পাট কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যৎও by ফারুক ওয়াসিফ
যোগাযোগটি কাকতালই বটে। সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ ঘোষণার রায় এবং পাট ও পাটজাতদ্রব্য দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্যের স্থান অধিকারের ঘটনা প্রায় একই সময়ের। বাংলাদেশের পাট খাতের সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ করেছিলেন এই এরশাদ। ১৯৮২ সালে তাঁর ঘোষিত শিল্পনীতিকে শিল্পধ্বংস-নীতি বলাই যুক্তিযুক্ত। বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারি মালিকানাধীন ৬৫০টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ছাড়া হয়। এটাই ছিল এযাবৎকালে বিশ্বের সব থেকে বড় বেসরকারীকরণ। ৬২টি পাটকলের মধ্যে ৩৩টি বিক্রি করা হয় এমন লোকদের কাছে, যাদের শিল্প চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। মুজিব ও জিয়া আমলে পাট-বস্ত্র ও চিনিশিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়ে এবং এরশাদ আমলে সেসবের পূর্ণ বারোটা বাজে। বিশ্বের আর কোথাও একটি দেশের শিল্প-অর্থনীতিকে এত দ্রুত কাবু করার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়নি।
বাঙালিরা কখনোই বড় কোনো শিল্প খাত গঠন করতে পারেনি। ব্রিটিশ আমলে কিছু করেছিল মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা, পাকিস্তান আমলে তাদের জায়গা নেয় পশ্চিম পাকিস্তানি আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানীরা। বাহাত্তর সালে এদেরই ফেলে যাওয়া ৫৪৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৎকালীন মুজিব সরকার জাতীয়করণ করে। এগুলো লাভজনকভাবে টিকিয়ে রাখা তো দূরের কথা, বরং জাতীয়করণের নামে দলীয় লোকজন ও আমলারা এগুলোকে দুর্নীতির মাধ্যমে ফোঁপরা করে দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষী, পাটের শত্রু মানেই জাতীয় শত্রু। গত দুই শ বছরের বাংলার ইতিহাসের বড় অংশজুড়ে পাটই ছিল নায়কের ভূমিকায়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলার পাট ইংল্যান্ড-আমেরিকায় রপ্তানি হতে শুরু করে। ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্প-দুনিয়ার রমরমা হয় বাংলার পাটের সুবাদেই। বিরাট বিরাট পাট-বস্ত্রকল প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরে। বাংলার সম্পদে ইংল্যান্ডে জুট ব্যারন নামে নতুন এক ধনিক শ্রেণীরও জন্ম হয়। পরে এই জুট ব্যারনদের জায়গা নেয় ভারতের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। বিশ শতকের শুরুতে পূর্ব বাংলায় পাটের আড়তদারি আর পশ্চিম বাংলার পাটশিল্পের মালিকানায় তারাই ছিল একচেটিয়া। আজকের ভারতের টাটা-বিড়লাদের শিল্পসাম্রাজ্যেরও গোড়াপত্তন পাটের কারখানার মাধ্যমেই।
ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান এল। পশ্চিম পাকিস্তানি ধনকুবের আদমজী-বাওয়ানী-ইস্পাহানীরাই হয় নতুন জুট ব্যারন। এভাবে পাটের মুনাফা বারবার বিভিন্ন রঙের ‘পশ্চিমা’দের হাতে চলে যাওয়া বাংলার মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। গত শতকের তিরিশের দশকে ময়মনসিংহের গ্রাম্য কবি সোমেদ আলী মিয়া গান লেখেন, ‘পাট আসিয়া যখন দেশেতে পৌঁছিল,/ পশ্চিমা এসে তখন দখল করিল।’ রংপুরের কৃষক কবি আবেদ আলী মিয়া লেখেন, ‘তোমার টাকা দিয়া যত মাড়োয়ারিরা ধনী,/ তোমরা পাইলে ছাই-ভস্ম, কাইড়া নেয় গুনি।’ গ্রামীণ কবিদের এই অভিযোগই পরে বিকশিত হয়ে ছয় দফা কর্মসূচিতে রূপ নেয়।
দীর্ঘ সময়জুড়ে পাটই ছিল বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল। গত শতকের শুরুতে বিশ্ববাজারে পাটের দাম বাড়তে থাকলে বাংলার কৃষকেরা সমৃদ্ধির মুখ দেখতে থাকেন। পাটের ফলন চাষির সামর্থ্য বাড়ায়। গ্রামগঞ্জের পাটের ব্যাপারিরা হয়ে ওঠেন সবল সামাজিক গোষ্ঠী। গ্রামীণ চাষি-জোতদার আর ব্যাপারিরা তাঁদের এই নতুন অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ও রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে থাকেন। কৃষকের সন্তান প্রথমবারের মতো আধুনিক শিক্ষা নিতে যায় মফস্বলের স্কুল-কলেজে, সেখান থেকে আরও উচ্চশিক্ষার জন্য আসে ঢাকায়। ঢাকা তত দিনে প্রাদেশিক রাজধানী এবং সেখানে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই পাটচাষি-জোতদার-ব্যাপারিরা সরাসরি জমিদার-মহাজনদের চ্যালেঞ্জ জানান। তাঁরা কত বলবান ছিলেন, তার প্রমাণ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান। নতুন এই রাজনৈতিক শক্তি তাঁর নেতৃত্বে ১৯৩৫ সালের নির্বাচনে হিন্দু জমিদার আর মুসলিম নবাব-নাইটদের হটিয়ে প্রাদেশিক সরকার পর্যন্ত গঠন করে ফেলে। তাঁর হাত ধরেই পূর্ব বাংলা একদিকে কংগ্রেস, আরেকদিকে মুসলিম লীগের অভিজাত-সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাংলায় সূচনা হয় জনগণভিত্তিক সেকুলার রাজনীতির। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে পাটের ভালো ফলন আর বর্ধিত দাম একে সম্ভব করেছিল (Taj Hashmi: Peasants Utopia, UPL)|
আগেই বলেছি, তিরিশের দশকে পশ্চিমা বলতে মানুষ বুঝত ভিনদেশি ইংরেজ আর মাড়োয়ারিদের। ষাটের দশকে একই রকম পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে পুষ্ট করতে থাকে। শেখ মুজিবের ছয় দফা জনপ্রিয় হয় পাটের বঞ্চনার অভিযোগের কারণেই। বাংলার কৃষক ভোলেননি, পাটের সোনালি আঁশের কল্যাণেই তাঁদের অনেকের ঘরের চালে প্রথম টিন লেগেছিল, মেয়ে-বউয়ের গলায় উঠেছিল সোনার গয়না। সেই স্মৃতি মনে ছিল বলেই ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’—এই প্রশ্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলল।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস তাই পাটেরও ইতিহাস। তিরিশের দশকে পাটচাষির আন্দোলন, ষাট ও আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাটকল-শ্রমিকদের সংগ্রামের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঋণী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্মাণ, সোনার বাংলার মিথ সৃজনের কৃতিত্ব আর অর্থনীতির সোনালি মুকুট তাই পাটচাষি ও পাটশ্রমিকের মস্তকেই শোভা পাওয়ার কথা। কিন্তু যা হওয়ার কথা এই পোড়ার দেশে তার উল্টোটাই ঘটে! পাটের আদর কমে, কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর চিংড়ি চাষে উৎসাহ বাড়ে।
মুজিব-জিয়া-এরশাদের আমলের অদূরদর্শী পদক্ষেপগুলোর সংশোধন তো দূরের কথা, নব্বইয়ের পরে চলতে থাকে সেসবেরই ধারাবাহিকতা। ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং স্টাডি’ ও ‘বাংলাদেশ রিস্ট্রাকচারিং অপশনস ফর দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক দুটি সমীক্ষা অনুসারে পাট খাত সমন্বয় ঋণ কর্মসূচি (জেএসএসি) হাতে নেওয়া হয়। এতেই পাটশিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। কর্পূরের মতো উবে যায় সোনার বাংলার স্বপ্নও। রাষ্ট্রের অপচয় আর ধ্বংসাত্মক কায়কারবারের এত বড় শিকার অর্থনীতির আর কোনো খাত হয়নি। পাটের বেদন তাই জাতীয় বেদন।
এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধের বছরই (২০০২) ঘোষিত হয় জাতীয় পাটনীতি। তখন দেশের মোট রপ্তানি-আয়ের ৮-১২ শতাংশ আসত পাট ও পাটজাতপণ্য থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩-০৪ সালে এই হার ৪ শতাংশে নামে। অথচ ১৯৭২-’৭৩ সালে রপ্তানি-আয়ের ৯০ শতাংশই জোগাত এই খাত। যে দেশের আবহাওয়া পাট চাষের অনুকূল, চাষিরাও দক্ষ এবং যে দেশের পাট জাতে সেরা বলেচাহিদাও বিশ্বব্যাপী, সেখানে এমন হওয়ার কারণ কী? কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, নানান ষড়যন্ত্রে পাটের সোনালি গৌরব মিলিয়ে গিয়েছিল (ডেইলি স্টার, ২ জুন, ২০১০)।
বিপরীতে ২০০৫ সালে ঘোষিত ভারতের পাটনীতিতে রপ্তানি আয় এক হাজার কোটি রুপি থেকে ২০১০ সালে পাঁচ হাজার কোটি রুপিতে তোলার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাট খাত চাঙা করায় বিশ্বব্যাংকের ঋণও তারা পায়। ভারত সরকার পাটচাষিদের ৫১৪ কোটি রুপি বকেয়া ঋণ ও সুদ মওকুফ করে। পাশাপাশি ৩০২ কোটি রুপির ভর্তুকিও চালু রাখে। দুই দেশের শাসকদের এই বৈপরীত্যের মধ্যেই বাংলাদেশের শিল্প ধ্বংস আর ভারতের শিল্প শক্তিশালী হওয়ার রহস্য নিহিত।
পাট খাতের পতনের সব দোষ শ্রমিকের ঘাড়ে চাপানো হয়ে থাকে। পাট মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৬ সালে লোকসান হওয়া ৪২১ কোটি টাকার মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনের দায় মাত্র ৩০ কোটি টাকা। অন্যদিকে পাট কিনতে দেরির ক্ষতি ১৪০ কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ বিবিধ অশ্রমিক কারণে লোকসান হয় ১৩০ কোটি টাকা। ভি ভাস্কর এবং মুশতাক খানের এ-সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গেছে, পাটকলগুলোতে বাড়তি শ্রমিক ছিলেন না, বরং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাড়তি কর্মচারী-কর্মকর্তা সেখানে পোষা হতো। বর্তমান পাটমন্ত্রীও এক সভায় যথার্থই বলেছেন, সমস্যাটা জুট মিলে নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়। গত চল্লিশ বছরে এ রকমটাই চলেছে। অথচ এর জন্য আজ অবধি কোনো মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদের শাস্তি হয়নি, ক্ষমা চায়নি বিশ্বব্যাংকের রাশভারী আমলারা। অথচ তাঁদেরই দোষে দক্ষ শ্রমিক হয়েছেন রিকশাচালক, অনেক শ্রমিকের স্ত্রী-কন্যারা চলে গেছে আদিম পেশায়, অনেকের লেখাপড়ার পাট চুকেছে। না খেয়ে মরেছে অনেকে। আদমজী বন্ধের পর সেখানকার এক শ্রমিক হাহাকার করে বলেছিলেন, ‘যেদিন কারখানার ভেঁপু বন্ধ হলো, সেদিনই আমাদের ভাগ্যের কবর হলো।’
এসবেরই পরিণাম হলো একসময় বিশ্বের পাটের বাজারের ৭০ শতাংশের জোগানদাতা বাংলাদেশের ভারতের কাছে মার খাওয়া। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ১৪ লাখ টন পাটদ্রব্য রপ্তানি করে; ভারত করে মাত্র ছয় টন। বিশ্ববাজারে তখন মোট চাহিদা ছিল ৩০ লাখ টন। দান উল্টে গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৬০টি পাটকল বন্ধ, চলছে মাত্র ২২টি। বিপরীতে ভারতে চালু আছে ৭৮টিরও বেশি পাটকল (ডেইলি স্টার, ২২ জুন, ২০১০)। একই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয় পাটকল বন্ধ করার জন্য, ভারতকে দেয় চালু করার জন্য।
এত মন্দের মধ্যেও চাষিরা এবার পাটের ভালো ফলন ফলিয়েছেন। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাতদ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছর পাটের রপ্তানি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিন-নকশা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। নতুন পাটনীতিতে সরকারও পাট খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলছে। ইতিমধ্যে খুলনার দুটি বন্ধ পাটকল খুলে দেওয়া হয়েছে, আরও হবে। কারখানা চালুর দিনকে শ্রমিকেরা বর্ণনা করেছেন ঈদের দিন বলে। এটাই সুযোগ ঘুরে দাঁড়ানোর।
আমাদের শক্ত শিল্পভিত্তি প্রয়োজন। দরকার শক্তিশালী কৃষিও। পাটের মধ্যে এ দুয়েরই সোনালি সম্ভাবনা। এ খাতে আমাদের শত শত বছরের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। এখানে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যদি তা হয়, বুঝতে হবে সচেতন আত্মঘাত। এবং সেটা এমন এক আত্মঘাত, যে করে সে বাঁচে কিন্তু ক্ষতি হয় দেশের। ঠিক যেমন এরশাদ এখনো বহাল তবিয়তে আছেন, কিন্তু দেশের পাটশিল্পের অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
বাঙালিরা কখনোই বড় কোনো শিল্প খাত গঠন করতে পারেনি। ব্রিটিশ আমলে কিছু করেছিল মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা, পাকিস্তান আমলে তাদের জায়গা নেয় পশ্চিম পাকিস্তানি আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানীরা। বাহাত্তর সালে এদেরই ফেলে যাওয়া ৫৪৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৎকালীন মুজিব সরকার জাতীয়করণ করে। এগুলো লাভজনকভাবে টিকিয়ে রাখা তো দূরের কথা, বরং জাতীয়করণের নামে দলীয় লোকজন ও আমলারা এগুলোকে দুর্নীতির মাধ্যমে ফোঁপরা করে দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষী, পাটের শত্রু মানেই জাতীয় শত্রু। গত দুই শ বছরের বাংলার ইতিহাসের বড় অংশজুড়ে পাটই ছিল নায়কের ভূমিকায়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলার পাট ইংল্যান্ড-আমেরিকায় রপ্তানি হতে শুরু করে। ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্প-দুনিয়ার রমরমা হয় বাংলার পাটের সুবাদেই। বিরাট বিরাট পাট-বস্ত্রকল প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরে। বাংলার সম্পদে ইংল্যান্ডে জুট ব্যারন নামে নতুন এক ধনিক শ্রেণীরও জন্ম হয়। পরে এই জুট ব্যারনদের জায়গা নেয় ভারতের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। বিশ শতকের শুরুতে পূর্ব বাংলায় পাটের আড়তদারি আর পশ্চিম বাংলার পাটশিল্পের মালিকানায় তারাই ছিল একচেটিয়া। আজকের ভারতের টাটা-বিড়লাদের শিল্পসাম্রাজ্যেরও গোড়াপত্তন পাটের কারখানার মাধ্যমেই।
ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তান এল। পশ্চিম পাকিস্তানি ধনকুবের আদমজী-বাওয়ানী-ইস্পাহানীরাই হয় নতুন জুট ব্যারন। এভাবে পাটের মুনাফা বারবার বিভিন্ন রঙের ‘পশ্চিমা’দের হাতে চলে যাওয়া বাংলার মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। গত শতকের তিরিশের দশকে ময়মনসিংহের গ্রাম্য কবি সোমেদ আলী মিয়া গান লেখেন, ‘পাট আসিয়া যখন দেশেতে পৌঁছিল,/ পশ্চিমা এসে তখন দখল করিল।’ রংপুরের কৃষক কবি আবেদ আলী মিয়া লেখেন, ‘তোমার টাকা দিয়া যত মাড়োয়ারিরা ধনী,/ তোমরা পাইলে ছাই-ভস্ম, কাইড়া নেয় গুনি।’ গ্রামীণ কবিদের এই অভিযোগই পরে বিকশিত হয়ে ছয় দফা কর্মসূচিতে রূপ নেয়।
দীর্ঘ সময়জুড়ে পাটই ছিল বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল। গত শতকের শুরুতে বিশ্ববাজারে পাটের দাম বাড়তে থাকলে বাংলার কৃষকেরা সমৃদ্ধির মুখ দেখতে থাকেন। পাটের ফলন চাষির সামর্থ্য বাড়ায়। গ্রামগঞ্জের পাটের ব্যাপারিরা হয়ে ওঠেন সবল সামাজিক গোষ্ঠী। গ্রামীণ চাষি-জোতদার আর ব্যাপারিরা তাঁদের এই নতুন অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ও রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে থাকেন। কৃষকের সন্তান প্রথমবারের মতো আধুনিক শিক্ষা নিতে যায় মফস্বলের স্কুল-কলেজে, সেখান থেকে আরও উচ্চশিক্ষার জন্য আসে ঢাকায়। ঢাকা তত দিনে প্রাদেশিক রাজধানী এবং সেখানে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই পাটচাষি-জোতদার-ব্যাপারিরা সরাসরি জমিদার-মহাজনদের চ্যালেঞ্জ জানান। তাঁরা কত বলবান ছিলেন, তার প্রমাণ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান। নতুন এই রাজনৈতিক শক্তি তাঁর নেতৃত্বে ১৯৩৫ সালের নির্বাচনে হিন্দু জমিদার আর মুসলিম নবাব-নাইটদের হটিয়ে প্রাদেশিক সরকার পর্যন্ত গঠন করে ফেলে। তাঁর হাত ধরেই পূর্ব বাংলা একদিকে কংগ্রেস, আরেকদিকে মুসলিম লীগের অভিজাত-সাম্প্রদায়িক বৃত্তের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাংলায় সূচনা হয় জনগণভিত্তিক সেকুলার রাজনীতির। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে পাটের ভালো ফলন আর বর্ধিত দাম একে সম্ভব করেছিল (Taj Hashmi: Peasants Utopia, UPL)|
আগেই বলেছি, তিরিশের দশকে পশ্চিমা বলতে মানুষ বুঝত ভিনদেশি ইংরেজ আর মাড়োয়ারিদের। ষাটের দশকে একই রকম পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব জাতীয়তাবাদী চেতনাকে পুষ্ট করতে থাকে। শেখ মুজিবের ছয় দফা জনপ্রিয় হয় পাটের বঞ্চনার অভিযোগের কারণেই। বাংলার কৃষক ভোলেননি, পাটের সোনালি আঁশের কল্যাণেই তাঁদের অনেকের ঘরের চালে প্রথম টিন লেগেছিল, মেয়ে-বউয়ের গলায় উঠেছিল সোনার গয়না। সেই স্মৃতি মনে ছিল বলেই ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’—এই প্রশ্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলল।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস তাই পাটেরও ইতিহাস। তিরিশের দশকে পাটচাষির আন্দোলন, ষাট ও আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাটকল-শ্রমিকদের সংগ্রামের কাছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ঋণী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্মাণ, সোনার বাংলার মিথ সৃজনের কৃতিত্ব আর অর্থনীতির সোনালি মুকুট তাই পাটচাষি ও পাটশ্রমিকের মস্তকেই শোভা পাওয়ার কথা। কিন্তু যা হওয়ার কথা এই পোড়ার দেশে তার উল্টোটাই ঘটে! পাটের আদর কমে, কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর চিংড়ি চাষে উৎসাহ বাড়ে।
মুজিব-জিয়া-এরশাদের আমলের অদূরদর্শী পদক্ষেপগুলোর সংশোধন তো দূরের কথা, নব্বইয়ের পরে চলতে থাকে সেসবেরই ধারাবাহিকতা। ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং স্টাডি’ ও ‘বাংলাদেশ রিস্ট্রাকচারিং অপশনস ফর দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক দুটি সমীক্ষা অনুসারে পাট খাত সমন্বয় ঋণ কর্মসূচি (জেএসএসি) হাতে নেওয়া হয়। এতেই পাটশিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। কর্পূরের মতো উবে যায় সোনার বাংলার স্বপ্নও। রাষ্ট্রের অপচয় আর ধ্বংসাত্মক কায়কারবারের এত বড় শিকার অর্থনীতির আর কোনো খাত হয়নি। পাটের বেদন তাই জাতীয় বেদন।
এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধের বছরই (২০০২) ঘোষিত হয় জাতীয় পাটনীতি। তখন দেশের মোট রপ্তানি-আয়ের ৮-১২ শতাংশ আসত পাট ও পাটজাতপণ্য থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩-০৪ সালে এই হার ৪ শতাংশে নামে। অথচ ১৯৭২-’৭৩ সালে রপ্তানি-আয়ের ৯০ শতাংশই জোগাত এই খাত। যে দেশের আবহাওয়া পাট চাষের অনুকূল, চাষিরাও দক্ষ এবং যে দেশের পাট জাতে সেরা বলেচাহিদাও বিশ্বব্যাপী, সেখানে এমন হওয়ার কারণ কী? কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, নানান ষড়যন্ত্রে পাটের সোনালি গৌরব মিলিয়ে গিয়েছিল (ডেইলি স্টার, ২ জুন, ২০১০)।
বিপরীতে ২০০৫ সালে ঘোষিত ভারতের পাটনীতিতে রপ্তানি আয় এক হাজার কোটি রুপি থেকে ২০১০ সালে পাঁচ হাজার কোটি রুপিতে তোলার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাট খাত চাঙা করায় বিশ্বব্যাংকের ঋণও তারা পায়। ভারত সরকার পাটচাষিদের ৫১৪ কোটি রুপি বকেয়া ঋণ ও সুদ মওকুফ করে। পাশাপাশি ৩০২ কোটি রুপির ভর্তুকিও চালু রাখে। দুই দেশের শাসকদের এই বৈপরীত্যের মধ্যেই বাংলাদেশের শিল্প ধ্বংস আর ভারতের শিল্প শক্তিশালী হওয়ার রহস্য নিহিত।
পাট খাতের পতনের সব দোষ শ্রমিকের ঘাড়ে চাপানো হয়ে থাকে। পাট মন্ত্রণালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৬ সালে লোকসান হওয়া ৪২১ কোটি টাকার মধ্যে শ্রমিক আন্দোলনের দায় মাত্র ৩০ কোটি টাকা। অন্যদিকে পাট কিনতে দেরির ক্ষতি ১৪০ কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ বিবিধ অশ্রমিক কারণে লোকসান হয় ১৩০ কোটি টাকা। ভি ভাস্কর এবং মুশতাক খানের এ-সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গেছে, পাটকলগুলোতে বাড়তি শ্রমিক ছিলেন না, বরং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাড়তি কর্মচারী-কর্মকর্তা সেখানে পোষা হতো। বর্তমান পাটমন্ত্রীও এক সভায় যথার্থই বলেছেন, সমস্যাটা জুট মিলে নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়। গত চল্লিশ বছরে এ রকমটাই চলেছে। অথচ এর জন্য আজ অবধি কোনো মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদের শাস্তি হয়নি, ক্ষমা চায়নি বিশ্বব্যাংকের রাশভারী আমলারা। অথচ তাঁদেরই দোষে দক্ষ শ্রমিক হয়েছেন রিকশাচালক, অনেক শ্রমিকের স্ত্রী-কন্যারা চলে গেছে আদিম পেশায়, অনেকের লেখাপড়ার পাট চুকেছে। না খেয়ে মরেছে অনেকে। আদমজী বন্ধের পর সেখানকার এক শ্রমিক হাহাকার করে বলেছিলেন, ‘যেদিন কারখানার ভেঁপু বন্ধ হলো, সেদিনই আমাদের ভাগ্যের কবর হলো।’
এসবেরই পরিণাম হলো একসময় বিশ্বের পাটের বাজারের ৭০ শতাংশের জোগানদাতা বাংলাদেশের ভারতের কাছে মার খাওয়া। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ১৪ লাখ টন পাটদ্রব্য রপ্তানি করে; ভারত করে মাত্র ছয় টন। বিশ্ববাজারে তখন মোট চাহিদা ছিল ৩০ লাখ টন। দান উল্টে গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৬০টি পাটকল বন্ধ, চলছে মাত্র ২২টি। বিপরীতে ভারতে চালু আছে ৭৮টিরও বেশি পাটকল (ডেইলি স্টার, ২২ জুন, ২০১০)। একই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয় পাটকল বন্ধ করার জন্য, ভারতকে দেয় চালু করার জন্য।
এত মন্দের মধ্যেও চাষিরা এবার পাটের ভালো ফলন ফলিয়েছেন। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাতদ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছর পাটের রপ্তানি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিন-নকশা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। নতুন পাটনীতিতে সরকারও পাট খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলছে। ইতিমধ্যে খুলনার দুটি বন্ধ পাটকল খুলে দেওয়া হয়েছে, আরও হবে। কারখানা চালুর দিনকে শ্রমিকেরা বর্ণনা করেছেন ঈদের দিন বলে। এটাই সুযোগ ঘুরে দাঁড়ানোর।
আমাদের শক্ত শিল্পভিত্তি প্রয়োজন। দরকার শক্তিশালী কৃষিও। পাটের মধ্যে এ দুয়েরই সোনালি সম্ভাবনা। এ খাতে আমাদের শত শত বছরের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। এখানে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যদি তা হয়, বুঝতে হবে সচেতন আত্মঘাত। এবং সেটা এমন এক আত্মঘাত, যে করে সে বাঁচে কিন্তু ক্ষতি হয় দেশের। ঠিক যেমন এরশাদ এখনো বহাল তবিয়তে আছেন, কিন্তু দেশের পাটশিল্পের অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments