স্মরণ-স্বপ্নদৃষ্টি ছিল যে মানুষটির by সায়মন ড্রিং
একজন মানুষকে আমার মনে পড়ে, যিনি নিজের দেশকে ভালোবাসতেন, যিনি বাংলাদেশের শক্তি ও স্বাধীনতায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি বিশ্বাস করতেন বিচ্ছিন্নতা, অসাম্য ও হতাশায় নিমজ্জিত দেশটিকে বদলে দেওয়ার, নতুন দিন আনার অমিত শক্তি ও সম্ভাবনা আছে সেই দেশের মানুষের।
সেই মানুষটি প্রয়াত এ এস মাহমুদ, ২০০৪ সালের এই দিনে যিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর জীবনাবসান মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে, ইংল্যান্ডে হওয়ার কথা ছিল না। দেশের মাটিতেই সেটা তিনি চেয়েছিলেন। তাহলে কেন তাঁর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল সুদূর বিভুঁইয়ে? কারণ, তিনি স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন সত্য করার সাহস ও অঙ্গীকার তাঁর ছিল। ‘একুশে টেলিভিশন’ ছিল তাঁর স্বপ্ন; সেই স্বপ্নকে তিনি বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন।
আজ থেকে ১২ বছর আগে খবর, তথ্য, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো দিয়ে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) জয় করেছিল চার কোটিরও বেশি দর্শকের হূদয়; তাদের সামনে খুলে ধরেছিল পুরো পৃথিবী এবং বাংলাদেশের সব মানুষের মধ্যে তৈরি করেছিল যোগাযোগের সেতু। ইটিভির এই সাফল্যই শেষ পর্যন্ত ছিল তার পতনের কারণ। ইটিভির সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর দুই বছরের কিছু বেশি সময় পেরোলে আবির্ভাব ঘটে তাঁদের, যাঁরা ইটিভি বন্ধ করে দেওয়ার সংকল্প করেন; ফলে এ এস মাহমুদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না।
নানা দিক থেকে বাংলাদেশ আমার জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ও তারপর ১৯৭২ সালের কয়েক মাস সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু এ এস মাহমুদ যখন একুশে টিভি গড়ে তোলার কাজে তাঁকে ও তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদকে সহযোগিতা করার জন্য আবারও আমাকে এই দেশে নিয়ে এলেন, তখনই আমার এ দেশের জন্য বড় কিছু করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। তাঁর উৎসাহ, আমাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের প্রতি তাঁর আস্থা এবং ৩০০ তরুণ-তরুণী, যারা ইটিভির সঙ্গে কাজ করতে এসেছিল, তাদের শেখার আগ্রহ—এসবের কারণেই আমরা বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন টেরিস্ট্রিয়াল বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও তাকে সফল করার কাজে নামার প্রেরণা পেয়েছিলাম।
চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস মাহমুদ একদম শুরু থেকেই একুশে টেলিভিশন গড়ে তোলার সব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন: এর দর্শন, এর আধেয়, এর ভাবমূর্তি এবং দেশে একটা পরিবর্তন সূচিত করার কাজে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার। ফরহাদ মাহমুদ যেমনটি স্মরণ করেন, ‘আমার বাবা সমতা, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাগুলো তাই তাঁর মনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। এই মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একুশে টেলিভিশনকে। আমার মনে হয়, এসব মূল্যবোধ নবীন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছিল এবং সেটাই একুশে টেলিভিশনের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছিল।’
এ এস মাহমুদের সঙ্গে কাটানো অনেক দিনের কথা আমার মনে পড়ে যখন তিনি বলতেন, ‘আমাদের সংবাদ ও শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো যেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রান্তিক চাষি ও গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের জীবনসংগ্রামের ছবি পৃথিবীবাসীকে দেখালেই শুধু চলবে না, তাঁরাও যে তাঁদের দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, তাঁরা নিজেরাই যেন তা উপলব্ধি করতে পারেন—তেমন অনুষ্ঠানও নির্মাণ ও প্রচার করতে হবে। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রচারমাধ্যমের এটাই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি।’
যেসব গ্রামে রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎ যেখানে পৌঁছেনি, যেসব গ্রামের মানুষ ব্যাটারিচালিত টেলিভিশন সেটের সামনে জড়ো হয়ে একুশে টেলিভিশনের সংবাদ ও অনুষ্ঠানগুলো দেখত; আর প্রায়ই গ্রামাঞ্চল থেকে গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো, যেসব গান তাদের নিজেদের। এটা জেনে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন এ এস মাহমুদ। শিশুদের প্রযোজিত, তাদেরই সংগৃহীত তথ্য ও খবরের ভিত্তিতে নির্মিত তথ্যমূলক অনুষ্ঠান ছিল তাঁর আরেকটি পছন্দের অনুষ্ঠান। এই শিশুদের কারও কারও বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তরুণদের সঙ্গে কাটাতেন, তাদের ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা শুনতেন এবং উৎসাহ জোগাতেন। আরেকটি অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘দেশজুড়ে’। দেশের প্রত্যেকটি জেলার প্রতিটি গ্রামের জীবন টিভির পর্দায় তুলে আনা ছিল এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্য (বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত একুশে টিভি ৯০০টি গ্রামের জীবন নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে।)
এ এস মাহমুদের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী জীবনের স্বাভাবিক চূড়া ছিল একুশে টিভি। তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদের বর্ণনায় এ এস মাহমুদ ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ, যাঁর কোনো জাত্যভিমান ছিল না, যিনি শ্রেণীহীন সমাজে বিশ্বাস করতেন এবং তীব্রভাবে অনুভব করতেন, এই সমাজে বিদ্যমান অসাম্য বিপুলসংখ্যক মানুষের অমিতসম্ভাবনা কাজে লাগানোর পথে প্রতিবন্ধক।
এ এস মাহমুদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদের স্মৃতিচারণা: পরে তিনি যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান অয়েল কোম্পানিতে। কোম্পানিটি পরিচালনা করত পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তাদের জাত্যভিমান সহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে অনেকের মতো তিনিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তেল সরবরাহের দায়িত্বরত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যখন লক্ষ করেন, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে হঠাৎ করে বিপুলসংখ্যক লোকবল মোতায়েন ও প্রচুর পরিমাণ লজিস্টিকস আনা হচ্ছে, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তথাকথিত ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে চলমান সংলাপের মধ্যে গুরুতর কোনো গলদ রয়ে গেছে। পরে বোঝা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবকিছু করছিল ২৫ মার্চের রাতে নারকীয় সামরিক হামলা পরিচালনার প্রস্তুতি হিসেবে। তিনি ফতুল্লা তেল ডিপোকে নির্দেশ দেন সামরিক ট্যাংকারগুলোকে তেল না দিতে। ডিপো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তিনি মার্চের শেষে সপরিবারে পালিয়ে লন্ডন চলে যান।
সব দিক থেকে এ এস মাহমুদ ছিলেন বিরল বিশ্বাসের অনন্যসাধারণ একজন মানুষ। সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি জগতের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘আমাদের আপন একজন’। তরুণ ও সৃজনশীল শিল্পীদের তিনি উৎসাহিত করতেন, সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছেন তারেক মাসুদের মতো তরুণ চলচ্চিত্রকারদের। এসব ক্ষেত্রে কাজ করার একটা জায়গা টেলিভিশন; তাই যখন তিনি জানতে পারলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের জন্য লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে, তখন তিনি কাজে নেমে পড়েন। লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী ছিল অনেক, দরপত্রের প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। একুশে টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়ার মুহূর্তটিই ছিল সম্ভবত এ এস মাহমুদের (এবং আমারও) জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এ এস মাহমুদ সারা জীবন যে বিশ্বাস বয়ে বেড়িয়েছেন, একুশে টেলিভিশনের জন্ম ছিল তারই এক উৎকৃষ্ট প্রতিফলন: এই দেশের ভবিষ্যতকে এক নতুন, উচ্চতর স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মের শক্তি ও সম্ভাবনাগুলো আলিঙ্গন করা যায়, তাদের সহযোগিতা করা যায়। ৩০০ তরুণ কর্মীর উৎসাহ-উদ্দীপনাতেই একুশে টেলিভিশন দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছিল।
এ এস মাহমুদের প্রতি জীবন্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য এই—যেসব দরজা একুশে টেলিভিশন খুলে দিয়েছিল, সেগুলো আর কোনো দিনই পুরোপুরি বন্ধ হবে না। পরবর্তী সরকারগুলো আরও অনেক নতুন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে, একুশে টেলিভিশনের সেসব কর্মীর অনেকেই এখন বাংলাদেশের নতুন ও গতিশীল সম্প্রচারমাধ্যমের অভিজ্ঞ ও পেশাদার মেরুদণ্ডের মতো ভূমিকা পালন করছেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সায়মন ড্রিং: ব্রিটিশ সাংবাদিক। একুশে টেলিভিশনের সাবেক যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আজ থেকে ১২ বছর আগে খবর, তথ্য, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো দিয়ে একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) জয় করেছিল চার কোটিরও বেশি দর্শকের হূদয়; তাদের সামনে খুলে ধরেছিল পুরো পৃথিবী এবং বাংলাদেশের সব মানুষের মধ্যে তৈরি করেছিল যোগাযোগের সেতু। ইটিভির এই সাফল্যই শেষ পর্যন্ত ছিল তার পতনের কারণ। ইটিভির সম্প্রচার শুরু হওয়ার পর দুই বছরের কিছু বেশি সময় পেরোলে আবির্ভাব ঘটে তাঁদের, যাঁরা ইটিভি বন্ধ করে দেওয়ার সংকল্প করেন; ফলে এ এস মাহমুদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না।
নানা দিক থেকে বাংলাদেশ আমার জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ও তারপর ১৯৭২ সালের কয়েক মাস সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু এ এস মাহমুদ যখন একুশে টিভি গড়ে তোলার কাজে তাঁকে ও তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদকে সহযোগিতা করার জন্য আবারও আমাকে এই দেশে নিয়ে এলেন, তখনই আমার এ দেশের জন্য বড় কিছু করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। তাঁর উৎসাহ, আমাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্যের প্রতি তাঁর আস্থা এবং ৩০০ তরুণ-তরুণী, যারা ইটিভির সঙ্গে কাজ করতে এসেছিল, তাদের শেখার আগ্রহ—এসবের কারণেই আমরা বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন টেরিস্ট্রিয়াল বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও তাকে সফল করার কাজে নামার প্রেরণা পেয়েছিলাম।
চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস মাহমুদ একদম শুরু থেকেই একুশে টেলিভিশন গড়ে তোলার সব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন: এর দর্শন, এর আধেয়, এর ভাবমূর্তি এবং দেশে একটা পরিবর্তন সূচিত করার কাজে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার। ফরহাদ মাহমুদ যেমনটি স্মরণ করেন, ‘আমার বাবা সমতা, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাগুলো তাই তাঁর মনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। এই মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একুশে টেলিভিশনকে। আমার মনে হয়, এসব মূল্যবোধ নবীন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছিল এবং সেটাই একুশে টেলিভিশনের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে কাজ করেছিল।’
এ এস মাহমুদের সঙ্গে কাটানো অনেক দিনের কথা আমার মনে পড়ে যখন তিনি বলতেন, ‘আমাদের সংবাদ ও শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো যেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রান্তিক চাষি ও গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের জীবনসংগ্রামের ছবি পৃথিবীবাসীকে দেখালেই শুধু চলবে না, তাঁরাও যে তাঁদের দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, তাঁরা নিজেরাই যেন তা উপলব্ধি করতে পারেন—তেমন অনুষ্ঠানও নির্মাণ ও প্রচার করতে হবে। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রচারমাধ্যমের এটাই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি।’
যেসব গ্রামে রাস্তাঘাট নেই, বিদ্যুৎ যেখানে পৌঁছেনি, যেসব গ্রামের মানুষ ব্যাটারিচালিত টেলিভিশন সেটের সামনে জড়ো হয়ে একুশে টেলিভিশনের সংবাদ ও অনুষ্ঠানগুলো দেখত; আর প্রায়ই গ্রামাঞ্চল থেকে গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো, যেসব গান তাদের নিজেদের। এটা জেনে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন এ এস মাহমুদ। শিশুদের প্রযোজিত, তাদেরই সংগৃহীত তথ্য ও খবরের ভিত্তিতে নির্মিত তথ্যমূলক অনুষ্ঠান ছিল তাঁর আরেকটি পছন্দের অনুষ্ঠান। এই শিশুদের কারও কারও বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তরুণদের সঙ্গে কাটাতেন, তাদের ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা শুনতেন এবং উৎসাহ জোগাতেন। আরেকটি অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘দেশজুড়ে’। দেশের প্রত্যেকটি জেলার প্রতিটি গ্রামের জীবন টিভির পর্দায় তুলে আনা ছিল এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্য (বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত একুশে টিভি ৯০০টি গ্রামের জীবন নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে।)
এ এস মাহমুদের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী জীবনের স্বাভাবিক চূড়া ছিল একুশে টিভি। তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদের বর্ণনায় এ এস মাহমুদ ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ, যাঁর কোনো জাত্যভিমান ছিল না, যিনি শ্রেণীহীন সমাজে বিশ্বাস করতেন এবং তীব্রভাবে অনুভব করতেন, এই সমাজে বিদ্যমান অসাম্য বিপুলসংখ্যক মানুষের অমিতসম্ভাবনা কাজে লাগানোর পথে প্রতিবন্ধক।
এ এস মাহমুদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁর ছেলে ফরহাদ মাহমুদের স্মৃতিচারণা: পরে তিনি যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান অয়েল কোম্পানিতে। কোম্পানিটি পরিচালনা করত পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তাদের জাত্যভিমান সহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে অনেকের মতো তিনিও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তেল সরবরাহের দায়িত্বরত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যখন লক্ষ করেন, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে হঠাৎ করে বিপুলসংখ্যক লোকবল মোতায়েন ও প্রচুর পরিমাণ লজিস্টিকস আনা হচ্ছে, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তথাকথিত ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে চলমান সংলাপের মধ্যে গুরুতর কোনো গলদ রয়ে গেছে। পরে বোঝা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবকিছু করছিল ২৫ মার্চের রাতে নারকীয় সামরিক হামলা পরিচালনার প্রস্তুতি হিসেবে। তিনি ফতুল্লা তেল ডিপোকে নির্দেশ দেন সামরিক ট্যাংকারগুলোকে তেল না দিতে। ডিপো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তিনি মার্চের শেষে সপরিবারে পালিয়ে লন্ডন চলে যান।
সব দিক থেকে এ এস মাহমুদ ছিলেন বিরল বিশ্বাসের অনন্যসাধারণ একজন মানুষ। সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি জগতের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘আমাদের আপন একজন’। তরুণ ও সৃজনশীল শিল্পীদের তিনি উৎসাহিত করতেন, সক্রিয় সমর্থন জুগিয়েছেন তারেক মাসুদের মতো তরুণ চলচ্চিত্রকারদের। এসব ক্ষেত্রে কাজ করার একটা জায়গা টেলিভিশন; তাই যখন তিনি জানতে পারলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের জন্য লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে, তখন তিনি কাজে নেমে পড়েন। লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী ছিল অনেক, দরপত্রের প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। একুশে টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়ার মুহূর্তটিই ছিল সম্ভবত এ এস মাহমুদের (এবং আমারও) জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত। এ এস মাহমুদ সারা জীবন যে বিশ্বাস বয়ে বেড়িয়েছেন, একুশে টেলিভিশনের জন্ম ছিল তারই এক উৎকৃষ্ট প্রতিফলন: এই দেশের ভবিষ্যতকে এক নতুন, উচ্চতর স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মের শক্তি ও সম্ভাবনাগুলো আলিঙ্গন করা যায়, তাদের সহযোগিতা করা যায়। ৩০০ তরুণ কর্মীর উৎসাহ-উদ্দীপনাতেই একুশে টেলিভিশন দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছিল।
এ এস মাহমুদের প্রতি জীবন্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য এই—যেসব দরজা একুশে টেলিভিশন খুলে দিয়েছিল, সেগুলো আর কোনো দিনই পুরোপুরি বন্ধ হবে না। পরবর্তী সরকারগুলো আরও অনেক নতুন টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে, একুশে টেলিভিশনের সেসব কর্মীর অনেকেই এখন বাংলাদেশের নতুন ও গতিশীল সম্প্রচারমাধ্যমের অভিজ্ঞ ও পেশাদার মেরুদণ্ডের মতো ভূমিকা পালন করছেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সায়মন ড্রিং: ব্রিটিশ সাংবাদিক। একুশে টেলিভিশনের সাবেক যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
No comments