রোগী মরিলেন, ডাক্তারও মরিয়া গেলেন by সুমন রহমান
ছোট্ট একটি খবর ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর ১০ জানুয়ারি ২০১০ সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায়। কবিরাজের দেওয়া আমাশয়ের ওষুধ খাওয়ার পর পেটের ব্যথায় মৃত্যু হয় সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার যুবক হাবিবুর রহমানের। পরে ওই যুবকের আত্মীয়স্বজন কবিরাজকে হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে চাইলে কবিরাজ ময়দান আলী অভিযোগ হাতে-কলমে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য তাঁদের সামনে নিজেই সেই ওষুধ পান করেন। একইভাবে তিনিও প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
‘ওষুধ বটে’ শিরোনামের এ সংবাদটি পড়ি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে। সেখানে আবার পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ আছে। যথারীতি এ সংবাদটুকুতেও প্রতিক্রিয়া করেছেন পাঠক। বেশির ভাগ প্রতিক্রিয়াই গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারদের এসব ‘অপকীর্তি’র নিন্দা জানিয়ে। কেউ কেউ আবার দেখছি, এ জোড়া মৃত্যুর জন্য সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ওষুধ প্রশাসনকে দোষারোপ বা দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য ন্যায্য, সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি এ সংবাদটুকুর মধ্যে আরও ভাববার কিছু আছে বলে মন খচখচ করতে থাকল। মামুলি দুটি মৃত্যু, এ মৃত্যুময় বাংলাদেশে আমার স্বস্তি হরণ করে নিল।
হাবিবুর রহমান দুরারোগ্য আমাশয়ের রোগী ছিলেন, পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানা যায়। অনেক চিকিত্সা করিয়েও কোনো সুফল পাননি তিনি। ফলে কবিরাজের দ্বারস্থ হন। এটুকু থেকে অনুমান করা যায়, আমাশয়ের জন্য তিনি অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সা করিয়েছেন। তারপর কবিরাজের শরণ নেন।
কবিরাজি, হাতুড়ে ডাক্তারিবিদ্যা বা টোটকা দাওয়াই, যা-ই বলি না কেন, এ চিকিত্সাপদ্ধতি অনাদিকাল থেকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে এবং শহরেও এর দাপট খুব কম নয়। ঢাকা শহরের গুলিস্তানে জ্যান্ত খাঁচাবন্দী শেয়ালকে নমুনা হিসেবে দেখিয়ে বাতের ওষুধ বিক্রির ঘটনা তো হরহামেশাই দেখা যায়। গ্রামের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে কিংবা ভাগ্যান্বেষণে যখন শহরে আসে, তখন তার সঙ্গে সে নিয়ে আসে তার গরিবি, তার সংস্কৃতি, তার গান এবং তার চিকিত্সাপদ্ধতিকেও। ফলে হাজার হাজার শিক্ষিত ডাক্তার, শত শত প্যাথলজি আর গন্ডা গন্ডা হাসপাতালের শহর এ ঢাকায় তাই কবিরাজি চিকিত্সা স্বচ্ছন্দে এবং প্রকাশ্যেই চলমান থাকে।
তবে মানুষ যে শুধু সামর্থ্যের অভাবেই কবিরাজের কাছে যায়, তা নয়। আলোচ্য ঘটনাটিই দেখি, বলা হয়েছে, হাবিবুর রহমান অনেক চিকিত্সার পর কবিরাজের কাছে ধরনা দেন। হাবিবুর রহমানের আমাশয় আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের অনধিগম্য সত্যিই ছিল কি না, তা আজ আর জানার উপায় নেই, যেহেতু তিনি মৃত। আর আমাশয় কতটা দুরারোগ্য কি অনারোগ্য, তার খবর চিকিত্সাবিজ্ঞানী কিংবা চিকিত্সকই জানবেন। তবে সাধারণভাবে যতটুকু বুঝি, দুরারোগ্য বা অনারোগ্য কোনো ব্যাধির সঙ্গে কীভাবে বসবাস করতে হয়, সে বিষয়ে রোগীকে ওয়াকিবহাল করা চিকিত্সকের দায়িত্ব। উন্নত বিশ্বের চিকিত্সাপদ্ধতির সঙ্গে যতটুকু পরিচয় হয়েছে, তাতে দেখেছি, চিকিত্সক রোগীকে বা তাঁর অভিভাবককে রোগ সম্পর্কে জানাতে কী পরিমাণ সময় ব্যয় করেন। সেসব দেশে চিকিত্সা একটি পেশা বা বৃত্তি, যাতে কিছু দায়িত্বশীল মানুষ নিয়োজিত থাকেন। আর আমাদের দেশে চিকিত্সক একটা স্ট্যাটাস গ্রুপ। একটা অভিজাত শ্রেণী। অংশত এ কারণে, অংশত চর্চার অভাবে আমাদের চিকিত্সকদের রোগীর সামনে বাকস্ফুর্তি বিশেষ হয় না। রোগীর কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কী করতে হবে, এতে রোগীর সায় আছে কি না— এসব বিষয়ে কথা খরচ করতে নারাজ তাঁরা। এমনকি রোগীর বাকস্ফুর্তিকেও তাঁরা খুব উত্সাহিত করেন, এমন চর্চাও বিরল।
এ রকম কোনো অবস্থার ফেরেই হয়তো অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সায় ফলাফলশূন্য আমাশয়ের রোগী হাবুিবর রহমানকে কবিরাজ ময়দান আলীর দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। কারণ, ময়দান আলী হচ্ছেন সেই ডাক্তার এবং প্রতিবেশী, যাঁকে মনের সব কথা খুলে বলা যায়, জিজ্ঞেস করা যায়। ধমকের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয় না। আবার ময়দান নিজেই ডাক্তার, নিজেই ফার্মাসি, সেই সঙ্গে নিজেই ফার্মাসিউটিক্যালস। ফলে তাঁর কাছে রোগী এক ধরনের স্বচ্ছতার অনুভব পাবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। ভুল বুঝবেন না পাঠক! আমি কবিরাজি চিকিত্সার ওকালতি করছি না। তার কোনো কারণও নেই। কিন্তু যত দিন না রাষ্ট্র তার নাগরিকদের চিকিত্সার দায়দায়িত্ব নিতে পারবে, এবং যত দিন না ‘আধুনিক’ চিকিত্সা-ব্যবস্থা শ্রেণীনির্বিশেষে সেবামূলক হয়ে উঠতে পারবে, তত দিন পর্যন্ত কবিরাজিকে হজম করতে হবে। কারণ, কবিরাজি চিকিত্সা-ব্যবস্থা তার ইনক্লুসিভ চরিত্র এবং তৃণমূল-সংশ্লিষ্টতার কারণে রোগীর মধ্যে এমন এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি এনে দেয়, যা আমাদের দেশের কম্পার্টমেন্টালাইজড এবং প্রেজুডিসড অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সা-ব্যবস্থা দেয় না। অথচ এটা দেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
মৃত হাবিবুর রহমানের আত্মীয়স্বজনের সামনে কবিরাজ ময়দান আলীর নিজের তৈরি ওষুধ সেবনে আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, ময়দান শুধু ডাক্তারই নন, পাশাপাশি তিনি একজন ওষুধ বিক্রেতা এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী। বিবেক পরিষ্কার থাকায় নিজের ওষুধের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস তাঁর ছিল। এ মৃত্যু ডাক্তার ময়দান আলীর যতটা, ওষুধ প্রস্তুতকারী ময়দান আলীর তার চেয়ে বেশি। এটি নিঃসন্দেহে একটি নৈতিক মৃত্যু। এখানে যা কিছু গলদ, তা কবিরাজিবিদ্যার—ইতিহাস বা ঐতিহ্য তার পক্ষে থাকলেও সে বর্তমানের চাহিদানুযায়ী অভিযোজিত হয়নি। যা কিছু গলদ তা বাংলাদেশে প্রচলিত এলিট অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সাবিদ্যার—কারণ, তা সর্বসাধারণকে প্রবেশাধিকার দেয় না। অর্থনৈতিকভাবেও না, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও না।
জবাবদিহিতার প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়া দরকার বাংলাদেশের চিকিত্সা-ব্যবস্থায়। ময়দান আলী যেখানে নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের জবাবদিহিতা করেছেন, সেখানে মাত্র কিছুদিন আগে প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ১৫-এর বেশি শিশুমৃত্যুর ঘটনার আদৌ কতটুকু প্রতিকার হয়েছে? কেবল ওষুধ কোম্পানিকে নিষিদ্ধ আর জরিমানা করে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনাকে সামাল দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত, যেখানে আমরা দেখেছি, ওই প্যারাসিটামল বিষাক্ত হয়ে ওঠার মূল কারণ ছিল একটি বিশেষ কাঁচামাল, যা কেবল মুনাফা বাড়ানোর জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল! কার কাছে কতটুকু জবাবদিহি করতে হয় আমাদের চিকিত্সক, প্যাথলজি ল্যাব আর হাসপাতালগুলোকে? উত্তর সবাই জানেন। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অবাধে ওষুধ বিক্রি হয়, যেখানে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করার বদলে ব্র্যান্ড প্রমোশনের বাজেট বাড়ায়, যেখানে নামধামহীন কোম্পানির রমরমা প্রমোশনে প্রলুব্ধ হয় নামধামওয়ালা দায়িত্বশীল চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র, সেখানে একটি আদিম চিকিত্সা-ব্যবস্থার বিভ্রান্ত বাহক ময়দান আলীর আত্মাহুতির ঘটনাটি কি কোনো নৈতিক টানাপোড়েন তৈরি করবে এ চিকিত্সা-বাণিজ্যের পাপচক্রে?
সুমন রহমান: লেখক ও গল্পকার।
‘ওষুধ বটে’ শিরোনামের এ সংবাদটি পড়ি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে। সেখানে আবার পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ আছে। যথারীতি এ সংবাদটুকুতেও প্রতিক্রিয়া করেছেন পাঠক। বেশির ভাগ প্রতিক্রিয়াই গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারদের এসব ‘অপকীর্তি’র নিন্দা জানিয়ে। কেউ কেউ আবার দেখছি, এ জোড়া মৃত্যুর জন্য সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ওষুধ প্রশাসনকে দোষারোপ বা দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য ন্যায্য, সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি এ সংবাদটুকুর মধ্যে আরও ভাববার কিছু আছে বলে মন খচখচ করতে থাকল। মামুলি দুটি মৃত্যু, এ মৃত্যুময় বাংলাদেশে আমার স্বস্তি হরণ করে নিল।
হাবিবুর রহমান দুরারোগ্য আমাশয়ের রোগী ছিলেন, পত্রিকা পড়ে যতটুকু জানা যায়। অনেক চিকিত্সা করিয়েও কোনো সুফল পাননি তিনি। ফলে কবিরাজের দ্বারস্থ হন। এটুকু থেকে অনুমান করা যায়, আমাশয়ের জন্য তিনি অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সা করিয়েছেন। তারপর কবিরাজের শরণ নেন।
কবিরাজি, হাতুড়ে ডাক্তারিবিদ্যা বা টোটকা দাওয়াই, যা-ই বলি না কেন, এ চিকিত্সাপদ্ধতি অনাদিকাল থেকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে এবং শহরেও এর দাপট খুব কম নয়। ঢাকা শহরের গুলিস্তানে জ্যান্ত খাঁচাবন্দী শেয়ালকে নমুনা হিসেবে দেখিয়ে বাতের ওষুধ বিক্রির ঘটনা তো হরহামেশাই দেখা যায়। গ্রামের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে কিংবা ভাগ্যান্বেষণে যখন শহরে আসে, তখন তার সঙ্গে সে নিয়ে আসে তার গরিবি, তার সংস্কৃতি, তার গান এবং তার চিকিত্সাপদ্ধতিকেও। ফলে হাজার হাজার শিক্ষিত ডাক্তার, শত শত প্যাথলজি আর গন্ডা গন্ডা হাসপাতালের শহর এ ঢাকায় তাই কবিরাজি চিকিত্সা স্বচ্ছন্দে এবং প্রকাশ্যেই চলমান থাকে।
তবে মানুষ যে শুধু সামর্থ্যের অভাবেই কবিরাজের কাছে যায়, তা নয়। আলোচ্য ঘটনাটিই দেখি, বলা হয়েছে, হাবিবুর রহমান অনেক চিকিত্সার পর কবিরাজের কাছে ধরনা দেন। হাবিবুর রহমানের আমাশয় আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের অনধিগম্য সত্যিই ছিল কি না, তা আজ আর জানার উপায় নেই, যেহেতু তিনি মৃত। আর আমাশয় কতটা দুরারোগ্য কি অনারোগ্য, তার খবর চিকিত্সাবিজ্ঞানী কিংবা চিকিত্সকই জানবেন। তবে সাধারণভাবে যতটুকু বুঝি, দুরারোগ্য বা অনারোগ্য কোনো ব্যাধির সঙ্গে কীভাবে বসবাস করতে হয়, সে বিষয়ে রোগীকে ওয়াকিবহাল করা চিকিত্সকের দায়িত্ব। উন্নত বিশ্বের চিকিত্সাপদ্ধতির সঙ্গে যতটুকু পরিচয় হয়েছে, তাতে দেখেছি, চিকিত্সক রোগীকে বা তাঁর অভিভাবককে রোগ সম্পর্কে জানাতে কী পরিমাণ সময় ব্যয় করেন। সেসব দেশে চিকিত্সা একটি পেশা বা বৃত্তি, যাতে কিছু দায়িত্বশীল মানুষ নিয়োজিত থাকেন। আর আমাদের দেশে চিকিত্সক একটা স্ট্যাটাস গ্রুপ। একটা অভিজাত শ্রেণী। অংশত এ কারণে, অংশত চর্চার অভাবে আমাদের চিকিত্সকদের রোগীর সামনে বাকস্ফুর্তি বিশেষ হয় না। রোগীর কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কী করতে হবে, এতে রোগীর সায় আছে কি না— এসব বিষয়ে কথা খরচ করতে নারাজ তাঁরা। এমনকি রোগীর বাকস্ফুর্তিকেও তাঁরা খুব উত্সাহিত করেন, এমন চর্চাও বিরল।
এ রকম কোনো অবস্থার ফেরেই হয়তো অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সায় ফলাফলশূন্য আমাশয়ের রোগী হাবুিবর রহমানকে কবিরাজ ময়দান আলীর দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। কারণ, ময়দান আলী হচ্ছেন সেই ডাক্তার এবং প্রতিবেশী, যাঁকে মনের সব কথা খুলে বলা যায়, জিজ্ঞেস করা যায়। ধমকের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয় না। আবার ময়দান নিজেই ডাক্তার, নিজেই ফার্মাসি, সেই সঙ্গে নিজেই ফার্মাসিউটিক্যালস। ফলে তাঁর কাছে রোগী এক ধরনের স্বচ্ছতার অনুভব পাবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। ভুল বুঝবেন না পাঠক! আমি কবিরাজি চিকিত্সার ওকালতি করছি না। তার কোনো কারণও নেই। কিন্তু যত দিন না রাষ্ট্র তার নাগরিকদের চিকিত্সার দায়দায়িত্ব নিতে পারবে, এবং যত দিন না ‘আধুনিক’ চিকিত্সা-ব্যবস্থা শ্রেণীনির্বিশেষে সেবামূলক হয়ে উঠতে পারবে, তত দিন পর্যন্ত কবিরাজিকে হজম করতে হবে। কারণ, কবিরাজি চিকিত্সা-ব্যবস্থা তার ইনক্লুসিভ চরিত্র এবং তৃণমূল-সংশ্লিষ্টতার কারণে রোগীর মধ্যে এমন এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি এনে দেয়, যা আমাদের দেশের কম্পার্টমেন্টালাইজড এবং প্রেজুডিসড অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সা-ব্যবস্থা দেয় না। অথচ এটা দেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
মৃত হাবিবুর রহমানের আত্মীয়স্বজনের সামনে কবিরাজ ময়দান আলীর নিজের তৈরি ওষুধ সেবনে আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, ময়দান শুধু ডাক্তারই নন, পাশাপাশি তিনি একজন ওষুধ বিক্রেতা এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী। বিবেক পরিষ্কার থাকায় নিজের ওষুধের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস তাঁর ছিল। এ মৃত্যু ডাক্তার ময়দান আলীর যতটা, ওষুধ প্রস্তুতকারী ময়দান আলীর তার চেয়ে বেশি। এটি নিঃসন্দেহে একটি নৈতিক মৃত্যু। এখানে যা কিছু গলদ, তা কবিরাজিবিদ্যার—ইতিহাস বা ঐতিহ্য তার পক্ষে থাকলেও সে বর্তমানের চাহিদানুযায়ী অভিযোজিত হয়নি। যা কিছু গলদ তা বাংলাদেশে প্রচলিত এলিট অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সাবিদ্যার—কারণ, তা সর্বসাধারণকে প্রবেশাধিকার দেয় না। অর্থনৈতিকভাবেও না, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও না।
জবাবদিহিতার প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়া দরকার বাংলাদেশের চিকিত্সা-ব্যবস্থায়। ময়দান আলী যেখানে নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের জবাবদিহিতা করেছেন, সেখানে মাত্র কিছুদিন আগে প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ১৫-এর বেশি শিশুমৃত্যুর ঘটনার আদৌ কতটুকু প্রতিকার হয়েছে? কেবল ওষুধ কোম্পানিকে নিষিদ্ধ আর জরিমানা করে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনাকে সামাল দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত, যেখানে আমরা দেখেছি, ওই প্যারাসিটামল বিষাক্ত হয়ে ওঠার মূল কারণ ছিল একটি বিশেষ কাঁচামাল, যা কেবল মুনাফা বাড়ানোর জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল! কার কাছে কতটুকু জবাবদিহি করতে হয় আমাদের চিকিত্সক, প্যাথলজি ল্যাব আর হাসপাতালগুলোকে? উত্তর সবাই জানেন। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অবাধে ওষুধ বিক্রি হয়, যেখানে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করার বদলে ব্র্যান্ড প্রমোশনের বাজেট বাড়ায়, যেখানে নামধামহীন কোম্পানির রমরমা প্রমোশনে প্রলুব্ধ হয় নামধামওয়ালা দায়িত্বশীল চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র, সেখানে একটি আদিম চিকিত্সা-ব্যবস্থার বিভ্রান্ত বাহক ময়দান আলীর আত্মাহুতির ঘটনাটি কি কোনো নৈতিক টানাপোড়েন তৈরি করবে এ চিকিত্সা-বাণিজ্যের পাপচক্রে?
সুমন রহমান: লেখক ও গল্পকার।
No comments