জেনারেল উইন্টার -দুই দু’গুণে পাঁচ by আতাউর রহমান
স্বনামধন্য
রুশ ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড পিস যাঁরা পাঠ
করেছেন, তাঁদের ব্যাপারটা বলা অনেকটা বিলেতের নিউক্যাসল শহরে কয়লা নিয়ে
যাওয়ার সমান, কিন্তু যাঁরা ওটা পড়েননি, তাঁদের উদ্দেশে নিবেদন করছি: সময়টা
১৮১২ সাল, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন তাঁর বিরাট সেনাবাহিনী দিয়ে রাশিয়া
আক্রমণ করে বসলেন। কিন্তু রুশরা কোনো সম্মুখ-সমরে অবতীর্ণ হলো না, ধাবমান
ফরাসিদের বিপরীতে ওরা ক্রমাগত পিছু হটতে থাকল। তবে পিছু হটার সময় ওরা
পোড়ামাটিনীতি, যেটাকে ইংরেজিতে বলে ‘স্করচড আর্থ পলিসি’ (Scorched Earth
Policy) গ্রহণ করায় ক্রম-অগ্রসরমাণ ফরাসি বাহিনী চরম বেকায়দায় পড়ে গেল।
তদুপরি শীতকাল এসে পড়ায় উপায়ান্তর না দেখে নেপোলিয়ন যখন তাঁর সেনাবাহিনী
প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন, তখন ফেরার পথে বিরাট সেনাবাহিনীর প্রায়
অর্ধেক অনাহারে ও অবশিষ্টরা রাশান শীতের তীব্রতা সইতে না পেরে নিশ্চিহ্ন
হয়ে গিয়েছিল।
তা উপন্যাসটি নেপোলিয়নের সেই আগ্রাসনের পটভূমিকায় লিখিত বিধায় টলস্টয় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পরিশেষে একটি মজার মন্তব্য করেছেন: অতঃপর রুশরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল জেনারেল কুটুজক (যিনি তত্কালে রুশ বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন) ও জেনারেল উইন্টারকে (অর্থাত্ শীতকালকে)। সত্যিই তো, শীতকালটা একজন আর্মি জেনারেলের মতোই পরাক্রমশালী। তা না হলে সম্প্রতি আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখতে পেতাম না বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে সমুন্নত ইউরোপ ও আমেরিকা শীতকালে তুষারপাতের যন্ত্রণায় কীভাবে পর্যুদস্ত। আর রাশান শীতের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। সাধে কি আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী ইউরোপীয় মিত্রশক্তিগুলো যখন বিভিন্ন দেশের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করছিল, তখন সীমান্তবর্তী এক পোলিশ কৃষকের বাড়ি রাশিয়ায় না পড়ে পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সে খুব খুশি হয়ে বলেছিল, ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল, রাশিয়ার ওই তীব্র শীত আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না!’
শীতকালের বদনাম অনেক—শীতকাল নাকি স্থবিরতা ও নির্জীবতার প্রতীক। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলী (P. B. Shelley) কিন্তু তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার শেষ চরণে শীতকাল প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত সারগর্ভ কথা বলেছেন, ‘ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড (If winter comes, can spring be far behind)?’ অর্থাত্, ‘শীতকাল যদি আসে, তাহলে বসন্তকাল কি রয় দূরে?’ আর বসন্তকাল হচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য ও জীবনীশক্তির প্রতীক। তাই তো এক বাঙালি কবি বসন্তের আগমনে উত্ফুল্ল হয়ে লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।’ তাই তো শীতকালকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই—শীতকাল আছে বলেই তো বসন্তকে আমরা উপভোগ করি, সানন্দে স্বাগত জানাই। প্রসঙ্গত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বহু-পঠিত পঙিক্তগুলোও স্মর্তব্য: ‘মেঘ দেখে তোরা কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে/হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।’
বলছিলাম রাশান শীতের কথা। সে দেশের যে অঞ্চলটি সাইবেরিয়া নামে খ্যাত, সেখানটাই শীতের তীব্রতা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই ওই অঞ্চলের হাঁস-পাখিরা শীতের আগমনে আমাদের মতো উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে ‘মাইগ্রেট’ করে এবং গ্রীষ্মের আগমনে আবার যখন ওদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে হয়, তখন নাকি ওদের কণ্ঠে এক ধরনের করুণ সংগীত শোনা যায়; যে কারণে ইংরেজি ভাষায় একটি বাগধারাই উদ্ভাবিত হয়েছে ‘সোয়ান সং’ (Swan song)—কোনো শিল্পীর শেষ সেরা কাজকে এই নামে অভিহিত করা হয়। তা সে যা হোক, সাইবেরিয়ার এক অধিবাসী নাকি একবার গল্পচ্ছলে বলেছিল, ‘আমাদের ওখানে শীত এতটাই তীব্র যে, শীতকালে যখন আমরা দুজন লোক বাইরে বসে আলাপ করি, তখন মাঝখানে একটা স্টোভ জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেননা, তা না হলে কেউ কারও কথা শুনতে পাই না, কথা জমে বরফ হয়ে যায়।’
স্কটল্যান্ডও পাহাড়ি এলাকা বিধায় শীত প্রচুর। তো আরেকবার একজন ইংলিশম্যান ও একজন স্কচম্যানের মধ্যে শীতকাল নিয়ে কথা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে স্কচম্যান ইংলিশম্যানকে বলল, ‘আমাদের এখানকার শীতের তুলনায় তোমাদের ইংল্যান্ডের শীত কিছুই নয়। আমার মনে পড়ে, একবার শীতকালে একটি ভেড়া টিলার ওপর থেকে মাঠের উদ্দেশে লাফ দিয়ে আর মাটিতে পড়তে পারেনি, মাঝপথে জমে গিয়ে বরফের বলের মতো ভাসছিল।’
‘কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তো সেটা মানবে না,’ ইংলিশম্যানের এই মন্তব্যে স্কচম্যান ঝটপট জবাব দিল, ‘আরে, রাখো তোমার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিজেই যে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল।’
আর শীতকাল তো আমাদের জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই হাসির গল্পেও শীতকাল তথা শীত ঘুরেফিরে আসে বৈকি। উদাহরণ চান? নিন তাহলে—
রকেটের সমান গতিসম্পন্ন প্লেনে তিন বন্ধু পৃথিবী পরিভ্রমণ করছিল; তাদের একজন আফ্রিকান, একজন রাশান ও একজন বাঙালি। তো তারা প্রত্যেকে প্লেনের জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে ধারণা করার চেষ্টা করছিল, প্লেনটি সে মুহূর্তে কোথায় আছে। রাশান লোকটি তার এক হাত বের করেই সেটা গুটিয়ে এনে বলল, ‘জায়গাটা নিশ্চয়ই আমাদের সাইবেরিয়ার কোথাও হবে। কারণ, ঠান্ডায় আমার হাত জমে যাচ্ছিল।’ খানিকক্ষণ পর আফ্রিকান তার ডান হাত বের করেই তা গুটিয়ে এনে বলতে লাগল, ‘জায়গাটা আমার মহাদেশের সাহারা মরুভূমি হবে। কারণ, গরমে আমার হাত যেন পুড়ে যাচ্ছিল।’ আরও কিছুক্ষণ পর বাঙালি ভদ্রলোক তার বাঁ হাত বের করেই ঝাড়ি খেয়ে হাতটা ভেতরে টেনে নিয়ে এসে বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই আমাদের ঢাকার গুলিস্তান এরিয়া হবে। কার,ণ আমি বাঁ হাত বের করা মাত্রই কে যেন ঝটকা দিয়ে আমার হাতঘড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।’
>>>আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
তা উপন্যাসটি নেপোলিয়নের সেই আগ্রাসনের পটভূমিকায় লিখিত বিধায় টলস্টয় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পরিশেষে একটি মজার মন্তব্য করেছেন: অতঃপর রুশরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল জেনারেল কুটুজক (যিনি তত্কালে রুশ বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন) ও জেনারেল উইন্টারকে (অর্থাত্ শীতকালকে)। সত্যিই তো, শীতকালটা একজন আর্মি জেনারেলের মতোই পরাক্রমশালী। তা না হলে সম্প্রতি আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখতে পেতাম না বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে সমুন্নত ইউরোপ ও আমেরিকা শীতকালে তুষারপাতের যন্ত্রণায় কীভাবে পর্যুদস্ত। আর রাশান শীতের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। সাধে কি আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী ইউরোপীয় মিত্রশক্তিগুলো যখন বিভিন্ন দেশের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করছিল, তখন সীমান্তবর্তী এক পোলিশ কৃষকের বাড়ি রাশিয়ায় না পড়ে পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সে খুব খুশি হয়ে বলেছিল, ‘যাক বাবা, বাঁচা গেল, রাশিয়ার ওই তীব্র শীত আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না!’
শীতকালের বদনাম অনেক—শীতকাল নাকি স্থবিরতা ও নির্জীবতার প্রতীক। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলী (P. B. Shelley) কিন্তু তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতার শেষ চরণে শীতকাল প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত সারগর্ভ কথা বলেছেন, ‘ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড (If winter comes, can spring be far behind)?’ অর্থাত্, ‘শীতকাল যদি আসে, তাহলে বসন্তকাল কি রয় দূরে?’ আর বসন্তকাল হচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য ও জীবনীশক্তির প্রতীক। তাই তো এক বাঙালি কবি বসন্তের আগমনে উত্ফুল্ল হয়ে লিখেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।’ তাই তো শীতকালকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই—শীতকাল আছে বলেই তো বসন্তকে আমরা উপভোগ করি, সানন্দে স্বাগত জানাই। প্রসঙ্গত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বহু-পঠিত পঙিক্তগুলোও স্মর্তব্য: ‘মেঘ দেখে তোরা কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে/হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।’
বলছিলাম রাশান শীতের কথা। সে দেশের যে অঞ্চলটি সাইবেরিয়া নামে খ্যাত, সেখানটাই শীতের তীব্রতা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই ওই অঞ্চলের হাঁস-পাখিরা শীতের আগমনে আমাদের মতো উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে ‘মাইগ্রেট’ করে এবং গ্রীষ্মের আগমনে আবার যখন ওদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে হয়, তখন নাকি ওদের কণ্ঠে এক ধরনের করুণ সংগীত শোনা যায়; যে কারণে ইংরেজি ভাষায় একটি বাগধারাই উদ্ভাবিত হয়েছে ‘সোয়ান সং’ (Swan song)—কোনো শিল্পীর শেষ সেরা কাজকে এই নামে অভিহিত করা হয়। তা সে যা হোক, সাইবেরিয়ার এক অধিবাসী নাকি একবার গল্পচ্ছলে বলেছিল, ‘আমাদের ওখানে শীত এতটাই তীব্র যে, শীতকালে যখন আমরা দুজন লোক বাইরে বসে আলাপ করি, তখন মাঝখানে একটা স্টোভ জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কেননা, তা না হলে কেউ কারও কথা শুনতে পাই না, কথা জমে বরফ হয়ে যায়।’
স্কটল্যান্ডও পাহাড়ি এলাকা বিধায় শীত প্রচুর। তো আরেকবার একজন ইংলিশম্যান ও একজন স্কচম্যানের মধ্যে শীতকাল নিয়ে কথা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে স্কচম্যান ইংলিশম্যানকে বলল, ‘আমাদের এখানকার শীতের তুলনায় তোমাদের ইংল্যান্ডের শীত কিছুই নয়। আমার মনে পড়ে, একবার শীতকালে একটি ভেড়া টিলার ওপর থেকে মাঠের উদ্দেশে লাফ দিয়ে আর মাটিতে পড়তে পারেনি, মাঝপথে জমে গিয়ে বরফের বলের মতো ভাসছিল।’
‘কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তো সেটা মানবে না,’ ইংলিশম্যানের এই মন্তব্যে স্কচম্যান ঝটপট জবাব দিল, ‘আরে, রাখো তোমার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিজেই যে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল।’
আর শীতকাল তো আমাদের জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই হাসির গল্পেও শীতকাল তথা শীত ঘুরেফিরে আসে বৈকি। উদাহরণ চান? নিন তাহলে—
রকেটের সমান গতিসম্পন্ন প্লেনে তিন বন্ধু পৃথিবী পরিভ্রমণ করছিল; তাদের একজন আফ্রিকান, একজন রাশান ও একজন বাঙালি। তো তারা প্রত্যেকে প্লেনের জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে ধারণা করার চেষ্টা করছিল, প্লেনটি সে মুহূর্তে কোথায় আছে। রাশান লোকটি তার এক হাত বের করেই সেটা গুটিয়ে এনে বলল, ‘জায়গাটা নিশ্চয়ই আমাদের সাইবেরিয়ার কোথাও হবে। কারণ, ঠান্ডায় আমার হাত জমে যাচ্ছিল।’ খানিকক্ষণ পর আফ্রিকান তার ডান হাত বের করেই তা গুটিয়ে এনে বলতে লাগল, ‘জায়গাটা আমার মহাদেশের সাহারা মরুভূমি হবে। কারণ, গরমে আমার হাত যেন পুড়ে যাচ্ছিল।’ আরও কিছুক্ষণ পর বাঙালি ভদ্রলোক তার বাঁ হাত বের করেই ঝাড়ি খেয়ে হাতটা ভেতরে টেনে নিয়ে এসে বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই আমাদের ঢাকার গুলিস্তান এরিয়া হবে। কার,ণ আমি বাঁ হাত বের করা মাত্রই কে যেন ঝটকা দিয়ে আমার হাতঘড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।’
>>>আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments