শিশুরা বলছে, ‘আমরাও আছি, তোমরা কি শুনতে পাচ্ছ’ by ফারুক ওয়াসিফ

‘...হাঁটিহাঁটি শিশুটিকে আর কোথাও দেখি না, কতগুলো রাজহাঁস দেখি...মুখস্থ মানুষ দেখি।’

কলকাকলি করা শিশুদের তেমন দেখি না ঢাকা শহরে। ব্যালকনিতে বিষণ্ন শিশুদের দাঁড়িয়ে থাকা দেখি, রাজহাঁসের মতো গর্বিত গাড়ির বহর দেখি। গাছগাছালিঘেরা খেলার মাঠ দেখি না, বাহারি শপিং মল দেখি, রাজধানীর রাজা-উজির-বণিক-অমাত্যদের মহড়া দেখি। মার্কেটের ভিড় আর আওয়াজের মধ্যে বাবা বা মায়ের হাতে ধরা লাজুক শিশুদের যদিবা দেখি, মনে হয় এটা তাদের জায়গা নয়। দেশের তিন ভাগের এক ভাগই শিশু। তাদের বেশির ভাগের জীবনই এমন নিরানন্দ। এ শহরে, শিশুদের জন্যই নেই কোনো ছাড়।
ঢাকা শহর কেবলই বড়দের শহর। বাড়িয়ে যে বলিনি, ৯ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠার ছবিটি তার প্রমাণ: একটি ছয়-সাত বছর বয়সী শিশু চলন্ত বাসের বন্ধ দরজার বাইরের পাদানিতে ঝুলে ঝুলে ফিরছে স্কুল থেকে। হয়তো এভাবেই তাকে ফিরতে হয় প্রতিদিন।
যে সমাজে শিশুরা সুখী ও স্বচ্ছন্দ নয়, সেই সমাজকে কোনোভাবেই সুস্থ বলা যায় না। শিশুদের অবস্থা দিয়েই বোঝা সম্ভব কোনো দেশ বা ব্যবস্থা কতটা মানবিক। শিশুরা সমাজের আয়নাও বটে। সেই আয়নায় ভাসা চেহারাটা দেখে তৃপ্তি পাওয়া কঠিন।
শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সময়, সঙ্গ ও সুযোগ। এই তিনটিই যেন বিরান এই ঢাকা শহরে। বাবা-মা জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ও ছুটন্ত। ঢাকার রাজপথে এই ক্লান্ত-বিরক্ত ও ছুটন্ত মানুষেরই দেখা মেলে। নগরজীবনে সমাজ মৃত প্রায়। বড়দের সমাজ যখন মরতে থাকে, তখন ছোটোদের সমাজ আরো বিপন্ন হয়ে যায়। অথচ আমরা ভুলে যাই, শিশুদেরও আছে নিজস্ব সমাজ। বন্ধুত্ব বিষয়ে শিশুরা অনেক সিরিয়াস। তারাও চায় তার মতো শিশুদের সঙ্গে মিলতে, খেলতে, ঝগড়া করতে আবার ভালোবাসতে। স্কুলেও তাদের সেই সুযোগ কম। এভাবে আমাদের বেশির ভাগ শিশু নিঃসঙ্গ অবস্থায় বড় হয়। মাঠ নাই, গাছ নাই, পার্ক নাই; এত সব নাই-য়ের মধ্যে তাদের শৈশবটাও যে নাই হয়ে যায়, তার খেয়াল রাখে ক’জনা?
আসলে আমাদের শিশুরা সত্যিকারভাবে কেমন আছে, তা হয়তো আমরা জানি না। সবটা জানা সম্ভবও নয় হয়তো। কারণ, নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া স্পষ্ট করে জানাতে পারে না শিশুরা। জানালেও তা বোঝার মন সব সময় আমাদের থাকে না। আমাদের মন পড়ে থাকে আপন-আপন স্বার্থ মেটানোর খায়েশে!
গবেষক জাকিউল ইসলাম জানাচ্ছেন, ‘‘ঢাকার তিন ভাগের এক ভাগ শিশু দৈনিক এক মিনিটও বাইরে খেলতে যায় না। ঢাকার প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একজনের পাড়ায় একটাও বন্ধু নেই এবং বড়দের সাহায্য ছাড়া বাসার সীমানা থেকে এক পা-ও যাওয়ার সাধ্য নেই। ...একটি শিশু, নাম মতিউর, বয়স আট বছর, থাকে সেন্ট্রাল রোডে; সে অভিযোগ করছিল যে সে আগে তার বন্ধুদের নিয়ে বাসার সামনের ছোট্ট গলিটাতে খেলত। কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে বাড়িওয়ালার ধমকে। এমনকি বাবা-মায়েরাও ... যখন অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন (বা ভাড়া নেন), তখন বেডরুমের সাইজ দেখেন, দেখেন মার্বেল আছে কি না। কিন্তু বাচ্চাদের খেলার জায়গা আছে কি না, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’
“ঢাকার শিশুরা এখন খেলার মাঠের অভাবে ছাদে খেলে। সেটাও অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। নজরুল, বয়স ১০, আমাকে বলছিল, ‘আগে আমরা ছাদে খেলতাম, কিন্তু ছাদে বিরাট একটা বিলবোর্ড লাগানোর পর থেকে এখন আর সেখানে খেলার জায়গা নাই।... ঢাকায় মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও করুণ। যেখানে ঢাকার ছেলেশিশুরা গড়ে প্রতিদিন ৪৫ মিনিটের মতো বাইরে সময় কাটায়, সেখানে মেয়েরা মাত্র ৩০ মিনিট বাইরে থাকে (স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে)।’’ (জাকিউল ইসলাম, প্রথম আলো, ৩০ জুন ০৯)
এভাবে শৈশবের আনন্দ হারিয়ে বড়দের পৃথিবীতে বন্দী হতে হতে যে বেদনা হয়, যে মন-খারাপ করা মন হয়, সেই মন তখন কম্পিউটার গেম আর টেলিভিশনে আসক্ত হয়। বড়রা যেমন করে অফিস করে, তেমন করে তারা পড়া তৈরি করে, হোমওয়ার্ক করে—করানো হয়। তাদের দেওয়ার মতো সময় রাখিনি, তাই কম্পিউটার বা ভিডিও গেম খেলতে বসিয়ে দিয়েছি। তাদের খেলার মাঠগুলোকে আমরা বিপণিবিতান আর অ্যাপার্টমেন্টে ভরিয়ে দিয়েছি। সেখানে সত্যিকার গাছ-পাখির বদলে তাদের দিচ্ছি প্লাস্টিকের গাছ-ফুল, রোলার কোস্টার। তাদের ওয়ান্ডারল্যান্ডে নিয়ে যাই, কিন্তু কোনো দিন যাই কি ওয়ান্ডারল্যান্ডের পাশেরই বন কিংবা নদী চেনাতে? তারা এখন হিন্দি ও ইংরেজি ছবি ও কমিক হিরোদের চেনে, কিন্তু ডালিমকুমার আর কাজলরেখাদের জানে না, জানে না কোন গাছের কী নাম, কোন ফুলের কেমন ঘ্রাণ। শৈশবেই মানুষের ইন্দ্রিয় ও মন অতি প্রখর ও তাজা থাকে; অথচ আজকের বেশির ভাগ শিশু গাছ না দেখে পাখি না দেখে, নদী ও আকাশ তথা প্রকৃতির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ না পেয়েই কল্পনাশক্তি বিকাশের সুযোগ হারায়। অন্যদিকে তাদের খাদ্য তালিকার বড় অংশও (আইসক্রিম, চকোলেট, বার্গার ইত্যাদি) নানান ক্ষতিকর উপাদানে ভরা। সব দিক থেকেই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধের স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত।
এই বঞ্চনার মধ্যেই স্বচ্ছর বাড়ির শিশুরা টেলিভিশন, আর ভিডিও গেমে বুঁদ হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এসব উত্তেজক ও মনকে আসক্ত করার মতো আনন্দ-উপকরণ শিশুর মনের বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করছে কীনা, তা কি ভেবে দেখা হয়েছে? অন্যদিকে দরিদ্র, বস্তিবাসী, ফুটপাত-আশ্রয়ী শিশুদের প্রায় পশু-জীবনে রেখে দিয়ে চলতে থাকা উন্নয়ন-বিলাসের কথা এখানে বলব না। সেটা বলা কঠিন, সওয়া আরও কঠিন।
খেলা ও কল্পনার অবারিত আমন্ত্রণ, শৈশবের প্রাণস্পন্দন এটাই। শিশুদের প্রতিটি খেলাই আসলে জীবনে ঢোকার মহড়া। তাদের প্রতিটি কল্পনা—যতই অদ্ভুত তা হোক—আসলে বাস্তব দুনিয়াকে নিজের মতো করে বোঝারই চেষ্টা। এসবের মাধ্যমে তারা ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় জীবনের জন্য। তা না করে তাদের জীবনযুদ্ধে নামিয়ে দেওয়াটা যে কত বড় নিষ্ঠুরতা, সেই সত্য আজ জ্ঞান করা চাই।
বড়রা বলছে দুষ্টুমি করো না, ভাল রেজাল্ট করো। টেলিভিশন তাকে শেখাচ্ছে ফ্যাশন, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও চকমকে হওয়ার বাসনা। চেনাচ্ছে না দেশ, জাতি ও সংস্কৃতির শোভা। শহরাঞ্চলে তারা কেবল দাদা-দাদি, নানা-নানির সাহচর্য থেকেই বঞ্চিত হয় না, বঞ্চিত হয় রূপকথা-ছড়া-শ্লোকের রঙিন জগত্ থেকেও। ফলে কল্পনার দিগন্তটি কুঁজো হয়ে যায়। সামাজিক অস্থিরতাও শিশুর মনোজগতে আঁচড় কাটে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, বিজ্ঞাপনে শিশুদের যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা। গাড়ি-বাড়ি-টেলিভিশন-শ্যাম্পু-সিমেন্ট-রড-ইট-ঘটি-বাটি হেন জিনিস নেই, যেখানে শিশুর কমনীয়তা ও সুন্দর সত্তার বাণিজ্যিক ও রুচিহীন ব্যবহার হয় না। বিজ্ঞাপনে নারী-শরীরের ব্যবহার নিয়েও আপত্তি আছে। কিন্তু সেখানে যারা ব্যবহূত হয়, তারা তো সাবালিকা। অন্তত তারা যায় স্বেচ্ছায়। কিন্তু শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে কার ইচ্ছায়? বাবা-মায়ের ইচ্ছায়? তাহলে কি বাবা-মা শিশুদের মালিক? কথাটা কঠিন, কিন্তু অসত্য নয়। এখানেও আমরা ভুলে যাই যে শিশুর মন-মেজাজ-শরীর সবকিছুর নিজস্ব অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা আছে। শিশুর সত্তা ব্যবহারের জিনিস নয়। শিশুরা সমাজের স্বপ্ন, ভবিষ্যতের সুবাতাস। একে খর্ব করে কোন ভবিষ্যত্ আমরা গড়তে চাইছি?
শিশুদের কটি অ্যানিমেশন ছবির গল্প বলে শেষ করি। গল্পটা এই: এক সাদা হাতি ছোট্ট লাল একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য বনের পশুদের সঙ্গে লড়াই করে। ফুলটিকে শুঁড়ের মধ্যে আগলে রেখে সে ছোটে। বাকি সব প্রাণী ওই ফুলটি পুড়িয়ে সুবাস বানাতে চায়। কিন্তু হাতিটি তাদের বোঝায়, এটা নিছক ফুল নয়, এর ভেতর রয়েছে আস্ত একটা জগত্। সেই জগতে আকাশের নিচে, মাটির ওপরে, বনের ধারে, নদীর পাড়ে আছে অজস্র প্রাণীর এক সুখী পৃথিবী। তারাও আমাদেরই মতো ছেলে-মেয়ে-পরিবার আর স্বপ্ন-ভালোবাসা ও আশা নিয়ে বেঁচে আছে। ফুলটি ধ্বংস করলে তার সবই ধ্বংস হবে। তখন সবাই বলে, প্রমাণ দাও যে তারা আছে?
কী প্রমাণ দেবে অসহায় হাতিটি আর তার শুঁড়ে আগলে রাখা ফুল-জগতের দুর্বল অধিবাসীরা? বন্দী হাতি তখন ফুলের ভেতর খবর পাঠায়, ‘তোমরা চিত্কার করো, তোমরা শব্দ করে জানাও যে তোমরা আছো!’
ফুলের ভেতরের জগতে তখন বিরাট আলোড়ন জাগে। সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে নেমে আসে মাঠে-রাস্তায়। একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে বলে, ‘ও পৃথিবীর প্রাণীরা, তোমরা শুনছ? আমরা আছি!’
ক্ষমতা আর বিত্তের মোহে আমরা আজ নিজেদেরই ভুলে গেছি। তারপরও নিবিড় ভাবে কান পাতলে কেউ কেউ হয়তো টের পাবেন আমাদের শিশুদের ভেতরকার বন্দী শৈশবের হাহাকার। শুনতে পাবেন বোবা কান্নার গুমড়ানো চিত্কার, ‘ও বড় মানুষেরা, আমরাও আছি, তোমরা কি শুনতে পাচ্ছ?’
>>>ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.