ঈদ আনন্দময় হোক তাদের -চলতি পথে by দীপংকর চন্দ
রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। অপেক্ষার প্রহর অসহনীয় মনে হচ্ছিল। অবচেতনে আমরা এই অসহনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছিলাম। ঠিক সে সময়ই স্বল্প প্রচলিত যন্ত্রযানটির আবির্ভাব। ভূমিকর্ষণ যন্ত্রের সঙ্গে কাঠের পাটাতন জুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে যানটি। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ভ্রমণসঙ্গী জুলফিকার উঠে পড়ল অদ্ভুত সেই যন্ত্রযানের পাটাতনে। অপরিসীম নির্লিপ্ততায় পা ঝুলিয়ে বসল পেছনে। অবলম্বনহীন মানুষের মতো জুলফিকারকে অনুসরণ করলাম আমিও। ভ্রু-জোড়ায় অকৃত্রিম কৌতূহল চিত্রিত করে বসলাম পাশাপাশি। পিচঢালা রাজপথ কাঁপিয়ে যন্ত্রযান ছুটল এবার। অমার্জিত ধ্বনি আর বিচিত্র কম্পন তুলে মিনিট দশেক চলার পর থামল যানটি। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নামলাম বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার কসবা গ্রামে।
ঢাকা বরিশাল মহাসড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এই কসবা গ্রামটি মূলত তিনটি গ্রামের সমন্বয়। ছোট কসবা, বড় কসবা ও লাখেরাজ কসবা। অতি প্রাথমিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর সঙ্গে কসবা গ্রামটির লক্ষণীয় কোনো পার্থক্য নেই। অথচ গ্রামটির স্থান-নামের উত্স ফারসি। বাংলায় কসবা শব্দটির অর্থ শহর। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, কসবা সুপ্রাচীন বাঙালাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৩ শতকে কোটালীপাড়ার মদনপুরে প্রাপ্ত বিশ্বরূপ সেনের তাম্রলিপিতে বাঙালাবাদের উল্লেখ আছে। শোনা যায়, ফরিদপুরের দক্ষিণ অঞ্চল এবং সমগ্র চন্দ্রদ্বীপ অর্থাত্ প্রাচীন বাকলা বা অধুনা বরিশাল বাঙালাবাদের অন্তর্গত ছিল। পাল আমলে বাঙালাবাদে উন্নত বৌদ্ধসভ্যতা গড়ে ওঠে। বৌদ্ধসভ্যতা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৩ ও ১৪ শতকে সেন রাজবংশ এ অঞ্চল শাসন করে। ১৪ ও ১৫ শতকে বাঙালাবাদে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ১৫ শতকের মধ্যভাগে হজরত খান জাহান আলী (রা.) এই অঞ্চলে পদার্পণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর শিষ্যগণ এ স্থানে ইসলামধর্ম প্রচার শুরু করেন। সম্ভবত সে সময়ই কসবার পত্তন হয়। তারপর ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয় বাঙালাবাদে উল্লিখিত রামসিদ্ধির নিকটবর্তী এই অঞ্চলটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। কসবায় তৈরি হয় নানা ধরনের ইমারত, গড়ে ওঠে নান্দনিক গঠনশৈলীর বেশ কিছু মসজিদ। সেই সব ইমারত কিংবা মসজিদের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও টিকে থাকা একটি অনন্য স্থাপত্যকর্মই গড়ে দেয় কসবার সঙ্গে অন্য যেকোনো গ্রামের লক্ষণীয় পার্থক্য। স্থাপত্যকর্মটি নিঃসন্দেহে কসবার ঐতিহ্যবাহী নয় গম্বুজ মসজিদ।
যন্ত্রযান থেকে নেমে কসবা গ্রামের সংকীর্ণ শাখাপথে পা বাড়ালাম আমরা। হরেক রকম গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন সেই শাখাপথের একাংশে কয়েকটি দোকান সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। দোকানগুলো পেছনে ফেলতে না ফেলতেই জং-ধরা গ্রিলের গেট আর কাঁটাতারে ঘেরা বিরাট আঙিনা। পরিচ্ছন্ন সেই আঙিনার কেন্দ্রস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত কসবার নয় গম্বুজ মসজিদ।
আনুমানিক ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত এই মসজিদটির চার কোণে চারটি গোলাকৃতি মিনার রয়েছে, উপরিভাগে রয়েছে তিন সারিতে নয়টি গম্বুজ। মসজিদের সামনের দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আরও একটি করে প্রবেশপথ থাকলেও কেবল সামনের দেয়ালের মাঝখানের প্রবেশপথটি ছাড়া অন্য পথগুলো গ্রিল দিয়ে বন্ধ এখন। বহিরঙ্গের সৌন্দর্য অবলোকন শেষে আমরা প্রবেশ করলাম মসজিদের অভ্যন্তরে। বর্গাকার এই মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব। এ ছাড়াও কেন্দ্রস্থলে রয়েছে চারটি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভ। মসজিদের খাদেম হিসেবে পরিচয়দানকারী বাবুল ফকির জানালেন, এ অঞ্চলের অনেক মানুষই স্তম্ভগুলোকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলে মনে করে। তারা বিশ্বাস করে, মিহরাব-নিকটবর্তী স্তম্ভ দুটো থেকে অবিরাম ঘাম নিঃসৃত হয় এবং নিঃসৃত এই ঘামের স্পর্শে সর্বরোগ নিরাময় হয়। বাবুল ফকিরের কথা শুনতে শুনতে রোগ নিরাময়ের আশায় আগত মানুষদের দেখি আমরা, নির্ণয় করার চেষ্টা করি তাদের সামাজিক বলয়, অর্থনৈতিক অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে তাদের বাস। দেশে প্রচলিত চিকিত্সাব্যবস্থার ওপর আস্থা স্থাপনের সংগতি নেই তাদের। আগৈলঝাড়ার রহিমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। হতদরিদ্র এই প্রৌঢ়া চার বছর বয়সী নাতি সুজনকে নিয়ে এসেছেন মসজিদের পবিত্র স্তম্ভের কাছে মানত করতে। সুজনের পা-জোড়া কোনো এক অজ্ঞাত রোগে দীর্ঘদিন চলত্শক্তিহীন। ভীষণ মায়াভরা চোখের নাতিটিকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন রহিমা খাতুন। তাঁর বিশ্বাস, স্তম্ভের অলৌকিক শক্তিতে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবে সুজন। আসন্ন ঈদের আগেই হেঁটে বেড়াবে পৃথিবীর বুকে। রহিমা খাতুনের বক্তব্য, আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সত্ত্বার সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হলেও আমরা তাঁর বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো যুক্তির অবতারণা করি না মোটেই। কারণ যে দেশে চিকিত্সা নামের সাংবিধানিক অধিকার সুনিশ্চিত নয়, সে দেশে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল মানুষের সরল বিশ্বাসের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক যুক্তির অবতারণা করার নৈতিক অধিকার কোথায় আমাদের! তারচেয়ে বরং বিশ্বাসই জয়ী হোক, আমাদের বোধগম্যতার অতীত কোনো আলৌকিক শক্তির স্পর্শে হলেও সেরে উঠুক রহিমা খাতুনের নাতি সুজন! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আসন্ন ঈদ আনন্দময় হোক তাদের!
ঢাকা বরিশাল মহাসড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এই কসবা গ্রামটি মূলত তিনটি গ্রামের সমন্বয়। ছোট কসবা, বড় কসবা ও লাখেরাজ কসবা। অতি প্রাথমিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর সঙ্গে কসবা গ্রামটির লক্ষণীয় কোনো পার্থক্য নেই। অথচ গ্রামটির স্থান-নামের উত্স ফারসি। বাংলায় কসবা শব্দটির অর্থ শহর। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, কসবা সুপ্রাচীন বাঙালাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৩ শতকে কোটালীপাড়ার মদনপুরে প্রাপ্ত বিশ্বরূপ সেনের তাম্রলিপিতে বাঙালাবাদের উল্লেখ আছে। শোনা যায়, ফরিদপুরের দক্ষিণ অঞ্চল এবং সমগ্র চন্দ্রদ্বীপ অর্থাত্ প্রাচীন বাকলা বা অধুনা বরিশাল বাঙালাবাদের অন্তর্গত ছিল। পাল আমলে বাঙালাবাদে উন্নত বৌদ্ধসভ্যতা গড়ে ওঠে। বৌদ্ধসভ্যতা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৩ ও ১৪ শতকে সেন রাজবংশ এ অঞ্চল শাসন করে। ১৪ ও ১৫ শতকে বাঙালাবাদে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ১৫ শতকের মধ্যভাগে হজরত খান জাহান আলী (রা.) এই অঞ্চলে পদার্পণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর শিষ্যগণ এ স্থানে ইসলামধর্ম প্রচার শুরু করেন। সম্ভবত সে সময়ই কসবার পত্তন হয়। তারপর ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয় বাঙালাবাদে উল্লিখিত রামসিদ্ধির নিকটবর্তী এই অঞ্চলটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। কসবায় তৈরি হয় নানা ধরনের ইমারত, গড়ে ওঠে নান্দনিক গঠনশৈলীর বেশ কিছু মসজিদ। সেই সব ইমারত কিংবা মসজিদের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও টিকে থাকা একটি অনন্য স্থাপত্যকর্মই গড়ে দেয় কসবার সঙ্গে অন্য যেকোনো গ্রামের লক্ষণীয় পার্থক্য। স্থাপত্যকর্মটি নিঃসন্দেহে কসবার ঐতিহ্যবাহী নয় গম্বুজ মসজিদ।
যন্ত্রযান থেকে নেমে কসবা গ্রামের সংকীর্ণ শাখাপথে পা বাড়ালাম আমরা। হরেক রকম গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন সেই শাখাপথের একাংশে কয়েকটি দোকান সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। দোকানগুলো পেছনে ফেলতে না ফেলতেই জং-ধরা গ্রিলের গেট আর কাঁটাতারে ঘেরা বিরাট আঙিনা। পরিচ্ছন্ন সেই আঙিনার কেন্দ্রস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত কসবার নয় গম্বুজ মসজিদ।
আনুমানিক ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত এই মসজিদটির চার কোণে চারটি গোলাকৃতি মিনার রয়েছে, উপরিভাগে রয়েছে তিন সারিতে নয়টি গম্বুজ। মসজিদের সামনের দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আরও একটি করে প্রবেশপথ থাকলেও কেবল সামনের দেয়ালের মাঝখানের প্রবেশপথটি ছাড়া অন্য পথগুলো গ্রিল দিয়ে বন্ধ এখন। বহিরঙ্গের সৌন্দর্য অবলোকন শেষে আমরা প্রবেশ করলাম মসজিদের অভ্যন্তরে। বর্গাকার এই মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব। এ ছাড়াও কেন্দ্রস্থলে রয়েছে চারটি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভ। মসজিদের খাদেম হিসেবে পরিচয়দানকারী বাবুল ফকির জানালেন, এ অঞ্চলের অনেক মানুষই স্তম্ভগুলোকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন বলে মনে করে। তারা বিশ্বাস করে, মিহরাব-নিকটবর্তী স্তম্ভ দুটো থেকে অবিরাম ঘাম নিঃসৃত হয় এবং নিঃসৃত এই ঘামের স্পর্শে সর্বরোগ নিরাময় হয়। বাবুল ফকিরের কথা শুনতে শুনতে রোগ নিরাময়ের আশায় আগত মানুষদের দেখি আমরা, নির্ণয় করার চেষ্টা করি তাদের সামাজিক বলয়, অর্থনৈতিক অবস্থান। স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে তাদের বাস। দেশে প্রচলিত চিকিত্সাব্যবস্থার ওপর আস্থা স্থাপনের সংগতি নেই তাদের। আগৈলঝাড়ার রহিমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। হতদরিদ্র এই প্রৌঢ়া চার বছর বয়সী নাতি সুজনকে নিয়ে এসেছেন মসজিদের পবিত্র স্তম্ভের কাছে মানত করতে। সুজনের পা-জোড়া কোনো এক অজ্ঞাত রোগে দীর্ঘদিন চলত্শক্তিহীন। ভীষণ মায়াভরা চোখের নাতিটিকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন রহিমা খাতুন। তাঁর বিশ্বাস, স্তম্ভের অলৌকিক শক্তিতে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবে সুজন। আসন্ন ঈদের আগেই হেঁটে বেড়াবে পৃথিবীর বুকে। রহিমা খাতুনের বক্তব্য, আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সত্ত্বার সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হলেও আমরা তাঁর বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো যুক্তির অবতারণা করি না মোটেই। কারণ যে দেশে চিকিত্সা নামের সাংবিধানিক অধিকার সুনিশ্চিত নয়, সে দেশে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল মানুষের সরল বিশ্বাসের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক যুক্তির অবতারণা করার নৈতিক অধিকার কোথায় আমাদের! তারচেয়ে বরং বিশ্বাসই জয়ী হোক, আমাদের বোধগম্যতার অতীত কোনো আলৌকিক শক্তির স্পর্শে হলেও সেরে উঠুক রহিমা খাতুনের নাতি সুজন! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আসন্ন ঈদ আনন্দময় হোক তাদের!
No comments