জাতীয় স্বার্থরক্ষার দায় এবং সরকারের করণীয় -প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ by আকবর আলি খান
টিপাইমুখ প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান দেখে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ মনে পড়ে: ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই যাহা পাই তাহা চাই না।’ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী টিপাইমুখ প্রশ্নে দেশে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে বিরোধটির আন্তর্জাতিকীকরণের পক্ষে। তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলো নিম্নরূপ। প্রথমত, বাংলাদেশে টিপাইমুখবিরোধী দুর্বার আন্দোলন ভারতকে তাদের পূর্বসিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করবে। লংমার্চ, ঘেরাও, ধরনা ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। দ্বিতীয়ত, টিপাইমুখ বাঁধ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ। সুতরাং বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণ করা হলে বাংলাদেশ ন্যায়বিচার পাবে।
দুটি যুক্তিই ত্রুটিপূর্ণ। ভারত সরকার নর্মদা, কাবেরী, তেহরি, টিপাইমুখ ইত্যাদি বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাদের জনগণের আপত্তি গ্রাহ্য করেনি। টিপাইমুখের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি গ্রাহ্য করবে বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় ও টানাপোড়েনে বাংলাদেশ যে লাভবান হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
দ্বিতীয়ত, টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক প্রশ্নে রূপান্তর করা কঠিন হবে। ফারাক্কার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোটেই সফল হয়নি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন অস্পষ্ট ও এসব আইন আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বলবত্ করা সম্ভব নয়। এ ঘরানার রাজনীতিবিদেরা টিপাইমুখকে ফারাক্কার সঙ্গে তুলনা করছেন ও দাবি করছেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। টিপাইমুখ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে পানি আটকিয়ে শুষ্ক মৌসুমে বেশি পানি ছাড়া হবে। কিন্তু ফারাক্কার মতো পানি প্রত্যাহার করা হবে না। ভারত দাবি করবে, বাংলাদেশ যদি কাপ্তাই জলবিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করতে পারে, ভারত কেন একই যুক্তিতে ভারতের অভ্যন্তরে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না? যারা টিপাইমুখকে ফারাক্কার মতো ক্ষতিকর প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচার চালাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের উপকারের চেয়ে বেশি অপকার করছে। কেননা, এই ধরনের বক্তব্যের অসারতা ভারত অতি সহজেই প্রমাণ করতে পারবে। এতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
যেসব রাজনৈতিক দল ভারত-বান্ধব, তারা মনে করেন যে টিপাইমুখে যদি সেচ প্রকল্প না হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভয়ের কারণ নেই। এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। টিপাইমুখ প্রকল্পের মূল সমস্যা হলো ঝুঁকি। এ বিষয়ে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ প্রকল্পে লাখ লাখ মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যেকোনো দেশপ্রেমিক সরকারকে এ বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ ধরনের আলোচনায় বাংলাদেশের বক্তব্যে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
১। ভারতীয় পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র থেকে দেখা যায়, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে প্রকল্পটির নকশা প্রস্তুত করা হয়নি। এখানে ১০০ বছরে সর্বোচ্চ বন্যার পরিবর্তে এক হাজার বছরে সর্বোচ্চ বন্যাকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ১৬ বছরের উপাত্তের পরিবর্তে দীর্ঘ সময়ের উপাত্তের ভিত্তিতে বাঁধের নকশাটি পুনরায় পরীক্ষা করা দরকার। এ জন্য ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে সমীক্ষা পরিচালনা সম্পন্ন করার আগে প্রকল্পটি স্থগিত করা হোক।
২। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য টিপাইমুখ বাঁধের বিকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিকল্প রয়েছে। একটি হলো বাঁধের উচ্চতা ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা। চন্দ্রভাগা নদীতে বাগলিহার জলবিদ্যুত্ প্রকল্প সম্পর্কে পাকিস্তান দুটি বিষয়ে আপত্তি করে। একটি হলো বাঁধের উচ্চতা, অন্যটি জলাধারের ধারণক্ষমতা। বাঁধের উচ্চতা কমানো হলে ও জলাধারের ধারণক্ষমতা হ্রাস করা হলে বাঁধ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে। তবে অন্যদিকে এর জলবিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা কমে যাবে। বাগলিহারে ভারত বাঁধের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট কমাতে রাজি হয়েছে (দেখুন lyer রচিত Towards Water Wisdom, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৫)। দ্বিতীয় ধরনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে আসামের ডিহং নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। এখানে একটি বড় বাঁধ না দিয়ে আশপাশের ছোট ছোট শাখানদীতে ছোট ছোট বাঁধ দিলে কম খরচে একই ধরনের বিদ্যুত্ পাওয়া যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিকল্প প্রস্তাবটি ব্রহ্মপুত্র বোর্ড পরীক্ষা করছে (দেখুন B.G. Vergese, Waters of Hope পৃষ্ঠা-১২৭)। টিপাইমুখের ওপর পার্বত্য অঞ্চলে বরাকের অনেকগুলো শাখানদী রয়েছে। সেসব নদীতে ছোট ছোট বাঁধ দিলে টিপাইমুখ বাঁধের প্রয়োজন হবে না। অন্যথায় বাঁধের বর্তমান নকশা পরিবর্তন করতে হবে, বর্তমান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কোনো উপকার না পেয়েও বাংলাদেশকে একটি বিশাল ঝুঁকি নিতে হবে।
৩। শুধু টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা করলে চলবে না। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদীতে যত বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সবগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যৌথ নদী কমিশনের বিধি-নিয়মের-৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতি তিন মাস অন্তর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হওয়ার বিধান রয়েছে। এখন বছরের পর বছর এ সভা অনুষ্ঠিত হয় না। নিয়মিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক করে প্রতিটি প্রস্তাবিত বাঁধ পরীক্ষা করার সুযোগ বাংলাদেশকে দিতে হবে।
৪। যেসব ক্ষেত্রে জলবিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মতৈক্য হবে, সেখানে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নিতে হবে:
ক) পৃথিবীতে কোনো বাঁধই নিরাপদ নয়, তাই বাঁধ ভেঙে গেলে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতির ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যবস্থা শুধু ভারতে নিলেই চলবে না, বাংলাদেশেও নিতে হবে। বাঁধ অঞ্চলে পানির প্রবাহ সম্পর্কে তথ্য তাত্ক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতির ব্যয় জলবিদ্যুত্ প্রকল্প থেকে বহন করতে হবে।
খ) বাঁধের ফলে বাংলাদেশের জানমালের ও অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি হলে পূর্বনির্ধারিত হারে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে উপদ্রুত অঞ্চলের জনগণের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পের আয়ের ২ শতাংশ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বাইরে প্রকল্প আয়ের ১ শতাংশ দিয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠন করা উচিত, যাতে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায়। বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার ভারতকে করতে হবে।
গ) রাতের অন্ধকারে বাঁধ ভাঙা পানির স্রোতে যাতে মানুষ না ভেসে যায়, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ বন্যার সীমার ঊর্ধ্বে (flood proof) আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ ভারতকে দিতে হবে।
ঘ) বাঁধের জলাধারে যখন প্রথম পানি জমানো হয়, তখন নদীর প্রবাহ একেবারে বন্ধ হওয়ার বা এক-দুই বছরের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাঁধ নির্মাণের আগে নির্মাণের সময় প্রয়োজনীয় জলপ্রবাহ সম্পর্কে বাংলাদেশকে গ্যারান্টি দিতে হবে।
ঙ) বাঁধের ফলে মত্স্য উত্পাদন ক্ষেত্রে ক্ষতি হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশকে প্রকল্প নিতে হবে। ভারতকে এর ব্যয়ভার বহন করতে হবে।
চ) জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে খরচ ভারত সরকারকে দিতে হবে।
ছ) পলিবিহীন পানিপ্রবাহের ফলে যদি বাংলাদেশে নদীভাঙন বেড়ে যায়, তবে নগর ও গ্রাম সংরক্ষণের জন্য প্রকল্পের ব্যয় ভারতকে বহন করতে হবে।
জ) মানবসৃষ্ট বাঁধের ফলে যদি বাংলাদেশের নদীতে চর জেগে ওঠে, তবে সেক্ষেত্রে ড্রেজিংয়ের খরচ ভারতকে দিতে হবে।
ঝ) পলির প্রবাহ হ্রাস পেলে হাওর এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠনের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে বিরূপ প্রভাব হ্রাসের জন্য প্রকল্প নিতে হবে।
ঞ) জলবায়ু পরিবর্তন ও বাঁধ নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলে যেসব সমস্যা দেখা দেবে, সেগুলো সম্পর্কে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন। প্রথমত, অনুমান করা হচ্ছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত বৃষ্টি না হয়ে আকস্মিকভাবে মাঝেমধ্যে নজিরবিহীন অতিবৃষ্টি হবে। এ ধরনের অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা বাঁধের নকশায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাঁধে বনাঞ্চল প্লাবিত হলে গ্রিনহাউস গ্যাসের উদিগরণ বেড়ে যাবে। এ ধরনের অনভিপ্রেত প্রভাব হ্রাস করার জন্য যৌথ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে হবে।
ট) বহুমুখী প্রকল্পে সেচ অন্তর্ভুক্ত হলে অথবা শুধু সেচ প্রকল্পের পানি বণ্টন সম্পর্কে প্রকল্প নির্মাণ হওয়ার আগে সুস্পষ্ট সমঝোতা থাকতে হবে।
টিপাইমুখ প্রশ্নে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো, ভারত খোলা মন নিয়ে এসব বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে রাজি হবে কি? বাংলাদেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভারতের এ ধরনের সমঝোতায় কোনো আগ্রহ নেই এবং ভারতের দেওয়া এবং নেওয়ার মনোবৃত্তিও নেই। এ জন্য বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার দাবি উঠেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না। উপরন্তু বেশির ভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্র নদীর উজানের দেশ (upper riparian), তাদের ভাটির দেশের (lower riparian) সমস্যায় আগ্রহ নেই। কাজেই তাদের নৈতিক সমর্থন আদায় করাও শক্ত হবে। তবু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ও দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যাটির ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নৈতিক সমর্থন সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো (NGO’s) যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী ও উন্নয়ন এনজিওগুলোর সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
তবে মনে রাখতে হবে, ভারত সরকারের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা সম্ভব নয়। শুধু ভারত সরকারের ওপর নির্ভর না করে টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে বাংলাদেশের উচিত হবে সহানুভূতিশীল ভারতীয় জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ করে বাঁধবিরোধী সংগ্রামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত মোর্চা গড়ে তোলা। অন্য কোনো প্রতিকারের উপায় না থাকলে ভারতীয় আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের মামলার সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, ভারত সরকার প্রয়োজনীয় উপাত্ত দিতে অস্বীকার করায় বাংলাদেশে অনেক সমস্যার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভারতের তথ্য স্বাধীনতা আইন (Freedom of Information Act) ব্যবহার করার সম্ভাবনা পরীক্ষা করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃসাধ্য সমস্যা। ভারত তার স্বার্থে নতুন নতুন বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুত্ উত্পাদন করবেই। অথচ এসব বাঁধের বহিঃপ্রভাব (externalities) ও ব্যর্থতার খেসারত ঠেকানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় অংশ সমুদ্রের তলায় হারিয়ে যাবে এবং মনুষ্য বসতির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে ভারতের জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলোর ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লোকালয় ও নগরগুলো মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হবে। এসব প্রবণতার সংশোধন না করা গেলে বাংলাদেশের মাটিতে একুশ শতকে পৃথিবীর করুণতম ট্র্যাজেডি উন্মোচিত হবে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এসব সমস্যার কারিগরি সমাধান রয়েছে। ভারত ইচ্ছে করলে বড় বড় জলবিদ্যুত্ স্থাপন না করে অনেকগুলো ছোট ছোট জলবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করতে পারে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করে মানবসৃষ্ট অবকাঠামোগুলোর ঝুঁকি কমাতে পারে। সমস্যা কারিগরি নয়, সমস্যা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার ও আর্থিক সম্পদের অভাব। রাজনৈতিক সমর্থন গড়ার জন্য বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের মতো প্রকল্পগুলোর সমস্যা ভারতসহ বিশ্বের সব মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশি ও বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা। সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত হলো, বাংলাদেশ সরকারের ঘুম ভাঙাতে হবে। বাংলাদেশ সরকার যদি এসব সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি না করে, তবে কেউই এসব পরিবেশগত সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না। শুধু নবনির্বাচিত সরকার নয়, পূর্ববর্তী সরকারও এ ব্যাপারে যথেষ্ট তত্পর ছিল না। বাংলাদেশের আত্মঘাতী রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপ দেখে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে:
‘কিন্তু ভেবে দেখেছ কি?
দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি।
লাইনে দাঁড়ানো অভ্যাস কর নি কোন দিন
একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর
তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে
বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ।’
(সমাপ্ত)
আকবর আলি খান: গবেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; অর্থ, বন ও পরিবেশ এবং মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
দুটি যুক্তিই ত্রুটিপূর্ণ। ভারত সরকার নর্মদা, কাবেরী, তেহরি, টিপাইমুখ ইত্যাদি বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে তাদের জনগণের আপত্তি গ্রাহ্য করেনি। টিপাইমুখের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি গ্রাহ্য করবে বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় ও টানাপোড়েনে বাংলাদেশ যে লাভবান হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
দ্বিতীয়ত, টিপাইমুখ বাঁধের প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক প্রশ্নে রূপান্তর করা কঠিন হবে। ফারাক্কার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মোটেই সফল হয়নি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন অস্পষ্ট ও এসব আইন আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বলবত্ করা সম্ভব নয়। এ ঘরানার রাজনীতিবিদেরা টিপাইমুখকে ফারাক্কার সঙ্গে তুলনা করছেন ও দাবি করছেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাবে। টিপাইমুখ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে পানি আটকিয়ে শুষ্ক মৌসুমে বেশি পানি ছাড়া হবে। কিন্তু ফারাক্কার মতো পানি প্রত্যাহার করা হবে না। ভারত দাবি করবে, বাংলাদেশ যদি কাপ্তাই জলবিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করতে পারে, ভারত কেন একই যুক্তিতে ভারতের অভ্যন্তরে জলবিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না? যারা টিপাইমুখকে ফারাক্কার মতো ক্ষতিকর প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে প্রচার চালাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের উপকারের চেয়ে বেশি অপকার করছে। কেননা, এই ধরনের বক্তব্যের অসারতা ভারত অতি সহজেই প্রমাণ করতে পারবে। এতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
যেসব রাজনৈতিক দল ভারত-বান্ধব, তারা মনে করেন যে টিপাইমুখে যদি সেচ প্রকল্প না হয়, তাহলে বাংলাদেশের ভয়ের কারণ নেই। এ ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। টিপাইমুখ প্রকল্পের মূল সমস্যা হলো ঝুঁকি। এ বিষয়ে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ প্রকল্পে লাখ লাখ মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যেকোনো দেশপ্রেমিক সরকারকে এ বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ ধরনের আলোচনায় বাংলাদেশের বক্তব্যে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
১। ভারতীয় পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র থেকে দেখা যায়, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে প্রকল্পটির নকশা প্রস্তুত করা হয়নি। এখানে ১০০ বছরে সর্বোচ্চ বন্যার পরিবর্তে এক হাজার বছরে সর্বোচ্চ বন্যাকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ১৬ বছরের উপাত্তের পরিবর্তে দীর্ঘ সময়ের উপাত্তের ভিত্তিতে বাঁধের নকশাটি পুনরায় পরীক্ষা করা দরকার। এ জন্য ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে সমীক্ষা পরিচালনা সম্পন্ন করার আগে প্রকল্পটি স্থগিত করা হোক।
২। ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য টিপাইমুখ বাঁধের বিকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিকল্প রয়েছে। একটি হলো বাঁধের উচ্চতা ও জলবিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা। চন্দ্রভাগা নদীতে বাগলিহার জলবিদ্যুত্ প্রকল্প সম্পর্কে পাকিস্তান দুটি বিষয়ে আপত্তি করে। একটি হলো বাঁধের উচ্চতা, অন্যটি জলাধারের ধারণক্ষমতা। বাঁধের উচ্চতা কমানো হলে ও জলাধারের ধারণক্ষমতা হ্রাস করা হলে বাঁধ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে। তবে অন্যদিকে এর জলবিদ্যুত্ উত্পাদনক্ষমতা কমে যাবে। বাগলিহারে ভারত বাঁধের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট কমাতে রাজি হয়েছে (দেখুন lyer রচিত Towards Water Wisdom, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৫)। দ্বিতীয় ধরনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে আসামের ডিহং নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুত্ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। এখানে একটি বড় বাঁধ না দিয়ে আশপাশের ছোট ছোট শাখানদীতে ছোট ছোট বাঁধ দিলে কম খরচে একই ধরনের বিদ্যুত্ পাওয়া যাবে বলে দাবি করা হচ্ছে। বিকল্প প্রস্তাবটি ব্রহ্মপুত্র বোর্ড পরীক্ষা করছে (দেখুন B.G. Vergese, Waters of Hope পৃষ্ঠা-১২৭)। টিপাইমুখের ওপর পার্বত্য অঞ্চলে বরাকের অনেকগুলো শাখানদী রয়েছে। সেসব নদীতে ছোট ছোট বাঁধ দিলে টিপাইমুখ বাঁধের প্রয়োজন হবে না। অন্যথায় বাঁধের বর্তমান নকশা পরিবর্তন করতে হবে, বর্তমান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কোনো উপকার না পেয়েও বাংলাদেশকে একটি বিশাল ঝুঁকি নিতে হবে।
৩। শুধু টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা করলে চলবে না। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদীতে যত বাঁধের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সবগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যৌথ নদী কমিশনের বিধি-নিয়মের-৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতি তিন মাস অন্তর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হওয়ার বিধান রয়েছে। এখন বছরের পর বছর এ সভা অনুষ্ঠিত হয় না। নিয়মিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক করে প্রতিটি প্রস্তাবিত বাঁধ পরীক্ষা করার সুযোগ বাংলাদেশকে দিতে হবে।
৪। যেসব ক্ষেত্রে জলবিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মতৈক্য হবে, সেখানে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নিতে হবে:
ক) পৃথিবীতে কোনো বাঁধই নিরাপদ নয়, তাই বাঁধ ভেঙে গেলে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতির ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যবস্থা শুধু ভারতে নিলেই চলবে না, বাংলাদেশেও নিতে হবে। বাঁধ অঞ্চলে পানির প্রবাহ সম্পর্কে তথ্য তাত্ক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতির ব্যয় জলবিদ্যুত্ প্রকল্প থেকে বহন করতে হবে।
খ) বাঁধের ফলে বাংলাদেশের জানমালের ও অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি হলে পূর্বনির্ধারিত হারে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে উপদ্রুত অঞ্চলের জনগণের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পের আয়ের ২ শতাংশ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বাইরে প্রকল্প আয়ের ১ শতাংশ দিয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তহবিল গঠন করা উচিত, যাতে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায়। বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার ভারতকে করতে হবে।
গ) রাতের অন্ধকারে বাঁধ ভাঙা পানির স্রোতে যাতে মানুষ না ভেসে যায়, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ বন্যার সীমার ঊর্ধ্বে (flood proof) আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ ভারতকে দিতে হবে।
ঘ) বাঁধের জলাধারে যখন প্রথম পানি জমানো হয়, তখন নদীর প্রবাহ একেবারে বন্ধ হওয়ার বা এক-দুই বছরের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাঁধ নির্মাণের আগে নির্মাণের সময় প্রয়োজনীয় জলপ্রবাহ সম্পর্কে বাংলাদেশকে গ্যারান্টি দিতে হবে।
ঙ) বাঁধের ফলে মত্স্য উত্পাদন ক্ষেত্রে ক্ষতি হ্রাস করার জন্য বাংলাদেশকে প্রকল্প নিতে হবে। ভারতকে এর ব্যয়ভার বহন করতে হবে।
চ) জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে খরচ ভারত সরকারকে দিতে হবে।
ছ) পলিবিহীন পানিপ্রবাহের ফলে যদি বাংলাদেশে নদীভাঙন বেড়ে যায়, তবে নগর ও গ্রাম সংরক্ষণের জন্য প্রকল্পের ব্যয় ভারতকে বহন করতে হবে।
জ) মানবসৃষ্ট বাঁধের ফলে যদি বাংলাদেশের নদীতে চর জেগে ওঠে, তবে সেক্ষেত্রে ড্রেজিংয়ের খরচ ভারতকে দিতে হবে।
ঝ) পলির প্রবাহ হ্রাস পেলে হাওর এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠনের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে বিরূপ প্রভাব হ্রাসের জন্য প্রকল্প নিতে হবে।
ঞ) জলবায়ু পরিবর্তন ও বাঁধ নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলে যেসব সমস্যা দেখা দেবে, সেগুলো সম্পর্কে যৌথ গবেষণা প্রয়োজন। প্রথমত, অনুমান করা হচ্ছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত বৃষ্টি না হয়ে আকস্মিকভাবে মাঝেমধ্যে নজিরবিহীন অতিবৃষ্টি হবে। এ ধরনের অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা বাঁধের নকশায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাঁধে বনাঞ্চল প্লাবিত হলে গ্রিনহাউস গ্যাসের উদিগরণ বেড়ে যাবে। এ ধরনের অনভিপ্রেত প্রভাব হ্রাস করার জন্য যৌথ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে হবে।
ট) বহুমুখী প্রকল্পে সেচ অন্তর্ভুক্ত হলে অথবা শুধু সেচ প্রকল্পের পানি বণ্টন সম্পর্কে প্রকল্প নির্মাণ হওয়ার আগে সুস্পষ্ট সমঝোতা থাকতে হবে।
টিপাইমুখ প্রশ্নে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো, ভারত খোলা মন নিয়ে এসব বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে রাজি হবে কি? বাংলাদেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভারতের এ ধরনের সমঝোতায় কোনো আগ্রহ নেই এবং ভারতের দেওয়া এবং নেওয়ার মনোবৃত্তিও নেই। এ জন্য বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার দাবি উঠেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে না। উপরন্তু বেশির ভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্র নদীর উজানের দেশ (upper riparian), তাদের ভাটির দেশের (lower riparian) সমস্যায় আগ্রহ নেই। কাজেই তাদের নৈতিক সমর্থন আদায় করাও শক্ত হবে। তবু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ও দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যাটির ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নৈতিক সমর্থন সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো (NGO’s) যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী ও উন্নয়ন এনজিওগুলোর সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
তবে মনে রাখতে হবে, ভারত সরকারের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা সম্ভব নয়। শুধু ভারত সরকারের ওপর নির্ভর না করে টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে বাংলাদেশের উচিত হবে সহানুভূতিশীল ভারতীয় জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ করে বাঁধবিরোধী সংগ্রামী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত মোর্চা গড়ে তোলা। অন্য কোনো প্রতিকারের উপায় না থাকলে ভারতীয় আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশিদের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের মামলার সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, ভারত সরকার প্রয়োজনীয় উপাত্ত দিতে অস্বীকার করায় বাংলাদেশে অনেক সমস্যার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ভারতের তথ্য স্বাধীনতা আইন (Freedom of Information Act) ব্যবহার করার সম্ভাবনা পরীক্ষা করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য একটি দুঃসাধ্য সমস্যা। ভারত তার স্বার্থে নতুন নতুন বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুত্ উত্পাদন করবেই। অথচ এসব বাঁধের বহিঃপ্রভাব (externalities) ও ব্যর্থতার খেসারত ঠেকানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বড় অংশ সমুদ্রের তলায় হারিয়ে যাবে এবং মনুষ্য বসতির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে ভারতের জলবিদ্যুত্ প্রকল্পগুলোর ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লোকালয় ও নগরগুলো মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হবে। এসব প্রবণতার সংশোধন না করা গেলে বাংলাদেশের মাটিতে একুশ শতকে পৃথিবীর করুণতম ট্র্যাজেডি উন্মোচিত হবে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এসব সমস্যার কারিগরি সমাধান রয়েছে। ভারত ইচ্ছে করলে বড় বড় জলবিদ্যুত্ স্থাপন না করে অনেকগুলো ছোট ছোট জলবিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করতে পারে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করে মানবসৃষ্ট অবকাঠামোগুলোর ঝুঁকি কমাতে পারে। সমস্যা কারিগরি নয়, সমস্যা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার ও আর্থিক সম্পদের অভাব। রাজনৈতিক সমর্থন গড়ার জন্য বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের মতো প্রকল্পগুলোর সমস্যা ভারতসহ বিশ্বের সব মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশি ও বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা। সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত হলো, বাংলাদেশ সরকারের ঘুম ভাঙাতে হবে। বাংলাদেশ সরকার যদি এসব সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি না করে, তবে কেউই এসব পরিবেশগত সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না। শুধু নবনির্বাচিত সরকার নয়, পূর্ববর্তী সরকারও এ ব্যাপারে যথেষ্ট তত্পর ছিল না। বাংলাদেশের আত্মঘাতী রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপ দেখে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে:
‘কিন্তু ভেবে দেখেছ কি?
দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি।
লাইনে দাঁড়ানো অভ্যাস কর নি কোন দিন
একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর
তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে
বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ।’
(সমাপ্ত)
আকবর আলি খান: গবেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; অর্থ, বন ও পরিবেশ এবং মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব। এ ছাড়া পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
No comments