পুনর্বিজয় থেকে পুনর্দখল ইউরোপ by তারিক আলি
আমাকে আপনারা পুরস্কৃত করেছেন বলে আমি সম্মানিত বোধ করছি। ১৪৯২ সালের এই দিনে (২ জানুয়ারি) স্পেনের শেষ মুসলিম শাসক ক্যাথলিক রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তবে আমি আরও বেশি আগ্রহী ইসলাম-বিষয়ে আমার পাঁচ পর্বের উপন্যাস ইসলাম কুইনটেট-এর প্রথম পর্বে বিবৃত ধারণাগুলোর বিষয়ে। ইউরোপের ইতিহাসে মুসলিম শাসন বিতাড়নের নাম ‘রিকনকুয়েস্তা’ বা পুনর্বিজয়।
২০ বছর আগে এই গ্রানাডা শহরে আমি উপন্যাসটি লেখা শুরু করি। আমি এতে স্পেনে (আল-আন্দালুসিয়া) মুসলিম শাসনের কষ্টকর শেষ দিনগুলোর কথা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। স্মৃতিকাতরতার জন্য নয়, বরং তাদের ওপর যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। এখান থেকে কিছু দূরেই বিব্বারাম্বলা এলাকা। সেখানকার পাঠাগারের সব বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। বিধর্মী বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল অনেককে। পবিত্র ভ্রাতৃত্ব নামে বিধর্মী নিধনের উদ্দেশ্যে গোপন পুলিশ দল লেলিয়ে দেওয়া হয় ও চূড়ান্তভাবে স্পেনীয় মুসলমানদের বের করে দেওয়া হয় দেশ থেকে। এসবের মধ্যে দিয়ে ইউরোপ ইসলামের চিহ্ন মুছে দিয়ে নতুন পরিচয় অর্জন করে। বলা যায়, এসব প্রবণতাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে ফ্যাসিবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে আবার আত্মপ্রকাশ করে। আজও স্পেনের ডানপন্থীরা এই দিনটিতে ‘নতুন রিকনকুয়েস্তার জন্য স্পেনের সব মুসলিমকে তাড়িয়ে দাও’ লেখা ব্যানার নিয়ে মিছিল করে।
ইতিহাসে অতীত ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু ঠিক আগের মতো করে ঘটনা আর ঘটে না। অনেক সময় অতীতের প্রতিধ্বনি আগের থেকে মারাত্মক চেহারা নিয়ে আসে। তাই অতীতকে স্মরণ করা মানে আজকের প্রজন্মকে তাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধ সম্পর্কে অপরাধবোধে ভোগানো নয়, কিংবা তা নয় অতীতের কৃতকর্মের শোধবোধের আয়োজন। বরং এর লক্ষ্য হওয়া উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া।
পঞ্চদশ শতাব্দীর পুনর্বিজয় আজ ফিরে এসেছে পুনরায় উপ-নিবেশিকীকরণের (রিকলোনাইজেশন) মাধ্যমে। একসময় পাশ্চাত্যের উপনিবেশ ছিল এমন দেশগুলো হয় সরাসরি দখল হচ্ছে, নতুবা তাদের সম্পদ ও স্বাধীনতা পশ্চিমা পরাশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
ইরাকে মার্কিন দখলদারি কায়েম হওয়ার পর সেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দানবীয় সেনা ঘাঁটি তৈরি করে সেই দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার আয়োজন চলছে। আট বছর ধরে আফগানিস্তান তাদের দখলাধীন। সেই দখলদারি শক্তির মধ্যে আপনাদের দেশে স্পেনের সেনারাও আছে। এসব দেখে দেখেই মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, ক্রুসেড (খ্রিষ্টীয় ধর্মযুদ্ধ) এখনো শেষ হয়নি?
ইউরোপের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব রয়েছে। তার অন্যতম হলো, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করা। আমরা বিভিন্ন মত ও পথের যেসব রাজনীতিবিদকে নির্বাচিত করেছি, তাঁদের এই যুদ্ধের তোড়জোড় আমাদের রুখে দিতে হবে।
মার্কিন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা খুদে উপগ্রহ বনে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আপনাদের মধ্যে কতজন আছেন, যাঁরা একজন ইউরোপীয় বা মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর মতো একজন ইরাকি বা একজন আফগান বা একজন ফিলিস্তিনির মৃত্যুকেও সমান চোখে দেখতে পারেন? তোমার জন্য এক নিয়ম আর আমার জন্য আরেক নিয়ম; এমন ধারা যদি চলতে থাকে তাহলে বলব, ইউরোপীয়রা ঘুমের ঘোরে আরেকটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তা হবে ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রানাডায় যা ঘটেছিল তার থেকে অনেক গুণ বেশি।
সবকিছুর পরও দুনিয়াকে যতই আশাহীন মনে হোক, আমাদের আশা হারানো চলবে না। কেননা আশা হারানো মানে নিষ্ক্রিয় থাকা, এবং মেনে নেওয়া যে পৃথিবী আর কখনো ভালো হবে না।
কাউন্টার পাঞ্চ থেকে অনূদিত
তারিক আলি: পাকিস্তানি-ব্রিটিশ লেখক, সম্পাদক নিউ লেফট।
২০ বছর আগে এই গ্রানাডা শহরে আমি উপন্যাসটি লেখা শুরু করি। আমি এতে স্পেনে (আল-আন্দালুসিয়া) মুসলিম শাসনের কষ্টকর শেষ দিনগুলোর কথা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। স্মৃতিকাতরতার জন্য নয়, বরং তাদের ওপর যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। এখান থেকে কিছু দূরেই বিব্বারাম্বলা এলাকা। সেখানকার পাঠাগারের সব বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। বিধর্মী বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল অনেককে। পবিত্র ভ্রাতৃত্ব নামে বিধর্মী নিধনের উদ্দেশ্যে গোপন পুলিশ দল লেলিয়ে দেওয়া হয় ও চূড়ান্তভাবে স্পেনীয় মুসলমানদের বের করে দেওয়া হয় দেশ থেকে। এসবের মধ্যে দিয়ে ইউরোপ ইসলামের চিহ্ন মুছে দিয়ে নতুন পরিচয় অর্জন করে। বলা যায়, এসব প্রবণতাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে ফ্যাসিবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে আবার আত্মপ্রকাশ করে। আজও স্পেনের ডানপন্থীরা এই দিনটিতে ‘নতুন রিকনকুয়েস্তার জন্য স্পেনের সব মুসলিমকে তাড়িয়ে দাও’ লেখা ব্যানার নিয়ে মিছিল করে।
ইতিহাসে অতীত ফিরে ফিরে আসে, কিন্তু ঠিক আগের মতো করে ঘটনা আর ঘটে না। অনেক সময় অতীতের প্রতিধ্বনি আগের থেকে মারাত্মক চেহারা নিয়ে আসে। তাই অতীতকে স্মরণ করা মানে আজকের প্রজন্মকে তাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধ সম্পর্কে অপরাধবোধে ভোগানো নয়, কিংবা তা নয় অতীতের কৃতকর্মের শোধবোধের আয়োজন। বরং এর লক্ষ্য হওয়া উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া।
পঞ্চদশ শতাব্দীর পুনর্বিজয় আজ ফিরে এসেছে পুনরায় উপ-নিবেশিকীকরণের (রিকলোনাইজেশন) মাধ্যমে। একসময় পাশ্চাত্যের উপনিবেশ ছিল এমন দেশগুলো হয় সরাসরি দখল হচ্ছে, নতুবা তাদের সম্পদ ও স্বাধীনতা পশ্চিমা পরাশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
ইরাকে মার্কিন দখলদারি কায়েম হওয়ার পর সেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দানবীয় সেনা ঘাঁটি তৈরি করে সেই দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার আয়োজন চলছে। আট বছর ধরে আফগানিস্তান তাদের দখলাধীন। সেই দখলদারি শক্তির মধ্যে আপনাদের দেশে স্পেনের সেনারাও আছে। এসব দেখে দেখেই মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, ক্রুসেড (খ্রিষ্টীয় ধর্মযুদ্ধ) এখনো শেষ হয়নি?
ইউরোপের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবারই নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব রয়েছে। তার অন্যতম হলো, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করা। আমরা বিভিন্ন মত ও পথের যেসব রাজনীতিবিদকে নির্বাচিত করেছি, তাঁদের এই যুদ্ধের তোড়জোড় আমাদের রুখে দিতে হবে।
মার্কিন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা খুদে উপগ্রহ বনে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আপনাদের মধ্যে কতজন আছেন, যাঁরা একজন ইউরোপীয় বা মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর মতো একজন ইরাকি বা একজন আফগান বা একজন ফিলিস্তিনির মৃত্যুকেও সমান চোখে দেখতে পারেন? তোমার জন্য এক নিয়ম আর আমার জন্য আরেক নিয়ম; এমন ধারা যদি চলতে থাকে তাহলে বলব, ইউরোপীয়রা ঘুমের ঘোরে আরেকটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তা হবে ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রানাডায় যা ঘটেছিল তার থেকে অনেক গুণ বেশি।
সবকিছুর পরও দুনিয়াকে যতই আশাহীন মনে হোক, আমাদের আশা হারানো চলবে না। কেননা আশা হারানো মানে নিষ্ক্রিয় থাকা, এবং মেনে নেওয়া যে পৃথিবী আর কখনো ভালো হবে না।
কাউন্টার পাঞ্চ থেকে অনূদিত
তারিক আলি: পাকিস্তানি-ব্রিটিশ লেখক, সম্পাদক নিউ লেফট।
No comments