স্বশাসনের স্পৃহা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
হিংস্র পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের বাঙালি সহযোগীদের সঙ্গে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর একাত্তরের ডিসেম্বরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। তা ছিল ইতিহাসের দেওয়া বহুকাল আগের একটি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন মাত্র। অর্থাত্ ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিণতি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এমনটি ঘটা ছাড়া আর যে বিকল্পগুলো ছিল, তার কোনোটিই এ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। স্বাধীনতা এবং শুধু স্বাধীনতাই ছিল তাদের কাম্য। তার জন্য জীবন দিতে তারা প্রস্তুত ছিল এবং জীবন তারা দিয়েছিল অকাতরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ব্রিটেনের কলোনি-উত্তর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের যথেষ্ট মিল রয়েছে। আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস তাঁর এক বিখ্যাত ভাষণে ঘোষণা করেন, আমেরিকার বিপ্লবের ইতিহাসের শুরু সুদূর ১৬২০ অব্দে। তাঁর ভাষায়, স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগে আমেরিকার বিপ্লব The American Revolution-এর সূচনা। বস্তুত সেটা ২০০ বছর আগে যেদিন ভার্জিনিয়ায় ক্রীতদাসদের দ্বারা তুলার খেতের আবাদ শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা, সেদিন থেকেই।
প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস বলেন, উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, নিজস্ব সংস্কৃতিও গড়ে উঠছিল এবং স্বশাসনের অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিল কলোনিগুলোর। সুতরাং তাদের মনে ও হূদয়ে বিপ্লবের চেতনার জন্ম হয়—The Revolution was in the minds and hearts of the people, সে বিপ্লবের চেতনা আর কিছুর জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য—উপনিবেশবাদীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। তার ফলে ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দখলদার ইংল্যান্ডের সঙ্গে উপনিবেশিত আমেরিকার জনগণের প্রত্যক্ষ লড়াই বা স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকার জনগণ জয়লাভ করে এবং ৩০ এপ্রিল ১৭৮৯ জর্জ ওয়াশিংটন নিউইয়র্কে প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার জাতির পিতা নন গান্ধী বা জিন্নাহর মতো, তিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের founding father-দের একজন।
গত ৩৭ বছরের কথা বাদ দিলেও চলতি ডিসেম্বর মাসের দুই সপ্তাহে দেশের বড় বড় ১০-১২টি কাগজে ২৮০টির মতো লেখা পড়লাম স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালির বীরত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে সেসব রচনা। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে উপলব্ধি হয়েছে, এই লেখাগুলো প্রায় একই ধরনের। বেশির ভাগ লেখা পড়ে কোনো পাঠক স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও ইতিহাস জানতে পারবে না।
একাত্তরের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম ও শেষ অধ্যায়। এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু আগে—বহু আগে—সম্ভবত পলাশীর যুদ্ধের পরদিন থেকেই। তা যদি নাও হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের সময় থেকে। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের আগ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ মনে করত, তারা স্বাধীন। স্বাধীনই ছিল বটে। মাথার ওপর মোগল-সম্রাট ছিলেন, কিন্তু বাংলার নবাব স্বাধীনভাবেই চলতেন। পলাশীর যুদ্ধের পর জনগণ বুঝতে পারে, মোগল-সম্রাট দিল্লিতে আছেন কি নেই সেটা বড় কথা নয়, বাংলা পরাধীন—বাংলার মানুষ ইংরেজের পদানত। স্বাধীন মানুষের মধ্যে নয়, পরাধীন মানুষের মধ্যেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। তাই পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু দেশপ্রেমিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়েছে। ১৮৫৭-এর সিপাহি জনতার বিদ্রোহ ছিল সর্বাত্মক। দেশের নতুন হিন্দু-মুসলমান জমিদারেরা ছাড়া সব মানুষই সেই বিদ্রোহ সমর্থন করেছিল।
মহাবিদ্রোহের পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শুধু ইংরেজদের নয়, তাদের দালাল জমিদারদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে থাকেন। কোনো কোনো স্বাধীনতাকামী সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্তও বসে ছিলেন না। যেমন তিতুমীর। ১৮৩১ সালে তিনি ৩৫০ জন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন। নারকেলবাড়িয়ার নায়ক তিতুমীরের ১০৩ বছর পর জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সূর্য সেন ধরা পড়েন এবং ১৯৩৪-এ ফাঁসির মঞ্চে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন দেশবাসীর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য, অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়।
যে ভূখণ্ড নিয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত, সেখানকার মানুষের ইতিহাস বাংলার অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে কিছুটা আলাদা। এই এলাকার মানুষ একবার স্বশাসনের অধিকার পেয়েছিল ১৯০৫-এ। উত্তাল এক অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সেই অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯০৫ থেকে ১৯১১—এই ছয় বছরে পূর্ব বাংলা এগিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর। পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল হলে এই এলাকার মানুষ হতাশ ও ব্যথিত হয়। তাই ১৯৪৭-এ পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে তারা স্বাগত ও সমর্থন জানায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর অবিলম্বেই তারা লক্ষ করে, যে স্বাধীনতা ও স্বশাসন তারা চেয়েছিল তা পায়নি। দেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের পদানত। সুতরাং স্বাধীনতার স্পৃহা আবার তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়।
পাকিস্তানে যদি গণতন্ত্র থাকত, তাহলে ২৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন হতো না। বাংলার মানুষ প্রথমে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যই লড়াই শুরু করে। সেই লড়াইয়ে যাঁরাই নেতৃত্ব দিতেন ও তাতে সমর্থন দিতেন, তাঁদেরই আখ্যায়িত করা হতো দেশদ্রোহী হিসেবে। ন্যায়সংগত অধিকার হরণ করা হলেই স্বাধিকারের জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়। পাঞ্জাবি শাসক ও বাঙালি জনগণের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। সে কারণেই যেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবিনামা ঘোষণা করে, বাংলার মানুষ তাকে প্রবলভাবে সমর্থন দেয়। ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সনদ।
ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ছয় দফা আন্দোলনে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না, কোনো দুর্বলতাও ছিল না। তা ছিল একটি বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তানি শাসকেরা যে কৌশল গ্রহণ করেন, তার পদ্ধতি ছিল ফ্যাসিস্ট—বর্বর।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শেষ বাক্যটিতে বলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাক্যে ‘এবারের’ শব্দটি থাকায় পরিষ্কার বোঝা যায়, ৬ মার্চ পর্যন্ত এত দিন আমাদের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম—স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়। এ দেশের মানুষের বহুকালের লালিত ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ভাষণে থাকায় বাংলার মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া, পাকিস্তানি জান্তাকে বিতাড়িত করে দেশকে মুক্ত করা ছাড়া, এ দেশের মানুষের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বাংলার জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ দুর্জয় শক্তিতে মোকাবিলা করে। আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। গঠিত হয় প্রবাসে অর্থাত্ ভারতে অস্থায়ী প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ও অতি অল্প সময়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ায় ধীরস্থিরভাবে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি সেদিনের নেতারা। প্রবাসী সরকারের যাবতীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার।
প্রবাসী সরকার গঠনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা গভীর উত্কণ্ঠায় ছিলেন এই আশঙ্কায় যে পাকিস্তান সরকার যদি আমেরিকার চাপে বন্দী মুজিবকে মুক্তি দেয় এবং তাঁকে নিরাপত্তা হেফাজতে বাংলাদেশে এনে কোনো আপসমূলক বিবৃতি দেওয়ায়, তখন কী উপায় হবে? ভারত বেকায়দায় পড়বে বাংলাদেশের লাখ লাখ উদ্বাস্তু নিয়ে এবং বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারাও বিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন। জনগণের ঐক্য নষ্ট করার জন্য পাকিস্তানিদের কিছু দালাল তো ছিলই। বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য ভালো যে সেসব কিছুই ঘটেনি। তার পরিবর্তে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দালালেরা বাংলাদেশের মানুষের ওপর আরও বেশি হিংস্রতা নিয়ে আক্রমণ চালায়। তবে যত বেশি বর্বরতা চালিয়েছে, বাংলার মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা তত শাণিত হয়েছে। বাংলার যুবসমাজের শপথ ছিল কোনো কিছুর বিনিময়েই তারা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করবে না।
যার যা আছে তা-ই নিয়ে কারও নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু প্রবাসী সরকারের কাজে বাস্তব কারণেই অনেক দুর্বলতা ছিল, ফাঁকফোকর ছিল। তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের বাইরে কোথাও যেতে পারেননি। সাড়ে আট মাসের মধ্যে তাঁরা বাংলাদেশের কোনো জেলা বা মহকুমা সদরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে পারেননি। ভারতের সীমান্তবর্তী কোনো কোনো শরণার্থী শিবির বা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রবাসী সরকারের নেতারা কখনো গেছেন, কিন্তু দেশের ভেতরে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ লড়াই চলছিল, সেখানে তাঁরা যেতে পারেননি। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেই বলছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে ভারতীয় ভূখণ্ডে ছিলেন এবং সাড়ে আট মাসে বাংলাদেশের কোনো সীমান্তবর্তী জেলাও সফর করেননি। এর ফলে সর্বস্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের দূরত্ব থেকে গিয়েছিল।
১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই গৃহীত আমেরিকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র মতো ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’টি এক অমূল্য দলিল। আমেরিকার ঘোষণাপত্রটি ছিল খুবই সুচিন্তিত রচনা। তাতে ঘোষিত হয়েছিল সব মানুষ সমান—all men are created equal এবং স্রষ্টা তাদের কিছু হস্তান্তরের অযোগ্য অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন—they are endowed by their Creator with certain inalienable rights। সেই অধিকারগুলোর কথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল: জীবনের অধিকার, মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ও সুখ অন্বেষণের অধিকার—life, liberty and the pursuit of happiness।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম থেকেই আমাদের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ গণতন্ত্রের চেয়ে সামন্ততান্ত্রিক একনায়কী চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। এই ঘোষণাপত্রটি যিনি বা যাঁরাই রচনা করুন না কেন, তাতে তাঁরা সামন্ততন্ত্রকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের ঘোষণায় জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়, জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব নয়, রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছিল সর্বময় বা সার্বভৌম ক্ষমতা। রাষ্ট্রপ্রধানকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা রাজতন্ত্রে রাজা ভোগ করেন। বিস্ময়কর সেই ঘোষণা, যেমন—
‘রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যেমনটি প্রয়োজন মনে করেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করিবার ক্ষমতা থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যেরূপ প্রয়োজন হইবে সেইমত কার্য করিবেন।’
স্বাধীন বাংলাদেশে যে সামরিক-বেসামরিক একনায়কত্বের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বীজ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই রোপিত ছিল। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের ঘোষণায় অধিকারের কথা—bill of rights ও অন্যান্য মানবাধিকারের বিষয় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়: জনগণের সার্বভৌমত্ব, বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মীয় ও বিবেকের স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে সরকার বদলের অধিকার ও নতুন সরকার গঠনের ক্ষমতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাগরিকদের হেবিয়াস কর্পাস রিট করার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জামিন পাওয়ার অধিকার ও অপরাধীকে নমনীয় ও মানবিক শাস্তি প্রদান প্রভৃতি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় ছিল না, তবে পরে সংবিধানে মৌলিক অধিকার এবং ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’ এ কথা বলা হয়েছে।
নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একাত্তরে সীমিত সাধ্যে যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাতে তাঁরা ইতিহাসের কাছে উতরে গেছেন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রগামী ছিল আমাদের যুব নেতৃত্ব ও যুবসমাজ। রাজনৈতিক ও যুব নেতৃত্বের ঋণ অপরিশোধ্য। স্বাধীনতার জন্য আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকদের হারিয়েছি। তাঁদের রক্তের ঋণও শোধ করা যাবে না। স্বাধীনতা রক্ত দিয়েই অর্জিত হয়, কথা দিয়ে নয়।
কোনো জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়টি একজন নেতার নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন সেই অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে বহু নেতা নেতৃত্ব দেন এবং জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করেন। এই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে স্বশাসনের চেতনা ও স্বাধীনতার স্পৃহা অনির্বাণ রাখতে দুই শতাব্দীব্যাপী যাঁরা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাঁদের স্মরণ না করে বিজয় দিবস উদ্যাপিত হতে পারে না। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন এলাকায় নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। একেক নেতার একেক ধরনের ভূমিকা। তবে তাঁদের অভিন্নতা শুধু ওখানে যে তাঁরা সবাই এ অঞ্চলের মানুষকে স্বশাসনের অধিকার দিতে চেয়েছেন এবং বিতাড়িত করতে চেয়েছেন বিদেশি শাসক-শোষককে। তিতুমীর, নবাব সলিমুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, সুভাষ বসু, নজরুল, মওলানা ভাসানী এই ভূখণ্ডে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র ও সাংবিধানিক উপায়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদেরসহ আমরা সব বিখ্যাত ও অজ্ঞাত স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ব্রিটেনের কলোনি-উত্তর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের যথেষ্ট মিল রয়েছে। আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস তাঁর এক বিখ্যাত ভাষণে ঘোষণা করেন, আমেরিকার বিপ্লবের ইতিহাসের শুরু সুদূর ১৬২০ অব্দে। তাঁর ভাষায়, স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগে আমেরিকার বিপ্লব The American Revolution-এর সূচনা। বস্তুত সেটা ২০০ বছর আগে যেদিন ভার্জিনিয়ায় ক্রীতদাসদের দ্বারা তুলার খেতের আবাদ শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা, সেদিন থেকেই।
প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস বলেন, উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, নিজস্ব সংস্কৃতিও গড়ে উঠছিল এবং স্বশাসনের অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিল কলোনিগুলোর। সুতরাং তাদের মনে ও হূদয়ে বিপ্লবের চেতনার জন্ম হয়—The Revolution was in the minds and hearts of the people, সে বিপ্লবের চেতনা আর কিছুর জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য—উপনিবেশবাদীদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। তার ফলে ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দখলদার ইংল্যান্ডের সঙ্গে উপনিবেশিত আমেরিকার জনগণের প্রত্যক্ষ লড়াই বা স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকার জনগণ জয়লাভ করে এবং ৩০ এপ্রিল ১৭৮৯ জর্জ ওয়াশিংটন নিউইয়র্কে প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার জাতির পিতা নন গান্ধী বা জিন্নাহর মতো, তিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের founding father-দের একজন।
গত ৩৭ বছরের কথা বাদ দিলেও চলতি ডিসেম্বর মাসের দুই সপ্তাহে দেশের বড় বড় ১০-১২টি কাগজে ২৮০টির মতো লেখা পড়লাম স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালির বীরত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে সেসব রচনা। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে উপলব্ধি হয়েছে, এই লেখাগুলো প্রায় একই ধরনের। বেশির ভাগ লেখা পড়ে কোনো পাঠক স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ও ইতিহাস জানতে পারবে না।
একাত্তরের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম ও শেষ অধ্যায়। এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু আগে—বহু আগে—সম্ভবত পলাশীর যুদ্ধের পরদিন থেকেই। তা যদি নাও হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের সময় থেকে। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের আগ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ মনে করত, তারা স্বাধীন। স্বাধীনই ছিল বটে। মাথার ওপর মোগল-সম্রাট ছিলেন, কিন্তু বাংলার নবাব স্বাধীনভাবেই চলতেন। পলাশীর যুদ্ধের পর জনগণ বুঝতে পারে, মোগল-সম্রাট দিল্লিতে আছেন কি নেই সেটা বড় কথা নয়, বাংলা পরাধীন—বাংলার মানুষ ইংরেজের পদানত। স্বাধীন মানুষের মধ্যে নয়, পরাধীন মানুষের মধ্যেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। তাই পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু দেশপ্রেমিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়েছে। ১৮৫৭-এর সিপাহি জনতার বিদ্রোহ ছিল সর্বাত্মক। দেশের নতুন হিন্দু-মুসলমান জমিদারেরা ছাড়া সব মানুষই সেই বিদ্রোহ সমর্থন করেছিল।
মহাবিদ্রোহের পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শুধু ইংরেজদের নয়, তাদের দালাল জমিদারদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে থাকেন। কোনো কোনো স্বাধীনতাকামী সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্তও বসে ছিলেন না। যেমন তিতুমীর। ১৮৩১ সালে তিনি ৩৫০ জন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন। নারকেলবাড়িয়ার নায়ক তিতুমীরের ১০৩ বছর পর জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সূর্য সেন ধরা পড়েন এবং ১৯৩৪-এ ফাঁসির মঞ্চে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন দেশবাসীর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য, অন্য কোনো কিছুর জন্য নয়।
যে ভূখণ্ড নিয়ে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত, সেখানকার মানুষের ইতিহাস বাংলার অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে কিছুটা আলাদা। এই এলাকার মানুষ একবার স্বশাসনের অধিকার পেয়েছিল ১৯০৫-এ। উত্তাল এক অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সেই অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯০৫ থেকে ১৯১১—এই ছয় বছরে পূর্ব বাংলা এগিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর। পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল হলে এই এলাকার মানুষ হতাশ ও ব্যথিত হয়। তাই ১৯৪৭-এ পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে তারা স্বাগত ও সমর্থন জানায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর অবিলম্বেই তারা লক্ষ করে, যে স্বাধীনতা ও স্বশাসন তারা চেয়েছিল তা পায়নি। দেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের পদানত। সুতরাং স্বাধীনতার স্পৃহা আবার তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়।
পাকিস্তানে যদি গণতন্ত্র থাকত, তাহলে ২৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন হতো না। বাংলার মানুষ প্রথমে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যই লড়াই শুরু করে। সেই লড়াইয়ে যাঁরাই নেতৃত্ব দিতেন ও তাতে সমর্থন দিতেন, তাঁদেরই আখ্যায়িত করা হতো দেশদ্রোহী হিসেবে। ন্যায়সংগত অধিকার হরণ করা হলেই স্বাধিকারের জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়। পাঞ্জাবি শাসক ও বাঙালি জনগণের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। সে কারণেই যেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবিনামা ঘোষণা করে, বাংলার মানুষ তাকে প্রবলভাবে সমর্থন দেয়। ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সনদ।
ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ছয় দফা আন্দোলনে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না, কোনো দুর্বলতাও ছিল না। তা ছিল একটি বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তানি শাসকেরা যে কৌশল গ্রহণ করেন, তার পদ্ধতি ছিল ফ্যাসিস্ট—বর্বর।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শেষ বাক্যটিতে বলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাক্যে ‘এবারের’ শব্দটি থাকায় পরিষ্কার বোঝা যায়, ৬ মার্চ পর্যন্ত এত দিন আমাদের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম—স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়। এ দেশের মানুষের বহুকালের লালিত ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ভাষণে থাকায় বাংলার মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া, পাকিস্তানি জান্তাকে বিতাড়িত করে দেশকে মুক্ত করা ছাড়া, এ দেশের মানুষের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বাংলার জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ দুর্জয় শক্তিতে মোকাবিলা করে। আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। গঠিত হয় প্রবাসে অর্থাত্ ভারতে অস্থায়ী প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ও অতি অল্প সময়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ায় ধীরস্থিরভাবে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি সেদিনের নেতারা। প্রবাসী সরকারের যাবতীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা পুষিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার।
প্রবাসী সরকার গঠনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা গভীর উত্কণ্ঠায় ছিলেন এই আশঙ্কায় যে পাকিস্তান সরকার যদি আমেরিকার চাপে বন্দী মুজিবকে মুক্তি দেয় এবং তাঁকে নিরাপত্তা হেফাজতে বাংলাদেশে এনে কোনো আপসমূলক বিবৃতি দেওয়ায়, তখন কী উপায় হবে? ভারত বেকায়দায় পড়বে বাংলাদেশের লাখ লাখ উদ্বাস্তু নিয়ে এবং বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারাও বিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন। জনগণের ঐক্য নষ্ট করার জন্য পাকিস্তানিদের কিছু দালাল তো ছিলই। বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য ভালো যে সেসব কিছুই ঘটেনি। তার পরিবর্তে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দালালেরা বাংলাদেশের মানুষের ওপর আরও বেশি হিংস্রতা নিয়ে আক্রমণ চালায়। তবে যত বেশি বর্বরতা চালিয়েছে, বাংলার মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা তত শাণিত হয়েছে। বাংলার যুবসমাজের শপথ ছিল কোনো কিছুর বিনিময়েই তারা স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস করবে না।
যার যা আছে তা-ই নিয়ে কারও নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু প্রবাসী সরকারের কাজে বাস্তব কারণেই অনেক দুর্বলতা ছিল, ফাঁকফোকর ছিল। তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের বাইরে কোথাও যেতে পারেননি। সাড়ে আট মাসের মধ্যে তাঁরা বাংলাদেশের কোনো জেলা বা মহকুমা সদরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে পারেননি। ভারতের সীমান্তবর্তী কোনো কোনো শরণার্থী শিবির বা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রবাসী সরকারের নেতারা কখনো গেছেন, কিন্তু দেশের ভেতরে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ লড়াই চলছিল, সেখানে তাঁরা যেতে পারেননি। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেই বলছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে ভারতীয় ভূখণ্ডে ছিলেন এবং সাড়ে আট মাসে বাংলাদেশের কোনো সীমান্তবর্তী জেলাও সফর করেননি। এর ফলে সর্বস্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রবাসী সরকারের দূরত্ব থেকে গিয়েছিল।
১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই গৃহীত আমেরিকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র মতো ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’টি এক অমূল্য দলিল। আমেরিকার ঘোষণাপত্রটি ছিল খুবই সুচিন্তিত রচনা। তাতে ঘোষিত হয়েছিল সব মানুষ সমান—all men are created equal এবং স্রষ্টা তাদের কিছু হস্তান্তরের অযোগ্য অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন—they are endowed by their Creator with certain inalienable rights। সেই অধিকারগুলোর কথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল: জীবনের অধিকার, মুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ও সুখ অন্বেষণের অধিকার—life, liberty and the pursuit of happiness।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম থেকেই আমাদের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ গণতন্ত্রের চেয়ে সামন্ততান্ত্রিক একনায়কী চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। এই ঘোষণাপত্রটি যিনি বা যাঁরাই রচনা করুন না কেন, তাতে তাঁরা সামন্ততন্ত্রকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের ঘোষণায় জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়, জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব নয়, রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছিল সর্বময় বা সার্বভৌম ক্ষমতা। রাষ্ট্রপ্রধানকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা রাজতন্ত্রে রাজা ভোগ করেন। বিস্ময়কর সেই ঘোষণা, যেমন—
‘রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যেমনটি প্রয়োজন মনে করেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করিবার ক্ষমতা থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যেরূপ প্রয়োজন হইবে সেইমত কার্য করিবেন।’
স্বাধীন বাংলাদেশে যে সামরিক-বেসামরিক একনায়কত্বের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বীজ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই রোপিত ছিল। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতাদের ঘোষণায় অধিকারের কথা—bill of rights ও অন্যান্য মানবাধিকারের বিষয় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়: জনগণের সার্বভৌমত্ব, বাক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মীয় ও বিবেকের স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে সরকার বদলের অধিকার ও নতুন সরকার গঠনের ক্ষমতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাগরিকদের হেবিয়াস কর্পাস রিট করার অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জামিন পাওয়ার অধিকার ও অপরাধীকে নমনীয় ও মানবিক শাস্তি প্রদান প্রভৃতি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় ছিল না, তবে পরে সংবিধানে মৌলিক অধিকার এবং ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’ এ কথা বলা হয়েছে।
নানা ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একাত্তরে সীমিত সাধ্যে যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাতে তাঁরা ইতিহাসের কাছে উতরে গেছেন। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রগামী ছিল আমাদের যুব নেতৃত্ব ও যুবসমাজ। রাজনৈতিক ও যুব নেতৃত্বের ঋণ অপরিশোধ্য। স্বাধীনতার জন্য আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকদের হারিয়েছি। তাঁদের রক্তের ঋণও শোধ করা যাবে না। স্বাধীনতা রক্ত দিয়েই অর্জিত হয়, কথা দিয়ে নয়।
কোনো জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়টি একজন নেতার নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন সেই অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে বহু নেতা নেতৃত্ব দেন এবং জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করেন। এই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে স্বশাসনের চেতনা ও স্বাধীনতার স্পৃহা অনির্বাণ রাখতে দুই শতাব্দীব্যাপী যাঁরা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাঁদের স্মরণ না করে বিজয় দিবস উদ্যাপিত হতে পারে না। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন এলাকায় নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। একেক নেতার একেক ধরনের ভূমিকা। তবে তাঁদের অভিন্নতা শুধু ওখানে যে তাঁরা সবাই এ অঞ্চলের মানুষকে স্বশাসনের অধিকার দিতে চেয়েছেন এবং বিতাড়িত করতে চেয়েছেন বিদেশি শাসক-শোষককে। তিতুমীর, নবাব সলিমুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, সুভাষ বসু, নজরুল, মওলানা ভাসানী এই ভূখণ্ডে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র ও সাংবিধানিক উপায়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদেরসহ আমরা সব বিখ্যাত ও অজ্ঞাত স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments