জন্মভূমির সঙ্গে রয়েছে মানুষের এক রহস্যময় যোগসূত্র -প্রবাসী বাঙালি by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
‘প্রবাসী বাঙালি’ শব্দটার সূচনা এ কালে নয়, ব্রিটিশ আমলে। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই বাঙালি ‘বাবু’রা সারা ভারতে বিদ্বান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ফলে ভালো চাকরিবাকরি নিয়ে তারা বাংলার বাইরে পাড়ি জমাতে শুরু করে। তবে ব্রিটিশ যুগে বাঙালির প্রবাসের দৌড় এই উপমহাদেশের বাইরে খুব একটা পৌঁছায়নি। ভারতবর্ষের নানা জায়গা, বিশেষ করে উত্তর ভারতের ছোট-বড় শহর ও অন্যান্য এলাকায় এরা বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসে। আগেই বলেছি, এদের অধিকাংশই ছিল উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু। বিদ্যার জন্য ভারতবর্ষের সবখানে এদের কদর ছিল। সঞ্জীব চন্দ্রের ‘পালামৌ’, রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রের বেশ কিছু লেখায়, বিভূতিভূষণের আরণ্যক-এর মতো অন্যান্য লেখকের অনেক লেখায় বাঙালির এই বহির্মুখী যাত্রার ছবি রয়েছে। বিশ শতকের শুরুতেই এলাহাবাদে প্রবাসী বাঙালিদের যে বড়সড় একটা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় সেখানে অতুল প্রসাদের নেতৃত্বে আয়োজিত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের ঘনঘটা দেখেই।
প্রবাসী বাঙালি আজ শুধু এই উপমহাদেশের চৌহদ্দীতে সীমাবদ্ধ নয়, পৃথিবীর সব দেশের সব শহরে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যের দুঃসহ চাবুক থেকে বাঁচার জন্য বা সচ্ছল জীবনের স্বর্ণমৃগের পেছনে ছুটে বাঙালি আজ বসত গাড়েনি এমন জায়গা পৃথিবীতে কম। আমার ধারণা, আল্পসের উচ্চতম শৃঙ্গের ওপর পৌঁছাতে পারলেও সেখানে দোকান খুলে বসে থাকা অন্তত একজন বাঙালির দেখা মিলবে। গত ৪০ বছর বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে বল্গাহীন গোল্ডরাশের যুগ। সৌভাগ্যের সোনার হরিণের পেছনে ছুটে লাখ লাখ বাঙালি এ সময় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশ বা পশ্চিম বাংলার বাইরের এই বিশ্ববাংলাকে তারা বলে ‘তৃতীয় বাংলা’। তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গেছে মূলত শিক্ষিত পেশাজীবী বাঙালিরা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখানকার মানুষের সামনে আচমকা সুযোগের কোটি কোটি রুদ্ধ দরজা খুলে যাওয়ার ফলে এখান থেকে শিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী বাঙালি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের সংখ্যা আজ মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। লন্ডন শহরের ৮০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে সাড়ে তিন লাখই আজ বাঙালি। নিউইয়র্কে বাঙলির সংখ্যা এক লাখের বেশি, লস অ্যাঞ্জেলেস, টরন্টো বা রোমে কম, সে কম ৫০ হাজার করে। পৃথিবীতে ছোট-বড় এমন শহর কমই আছে, যেখানে বাঙালির একটা ছোটখাটো ডেরা নেই। আজ বাংলাদেশের মানুষের জন্য কোনো দেশই যেন আর বিদেশ নয়। যে দেশে যে শহরেই যান মুহূর্তের মধ্যে সেখানে কিছু ‘বাঙালি ভাই’ পেয়ে যাবেন এবং প্রাণভরে বাংলায় কথা বলতে পারবেন। ‘প্রবাসে বাঙালিমাত্রেই সজ্জন’। কাজেই বেশ কিছু দেশায়ালি ভাইয়ের বাড়িতে ভাত-মাছের নিমন্ত্রণ পেয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-পড়া প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা আজ ৫০ লাখের ওপর। প্রবাসী বাঙালি শ্রমিকদের পাঠানো টাকা আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বৃহত্তম উত্স।
২.
একজন মানুষের শৈশব-কৈশোরের সুন্দর দিনগুলো যে দেশে কাটে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেটিই তার দেশ। সেটিই তার চিরকালের জন্মভূমি। যত দূরে বা যে দেশেই সে যাক, শৈশবের স্নিগ্ধ রঙিন অনুভূতিভরা দিনগুলোয় যে দেশের গাছপালা, নদী, আকাশকে সে তার রক্তকণিকায় আহরণ করেছে, সেই জন্মভূমির জন্যই তার আমৃত্যু কান্না। এর কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। আমাদের জীবনের প্রিয়তম, রঙিনতম জিনিসগুলো আমরা তো আহরণ করি আমাদের শৈশব-কৈশোরেই। এ সময় চারপাশ থেকে আমরা যা কিছুই গ্রহণ করি, তা এমনভাবে আমাদের রক্তের কণায় কণায় মিশে যায় যে তা-ই হয়ে যায় আমাদের আজন্মের পরিচয়। মৃত্যু পর্যন্ত ওই মানুষটাই আমরা থাকি। প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো ওই স্বপ্ন আর ভালোবাসার দেশটাকে তাদের আচমকা হারিয়ে ফেলতে হয়। তাই দেশত্যাগী স্মৃতিভারাতুর এই মানুষগুলো পৃথিবীর নানা বিচ্ছিন্ন প্রান্তে গিয়েও এই দেশটির চারপাশেই সারা জীবন জেগে থাকে। কেবল তারাই নয়, তাদের সন্তানসন্ততি এমনকি অনেক পরের প্রজন্মের মানুষেরা—যারা নানা দেশের বাসিন্দা হয়ে পুরো ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে, যাদের সংস্কৃতি আলাদা, ভাষা আলাদা, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ আলাদা, তারাও তাদের পিতৃপিতামহের ফেলে আসা সেই অতীত দেশটির জন্য—নিজেদের আদি শেকড়ের জন্য—একটা ব্যাখ্যাহীন আকুলতা অনুভব করে। যে দেশে যত দিন ধরেই তারা থাকুক, ঐতিহ্য, ধর্ম বা বর্ণগত পার্থক্যের কারণে সেখানকার মানুষের সঙ্গে তারা কখনোই পুরোপুরি এক হতে পারে না—তাদের জীবনের ভেতর কিছু পরিমাণ ফাঁকা জায়গা থেকেই যায়। উেসর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ জন্যই তারা হয়তো তাদের সেই শূন্য স্থান পূরণের চেষ্টা করে।
প্রবাসী জীবনের একটা খুব বড় ধরনের দুঃখের দিক আছে, সেটা হলো, যত সুখ আর সম্ভোগের মধ্যেই তারা থাকুক, শেষ হিসেবে তারা যাযাবর, উদ্বাস্তু। ঘরবাড়ি, আত্মীয়, বন্ধু-শৈশব-কৈশোর, জন্মভূমি জননী পিছে ফেলে অপরিচিত দূরদেশে, অচেনা পরিবেশে পরিচয়হীনভাবে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের ঘুরে বেড়াতে হবে, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতি কোনো কিছুর সঙ্গেই তাদের আত্মার সত্যিকার যোগ নেই। তাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সন্তানসন্ততিরা মিশে যাবে ওসব দেশের জল-হাওয়া বা ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে, ওইসব সংস্কৃতির বৈভব আর উত্তেজনার ভেতর মর্যাদাবান (কিংবা হয়তো তাদের মতোই মর্যাদাহীন) জীবন কাটাবে; কিন্তু তাদের সেখানে বেঁচে থাকতে হবে বহিরাগতের মতো, প্রায় অবাঞ্ছিত হিসেবে। তারা সেখানকার সবকিছুই দেখবে, উপভোগ করবে—সেসব থেকে আনন্দও হয়তো পাবে। কিন্তু কোনো কিছুকেই নিজের বলে ভাবতে পারবে না। যেন এসব তাদের নয়, অন্য কারও। যেন নাগরিক হয়েও তারা নাগরিক নয়, যেন তারা এক ধরনের চির পর্যটক। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উদ্বাস্তুজীবনের এই গভীর দুঃখ আমি সব জায়গায় অনুভব করেছি। লক্ষ করেছি বাংলার গাছপালা-ঢাকা সবুজ গ্রাম, মেঘ-ওড়া নীল আকাশ, নদীর কলকণ্ঠ—সবকিছুর পাশে কীভাবে তাদের হূদয় মরে পড়ে আছে। ছেলেবেলার বন্ধু, শৈশব-কৈশোরের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী, বাংলার মাটি, বাংলার জল—সবকিছুর জন্য তাদের কী আকুতি, কী ব্যাকুলতা।
সন্দেহ নেই আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি তাদের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য ভালোবাসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভেতর অনেক বেশি। এটা অকারণে নয়। আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করছি, প্রতিদিন এর প্রিয়-অপ্রিয়, তিক্ত বা বিরক্তিকর সান্নিধ্য বা উপস্থিতি সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি, তাদের কাছে দেশ যতখানি স্বপ্নের জিনিস, তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব আর কাঠখোট্টা। এ সম্পর্ক একেবারেই দাম্পত্য সম্পর্ক বা তেল-নুন-লাকড়ির মতো হিসাব করার ব্যাপার। অতি পাওয়ায় এ একঘেয়ে, বিরক্তিকর। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক দাম্পত্যের মতো বিস্বাদ, কটু বা একঘেয়ে নয়, এ সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক। বিচ্ছেদের কষ্টে এ দীর্ণ; তাই এ এমন হাহাকার-ভরা। জেলখানার কয়েদির কাছে প্রাচীরের বাইরের তুচ্ছ একটা পাখির গান বা দূরের কোনো মানুষের কণ্ঠের ছোট্ট একটু সজীব আওয়াজ যেমন মুক্ত আর চিরযৌবনের বার্তা নিয়ে হাজির হয়, তাদের কাছে মাতৃভূমিও তা-ই। দেশ হয়ে ওঠে স্বর্গাদপি গরীয়সী।
এই স্বপ্নের জন্য পৃথিবীজোড়া দেশ-বিদেশের অসংখ্য শহরে আজ লাখ লাখ বাঙালি বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাসে দিন কাটায়। অনেক উপস্থিত বাস্তব দুঃখ তাদের এই বিষণ্নতা আর অসহায়তাকে বাড়িয়ে দেয়। চোখের সামনে তারা দেখে, বিদেশে জন্ম নিয়ে বা বেড়ে উঠে তাদের ছেলেমেয়েরা ভিন্ন সংস্কৃতির ভেতর বিচ্ছিন্ন হতে হতে একসময় অচেনা হয়ে যাচ্ছে, তাদের বিজাতীয় ও অশালীন চালচলন মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। নিজেদের দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে কখনো দেশে ফিরে যাওয়ার কথাও তারা হয়তো ভাবে। কিন্তু তত দিনে নিজেদের তৈরি বিধিলিপিই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। আজ দেশে ফিরলেও সন্তানসন্ততির সঙ্গে চিরবিচ্ছিন্নতা, না ফেরা মানেও তাদের হারানো। তারা টের পায় নির্মম অর্থকষ্টের চাবকানি বা বেশি রকম লাভের মোহে দেশ ছাড়ার পর সত্যি সত্যি বড় বেশি দেরি করে ফেলেছে তারা। সে দেশের মাটিতে তাদের শেকড় ছড়িয়ে গেছে। তাদের ছেলেমেয়েদের অস্তিত্ব বা ভবিষ্যত্ও আজ সে দেশের মাটির সঙ্গে নিয়তির মতো বাঁধা।
তাদের এ কথা ভাবতে কষ্ট লাগে যে তাদের সন্তানেরা তাদের মতো বাংলাদেশি নয়। ওই সন্তানদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই দেশে। তাদের দেশ আমেরিকা বা এমনই কোনো দেশ। তাদের বাবাদের যেমন আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের সঙ্গে কোনো আত্মিক যোগ নেই, তাদেরও তেমনি নেই বাংলাদেশের সঙ্গে। সন্তানদের এভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠার কষ্ট বাবা-মায়ের বুকে পেরেকের মতো বেঁধে। মানুষ ভাবতে ভালোবাসে তাদের জৈবিক অস্তিত্বের মতো তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সন্তানদের মধ্য দিয়ে বহমান থাকুক। কিন্তু যখন তারা দেখে, তাদের ছেলেমেয়েরা আলাদা দেশের অপরিচিত মানুষ হয়ে যাচ্ছে, নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরবময় পরিচয়কে পর্যন্ত সম্মান করছে না, তখন তারা এক নিদারুণ একাকিত্বে ভোগে। এ দেশে আসার সময় এই পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। যে সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য একদিন তারা প্রিয় জন্মভূমি, বন্ধু, ভাই, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে অনিশ্চিত বিদেশের পথে পা বাড়িয়েছিল, তাদের উপেক্ষা-তাচ্ছিল্য তাদের ভেতরে ভেতরে কাঁদায়, ভেঙে দেয়।
পৃথিবীর সব দেশেই বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য যে উত্কণ্ঠা, আগ্রহ বা ব্যাকুলতা দেখি, তা দেখে উগ্র জাতীয়তাবাদী না হয়েও আমার মনে হয়েছে মানুষ আর তার জন্মভূমির মধ্যে রয়েছে এক রহস্যময় যোগসূত্র।
৩.
দেশের জন্য এই ব্যাকুলতা প্রবাসীদের মধ্যে যে কতখানি প্রবল, একটা গল্প শুনিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করি। আগেই বলেছি, বিদেশে বাস করা সম্পন্ন বা সচ্ছল বাঙালিদের মধ্যে এই ব্যাকুলতা যতখানি তার চেয়ে এ অনেক বেশি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শ্রমিক শ্রেণীর গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে। সচ্ছল মানুষদের মনকে জন্মভূমির রক্তিম হাতছানি যে কখনো কখনো উতলা করে না তা নয়। কিন্তু গাড়ি-বাড়ি, বিলাস-বৈভবে, ঝলমল করা তাদের জীবনে সে পিছুটান খুব বড় কিছু নয়। তা ছাড়া ইচ্ছা করলেই তো তারা মাঝেমধ্যে দেশে এসে ঘুরে যেতে পারে। তারা তা যায়ও। তাই বিদেশে থাকলেও দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট তাদের অত প্রবল নয়। কিন্তু গরিব প্রবাসীদের ব্যাপারে ঘটনাটা আলাদা। আদম বেপারিদের খপ্পরে পড়ে জমি-বাড়ি বিক্রি বা বন্ধক দিয়ে নামমাত্র রোজগারের আশায় অচেনা দূর বিদেশের পথে পাড়ি জমায় তারা। দূরদেশের নির্মম আবহাওয়া বা ঝলসানো রোদের ভেতর শরীর আয়ু ক্ষয় করে অমানুষিক শ্রমে তাদের জন্য দূর প্রবাস থেকে এরা বছরের পর বছর টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে তার ভাইয়েরা বাজার থেকে চড়াদামে মাছ-মাংস কিনে নবাবী হালে দিন কাটায়, চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে ফূর্তিতে সময় গুজরান করে। ভাইয়ের পাঠানো টাকায় তার জন্য জমি কেনার বদলে অনেক সময় গোপনে তা নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। তবু এই মানুষগুলো তাদের মুখ স্মরণ করেই হাজারো শৌখিন জিনিসে বড় বড় ব্যাগ-বস্তা ভর্তি করে বাড়ি ফেরে।
এমনই একদল দুঃখী মানুষের সঙ্গে বছর তিনেক আগে দেখা হয়েছিল, দুবাই এয়ারপোর্টে। সেবারও আমেরিকা থেকে ফিরছিলাম। দুবাইয়ে প্লেন পাল্টে ঢাকার প্লেনে উঠছি। বের্ডিং কাউন্টারে গিয়ে দেখি ফ্লাইটে বিদেশি নেই বললেই চলে। কাউন্টারজুড়ে গিজগিজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের নানা জায়গা থেকে জড়ো হওয়া ঘরমুখো বাঙালি শ্রমিকের দল। বুঝলাম, এদের নিয়মিত আনা-নেওয়ার জন্যই এমিরেটস, ইতিহাদ, কাতার বা কুয়েত এয়ারলাইনসের এত ঢাকামুখো ফ্লাইট। এদের কেউ তিন বছর কেউ চার বছর কেউ এমনকি পাঁচ বছর পর দেশে ফিরছে, সবার সঙ্গে বিরাট বিরাট বাক্স-পেঁটরার ভেতর কেনাকাটা করা সাধ্যমতো জিনিসপত্র। প্রিয়জনের জন্য কেনা এই জিনিসগুলো তাদের হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্নে তাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। দেশের জন্য কী ব্যাকুলতা আর স্বপ্ন সবার চোখে। বাঁধভাঙা বন্যার মতো উদ্বেল হূদয় নিয়ে ফ্লাইটের পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়টুকু সহ্য করার শক্তিও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। যেন পারলে দুবাইয়ে প্লেনে উঠেই সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে যায়। কথা বলে বোঝা গেল এদের অধিকাংশই লিখতে-পড়তে পর্যন্ত জানে না। আমার পাশেই বসেছিলেন রীতিমতো স্যুটটাইপরা ডাকসাইটে এক ভদ্রলোক। কিছুক্ষণ আলাপের পরে একগাল বিগলিত হাসির সঙ্গে হাতের ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের কাগজ দুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ভাবলাম, আমার ওগুলো দরকার ভেবেই হয়তো ওগুলো আমাকে দিচ্ছেন। বললাম, আমার আছে, লাগবে না।
‘একটু ফিলাপ কইরা দিবেন স্যার?’ মুখে দাঁত বের করা বিগলিত হাসি। কী আশ্চর্য! এ রকম একজন স্যুটপরা পুরোদস্তুর ডাঁটপাটওয়ালা ভদ্রলোক লিখতে পর্যন্ত জানেন না? কিন্তু না, এমন বাঙালি একজন-দুজন না, হাজারে হাজারে পাবেন মধ্যপ্রাচ্যের মতো পৃথিবীর নানা দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের ভিড়ে।
কথায় কথায় জানলাম, তিনিও একজন শ্রমিক। বাড়ি সিলেটে। রিয়াদে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। প্রথম এসেছিলেন বসরায়, ইরাকে। সেখানে যুদ্ধের তাড়া খেয়ে আরবে পাড়ি জমিয়েছেন।
তার ফরম ফিলাপ শেষ হতেই আরেকটা হাত এগিয়ে এল সামনের দিক থেকে। তারটা শেষ হতেই দেখি চারপাশ থেকে ডজনখানেক হাত আমার দিকে এগিয়ে আছে। সব হাতে একই ফরম। সবাই যে ভদ্রভাবে অনুরোধ করছে তা-ও না। অনুরোধ করার ভাষাও অনেকে জানে না। এ ধরনের দেহাতী মানুষের পক্ষে কী করেই বা তা সম্ভব?
‘এই যে, দেন তো, আমারডা ফিলাপ কইরা দেন।’
মনে হয় হুকুম করছে।
দুঃখী এই লোকগুলোর জন্য মমতায় মনটা ভরে উঠল। প্লেনযাত্রার পুরো সময়টা এদের ফরম ফিলাপ করে চললাম। এদিকে বাংলাদেশ এগিয়ে আসছে। প্লেন ভর্তি লোকগুলোর মধ্যে টানটান উত্তেজনা। কখন আসবে বাংলাদেশ। কেন আসছে না। লোকগুলোর চেহারায় আগ্নেয় উগ্রতা। সবার কথাবার্তার বিষয় একটাই: বাংলাদেশ। ঘরে ফেরার আগ্রহে, আনন্দে, উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়ছে সবাই।
সামনের টিভির পর্দায় প্লেনের ছুটে চলার ছবি চোখে পড়ছে। আরব সাগরের ধার দিয়ে করাচির পাশ কাটিয়ে দিল্লি-কানপুর পেরিয়ে প্লেন এখন বিহারের ওপর। এখনো অন্তত ঘণ্টাখানেক বাকি। যাত্রীরা অস্থির, বেসামাল। উত্তেজনায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোথায় বাংলাদেশ, কোথায় তুমি? মাতৃভূমি, তুমি কত দূর! অধিকাংশ লোকই মানচিত্র চেনে না। বুঝতে পারছে না ঠিক কোনখানে আছে। হঠাত্ জানালার পাশ থেকে কে একজন চিত্কার করে উঠল: ওই যে! ওই যে।
তার ব্যগ্র চিত্কার সারা প্লেনে যেন কেঁপে কেঁপে বেড়াতে লাগল। সবাই যেন মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিল। হঠাত্ প্লেনের ভেতর ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। প্লেন ভর্তি প্রায় সব লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে হুড়মুড় করে জানালার দিকে ঝুঁকে কী যেন আঁতিপাতি করে খুঁজছে। গলায় শুধু একটাই চিত্কার—কই? কই? (কোথায় আমার দেশ—ভাই, সন্তান, জীবনসঙ্গী, বাপ, মা, কোথায় তোমরা?) প্লেন ভর্তি এত লোক পাগলের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে শুধু বাংলাদেশ দেখার চেষ্টা করছে।
হঠাত্ গোটা প্লেন ভর্তি লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলে যে বিমানের বিপদ হতে পারে সে জ্ঞান নেই এই লোকগুলোর। বিমানবালা আর পুরুষ ক্রুরা ধমক দিয়ে, চিত্কার করে পাগলের মতো দুই হাতে টেনেহিঁচড়ে ঘাড় চেপে তাদের বসানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জানালা থেকে তাদের ফেরানো সোজা নয়। প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশ এমনই এক জ্বলন্ত রূপসী। আমাদের কাছে এর কতটুকু?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক, প্রাবন্ধিক। প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র।
প্রবাসী বাঙালি আজ শুধু এই উপমহাদেশের চৌহদ্দীতে সীমাবদ্ধ নয়, পৃথিবীর সব দেশের সব শহরে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। দারিদ্র্যের দুঃসহ চাবুক থেকে বাঁচার জন্য বা সচ্ছল জীবনের স্বর্ণমৃগের পেছনে ছুটে বাঙালি আজ বসত গাড়েনি এমন জায়গা পৃথিবীতে কম। আমার ধারণা, আল্পসের উচ্চতম শৃঙ্গের ওপর পৌঁছাতে পারলেও সেখানে দোকান খুলে বসে থাকা অন্তত একজন বাঙালির দেখা মিলবে। গত ৪০ বছর বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনে বল্গাহীন গোল্ডরাশের যুগ। সৌভাগ্যের সোনার হরিণের পেছনে ছুটে লাখ লাখ বাঙালি এ সময় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশ বা পশ্চিম বাংলার বাইরের এই বিশ্ববাংলাকে তারা বলে ‘তৃতীয় বাংলা’। তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গেছে মূলত শিক্ষিত পেশাজীবী বাঙালিরা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখানকার মানুষের সামনে আচমকা সুযোগের কোটি কোটি রুদ্ধ দরজা খুলে যাওয়ার ফলে এখান থেকে শিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী বাঙালি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের সংখ্যা আজ মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। লন্ডন শহরের ৮০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে সাড়ে তিন লাখই আজ বাঙালি। নিউইয়র্কে বাঙলির সংখ্যা এক লাখের বেশি, লস অ্যাঞ্জেলেস, টরন্টো বা রোমে কম, সে কম ৫০ হাজার করে। পৃথিবীতে ছোট-বড় এমন শহর কমই আছে, যেখানে বাঙালির একটা ছোটখাটো ডেরা নেই। আজ বাংলাদেশের মানুষের জন্য কোনো দেশই যেন আর বিদেশ নয়। যে দেশে যে শহরেই যান মুহূর্তের মধ্যে সেখানে কিছু ‘বাঙালি ভাই’ পেয়ে যাবেন এবং প্রাণভরে বাংলায় কথা বলতে পারবেন। ‘প্রবাসে বাঙালিমাত্রেই সজ্জন’। কাজেই বেশ কিছু দেশায়ালি ভাইয়ের বাড়িতে ভাত-মাছের নিমন্ত্রণ পেয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-পড়া প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা আজ ৫০ লাখের ওপর। প্রবাসী বাঙালি শ্রমিকদের পাঠানো টাকা আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বৃহত্তম উত্স।
২.
একজন মানুষের শৈশব-কৈশোরের সুন্দর দিনগুলো যে দেশে কাটে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেটিই তার দেশ। সেটিই তার চিরকালের জন্মভূমি। যত দূরে বা যে দেশেই সে যাক, শৈশবের স্নিগ্ধ রঙিন অনুভূতিভরা দিনগুলোয় যে দেশের গাছপালা, নদী, আকাশকে সে তার রক্তকণিকায় আহরণ করেছে, সেই জন্মভূমির জন্যই তার আমৃত্যু কান্না। এর কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। আমাদের জীবনের প্রিয়তম, রঙিনতম জিনিসগুলো আমরা তো আহরণ করি আমাদের শৈশব-কৈশোরেই। এ সময় চারপাশ থেকে আমরা যা কিছুই গ্রহণ করি, তা এমনভাবে আমাদের রক্তের কণায় কণায় মিশে যায় যে তা-ই হয়ে যায় আমাদের আজন্মের পরিচয়। মৃত্যু পর্যন্ত ওই মানুষটাই আমরা থাকি। প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো ওই স্বপ্ন আর ভালোবাসার দেশটাকে তাদের আচমকা হারিয়ে ফেলতে হয়। তাই দেশত্যাগী স্মৃতিভারাতুর এই মানুষগুলো পৃথিবীর নানা বিচ্ছিন্ন প্রান্তে গিয়েও এই দেশটির চারপাশেই সারা জীবন জেগে থাকে। কেবল তারাই নয়, তাদের সন্তানসন্ততি এমনকি অনেক পরের প্রজন্মের মানুষেরা—যারা নানা দেশের বাসিন্দা হয়ে পুরো ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে, যাদের সংস্কৃতি আলাদা, ভাষা আলাদা, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ আলাদা, তারাও তাদের পিতৃপিতামহের ফেলে আসা সেই অতীত দেশটির জন্য—নিজেদের আদি শেকড়ের জন্য—একটা ব্যাখ্যাহীন আকুলতা অনুভব করে। যে দেশে যত দিন ধরেই তারা থাকুক, ঐতিহ্য, ধর্ম বা বর্ণগত পার্থক্যের কারণে সেখানকার মানুষের সঙ্গে তারা কখনোই পুরোপুরি এক হতে পারে না—তাদের জীবনের ভেতর কিছু পরিমাণ ফাঁকা জায়গা থেকেই যায়। উেসর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ জন্যই তারা হয়তো তাদের সেই শূন্য স্থান পূরণের চেষ্টা করে।
প্রবাসী জীবনের একটা খুব বড় ধরনের দুঃখের দিক আছে, সেটা হলো, যত সুখ আর সম্ভোগের মধ্যেই তারা থাকুক, শেষ হিসেবে তারা যাযাবর, উদ্বাস্তু। ঘরবাড়ি, আত্মীয়, বন্ধু-শৈশব-কৈশোর, জন্মভূমি জননী পিছে ফেলে অপরিচিত দূরদেশে, অচেনা পরিবেশে পরিচয়হীনভাবে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের ঘুরে বেড়াতে হবে, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, প্রকৃতি কোনো কিছুর সঙ্গেই তাদের আত্মার সত্যিকার যোগ নেই। তাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের সন্তানসন্ততিরা মিশে যাবে ওসব দেশের জল-হাওয়া বা ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে, ওইসব সংস্কৃতির বৈভব আর উত্তেজনার ভেতর মর্যাদাবান (কিংবা হয়তো তাদের মতোই মর্যাদাহীন) জীবন কাটাবে; কিন্তু তাদের সেখানে বেঁচে থাকতে হবে বহিরাগতের মতো, প্রায় অবাঞ্ছিত হিসেবে। তারা সেখানকার সবকিছুই দেখবে, উপভোগ করবে—সেসব থেকে আনন্দও হয়তো পাবে। কিন্তু কোনো কিছুকেই নিজের বলে ভাবতে পারবে না। যেন এসব তাদের নয়, অন্য কারও। যেন নাগরিক হয়েও তারা নাগরিক নয়, যেন তারা এক ধরনের চির পর্যটক। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উদ্বাস্তুজীবনের এই গভীর দুঃখ আমি সব জায়গায় অনুভব করেছি। লক্ষ করেছি বাংলার গাছপালা-ঢাকা সবুজ গ্রাম, মেঘ-ওড়া নীল আকাশ, নদীর কলকণ্ঠ—সবকিছুর পাশে কীভাবে তাদের হূদয় মরে পড়ে আছে। ছেলেবেলার বন্ধু, শৈশব-কৈশোরের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী, বাংলার মাটি, বাংলার জল—সবকিছুর জন্য তাদের কী আকুতি, কী ব্যাকুলতা।
সন্দেহ নেই আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি তাদের চেয়ে বাংলাদেশের জন্য ভালোবাসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভেতর অনেক বেশি। এটা অকারণে নয়। আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করছি, প্রতিদিন এর প্রিয়-অপ্রিয়, তিক্ত বা বিরক্তিকর সান্নিধ্য বা উপস্থিতি সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি, তাদের কাছে দেশ যতখানি স্বপ্নের জিনিস, তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব আর কাঠখোট্টা। এ সম্পর্ক একেবারেই দাম্পত্য সম্পর্ক বা তেল-নুন-লাকড়ির মতো হিসাব করার ব্যাপার। অতি পাওয়ায় এ একঘেয়ে, বিরক্তিকর। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক দাম্পত্যের মতো বিস্বাদ, কটু বা একঘেয়ে নয়, এ সম্পর্ক প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক। বিচ্ছেদের কষ্টে এ দীর্ণ; তাই এ এমন হাহাকার-ভরা। জেলখানার কয়েদির কাছে প্রাচীরের বাইরের তুচ্ছ একটা পাখির গান বা দূরের কোনো মানুষের কণ্ঠের ছোট্ট একটু সজীব আওয়াজ যেমন মুক্ত আর চিরযৌবনের বার্তা নিয়ে হাজির হয়, তাদের কাছে মাতৃভূমিও তা-ই। দেশ হয়ে ওঠে স্বর্গাদপি গরীয়সী।
এই স্বপ্নের জন্য পৃথিবীজোড়া দেশ-বিদেশের অসংখ্য শহরে আজ লাখ লাখ বাঙালি বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাসে দিন কাটায়। অনেক উপস্থিত বাস্তব দুঃখ তাদের এই বিষণ্নতা আর অসহায়তাকে বাড়িয়ে দেয়। চোখের সামনে তারা দেখে, বিদেশে জন্ম নিয়ে বা বেড়ে উঠে তাদের ছেলেমেয়েরা ভিন্ন সংস্কৃতির ভেতর বিচ্ছিন্ন হতে হতে একসময় অচেনা হয়ে যাচ্ছে, তাদের বিজাতীয় ও অশালীন চালচলন মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। নিজেদের দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে কখনো দেশে ফিরে যাওয়ার কথাও তারা হয়তো ভাবে। কিন্তু তত দিনে নিজেদের তৈরি বিধিলিপিই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। আজ দেশে ফিরলেও সন্তানসন্ততির সঙ্গে চিরবিচ্ছিন্নতা, না ফেরা মানেও তাদের হারানো। তারা টের পায় নির্মম অর্থকষ্টের চাবকানি বা বেশি রকম লাভের মোহে দেশ ছাড়ার পর সত্যি সত্যি বড় বেশি দেরি করে ফেলেছে তারা। সে দেশের মাটিতে তাদের শেকড় ছড়িয়ে গেছে। তাদের ছেলেমেয়েদের অস্তিত্ব বা ভবিষ্যত্ও আজ সে দেশের মাটির সঙ্গে নিয়তির মতো বাঁধা।
তাদের এ কথা ভাবতে কষ্ট লাগে যে তাদের সন্তানেরা তাদের মতো বাংলাদেশি নয়। ওই সন্তানদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই দেশে। তাদের দেশ আমেরিকা বা এমনই কোনো দেশ। তাদের বাবাদের যেমন আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের সঙ্গে কোনো আত্মিক যোগ নেই, তাদেরও তেমনি নেই বাংলাদেশের সঙ্গে। সন্তানদের এভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠার কষ্ট বাবা-মায়ের বুকে পেরেকের মতো বেঁধে। মানুষ ভাবতে ভালোবাসে তাদের জৈবিক অস্তিত্বের মতো তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সন্তানদের মধ্য দিয়ে বহমান থাকুক। কিন্তু যখন তারা দেখে, তাদের ছেলেমেয়েরা আলাদা দেশের অপরিচিত মানুষ হয়ে যাচ্ছে, নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরবময় পরিচয়কে পর্যন্ত সম্মান করছে না, তখন তারা এক নিদারুণ একাকিত্বে ভোগে। এ দেশে আসার সময় এই পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। যে সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য একদিন তারা প্রিয় জন্মভূমি, বন্ধু, ভাই, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে অনিশ্চিত বিদেশের পথে পা বাড়িয়েছিল, তাদের উপেক্ষা-তাচ্ছিল্য তাদের ভেতরে ভেতরে কাঁদায়, ভেঙে দেয়।
পৃথিবীর সব দেশেই বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য যে উত্কণ্ঠা, আগ্রহ বা ব্যাকুলতা দেখি, তা দেখে উগ্র জাতীয়তাবাদী না হয়েও আমার মনে হয়েছে মানুষ আর তার জন্মভূমির মধ্যে রয়েছে এক রহস্যময় যোগসূত্র।
৩.
দেশের জন্য এই ব্যাকুলতা প্রবাসীদের মধ্যে যে কতখানি প্রবল, একটা গল্প শুনিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করি। আগেই বলেছি, বিদেশে বাস করা সম্পন্ন বা সচ্ছল বাঙালিদের মধ্যে এই ব্যাকুলতা যতখানি তার চেয়ে এ অনেক বেশি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শ্রমিক শ্রেণীর গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে। সচ্ছল মানুষদের মনকে জন্মভূমির রক্তিম হাতছানি যে কখনো কখনো উতলা করে না তা নয়। কিন্তু গাড়ি-বাড়ি, বিলাস-বৈভবে, ঝলমল করা তাদের জীবনে সে পিছুটান খুব বড় কিছু নয়। তা ছাড়া ইচ্ছা করলেই তো তারা মাঝেমধ্যে দেশে এসে ঘুরে যেতে পারে। তারা তা যায়ও। তাই বিদেশে থাকলেও দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট তাদের অত প্রবল নয়। কিন্তু গরিব প্রবাসীদের ব্যাপারে ঘটনাটা আলাদা। আদম বেপারিদের খপ্পরে পড়ে জমি-বাড়ি বিক্রি বা বন্ধক দিয়ে নামমাত্র রোজগারের আশায় অচেনা দূর বিদেশের পথে পাড়ি জমায় তারা। দূরদেশের নির্মম আবহাওয়া বা ঝলসানো রোদের ভেতর শরীর আয়ু ক্ষয় করে অমানুষিক শ্রমে তাদের জন্য দূর প্রবাস থেকে এরা বছরের পর বছর টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে তার ভাইয়েরা বাজার থেকে চড়াদামে মাছ-মাংস কিনে নবাবী হালে দিন কাটায়, চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে ফূর্তিতে সময় গুজরান করে। ভাইয়ের পাঠানো টাকায় তার জন্য জমি কেনার বদলে অনেক সময় গোপনে তা নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়। তবু এই মানুষগুলো তাদের মুখ স্মরণ করেই হাজারো শৌখিন জিনিসে বড় বড় ব্যাগ-বস্তা ভর্তি করে বাড়ি ফেরে।
এমনই একদল দুঃখী মানুষের সঙ্গে বছর তিনেক আগে দেখা হয়েছিল, দুবাই এয়ারপোর্টে। সেবারও আমেরিকা থেকে ফিরছিলাম। দুবাইয়ে প্লেন পাল্টে ঢাকার প্লেনে উঠছি। বের্ডিং কাউন্টারে গিয়ে দেখি ফ্লাইটে বিদেশি নেই বললেই চলে। কাউন্টারজুড়ে গিজগিজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের নানা জায়গা থেকে জড়ো হওয়া ঘরমুখো বাঙালি শ্রমিকের দল। বুঝলাম, এদের নিয়মিত আনা-নেওয়ার জন্যই এমিরেটস, ইতিহাদ, কাতার বা কুয়েত এয়ারলাইনসের এত ঢাকামুখো ফ্লাইট। এদের কেউ তিন বছর কেউ চার বছর কেউ এমনকি পাঁচ বছর পর দেশে ফিরছে, সবার সঙ্গে বিরাট বিরাট বাক্স-পেঁটরার ভেতর কেনাকাটা করা সাধ্যমতো জিনিসপত্র। প্রিয়জনের জন্য কেনা এই জিনিসগুলো তাদের হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্নে তাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। দেশের জন্য কী ব্যাকুলতা আর স্বপ্ন সবার চোখে। বাঁধভাঙা বন্যার মতো উদ্বেল হূদয় নিয়ে ফ্লাইটের পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়টুকু সহ্য করার শক্তিও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। যেন পারলে দুবাইয়ে প্লেনে উঠেই সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে যায়। কথা বলে বোঝা গেল এদের অধিকাংশই লিখতে-পড়তে পর্যন্ত জানে না। আমার পাশেই বসেছিলেন রীতিমতো স্যুটটাইপরা ডাকসাইটে এক ভদ্রলোক। কিছুক্ষণ আলাপের পরে একগাল বিগলিত হাসির সঙ্গে হাতের ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের কাগজ দুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ভাবলাম, আমার ওগুলো দরকার ভেবেই হয়তো ওগুলো আমাকে দিচ্ছেন। বললাম, আমার আছে, লাগবে না।
‘একটু ফিলাপ কইরা দিবেন স্যার?’ মুখে দাঁত বের করা বিগলিত হাসি। কী আশ্চর্য! এ রকম একজন স্যুটপরা পুরোদস্তুর ডাঁটপাটওয়ালা ভদ্রলোক লিখতে পর্যন্ত জানেন না? কিন্তু না, এমন বাঙালি একজন-দুজন না, হাজারে হাজারে পাবেন মধ্যপ্রাচ্যের মতো পৃথিবীর নানা দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের ভিড়ে।
কথায় কথায় জানলাম, তিনিও একজন শ্রমিক। বাড়ি সিলেটে। রিয়াদে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। প্রথম এসেছিলেন বসরায়, ইরাকে। সেখানে যুদ্ধের তাড়া খেয়ে আরবে পাড়ি জমিয়েছেন।
তার ফরম ফিলাপ শেষ হতেই আরেকটা হাত এগিয়ে এল সামনের দিক থেকে। তারটা শেষ হতেই দেখি চারপাশ থেকে ডজনখানেক হাত আমার দিকে এগিয়ে আছে। সব হাতে একই ফরম। সবাই যে ভদ্রভাবে অনুরোধ করছে তা-ও না। অনুরোধ করার ভাষাও অনেকে জানে না। এ ধরনের দেহাতী মানুষের পক্ষে কী করেই বা তা সম্ভব?
‘এই যে, দেন তো, আমারডা ফিলাপ কইরা দেন।’
মনে হয় হুকুম করছে।
দুঃখী এই লোকগুলোর জন্য মমতায় মনটা ভরে উঠল। প্লেনযাত্রার পুরো সময়টা এদের ফরম ফিলাপ করে চললাম। এদিকে বাংলাদেশ এগিয়ে আসছে। প্লেন ভর্তি লোকগুলোর মধ্যে টানটান উত্তেজনা। কখন আসবে বাংলাদেশ। কেন আসছে না। লোকগুলোর চেহারায় আগ্নেয় উগ্রতা। সবার কথাবার্তার বিষয় একটাই: বাংলাদেশ। ঘরে ফেরার আগ্রহে, আনন্দে, উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়ছে সবাই।
সামনের টিভির পর্দায় প্লেনের ছুটে চলার ছবি চোখে পড়ছে। আরব সাগরের ধার দিয়ে করাচির পাশ কাটিয়ে দিল্লি-কানপুর পেরিয়ে প্লেন এখন বিহারের ওপর। এখনো অন্তত ঘণ্টাখানেক বাকি। যাত্রীরা অস্থির, বেসামাল। উত্তেজনায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোথায় বাংলাদেশ, কোথায় তুমি? মাতৃভূমি, তুমি কত দূর! অধিকাংশ লোকই মানচিত্র চেনে না। বুঝতে পারছে না ঠিক কোনখানে আছে। হঠাত্ জানালার পাশ থেকে কে একজন চিত্কার করে উঠল: ওই যে! ওই যে।
তার ব্যগ্র চিত্কার সারা প্লেনে যেন কেঁপে কেঁপে বেড়াতে লাগল। সবাই যেন মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিল। হঠাত্ প্লেনের ভেতর ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। প্লেন ভর্তি প্রায় সব লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে হুড়মুড় করে জানালার দিকে ঝুঁকে কী যেন আঁতিপাতি করে খুঁজছে। গলায় শুধু একটাই চিত্কার—কই? কই? (কোথায় আমার দেশ—ভাই, সন্তান, জীবনসঙ্গী, বাপ, মা, কোথায় তোমরা?) প্লেন ভর্তি এত লোক পাগলের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে শুধু বাংলাদেশ দেখার চেষ্টা করছে।
হঠাত্ গোটা প্লেন ভর্তি লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলে যে বিমানের বিপদ হতে পারে সে জ্ঞান নেই এই লোকগুলোর। বিমানবালা আর পুরুষ ক্রুরা ধমক দিয়ে, চিত্কার করে পাগলের মতো দুই হাতে টেনেহিঁচড়ে ঘাড় চেপে তাদের বসানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জানালা থেকে তাদের ফেরানো সোজা নয়। প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশ এমনই এক জ্বলন্ত রূপসী। আমাদের কাছে এর কতটুকু?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক, প্রাবন্ধিক। প্রতিষ্ঠাতা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র।
No comments