাঁর কর্মস্থলের আশপাশের এলাকার লোকজন বলেন, ৪ এপ্রিল দুপুরে আমিনুল আশুলিয়ার মধ্য গাজীরচটে বিসিডব্লিউএসের কার্যালয়ে যান। সন্ধ্যায় পাশের খন্দকারবাড়ি মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পুলিশের গাড়ি দেখে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি মাগরিবের নামাজ আদায় করে কার্যালয়ে ফিরে এক সহকর্মীকে তিনি বিষয়টি জানান। একই সময় ওই এলাকায় আসেন ‘শ্রমিক’ মোস্তাফিজুর। তাঁর সঙ্গে একজন নারী ছিলেন। আমিনুল তাঁর সহকর্মীকে বলেছিলেন, মোস্তাফিজ ওই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে তাঁর সাহায্য চেয়েছেন। আমিনুল চাকরির পাশাপাশি বিয়ে পড়াতেন।
এলাকার লোকজন বলেন, সন্ধ্যার পর আমিনুল একটি রিকশায় আর মোস্তাফিজ ও মেয়েটি অন্য রিকশায় চেপে জিরানীবাজারের দিকে রওনা দেন। এরপর আর জীবিত আমিনুলের দেখা মেলেনি। পরদিন তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ মেলে।
মোস্তাফিজুর নিখোঁজ! আমিনুলের লাশ শনাক্ত হওয়ার পর আশুলিয়া, ডেন্ডাবর এলাকায় আর মোস্তাফিজুরকে দেখা যায়নি। গত ১২ জুন মোস্তাফিজুরের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার রাধানগরের কাধিরপাড়া গ্রামে যান প্রথম আলোর মাগুরা প্রতিনিধি। তখন মোস্তাফিজুরের বৃদ্ধ বাবা শমসের মল্লিক জানান, ২০-২৫ দিন আগে মোস্তাফিজুর গ্রামের বাড়িতে এসে কয়েক দিন থেকে চলে যান। ঢাকায় মোস্তাফিজ কোথায় থাকেন, বিয়ে করেছেন কি না, কিছুই তিনি জানেন না। মোস্তাফিজুরের খোঁজে পুলিশের দলও একাধিকবার এলাকায় গিয়েছে। স্থানীয় থানাকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
আশুলিয়া, ডেন্ডাবর, জিরানীবাজার এলাকার শ্রমিকেরা মোস্তাফিজুরকে চিনতেন। তাঁদের কয়েকজন বলেছেন, যারা আমিনুলকে গায়েব করেছে, তারা মোস্তাফিজুরকেও গায়েব করে দিতে পারে। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টিকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে তাঁদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
বিসিডব্লিউএসের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ৪ এপ্রিল আমিনুল নিখোঁজ হওয়ার রাতেই তাঁরা মোস্তাফিজুরকে ফোন করে তাঁর সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তখন মোস্তাফিজুর বলেছিলেন, তিনি এক রিকশায় আর আমিনুল আরেক রিকশায় জিরানীবাজার যাচ্ছিলেন। তিনি জিরানীবাজার পৌঁছে দেখেন আমিনুল নেই।
সর্বশেষ ১০ এপ্রিল মোস্তাফিজুরের সঙ্গে বিসিডব্লিউএসের কর্মীদের মুঠোফোনে কথা হয়। আমিনুলের দাফন ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তাঁরা মোস্তাফিজুরকে আসতে বলেন। কিন্তু মোস্তাফিজুর আসেননি। এর পর থেকেই তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ।
তিন সংস্থার সোর্স মোস্তাফিজুর: মোস্তাফিজুর একসময় সাউথ কুইন্স টেক্সটাইলের শ্রমিক ছিলেন। ২০০৯ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর আর কোথাও চাকরি করেছেন বলে জানা যায়নি। তবে তিনি নিজেকে শ্রমিকনেতা হিসেবে দাবি করতেন।
মোস্তাফিজুর সাভারের ডেন্ডাবর এলাকায় থাকতেন বলে তাঁর সহকর্মী শ্রমিক ও পুলিশ জানিয়েছে। অবশ্য ডেন্ডাবরের কোথাও তাঁর বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, মোস্তাফিজ একজন শ্রমিক, এই ধারণা নিয়েই তাঁরা তদন্ত শুরু করেন। মোস্তাফিজুরের ছয়টি মুঠোফোন নম্বর (বর্তমানে বন্ধ) বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, তাঁর সঙ্গে এনএসআই, শিল্প পুলিশ ও বেপজার নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্র ধরে বেপজার মেজর পদমর্যাদার একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা জানতে পারেন, বেপজার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী হিসেবে মোস্তাফিজুরকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো। পরে এনএসআই ও শিল্প পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, মোস্তাফিজুর এনএসআই ও শিল্প পুলিশের সোর্স ছিলেন।
টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এ কে এম হাফিজ আখতার বলেন, মোস্তাফিজুরের সঙ্গে এনএসআই, শিল্প পুলিশ ও বেপজার যেসব কর্মকর্তার যোগাযোগ ছিল, তাঁদের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে।
তদন্ত: লাশ উদ্ধারের বিষয়ে ৪ এপ্রিল ঘাটাইল থানার উপপরিদর্শক শাহীন মিয়া ওই থানাতেই একটি হত্যা মামলা করেন। কয়েক দিন পর মামলার তদন্তভার পান টাঙ্গাইল জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপপরিদর্শক দুলাল হোসেন। গত ২২ মে থেকে মামলা তদন্ত করছেন জেলা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবীর আকন্দ।
হুমায়ুন কবীর আকন্দ বলেন, ২০ মে মামলার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিন মাসে অন্তত ৩০ বার তিনি ঢাকা, আশুলিয়া, ইপিজেড এলাকায় এসেছেন। মাগুরার শ্রীপুরে মোস্তাফিজুরের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও তাঁর খোঁজ মেলেনি।
এসপি হাফিজ আখতার বলেন, মোস্তাফিজুর যাতে দেশের বাইরে চলে যেতে না পারেন, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যাদের ন্যূনতম সন্দেহ হচ্ছে, তাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সন্দেহের ভিত্তিটা কী জানতে চাইলে এসপি বলেন, তদন্তের স্বার্থে অনেক কথা বলা যাবে না। তবে মোস্তাফিজকে না পাওয়া পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব মিলবে না।
No comments