সংবাদ বিশ্লেষণঃ একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত, একের পর এক কেলেঙ্কারি by শওকত হোসেন
আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে ২০০৯ সালের শুরুতে। এরপর চলে গেল সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়। একটু পেছনে ফিরে তাকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেখবেন যে, তাঁর দায়িত্বের সময় বড় ধরনের চারটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। যেমন: ২০১০ সাল ছিল শেয়ার কেলেঙ্কারির বছর; ২০১১ সাল পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির বছর; ২০১২ সালের শুরুটা হয়েছিল ডেসটিনি কেলেঙ্কারি নিয়ে; কিন্তু এর রেশ না কাটতেই শুরু হলো হলমার্ক কেলেঙ্কারি।
এবারের শেয়ার কেলেঙ্কারি ছিল দেশের সবচেয়ে বড়, যা ১৯৯৬ সালকে ছাড়িয়ে যায়। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের ঘটনা বিশ্বে আর কোথাও হয়নি। অর্থের পরিমাণ বিচারে হলমার্ক কেলেঙ্কারিও দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সব কটি কেলেঙ্কারিই অর্থনীতিসংক্রান্ত। এসব কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব সরকারেরই। কোনোটিই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, বরং সরকারের মধ্যে সাধারণ প্রবণতা ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি বা জালিয়াতির খবর অস্বীকার করা। এ কারণে একদিকে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, অন্যদিকে কেলেঙ্কারির নায়কেরা উৎসাহ পেয়েছেন। এতে কেলেঙ্কারি আওতার বাইরে চলে যায়।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়েও এখন অনেক ঘটনা দেখা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। এসব কথাবার্তায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বরং বেড়েছে। অর্থমন্ত্রীর কিছু পদক্ষেপেও সংশয় বেড়েছে। কেলেঙ্কারির দায় যাঁদের ওপর বর্তায়, তাঁদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কারও দেওয়া হচ্ছে। ফলে অনেকেরই ধারণা, দায়ী এবং নিরীহ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার চাকরি চলে গেলেও হলমার্ক গ্রুপের কিছুই হবে না। বাইরে থেকে যাঁরা হলমার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করার সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করেছেন, তাঁরাও থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অর্থমন্ত্রী গত মঙ্গলবার বললেন, তিন বা চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু নয়। গতকাল আবারও একই কথা বললেন তিনি। তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের দেওয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চার হাজার কোটি টাকা সামান্য। এ নিয়ে গণমাধ্যম বাড়াবাড়ি করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে যে প্রতিবেদন পাঠায়, তাকেও এখতিয়ারবহির্ভূত বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আবারও উৎসাহ পেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেন যে, তিনি এভাবে বললে দুর্নীতি হয়তো উৎসাহিত হয়।
এটা ঠিক যে অর্থমন্ত্রীর একার পক্ষে সশরীরে গিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্ত করা সম্ভব নয়। এ জন্য নির্দিষ্ট সংস্থা আছে। যেমন: শেয়ারবাজারের জন্য আছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। যদিও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য এসইসি নিজেও দায়ী ছিল। ব্যাংক খাত দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরও দায় বর্তায়। তবে এককভাবে এই দায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে পুরোপুরি চাপানো ঠিক হবে না। কারণ, অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দেখভালের দায়িত্ব নিজেই দিয়েছেন তাঁর মন্ত্রণালয়ের নতুন বিভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথমবারের মতো ব্যাংকিং বিভাগ চালু হয়েছিল। পরে আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং বিভাগ বাতিল করে একে আবারও ব্যাংকিং অনুবিভাগে রূপান্তর করা হয়েছিল। অথচ এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই আবার তৈরি করল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত শাসনের উদ্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর পরিদর্শন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ ক্ষমতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। তাই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা তাকিয়ে থাকেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর। একই পরিস্থিতি পর্ষদের ক্ষেত্রেও। পর্ষদ নিয়োগ দেয় সরকার। এখানেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
ব্যাংক দেখভাল করার কোনো দক্ষতা ও যোগ্যতা ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেই। বরং বিভাগটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ যেমন: ঋণ অনুমোদন, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে তদবিরের একটা বড় জায়গা হয়ে গেছে। এই বিভাগটি অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়াই হবে সঠিক কাজ। অর্থমন্ত্রী এই কাজটি করবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম প্রথম থেকেই বলে আসছেন, এই বিভাগের আদৌ প্রয়োজন নেই। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে গতকাল তিনি আবারও একই কথা বললেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর বিমা খাতের জন্য তৈরি হয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। সুতরাং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রয়োজনই নেই।
আগের আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো অর্থনীতিবিদেরা। আর বর্তমান পরিচালকদের তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগের নিম্ন ও মধ্যম সারির নেতা-কর্মী। যাঁদের ব্যাংক সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই, আছে কেবল তদবির ও দুর্নীতি করার ক্ষমতা। দলের নেতা-কর্মীদের পুরস্কার দেওয়ার প্রবণতার কারণে গভীর সংকটে পড়ে আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংক।
পর্ষদের কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো যে সংকটে পড়বে, সেই আশঙ্কা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারিই অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে পর্ষদ পরিবর্তনের সুপারিশ করে গভর্নর লিখেছিলেন, ‘ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বদলি ও পদোন্নতি ইত্যাদিতে পর্ষদের সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করছেন।’ সেই চিঠি আমলে নেওয়া হয়নি। বরং পর্ষদের সদস্যদের ডেকে এনে বৈঠক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই বৈঠকে একাধিক পর্ষদ সদস্য অর্থমন্ত্রীর সামনেই গভর্নরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী কিছুই বলেননি। সে সময় গভর্নরের চিঠি আমলে নেওয়া হলে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৬(৬) ধারায় বলা আছে, ‘সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট কোন প্রতিবেদন পেশ করিলে সরকার উহা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করিবে।’ আইনের এই ধারা মেনে গত ২৭ মে গভর্নর আবারও পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। আইনে বলা আছে, এ ধরনের সুপারিশ সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। গুরুত্বসহকারে বিবেচনার নজিরও দেখালেন গতকাল অর্থমন্ত্রী। সোনালী ব্যাংক ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘পর্ষদের সদস্যদের মধ্য থেকেও কেউ থাকবেন, কেউ যাবেন।’
সুতরাং আগামী কয়েক দিন সরকারি মহলে চলবে নানা ধরনের যোগাযোগ, তদবির। যাঁদের যোগাযোগ বেশি ও ভালো, তাঁরা আবার পরিচালক হবেন। ব্যাংকগুলো চলবে আগের মতোই। সুযোগও থাকবে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের। এভাবেই একের পর এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে সংকটে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অথচ এ থেকে উত্তরণের পরিবর্তে সংকট তীব্র করার পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে একের পর এক।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি তিনটি। এক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া। দুই, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া। তিন, ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করা হয়েছে, সুতরাং চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের দায়িত্ব পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি একটি নিরপেক্ষ প্যানেলের মাধ্যমে পর্ষদ সদস্য নিয়োগ প্রদান।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়েও এখন অনেক ঘটনা দেখা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। এসব কথাবার্তায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বরং বেড়েছে। অর্থমন্ত্রীর কিছু পদক্ষেপেও সংশয় বেড়েছে। কেলেঙ্কারির দায় যাঁদের ওপর বর্তায়, তাঁদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কারও দেওয়া হচ্ছে। ফলে অনেকেরই ধারণা, দায়ী এবং নিরীহ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার চাকরি চলে গেলেও হলমার্ক গ্রুপের কিছুই হবে না। বাইরে থেকে যাঁরা হলমার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করার সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করেছেন, তাঁরাও থেকে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অর্থমন্ত্রী গত মঙ্গলবার বললেন, তিন বা চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু নয়। গতকাল আবারও একই কথা বললেন তিনি। তিনি বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের দেওয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চার হাজার কোটি টাকা সামান্য। এ নিয়ে গণমাধ্যম বাড়াবাড়ি করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে যে প্রতিবেদন পাঠায়, তাকেও এখতিয়ারবহির্ভূত বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। ফলে এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আবারও উৎসাহ পেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেন যে, তিনি এভাবে বললে দুর্নীতি হয়তো উৎসাহিত হয়।
এটা ঠিক যে অর্থমন্ত্রীর একার পক্ষে সশরীরে গিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্ত করা সম্ভব নয়। এ জন্য নির্দিষ্ট সংস্থা আছে। যেমন: শেয়ারবাজারের জন্য আছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। যদিও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য এসইসি নিজেও দায়ী ছিল। ব্যাংক খাত দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরও দায় বর্তায়। তবে এককভাবে এই দায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে পুরোপুরি চাপানো ঠিক হবে না। কারণ, অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দেখভালের দায়িত্ব নিজেই দিয়েছেন তাঁর মন্ত্রণালয়ের নতুন বিভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথমবারের মতো ব্যাংকিং বিভাগ চালু হয়েছিল। পরে আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং বিভাগ বাতিল করে একে আবারও ব্যাংকিং অনুবিভাগে রূপান্তর করা হয়েছিল। অথচ এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই আবার তৈরি করল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত শাসনের উদ্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর পরিদর্শন পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ ক্ষমতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। তাই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা তাকিয়ে থাকেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওপর। একই পরিস্থিতি পর্ষদের ক্ষেত্রেও। পর্ষদ নিয়োগ দেয় সরকার। এখানেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
ব্যাংক দেখভাল করার কোনো দক্ষতা ও যোগ্যতা ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেই। বরং বিভাগটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ যেমন: ঋণ অনুমোদন, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে তদবিরের একটা বড় জায়গা হয়ে গেছে। এই বিভাগটি অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়াই হবে সঠিক কাজ। অর্থমন্ত্রী এই কাজটি করবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম প্রথম থেকেই বলে আসছেন, এই বিভাগের আদৌ প্রয়োজন নেই। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে গতকাল তিনি আবারও একই কথা বললেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর বিমা খাতের জন্য তৈরি হয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। সুতরাং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রয়োজনই নেই।
আগের আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ড. আতিউর রহমান, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো অর্থনীতিবিদেরা। আর বর্তমান পরিচালকদের তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগের নিম্ন ও মধ্যম সারির নেতা-কর্মী। যাঁদের ব্যাংক সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই, আছে কেবল তদবির ও দুর্নীতি করার ক্ষমতা। দলের নেতা-কর্মীদের পুরস্কার দেওয়ার প্রবণতার কারণে গভীর সংকটে পড়ে আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংক।
পর্ষদের কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো যে সংকটে পড়বে, সেই আশঙ্কা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারিই অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে পর্ষদ পরিবর্তনের সুপারিশ করে গভর্নর লিখেছিলেন, ‘ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বদলি ও পদোন্নতি ইত্যাদিতে পর্ষদের সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করছেন।’ সেই চিঠি আমলে নেওয়া হয়নি। বরং পর্ষদের সদস্যদের ডেকে এনে বৈঠক করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই বৈঠকে একাধিক পর্ষদ সদস্য অর্থমন্ত্রীর সামনেই গভর্নরের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী কিছুই বলেননি। সে সময় গভর্নরের চিঠি আমলে নেওয়া হলে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৬(৬) ধারায় বলা আছে, ‘সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট কোন প্রতিবেদন পেশ করিলে সরকার উহা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করিবে।’ আইনের এই ধারা মেনে গত ২৭ মে গভর্নর আবারও পর্ষদ পুনর্গঠনের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। আইনে বলা আছে, এ ধরনের সুপারিশ সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। গুরুত্বসহকারে বিবেচনার নজিরও দেখালেন গতকাল অর্থমন্ত্রী। সোনালী ব্যাংক ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘পর্ষদের সদস্যদের মধ্য থেকেও কেউ থাকবেন, কেউ যাবেন।’
সুতরাং আগামী কয়েক দিন সরকারি মহলে চলবে নানা ধরনের যোগাযোগ, তদবির। যাঁদের যোগাযোগ বেশি ও ভালো, তাঁরা আবার পরিচালক হবেন। ব্যাংকগুলো চলবে আগের মতোই। সুযোগও থাকবে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের। এভাবেই একের পর এক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে সংকটে পড়ে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অথচ এ থেকে উত্তরণের পরিবর্তে সংকট তীব্র করার পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে একের পর এক।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি তিনটি। এক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া। দুই, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া। তিন, ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করা হয়েছে, সুতরাং চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের দায়িত্ব পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি একটি নিরপেক্ষ প্যানেলের মাধ্যমে পর্ষদ সদস্য নিয়োগ প্রদান।
No comments