উপজেলা-জেলার চেয়ে ঢাকায় ফরমালিনযুক্ত মাছ বেশিঃ বড় মাছে ফরমালিন বেশি by আবুল হাসনাত
দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া মাছ পরীক্ষা করে তাতে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৭০ (পিপিএম) মাত্রার ফরমালিন পাওয়া গেছে। গ্রাম থেকে শহর পর্যায়ে ফরমালিনের ব্যবহার ও মাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর পরিচালিত পরীক্ষা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে মাছের চাহিদা যত বেশি, সে মাছে ফরমালিন দেওয়ার প্রবণতা তত বেশি। সব কটি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি ফরমালিন পাওয়া গেছে বড় মাছে, বিশেষ করে রুই মাছে। মূলত কৃত্রিমভাবে দীর্ঘ সময় মাছ সংরক্ষণ করতে বরফের পরিবর্তে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহযোগী সংগঠন আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি) ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিসেবে ফরমালিনকে এক নম্বর তালিকায় রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিষাক্ত উপাদান ও রোগ নিবন্ধন সংস্থার ফরমালিন-বিষয়ক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দশমিক ৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন যদি কোনো মানুষের শরীরে ঢোকে, তাহলে তার অ্যালার্জি, হাঁপানি, চোখ ও নাক জ্বালাপোড়া এবং স্নায়ুগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে যাঁরা মাছে ফরমালিন দেন এবং দীর্ঘ সময় বসে ওই মাছ বিক্রি করেন, তাঁদের শরীরে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ফরমালিন সরাসরি ঢুকে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মামুন রশীদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মাছের ওপরের অংশে যে ফরমালিন থাকে, তা ধোয়ার সময় চলে যায়। রান্নার সময় তাপে কিছু ফরমালিন নষ্ট হয়। কিন্তু তার পরও বড় একটা অংশ মাছে থেকে যায়। কারণ, ফরমালিন ওই মাছের কোষে চলে যায়।
মামুন রশীদ বলেন, ‘মাছে ৩-৪ পিপিএম ফরমালিন পাওয়া খুবই উদ্বেগের বিষয়। যদিও এই মাত্রায় ফরমালিন মেশানো খাবার খেলে সঙ্গে সঙ্গেই আপনার শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে ক্যানসারসহ নানা জটিল রোগের লক্ষণ দেখা দেবে। এসব লক্ষণ দেখা দিতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এটা অনেকটা আর্সেনিকের মতো।’
মৎস্য অধিদপ্তরে পরীক্ষায় দেখা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে খুব কম মাছে ফরমালিন মেশানো হয়। জেলা পর্যায়ে এসে তা কিছুটা বাড়ে। কিন্তু ঢাকায় ফরমালিন মেশানো মাছ যেমন বেশি, তেমনি ফরমালিনের মাত্রাও অনেক বেশি। অর্থাৎ গ্রাম থেকে যতই ঢাকামুখী হতে থাকে, মাছে ততই ফরমালিনের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
মৎস্য আইন অনুযায়ী, মাছে ফরমালিন দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। এর শাস্তি অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু মেশানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির তিন বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
কোন মাছে কী মাত্রায়: রাজধানীর ফকিরাপুল বাজারে গত ১৭ জুলাই একটি রুই মাছে ৪ দশমিক ৭০ পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন পান মৎস্য অধিদপ্তর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৩১ জুলাই আরেক অভিযানে আদালত মিরপুরের সুপার শপ জি-মার্টের চিতল মাছে ৩ দশমিক ০৭ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন পান।
অধিদপ্তর জানায়, গত ৮ আগস্ট মোহাম্মদপুরের রিং রোডে ক্যারি ফ্যামিলিতে পাবদা মাছে ১ দশমিক ০৫ পিপিএম ফরমালিন পাওয়া যায়। একই দিন আরেক সুপার শপ স্বপ্নতে ফলি মাছে দশমিক ৯৮ পিপিএম ফরমালিন পান ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য সংরক্ষণে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রকল্পের পরিচালক জি এম শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, রুই, চিতল, কাতল, বড় পাঙাশ, বড় বোয়াল ও কিছু ছোট মাছে বেশি ফরমালিন পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা রুই মাছে ফরমালিন ব্যবহারের প্রবণতা বেশি।
শহরের মাছে ফরমালিন বেশি: মৎস্য অধিদপ্তরের ওই প্রকল্পের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১৩ জুন থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর ৩৬টি মাছের বাজার, আড়ত ও সুপার শপে ২৭টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এসব স্থানের ৫৪০টি মাছ পরীক্ষা করে ৮ শতাংশ মাছে ফরমালিন পাওয়া গেছে।
একই সময়ে জেলা পর্যায়ের ৩১০টি বাজার ও আড়তে ২৪৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। সেখান থেকে পাঁচ হাজার ১২৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫ শতাংশ মাছে ফরমালিন পাওয়া গেছে। আর উপজেলা পর্যায়ে এক হাজার ২২০টি বাজার ও আড়ত ৭৯০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আট হাজার ৬১৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১ শতাংশ মাছে ফরমালিন পাওয়া গেছে।
আরও কিছু গবেষণা: দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের প্রভাষক রিয়াজ উদ্দিনসহ কয়েকজন ২০১১ সালে মাছে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেন। এটি স্ট্যামফোর্ড জার্নাল অন ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত হয়।
গবেষকেরা ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজার এবং তিনটি সুপার শপ থেকে ১০০টি রুই, কাতল, ইলিশ, মৃগেল এবং সরপুঁটি মাছের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করেন। তাতে সংগৃহীত ৭০ শতাংশ রুই মাছে ফরমালিন পাওয়া যায়। ৫০ শতাংশ কাতল ও ইলিশ মাছে, ৪০ শতাংশ মৃগেল মাছে ফরমালিন পাওয়া যায়। তবে সরপুঁটি মাছে ফরমালিন পাননি তাঁরা।
২০০৯ সালে আরেকটি গবেষণা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আ ব ম মহসিন এবং একই বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইমদাদুল হক। গবেষকেরা ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও সাভার এলাকা থেকে ৪০০টি ছোট এবং ৪০০টি বড় মাছ সংগ্রহ করেন। ৮০০ মাছের মধ্যে ৫০টিতে ফরমালিন পান তাঁরা। এর মধ্যে ৪১টিই ছিল বড় মাছ। ফরমালিন পাওয়া মাছের ৪১ শতাংশই ছিল রুই। ২২ শতাংশ ছিল কাতল। ৬ শতাংশ করে মৃগেল, ছোট চিংড়ি ও কাচকিতে, ২ শতাংশ বেলে এবং ৪ শতাংশ অন্যান্য ছোট মাছে ফরমালিন পাওয়া গেছে। এ থেকে গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, বাণিজ্যিকভাবে চাহিদা বেশি এমন মাছেই ব্যবসায়ীরা বেশি ফরমালিন মেশান।
ফরমালিন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ নেই: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে ২০৫ টন ফরমালিন আমদানি হয়েছে। এসব ফরমালিন শিল্প, পরীক্ষাগারসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু আমদানিতে খুব বেশি শর্ত না থাকায় কিছু ব্যবসায়ী অবাধে ফরমালিন আমদানি করছেন। আর তার অপব্যবহার হচ্ছে মাছ ও ফলে।
বাংলাদেশ পেইন্ট, ডায়িং অ্যান্ড কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির অনুমোদন পেতে আমদানিকারককে খুব বেশি শর্ত পূরণ করতে হয় না। সে কারণে রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি দিন দিন বাড়ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তা খোলাবাজারে বিক্রি করছেন।
আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ক্ষতিকারক রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য টিসিবির মাধ্যমে আমদানি করা হোক। যার প্রয়োজন হবে সে টিসিবির কাছ থেকে কিনবে। তাহলে কারা এসব রাসায়নিক ব্যবহার করছে, কী কারণে ব্যবহার করছে, তা তদারকি করা যেত।’
No comments