রাজশাহী বড়কুঠির দুর্দশা by মুহাম্মদ লুৎফুল হক
১৬৫৩ সালে ডাচরা কাশিমবাজারে ব্যবসা শুরু করে এবং কালক্রমে সারা বাংলায় বিস্তার লাভ করে। ১৬৬০ সালে ব্যবসার প্রসারের জন্য ডাচ গভর্নর ম্যাথু ভ্যান ডেন ব্রুক বাংলা ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানচিত্র তৈরি করেন। এটি এখনো এই এলাকার অন্যতম প্রাচীন মানচিত্র হিসেবে গণ্য হচ্ছে। মানচিত্রে তিনি তাঁদের ব্যবসাকেন্দ্র, বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও জনবসতিগুলো চিহ্নিত করেন। এই মানচিত্রে রাজশাহীর উল্লেখ আছে।
ডাচরা রাজশাহীতে কবে ব্যবসা শুরু করে, তা জানা যায় না, তবে ও’ মেলির গেজেট থেকে পাওয়া যায় যে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রাজশাহীতে ডাচদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ প্রসার লাভ করেছিল। ব্যবসাসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল রেশম। ডাচদের এই ব্যবসা ‘বড়কুঠি’ নামের একটি দ্বিতল ইমারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে পদ্মার তীরে বড়কুঠি নির্মাণ করা হয়। বড়কুঠির নির্মাণকাল নির্ধারণ করা না গেলেও এটি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তৈরি, তা ও’ মেলির গেজেট এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ধারণা করা যায়।
গত প্রায় পৌনে ৩০০ বছরে বড়কুঠির মালিকানা একাধিকবার হাতবদল হয়। মূল কাঠামোর সঙ্গে নতুন কিছু স্থাপনাও সংযুক্ত হয়। নতুন স্থাপনাগুলো কালের বিবর্তনে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু ডাচদের তৈরি মূল বড়কুঠি প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বড়কুঠির ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় ও’ মেলির গেজেটে। এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং এতে ব্যবহূত কামানের বিশদ বর্ণনা ও’ মেলির গেজেট ও মেসের আলীর বইয়ে উল্লেখ আছে। বড়কুঠির স্থাপত্যের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় ড. নাজিমুদ্দিন আহমদের বইয়ে। কিছুদিন আগে ডাচ প্রতিনিধিরা বড়কুঠি দেখে নিশ্চিত করেছেন, এটি তাঁদের তৈরি স্থাপত্য এবং এই স্থাপনার অনেক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁদের সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপনার মিল আছে।
এই ভবন ঘিরে জমে আছে অনেক স্মৃতি। ডাচদের রেশম ব্যবসা, ইংরেজদের নীল ব্যবসা, বিভিন্ন কোম্পানির অন্যান্য ব্যবসা, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহকালে ইংরেজ বাহিনীর সদর দপ্তর, দেশভাগের পর খাদ্য বিভাগের কার্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊষালগ্নে উপাচার্যের কার্যালয়—এই সবই বড়কুঠির অতীত ইতিহাস, প্রকারান্তরে রাজশাহীর ইতিহাস। বড়কুঠির ভেতরের কয়েদখানা মনে করিয়ে দেয় নীলচাষিদের ওপর নির্যাতনের কথা। ভবনটি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ক্লাব হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
আয়ুর বিচারে বড়কুঠি রাজশাহী শহরের প্রাচীনতম স্থাপনা। সারা বাংলাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলের কয়েকটি স্থাপনা ছাড়া বড়কুঠির চেয়ে প্রাচীন স্থাপনা হাতে গোনা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বড়কুঠি তার প্রাচীন এবং কার্যকর রূপ নিয়ে এখনো অক্ষত আছে।
বড়কুঠি যেকোনো মানদণ্ডে একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন, এটির সংরক্ষণ সেভাবেই হওয়া উচিত। তবে বর্তমানে ভবনটি যে অবস্থায় আছে বা যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা ভবনটির ধস ত্বরান্বিত করছে। কুঠির ভেতর-বাইরে অপরিষ্কার, উঠান জঙ্গলাকীর্ণ, কাঠের সিঁড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী এবং ধ্বংসপ্রায়, বুরুজ হয়ে ছাদে যাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে নতুন ধাঁচের সিঁড়ি তৈরি—এসবই ভবনটির প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলার প্রকাশ।
অনেকেই উল্লেখ করেছেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে বাঙালি বেশ উদাসীন। অন্যরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, বাঙালি তা থেকে বিরত থাকে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত সবার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। বেশ কিছুদিন আগে ডাচ দূতাবাস বড়কুঠি সংরক্ষণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় পিছিয়ে যায়।
রাজশাহীর সুশীল সমাজ বড়কুঠি রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সবার কাছে আবেদন করেছে, স্থানীয় সাংবাদিকেরা বড়কুঠির ঐতিহ্যের পক্ষে কলম ধরেছেন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক বড়কুঠিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং একে সংরক্ষণের আগ্রহ দেখিয়েছেন। সর্বোপরি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রও বড়কুঠিকে ঘিরে রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখছেন; শুধু বাকি থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থন। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক একত্রে প্রথম আলোয় একটি লেখার মাধ্যমে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রক্ষার সপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। আমরা কি আশা করতে পারি না যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাঁদের নৈতিক ও মননের অবস্থান থেকে বড়কুঠি রক্ষার জন্য এ ধরনের কিছু একটা করবেন!
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
lutful55@gmail.com
ডাচরা রাজশাহীতে কবে ব্যবসা শুরু করে, তা জানা যায় না, তবে ও’ মেলির গেজেট থেকে পাওয়া যায় যে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রাজশাহীতে ডাচদের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ প্রসার লাভ করেছিল। ব্যবসাসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম ছিল রেশম। ডাচদের এই ব্যবসা ‘বড়কুঠি’ নামের একটি দ্বিতল ইমারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে পদ্মার তীরে বড়কুঠি নির্মাণ করা হয়। বড়কুঠির নির্মাণকাল নির্ধারণ করা না গেলেও এটি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তৈরি, তা ও’ মেলির গেজেট এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ধারণা করা যায়।
গত প্রায় পৌনে ৩০০ বছরে বড়কুঠির মালিকানা একাধিকবার হাতবদল হয়। মূল কাঠামোর সঙ্গে নতুন কিছু স্থাপনাও সংযুক্ত হয়। নতুন স্থাপনাগুলো কালের বিবর্তনে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু ডাচদের তৈরি মূল বড়কুঠি প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বড়কুঠির ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় ও’ মেলির গেজেটে। এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং এতে ব্যবহূত কামানের বিশদ বর্ণনা ও’ মেলির গেজেট ও মেসের আলীর বইয়ে উল্লেখ আছে। বড়কুঠির স্থাপত্যের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় ড. নাজিমুদ্দিন আহমদের বইয়ে। কিছুদিন আগে ডাচ প্রতিনিধিরা বড়কুঠি দেখে নিশ্চিত করেছেন, এটি তাঁদের তৈরি স্থাপত্য এবং এই স্থাপনার অনেক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁদের সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপনার মিল আছে।
এই ভবন ঘিরে জমে আছে অনেক স্মৃতি। ডাচদের রেশম ব্যবসা, ইংরেজদের নীল ব্যবসা, বিভিন্ন কোম্পানির অন্যান্য ব্যবসা, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহকালে ইংরেজ বাহিনীর সদর দপ্তর, দেশভাগের পর খাদ্য বিভাগের কার্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊষালগ্নে উপাচার্যের কার্যালয়—এই সবই বড়কুঠির অতীত ইতিহাস, প্রকারান্তরে রাজশাহীর ইতিহাস। বড়কুঠির ভেতরের কয়েদখানা মনে করিয়ে দেয় নীলচাষিদের ওপর নির্যাতনের কথা। ভবনটি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ক্লাব হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
আয়ুর বিচারে বড়কুঠি রাজশাহী শহরের প্রাচীনতম স্থাপনা। সারা বাংলাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলের কয়েকটি স্থাপনা ছাড়া বড়কুঠির চেয়ে প্রাচীন স্থাপনা হাতে গোনা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বড়কুঠি তার প্রাচীন এবং কার্যকর রূপ নিয়ে এখনো অক্ষত আছে।
বড়কুঠি যেকোনো মানদণ্ডে একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন, এটির সংরক্ষণ সেভাবেই হওয়া উচিত। তবে বর্তমানে ভবনটি যে অবস্থায় আছে বা যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা ভবনটির ধস ত্বরান্বিত করছে। কুঠির ভেতর-বাইরে অপরিষ্কার, উঠান জঙ্গলাকীর্ণ, কাঠের সিঁড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী এবং ধ্বংসপ্রায়, বুরুজ হয়ে ছাদে যাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া, প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে নতুন ধাঁচের সিঁড়ি তৈরি—এসবই ভবনটির প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলার প্রকাশ।
অনেকেই উল্লেখ করেছেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে বাঙালি বেশ উদাসীন। অন্যরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, বাঙালি তা থেকে বিরত থাকে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত সবার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। বেশ কিছুদিন আগে ডাচ দূতাবাস বড়কুঠি সংরক্ষণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় পিছিয়ে যায়।
রাজশাহীর সুশীল সমাজ বড়কুঠি রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সবার কাছে আবেদন করেছে, স্থানীয় সাংবাদিকেরা বড়কুঠির ঐতিহ্যের পক্ষে কলম ধরেছেন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক বড়কুঠিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং একে সংরক্ষণের আগ্রহ দেখিয়েছেন। সর্বোপরি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রও বড়কুঠিকে ঘিরে রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখছেন; শুধু বাকি থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থন। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক একত্রে প্রথম আলোয় একটি লেখার মাধ্যমে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো রক্ষার সপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। আমরা কি আশা করতে পারি না যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাঁদের নৈতিক ও মননের অবস্থান থেকে বড়কুঠি রক্ষার জন্য এ ধরনের কিছু একটা করবেন!
মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
lutful55@gmail.com
No comments