ব্যবসা প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ১০ ধাপ পিছিয়েছে দেশ

ব্যবসায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দিক থেকে বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১১৮। এ ক্ষেত্রে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ১০ ধাপ। ২০১১ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৮তম।

বিশ্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১২-তে বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশ্বের ১৪৪টি দেশে একযোগে গতকাল বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ১৪৪টি দেশের ১৪ হাজারের বেশি মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীর ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। বাংলাদেশের ৮৭ জন ব্যবসায়ী এতে অংশ নেন। গবেষণায় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশেরই অবনমন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা পিছিয়েছে ১৬ ধাপ, পাকিস্তান ছয় ধাপ, ভারত তিন ধাপ। শুধু নেপালই তার আগের অবস্থান (১২৫তম) ধরে রেখেছে। আর গত বছরের মতো শীর্ষ দুই স্থানে আছে সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। এর পরের তিনটি স্থান ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডের।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে প্রতিবেদনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সঙ্গে ছিলেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৪ ধাপ পিছিয়েছিল। তার পর এটাই সর্বোচ্চ অবনমন। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কিছুটা উন্নতি হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাঁচ ধাপ এগিয়ে যায়। এসব তথ্য উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা হাঁটি হাঁটি করে এগোচ্ছিলাম। কিন্তু এবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চল হয়ে গেছি। উন্নতির যে ধারাবাহিকতা চলছিল, তাতে ছেদ পড়ে কি না, এখন সে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ১০ ধাপ পেছানোকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় অবনমন উল্লেখ করে বলেন, ‘যদিও আমাদের অবস্থান পেছনে থাকত, তবু আমাদের স্কোর একটু একটু করে বাড়ছিল। আমরা নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এবার স্কোরও কমেছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২তম। এবার দাঁড়িয়েছে ১২৭-এ। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ৭৫তম থেকে নেমে হয়েছে ১০০তম। পণ্য ও শ্রমবাজারের দক্ষতায় অবনমন হয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ১৭ ধাপ। অর্থনৈতিক বাজার উৎকর্ষে অবনমন হয়েছে ২৮ ধাপ। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বাজার সৃষ্টিতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে এ দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে ১৬টি বড় সমস্যা। এগুলো হলো দুর্বল অবকাঠামো, দুর্নীতি, বিনিয়োগের জন্য অর্থ না পাওয়া, নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, করহার, শিক্ষিত কর্মীর অভাব, করব্যবস্থার জটিলতা, অপরাধ, উদ্ভাবনী দক্ষতার অভাব, শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা, দুর্বল জনস্বাস্থ্য সেবা।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনুধাবন: ২০১২ সালে দেশের অর্থনীতি কেমন যাবে—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল দেশের ব্যবসায়ীদের। তাঁদের ৩৬ শতাংশ উত্তর দিয়েছেন, ভালো যাবে। একই প্রশ্ন গত বছরের জরিপেও করা হয়েছিল। তখন ব্যবসায়ীদের ৬৪ শতাংশ বলেছিলেন, ভালো যাবে। ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, ২০১১ সালের বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ খুব একটা কার্যকর ছিল না।
পাল্টেছে দুর্নীতির ধরন: প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির মধ্যে অলিখিত লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ ধরনের সিদ্ধান্ত পেতেই এমন লেনদেন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার, নাগরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবে বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হচ্ছে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট নীতি ভালো অবস্থানে নেই।
রাজনীতিকদের ওপর আস্থা কমেছে: প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিকদের ওপর ব্যবসায়ীদের আস্থা সব সময়ই কম। এবার আস্থা আরও কমেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ীই এমন মত দিয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আস্থা খুব খারাপ থেকে সবচেয়ে খারাপে নেমে গেছে। এ ছাড়া আয়বৈষম্য দূরীকরণে সরকারি পদক্ষেপ খুবই দুর্বল। পুলিশি সেবার ওপরও আস্থা কমেছে।
আর্থিক খাত: প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্বল আর্থিক সুশাসন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দুর্বল তদারকি, আর্থিক খাতের অনিয়মগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব দেশের আর্থিক খাতের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থবাজারের উৎকর্ষ খুবই দুর্বল। বিনিয়োগের জন্য ঋণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না। স্টক মার্কেটে শেয়ার ছেড়ে অর্থ জোগাড় করা খুবই কঠিন।
করণীয় কী? প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা ফেরাতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও আর্থিক খাতের সক্ষমতা আগের অবস্থায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতি নীতিমালা করা, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোর সময়মতো বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দিতে হবে।
সিপিডির ত্বরিত মতামত জরিপ: সিপিডির ত্বরিত মতামত জরিপে বলা হয়, ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বল ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তিত। ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী চিন্তিত ব্যবসার জন্য ঋণ না পাওয়া নিয়ে। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। ৭২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।
৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসায় ব্যয় বেড়েছে। আগের বছর ২৬ শতাংশ ব্যবসায়ী এ মত দিয়েছিলেন। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার ব্যবসার ব্যয় বাড়াচ্ছে, এমন মত ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর। আগের বছর এ মত দিয়েছিলেন ১৮ শতাংশ ব্যবসায়ী।
আলোচনা: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য অর্থ পাওয়াই এখন ব্যবসায়ীদের বড় সমস্যা। দুর্নীতি বাড়ার যে প্রবণতা ছিল, সেটা স্থিতিশীল হচ্ছে। দুর্নীতির সূচকগুলো খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হচ্ছে। আর্থিক খাতে দক্ষতার অভাব রয়েছে। পুঁজিবাজারে লুটপাট হয়েছে। ব্যাংকিং খাতেও সমস্যা রয়েছে। তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা যদি বাড়ে, আর্থিক খাতের দুর্বলতাসহ অন্য দুর্বলতাগুলোও বেড়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.