ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক হো by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আরবি শব্দ ঈদ, যার আক্ষরিক অর্থ আনন্দ বা খুশি। খুশি হওয়ার ক্ষমতা শিশু-কিশোর, যুবকদের যতটা, তার ১ শতাংশের ১ ভাগও প্রবীণ ও বৃদ্ধদের নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে খুশি হওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তার পরও বয়স্করা যে আনন্দ করেন বা খুশি হন, তা যেন দায়ে পড়ে। শিশু-কিশোরদের আনন্দের প্রকাশ ও খুশি স্বতঃস্ফূর্ত। ঘরের মধ্যে একটি রঙিন ফড়িং বা প্রজাপতি ঢুকে পড়লে একটি শিশুর চোখে-মুখে নির্মল আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ে। বুড়ো মানুষ বসে থাকেন পাথরের মতো মুখ করে। হাত নেড়ে তাড়িয়েও দিতে পারেন ফড়িং বা প্রজাপতিটিকে।
ঈদুল ফিতর মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় উর্যাসবও। ধর্মীয় পরবে নতুন কাপড়চোপড় পরা, ভালো খাওয়াদাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে একত্র হওয়া এবং অন্য আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসে, শিশু-কিশোরদের চোখের ঘুম হারাম হতে থাকে, কবে মা-বাবা নতুন কাপড় কিনে দেবেন। তবে আমাদের মতো গরিব দেশে ৯০ ভাগ মা-বাবারও চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের জন্য বাজেটের মধ্যে জামা-কাপড়-জুতা কেনা যাবে তো! সুতরাং উর্যাসবে ঘুম দুই পক্ষেরই হারাম হয়—এক পক্ষের আনন্দে, আরেক পক্ষের আতঙ্কে।
আজকাল বাজারের যে অবস্থা, তাতে বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটতে পারে ঈদ উপলক্ষে। সেদিন গাউছিয়ার সামনে এক দম্পতি দেখলাম প্রায় হাতাহাতি করার পর্যায়ে। ক্ষিপ্ত ভদ্রলোকের চেহারা ভিমরুলে কামড়াতে থাকলে যেমনটি হয়, সেই রকম। ভদ্রমহিলা গজগজ করছেন। মহিলা শাড়ির প্যাকেটটি ভদ্রলোকের হাতে দিতেই তিনি তা রাস্তার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাচ্চা দুটি অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা-বাবার কাণ্ড দেখছিল। তাদের একজনের শুভবুদ্ধি যেকোনো বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি। সে প্যাকেটটি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল। ঈদে ওদের ভাগ্যে কী জুটেছে, তা জানা যায়নি।
আজকাল বাংলার মাটিতে ঈদে অন্য রকম ঘটনাও ঘটে। ৫০ বছর বয়স-বয়সিনীর রূপ-যৌবন-শরীর যতই বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের মতো হয়ে থাক, ঈদে ৫০ হাজার টাকা থেকে দেড়-দুই লাখ টাকার শাড়ি দিতেই হবে। ৬০ হাজার টাকা ভরি সোনার এক সেট ভারী গয়নাও চাই। ওই শাড়ি ও গয়নায় রূপ কতটা খোলতাই হলো, সেটা বড় কথা নয়, ওগুলো না দিলে মুখের যে অবস্থা হতো, তার কাছে চুলার হাঁড়ির তলা কিছুই না। ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে ঈদ করা তো এখন নস্যি! আজকাল অনেকে ঈদে ‘বিজনেসের ব্যাপারে’ ছুটিটা ব্যাংককে কাটান। ওখানে গিয়ে বিভিন্ন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে বলে স্ত্রীকে সঙ্গে নেন না।
বহু ভাগ্যবান বাঙালি ঈদ করেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপপুঞ্জে অথবা ব্যাংককে। থাই উপসাগরের বালুকাবেলার বিকেলগুলো রুপার পাতের মতো ঝকঝক করে। সন্ধ্যা নামে মন্দ-মন্থরে। সমুদ্রের পাখিগুলো ওড়াউড়ি বন্ধ করে নীড়ে ফিরে যায়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় বাড়িতে ও অফিসের যত যন্ত্রণা, শ্রমিকদের বোনাস প্রভৃতি দেওয়ার মতো যত্ত সব বিরক্তিকর ব্যাপার, কিছুই নেই ব্যাংককের বালুকাবেলায়। পুতুলের মতো থাই যুবতী। মনে হয় যেন মাখনের শরীর। সমুদ্রসৈকতে ও হোটেল-মোটেলের কক্ষে স্বর্গ নেমে আসে। রোমান্টিক মুহূর্তে ঢাকা থেকে স্ত্রীর ফোন যায় ঈদের দিন: ‘তোমার জন্য বাচ্চাদের মন খারাপ।’ ব্যাংককের জবাব: ‘তোমাকে ভীষণ মিস করছি। কাজের চাপে এক মিনিট ফুরসত নেই।’ হোটেলের নির্জন কক্ষে থাই তরুণীটি চেয়ে থাকে। ভাগ্যিস যে বাংলা জানে না।
কিন্তু ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ বাঙালি ব্যাংকক-বালিতে নয়, নিজের বাড়িতেই ঈদ করে। বউ-বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ-খুশি করে। সম্ভব হলে নতুন জামা-কাপড়-জুতা কেনে পরিবারের সদস্যদের জন্য। একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এসবের ভেতর দিয়ে ঈদের মতো আনন্দোর্যাসব উদ্যাপিত হয়। আমার ধারণা এবং যতটুকু খবর রাখি, তাতে অন্য জাতির চেয়ে বাঙালি মুসলমানের কাছে ঈদুল ফিতর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উর্যাসব। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতিতে উর্যাসবের উপাদান খুব বেশি। ঈদুল ফিতর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উর্যাসব হলেও এর ঈদগায় নামাজ আদায় করা ছাড়া সবটাই অসাম্প্রদায়িক। কারণ, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও ঈদ উদ্যাপনে অংশগ্রহণে বাধা নেই। ছোটবেলায় দেখেছি নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই আমার বাবার হিন্দু বন্ধুরা চলে আসতেন। দুপুরে-বিকেলে-রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হতো। মুসলমানি খানাপিনা তাঁরা উপভোগ করতেন। বিশেষভাবে দেখেছি, শুধু যে সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ঈদের দিন আসতেন তা নয়, আমাদের পারিবারিক নাপিত লোকনাথ শীলও অবধারিতভাবে দুপুরে খেতেন।
তবে শৈশবের সব ঈদই যে সমান আনন্দপূর্ণ ছিল, তা হয়তো নয়। আজও মনে পড়ে একটি ঈদ বেজায় উপভোগ্য হয়েছিল। আমাদের এলাকায় নেতাগোছের একজন ছিলেন, শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি বা আওয়ামী লীগ করতেন। আমাদের মতো ছোট ছেলেমেয়েদের অকারণে শাসন করতেন ও অনবরত উপদেশ দিতেন। ঈদের দিন তিনি পরতেন বহুকাল আগে তাঁর কোনো পূর্বপুরুষের তৈরি একটি কালো আচকান। কানে গোঁজা থাকত মেশকে আম্বার আতর দেওয়া তুলা। মাথায় আচকানের বয়সীই একটি ফেজ বা তুর্কি টুপি, যার ঝুল যথেষ্ট দীর্ঘ।
আশ্বিন-কার্তিক মাস হবে। ডোবা-পুকুর সব পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। তিনি ঈদের নামাজ পড়তে এসে কী কারণে হাত ধুতে বা কুলি করতে ঈদগার পাশের পুকুরটিতে যান। ঘাট বানানো ছিল খেজুরগাছের গুঁড়ি দিয়ে। মুহূর্তে পা ফসকে পাম্প শুসহ তিনি পুকুরে পড়ে যান। একেবারে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত। শুধু মাথার তুর্কি টুপিটি ছিল শুকনা। তাঁর পদস্খলন শুধু ছোটদের নয়, উপভোগ্য হয়েছিল সবারই।
জামাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিনি সিক্ত বসনেই এসে দাঁড়ালেন। নেতা মানুষ, সবার পেছনে দাঁড়াতে পারেন না, ইমামের পেছনেই গিয়ে দাঁড়ালেন। অর্ধেক নামাজের মধ্যে ছোটদের অনেকে হাসি চেপে রাখতে না পেরে মুখ দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ইমাম বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ধমক দিলেন, ‘কোন বেতামিজে এমন করে, আমার নামাজে ভুল করাইয়া দিলা।’ এ কথা শুনে উচ্চ স্বরেই হেসে উঠল অধিকাংশ। যা হোক, সে ঈদ আমাদের বড় খুশিতে কাটল। আসলে কাউকে পড়ে যাওয়া বা কারও পতন দেখলে মানুষ খুশি না হয়ে পারে না। তা যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
জলবায়ুর অতি দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির যে কী ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না। সেকালে দু-এক বছর পর পর ভয়াবহ বন্যা হতো। বাড়িঘর, গাছপালা সব ডুবে যেত।
আমার জীবনে অন্তত দুবার আমি বন্যার মধ্যে ঈদ উদ্যাপন করেছি। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। মসজিদ ও ঈদগাহে কোমর পর্যন্ত পানি। মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, নৌকায় নামাজ হবে। কুড়ি-পঁচিশটি নৌকা পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে ঈদের জামাত হয়।
আমরা সাহিত্যসমালোচকেরা যেমন বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যকে ভাগ করি দশকওয়ারি—পঞ্চাশের কবিতা, ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা প্রভৃতি, তেমনি এখন দেখছি ঈদ উদ্যাপনও দশকওয়ারি করা যায়। যেমন বাঙালি পঞ্চাশের দশকে একভাবে ঈদ উদ্যাপন করত, ষাটের দশকে আরেক রকম, সত্তর, আশি এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে আরেক রকম। সত্তর দশক পর্যন্ত জামাকাপড়ের জৌলুশ এত ছিল না। এক ভাগ লোকও ঈদে নতুন জুতা-স্যান্ডেল কিনত না। নতুন কাপড়ের মধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি ও শার্ট-প্যান্ট। এত বাহারি পাঞ্জাবিও ছিল না।
১০-১৫ বছর ধরে বিলাসিতা ও ভোগবাদ গোটা সমাজকে গ্রাস করেছে। শুনলাম, এবার নাকি তিন-চার হাজার টাকায়ও পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে। ৩০-৪০ হাজার টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে দেদার। বাংলাদেশ কবে মধ্যম আয়ের দেশ হবে জানি না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এখনই শীর্ষ ব্যয়ের দেশ হয়ে গেছে। ১০ তলা দালানে দাঁড়ালে দেখা যায় অন্তহীন গাড়ির স্রোত। মনে হয় উত্তাল সমুদ্রে ইস্পাতের ঢেউ। এক লাখ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে এবার। বহু বছর আমার নিজের ঈদের কাপড় কেনা লাগে না। ঘনিষ্ঠরাই দেন। অত কাপড় সারা বছর আমার লাগেও না। এবার দুই সেট লুঙ্গিচাদর পাঠিয়েছেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শীর্ষ নেতা, যাঁর বক্তৃতা মন্ত্রমুন্ধের মতো মানুষ শুনত, সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নূরে আলম সিদ্দিকী। হিসাব করে দেখলাম, গত কুড়ি বছরে যাঁরা আমাকে কাপড় উপহার দিয়েছেন, তাঁদের একজন জাতীয়তাবাদী দলের এবং অন্যরা আওয়ামী লীগের নেতা। সেই জাতীয়তাবাদী নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আজ নেই। কমিউনিস্টরা কিছু দিলে খুশি হতাম, কিন্তু তাঁরা দেন না। তাঁদের পার্টি চালানোরই টাকা নেই।
আজ নগরায়ণ ঘটেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকে ছিল শুধু গ্রাম আর গ্রাম। সেই গ্রামের ঈদ ছিল অন্য রকম। আমাদের জমি বর্গাদারেরা চাষ করলেও দুধের জন্য বাড়িতে গরু পালা হতো। কাজের লোকেরা ঈদের দিন গরুগুলোকে সাবান দিয়ে গোসল করাত।
ঢাকায় লালবাগে থাকতাম বলে ঈদের জামাতে অংশ নিতাম মোগল আমলের শাহি মসজিদে। এখন মনে হয় ওখানে জামাত হয় না, কারণ ওটা এখন পুরাকীর্তি হিসেবে রক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে একবার এবং স্বাধীনতার পরে একবার কি দুবার বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছি। একবার মনে আছে, খুব শীত ছিল। বঙ্গবন্ধুর চাদর গায়ে জড়ানো।
দেশের বাইরে বার তিনেক আমি ঈদের সময় ছিলাম কলকাতা ও দিল্লিতে। দিল্লির শাহি মসজিদে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে জামাতে দাঁড়িয়েছি। কলকাতা দুবার ঈদের দিন থাকলেও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। মালয়েশিয়ায় এক ঈদের জামাতে মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে নামাজ পড়েছি। খুবই অনাড়ম্বর তাদের আয়োজন। মাহাথিরের পরনে লুঙ্গি ও কুর্তা।
বাঙালি সব সময়ই প্রথার মধ্যে পড়ে থাকতে চায়। অর্থার্যা যেমনটি আছে তেমনই থাক। সংস্কারে তার অনিচ্ছা। বাঙালি মুসলমানের ঈদ আরও উর্যাসবমুখর করা যায়। শুধু খাওয়াদাওয়া ও কাপড় পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিষয়ও যোগ হতে পারে। কিছু যে হয়নি, তা নয়। টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বহু নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। কিছু নাটক-সংগীত প্রভৃতির প্রসার ঘটানো উচিত সাধারণ মানুষের মধ্যে—তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
কুড়ি শতকের শুরুতে মাসিক মোহাম্মদী এবং সাপ্তাহিক ও মাসিক সওগাত প্রকাশের পর থেকে ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। গত ৯০ বছরে বিখ্যাত বাঙালি লেখক ও কবি ঈদ নিয়ে যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন, সারা পৃথিবীতে গত নয় শ বছরে তত লেখা প্রকাশিত হয়নি। ঈদের বিশেষ সংখ্যা বহুকাল থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সমৃদ্ধ বিশেষ ঈদসংখ্যা বের করছে দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলো। সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতির ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা ভালো।
বাংলা ভাষায় ঈদ বিষয়ে যত কবিতা-গান রচিত হয়েছে, তার মধ্যে নজরুল ইসলামের রচনাই সব লেখার কাজি। দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। এখানে সবার জীবনে ঈদ আসে না। নজরুলকে দিয়ে শেষ করি:
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখিজলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ্-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ঈদুল ফিতর মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় উর্যাসবও। ধর্মীয় পরবে নতুন কাপড়চোপড় পরা, ভালো খাওয়াদাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে একত্র হওয়া এবং অন্য আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসে, শিশু-কিশোরদের চোখের ঘুম হারাম হতে থাকে, কবে মা-বাবা নতুন কাপড় কিনে দেবেন। তবে আমাদের মতো গরিব দেশে ৯০ ভাগ মা-বাবারও চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের জন্য বাজেটের মধ্যে জামা-কাপড়-জুতা কেনা যাবে তো! সুতরাং উর্যাসবে ঘুম দুই পক্ষেরই হারাম হয়—এক পক্ষের আনন্দে, আরেক পক্ষের আতঙ্কে।
আজকাল বাজারের যে অবস্থা, তাতে বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটতে পারে ঈদ উপলক্ষে। সেদিন গাউছিয়ার সামনে এক দম্পতি দেখলাম প্রায় হাতাহাতি করার পর্যায়ে। ক্ষিপ্ত ভদ্রলোকের চেহারা ভিমরুলে কামড়াতে থাকলে যেমনটি হয়, সেই রকম। ভদ্রমহিলা গজগজ করছেন। মহিলা শাড়ির প্যাকেটটি ভদ্রলোকের হাতে দিতেই তিনি তা রাস্তার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাচ্চা দুটি অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা-বাবার কাণ্ড দেখছিল। তাদের একজনের শুভবুদ্ধি যেকোনো বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি। সে প্যাকেটটি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল। ঈদে ওদের ভাগ্যে কী জুটেছে, তা জানা যায়নি।
আজকাল বাংলার মাটিতে ঈদে অন্য রকম ঘটনাও ঘটে। ৫০ বছর বয়স-বয়সিনীর রূপ-যৌবন-শরীর যতই বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের মতো হয়ে থাক, ঈদে ৫০ হাজার টাকা থেকে দেড়-দুই লাখ টাকার শাড়ি দিতেই হবে। ৬০ হাজার টাকা ভরি সোনার এক সেট ভারী গয়নাও চাই। ওই শাড়ি ও গয়নায় রূপ কতটা খোলতাই হলো, সেটা বড় কথা নয়, ওগুলো না দিলে মুখের যে অবস্থা হতো, তার কাছে চুলার হাঁড়ির তলা কিছুই না। ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে ঈদ করা তো এখন নস্যি! আজকাল অনেকে ঈদে ‘বিজনেসের ব্যাপারে’ ছুটিটা ব্যাংককে কাটান। ওখানে গিয়ে বিভিন্ন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে বলে স্ত্রীকে সঙ্গে নেন না।
বহু ভাগ্যবান বাঙালি ঈদ করেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপপুঞ্জে অথবা ব্যাংককে। থাই উপসাগরের বালুকাবেলার বিকেলগুলো রুপার পাতের মতো ঝকঝক করে। সন্ধ্যা নামে মন্দ-মন্থরে। সমুদ্রের পাখিগুলো ওড়াউড়ি বন্ধ করে নীড়ে ফিরে যায়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় বাড়িতে ও অফিসের যত যন্ত্রণা, শ্রমিকদের বোনাস প্রভৃতি দেওয়ার মতো যত্ত সব বিরক্তিকর ব্যাপার, কিছুই নেই ব্যাংককের বালুকাবেলায়। পুতুলের মতো থাই যুবতী। মনে হয় যেন মাখনের শরীর। সমুদ্রসৈকতে ও হোটেল-মোটেলের কক্ষে স্বর্গ নেমে আসে। রোমান্টিক মুহূর্তে ঢাকা থেকে স্ত্রীর ফোন যায় ঈদের দিন: ‘তোমার জন্য বাচ্চাদের মন খারাপ।’ ব্যাংককের জবাব: ‘তোমাকে ভীষণ মিস করছি। কাজের চাপে এক মিনিট ফুরসত নেই।’ হোটেলের নির্জন কক্ষে থাই তরুণীটি চেয়ে থাকে। ভাগ্যিস যে বাংলা জানে না।
কিন্তু ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ বাঙালি ব্যাংকক-বালিতে নয়, নিজের বাড়িতেই ঈদ করে। বউ-বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ-খুশি করে। সম্ভব হলে নতুন জামা-কাপড়-জুতা কেনে পরিবারের সদস্যদের জন্য। একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এসবের ভেতর দিয়ে ঈদের মতো আনন্দোর্যাসব উদ্যাপিত হয়। আমার ধারণা এবং যতটুকু খবর রাখি, তাতে অন্য জাতির চেয়ে বাঙালি মুসলমানের কাছে ঈদুল ফিতর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উর্যাসব। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতিতে উর্যাসবের উপাদান খুব বেশি। ঈদুল ফিতর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উর্যাসব হলেও এর ঈদগায় নামাজ আদায় করা ছাড়া সবটাই অসাম্প্রদায়িক। কারণ, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও ঈদ উদ্যাপনে অংশগ্রহণে বাধা নেই। ছোটবেলায় দেখেছি নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই আমার বাবার হিন্দু বন্ধুরা চলে আসতেন। দুপুরে-বিকেলে-রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হতো। মুসলমানি খানাপিনা তাঁরা উপভোগ করতেন। বিশেষভাবে দেখেছি, শুধু যে সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ঈদের দিন আসতেন তা নয়, আমাদের পারিবারিক নাপিত লোকনাথ শীলও অবধারিতভাবে দুপুরে খেতেন।
তবে শৈশবের সব ঈদই যে সমান আনন্দপূর্ণ ছিল, তা হয়তো নয়। আজও মনে পড়ে একটি ঈদ বেজায় উপভোগ্য হয়েছিল। আমাদের এলাকায় নেতাগোছের একজন ছিলেন, শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি বা আওয়ামী লীগ করতেন। আমাদের মতো ছোট ছেলেমেয়েদের অকারণে শাসন করতেন ও অনবরত উপদেশ দিতেন। ঈদের দিন তিনি পরতেন বহুকাল আগে তাঁর কোনো পূর্বপুরুষের তৈরি একটি কালো আচকান। কানে গোঁজা থাকত মেশকে আম্বার আতর দেওয়া তুলা। মাথায় আচকানের বয়সীই একটি ফেজ বা তুর্কি টুপি, যার ঝুল যথেষ্ট দীর্ঘ।
আশ্বিন-কার্তিক মাস হবে। ডোবা-পুকুর সব পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। তিনি ঈদের নামাজ পড়তে এসে কী কারণে হাত ধুতে বা কুলি করতে ঈদগার পাশের পুকুরটিতে যান। ঘাট বানানো ছিল খেজুরগাছের গুঁড়ি দিয়ে। মুহূর্তে পা ফসকে পাম্প শুসহ তিনি পুকুরে পড়ে যান। একেবারে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত। শুধু মাথার তুর্কি টুপিটি ছিল শুকনা। তাঁর পদস্খলন শুধু ছোটদের নয়, উপভোগ্য হয়েছিল সবারই।
জামাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিনি সিক্ত বসনেই এসে দাঁড়ালেন। নেতা মানুষ, সবার পেছনে দাঁড়াতে পারেন না, ইমামের পেছনেই গিয়ে দাঁড়ালেন। অর্ধেক নামাজের মধ্যে ছোটদের অনেকে হাসি চেপে রাখতে না পেরে মুখ দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ইমাম বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ধমক দিলেন, ‘কোন বেতামিজে এমন করে, আমার নামাজে ভুল করাইয়া দিলা।’ এ কথা শুনে উচ্চ স্বরেই হেসে উঠল অধিকাংশ। যা হোক, সে ঈদ আমাদের বড় খুশিতে কাটল। আসলে কাউকে পড়ে যাওয়া বা কারও পতন দেখলে মানুষ খুশি না হয়ে পারে না। তা যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
জলবায়ুর অতি দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির যে কী ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না। সেকালে দু-এক বছর পর পর ভয়াবহ বন্যা হতো। বাড়িঘর, গাছপালা সব ডুবে যেত।
আমার জীবনে অন্তত দুবার আমি বন্যার মধ্যে ঈদ উদ্যাপন করেছি। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। মসজিদ ও ঈদগাহে কোমর পর্যন্ত পানি। মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, নৌকায় নামাজ হবে। কুড়ি-পঁচিশটি নৌকা পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে ঈদের জামাত হয়।
আমরা সাহিত্যসমালোচকেরা যেমন বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যকে ভাগ করি দশকওয়ারি—পঞ্চাশের কবিতা, ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা প্রভৃতি, তেমনি এখন দেখছি ঈদ উদ্যাপনও দশকওয়ারি করা যায়। যেমন বাঙালি পঞ্চাশের দশকে একভাবে ঈদ উদ্যাপন করত, ষাটের দশকে আরেক রকম, সত্তর, আশি এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে আরেক রকম। সত্তর দশক পর্যন্ত জামাকাপড়ের জৌলুশ এত ছিল না। এক ভাগ লোকও ঈদে নতুন জুতা-স্যান্ডেল কিনত না। নতুন কাপড়ের মধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি ও শার্ট-প্যান্ট। এত বাহারি পাঞ্জাবিও ছিল না।
১০-১৫ বছর ধরে বিলাসিতা ও ভোগবাদ গোটা সমাজকে গ্রাস করেছে। শুনলাম, এবার নাকি তিন-চার হাজার টাকায়ও পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে। ৩০-৪০ হাজার টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে দেদার। বাংলাদেশ কবে মধ্যম আয়ের দেশ হবে জানি না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এখনই শীর্ষ ব্যয়ের দেশ হয়ে গেছে। ১০ তলা দালানে দাঁড়ালে দেখা যায় অন্তহীন গাড়ির স্রোত। মনে হয় উত্তাল সমুদ্রে ইস্পাতের ঢেউ। এক লাখ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে এবার। বহু বছর আমার নিজের ঈদের কাপড় কেনা লাগে না। ঘনিষ্ঠরাই দেন। অত কাপড় সারা বছর আমার লাগেও না। এবার দুই সেট লুঙ্গিচাদর পাঠিয়েছেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শীর্ষ নেতা, যাঁর বক্তৃতা মন্ত্রমুন্ধের মতো মানুষ শুনত, সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নূরে আলম সিদ্দিকী। হিসাব করে দেখলাম, গত কুড়ি বছরে যাঁরা আমাকে কাপড় উপহার দিয়েছেন, তাঁদের একজন জাতীয়তাবাদী দলের এবং অন্যরা আওয়ামী লীগের নেতা। সেই জাতীয়তাবাদী নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আজ নেই। কমিউনিস্টরা কিছু দিলে খুশি হতাম, কিন্তু তাঁরা দেন না। তাঁদের পার্টি চালানোরই টাকা নেই।
আজ নগরায়ণ ঘটেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকে ছিল শুধু গ্রাম আর গ্রাম। সেই গ্রামের ঈদ ছিল অন্য রকম। আমাদের জমি বর্গাদারেরা চাষ করলেও দুধের জন্য বাড়িতে গরু পালা হতো। কাজের লোকেরা ঈদের দিন গরুগুলোকে সাবান দিয়ে গোসল করাত।
ঢাকায় লালবাগে থাকতাম বলে ঈদের জামাতে অংশ নিতাম মোগল আমলের শাহি মসজিদে। এখন মনে হয় ওখানে জামাত হয় না, কারণ ওটা এখন পুরাকীর্তি হিসেবে রক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে একবার এবং স্বাধীনতার পরে একবার কি দুবার বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছি। একবার মনে আছে, খুব শীত ছিল। বঙ্গবন্ধুর চাদর গায়ে জড়ানো।
দেশের বাইরে বার তিনেক আমি ঈদের সময় ছিলাম কলকাতা ও দিল্লিতে। দিল্লির শাহি মসজিদে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে জামাতে দাঁড়িয়েছি। কলকাতা দুবার ঈদের দিন থাকলেও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। মালয়েশিয়ায় এক ঈদের জামাতে মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে নামাজ পড়েছি। খুবই অনাড়ম্বর তাদের আয়োজন। মাহাথিরের পরনে লুঙ্গি ও কুর্তা।
বাঙালি সব সময়ই প্রথার মধ্যে পড়ে থাকতে চায়। অর্থার্যা যেমনটি আছে তেমনই থাক। সংস্কারে তার অনিচ্ছা। বাঙালি মুসলমানের ঈদ আরও উর্যাসবমুখর করা যায়। শুধু খাওয়াদাওয়া ও কাপড় পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিষয়ও যোগ হতে পারে। কিছু যে হয়নি, তা নয়। টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বহু নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। কিছু নাটক-সংগীত প্রভৃতির প্রসার ঘটানো উচিত সাধারণ মানুষের মধ্যে—তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
কুড়ি শতকের শুরুতে মাসিক মোহাম্মদী এবং সাপ্তাহিক ও মাসিক সওগাত প্রকাশের পর থেকে ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। গত ৯০ বছরে বিখ্যাত বাঙালি লেখক ও কবি ঈদ নিয়ে যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন, সারা পৃথিবীতে গত নয় শ বছরে তত লেখা প্রকাশিত হয়নি। ঈদের বিশেষ সংখ্যা বহুকাল থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সমৃদ্ধ বিশেষ ঈদসংখ্যা বের করছে দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলো। সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতির ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা ভালো।
বাংলা ভাষায় ঈদ বিষয়ে যত কবিতা-গান রচিত হয়েছে, তার মধ্যে নজরুল ইসলামের রচনাই সব লেখার কাজি। দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। এখানে সবার জীবনে ঈদ আসে না। নজরুলকে দিয়ে শেষ করি:
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখিজলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ্-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments