দুটি মৃত্যু, একটি গোলটেবিল -কেডেনি ও অন্যান্য by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
ইংরেজি হাইওয়ে (highway) শব্দটির কোনো জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি হয়নি। প্রধান রাজপথ, মহাসড়ক, সংসরণ—কোনোটাই আমাদের নিত্যদিনের কথায়, লেখায় ব্যবহূত নয়; ইংরেজি হাইওয়ে যেভাবে হয়ে আসছে। যা হোক, হাইওয়ে বা মহাসড়ক একটি মূল্যবান প্রাণ হরণ করেছে। আমি সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিক সাইফুর রহমানের মৃত্যুর কথা বলছি। দুর্ঘটনার যে বিবরণ কাগজে এসেছে, তাতে মহাসড়ক কতটা দায়ী, আর সাবেক মন্ত্রীর বাহন কতটা দায়ী বা বাহনের চালক কতটা দায়ী, সেটা নির্ণীত হয়নি। একটা তদন্ত হচ্ছে বা হবে, তখন হয়তো জানা যাবে। ইতিমধ্যে সাইফুর রহমানের মৃত্যু সব মহল থেকে যে শোকবার্তা বয়ে এনেছে সেটা চোখে পড়ার মতো, মনে ধরার মতো।
দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন সাইফুর রহমান, সেটা স্থায়িত্বের দিক দিয়ে যেমন অতুলনীয়, গুরুত্বের দিক দিয়েও সমান গুরুত্বের দাবিদার—বেশ বোঝা যায়। এই দায়িত্ব পালনে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন যেমন, তেমনি যোগ্যতারও পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির বুনিয়াদ তিনিই তৈরি করে দিয়েছেন, এমন কথাও বলেছেন অনেকে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সঙ্গে তিনি যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ছিল পুরোদস্তুর দ্বান্দ্বিক। ওরা ওদের কথা বলেছে, তিনি তাঁর কথা বলেছেন; এবং শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় পৌঁছেছেন, যেখানে সাধ্যমতো তিনি দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এই হচ্ছে সাধারণ ধারণা। দাতাপক্ষের চাপের কাছে তিনি সহজে নতি স্বীকার করেননি। যখন করেছেন, যেমন আদমজী জুট মিল বন্ধ করার বেলায়, সেখানে আর কোনো বিকল্প ছিল কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শেষ কথা, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেষ হবে না। বিএনপির দুই মেয়াদে শাসনকালে, সরকারের একটি প্রধান স্তম্ভ ছিলেন তিনি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একটি দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছেন। এ জন্য দল তাঁর অভাব অনুভব করবে সামনের দিনগুলোতে। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করা সহজ হবে না।
নিজের জেলা মৌলভীবাজার ও বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নে তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ। সে জন্য দলমতনির্বিশেষে সিলেটবাসী তাঁর প্রয়াণে শোকাভিভূত হয়েছে। জীবিতকালে তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রমে যত সমালোচনা হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর আকস্মিকতায় সব মূক হয়ে গেছে। কথায় আছে, তাঁতির হাতে রং লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাবান রাজনীতিকের নামে যত নিন্দা, তা এই তাঁতির হাতে রং লাগার অনিবার্যতার কথা মনে করায়।
সব দোষগুণ নিয়ে সাইফুর রহমান ছিলেন একজন বর্ণাঢ্য মানুষ। তাঁর স্পষ্টবাদিতা, তাঁর নিজস্ব কৌতুক পরায়ণতা, দলের হয়েও নিজের মাথা উঁচু করে চলার ক্ষমতা তাঁকে তাঁর বিশিষ্টতা দিয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও সেটা মানতে বাধ্য হয়েছে; এবং তাঁর মৃত্যুতে সাধারণ শোকে, সাধারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে, সাধারণ সম্মানদানে শরিক হয়েছে। আমাদের সমাজে এ দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্প্রতি আরও একটি মৃত্যু একটা শূন্যতা রেখে গেল। বাংলাদেশে নয়, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে। এডওয়ার্ড কেনেডি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—কীভাবে একজন রাজনীতিক একটি দলের হয়েও সবার শ্রদ্ধেয় হয়ে যান। তাঁর জ্যেষ্ঠ দুই ভাইয়ের একজন—জন এফ কেনেডি—রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে (১৯৬৩), আরেক ভাই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রাক্কালে আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। কেনেডি পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এমনই মজবুত ছিল ওই সময়ে যে এরপর এডওয়ার্ড কেনেডিরও ডেমোক্রেটিক পার্টির টিকিটে প্রেসিডেন্ট হওয়া ছিল এক সাধারণ প্রত্যাশা। ব্যক্তিগত কারণে সে প্রত্যাশা পূরণের পথে তিনি যাননি। না গেলেও দেশের রাজনীতিতে, একজন সিনেটর হিসেবে তিনি এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিতদের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের স্বার্থরক্ষায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। এ কাজে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন তিনি জানতেন, আর সংলাপের মাধ্যমে ওদের বিরোধিতাকে জয় করে, ওদের সমর্থন আদায় করে তিনি তাঁর উদ্যোগের সফলতা নিশ্চিত করেছেন। এটা তাঁর বিশেষ ক্ষমতা, বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ গণতন্ত্রের এক মূল শর্ত। সংবিধানে সেই ব্যবস্থাই থাকে। কিন্তু অপরিণত গণতন্ত্র—এবং বাংলাদেশে যা হয়েছে, প্রকটভাবে সক্রিয় দলতন্ত্র গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ আগলে রেখেছে—এই সংলাপের সুস্থ ধারা বাধাগ্রস্ত। যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত, সেখানে রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে, এক জায়গায় দাঁড়ানো যে কতটা জরুরি, এ দেশে আমরা এখনো সেটা বুঝিনি। এডওয়ার্ড কেনেডি দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থে, দলীয় বিভাজন অস্বীকার করে কীভাবে বিপক্ষের সহায়তা নিয়ে কাজ করা সম্ভব। তাঁর মৃত্যুর পর যে শোক প্রকাশ করা হয়েছে, সেটা জাতীয়ভাবেই হয়েছে, দলীয়ভাবে নয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের চরম দুঃসময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, তখন মহত্ প্রাণের মানুষ এডওয়ার্ড কেনেডি, রাষ্ট্রীয় নীতি উপেক্ষা করে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। একথা কৃতজ্ঞ বাঙালি কোনো দিন ভুলবে না।
বাহাত্তরের এক শীতের সকালে এডওয়ার্ড কেনেডিকে আমরা পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাঙ্গণে। কী কারণে আমি ভুলে গেছি, আমিও উপস্থিত ছিলাম সেদিন ঘটনাস্থলে। এডওয়ার্ড কেনেডিকে ঘিরে ভিড় জমিয়েছিল ছাত্ররা। আমি বরাবর ভিড়কে ভয় করেছি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কলাভবন প্রাঙ্গণের যে বটগাছটি পাকিস্তানি বাহিনী ভূমিসাত্ করেছিল, ঠিক সেই জায়গাটিতেই তিনি দাঁড়িয়ে। বোধহয় তখনই সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, ঠিক ওই জায়গায় তিনি একটি বটের চারা রোপণ করবেন। তা-ই করেছিলেন তিনি। সেই চারাটি এত দিনে বড় হয়েছে; ও কেনেডির কথা বলছে।
কেনেডি প্রেসিডেন্ট হননি, কিন্তু মৃত্যুর পর যে সম্মান তিনি পেলেন সব পক্ষের, সব মতের মানুষের, সে প্রশংসা কয়জন প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন তাঁদের মৃত্যুর পর? মহত্ত্বের কোন চূড়ায় পৌঁছালে একজন মানুষ সবার বরণীয় মানুষে পরিণত হন? বাংলাদেশ কীভাবে, কৃতজ্ঞতার চেয়েও যা বড়, সম্মান জানাতে পারে এই দুর্দিনের বন্ধুকে? চলমান সংসদীয় অধিবেশনে শোক প্রকাশের তালিকায় সাইফুর রহমান কি ছিলেন? আশা করি সংসদ ভুল করেনি। তার পরও বোধহয় কিছু করার থাকে। আশা করি সংসদ এটা বিবেচনা করবে।
শিক্ষা সংস্কার কমিটি মন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছে তাদের খসড়া প্রতিবেদন। কাজটি বেশ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে কমিটি। এ ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম করল এ কমিটি, কারণ অতীতে দেখা গেছে, বারবার অতিরিক্ত সময় প্রার্থনাই এ দেশে কমিটিগুলোর রীতি। এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৃতিত্ব মন্ত্রীকেও দিতে হয়। তাঁর চাহিদার জোর ছিল, তাই কমিটিও সেভাবে সাড়া দিয়েছে। এরপর, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর, কালবিলম্ব না করে মন্ত্রী তাঁর হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেদনের ব্যাপক প্রচারের ও মতামত সংগ্রহের ওপর জোর দিয়েছেন।
প্রতিবেদনের মূল সুপারিশগুলোর ওপর ভিত্তি করে যে গোলটেবিল করেছে সমকাল, সেখানে উপস্থিত হয়ে একটি লাভ হয়েছে আমার—আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত উচ্চ পদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ পেয়েছি। এঁরা চালু ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। জুতো যার পায়ে, সে-ই জানে কোথায় খোঁচাটা বিঁধছে। মন্ত্রী মহোদয় নিজে প্রধান অতিথি ছিলেন, তিনিও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কোথায় গলদ এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে।
যেটা লক্ষ করে আমি খুশি তা হলো, শিক্ষার মানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছে। মান এমন একটা বিষয়, যার তল খুঁঁজে পাওয়া যায় না। কীভাবে মান অর্জিত হয়, কীভাবে সেটা আঙুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যায়, কীভাবে তাকে পুনরুদ্ধার করা যায়—এ নিয়ে আজও এ দেশে কোনো গভীর পর্যালোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ জন্য প্রয়োজন একটা সত্যিকার মগজ-ঝাঁকানো—ব্রেইন স্টর্মি—বৈঠক। তেমন একটা বৈঠক যদি হয়, আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করব।
আরও একটি বিষয় রীতিমতো গুরুত্ব পেয়েছে ওই গোলটেবিলে, সেটা হলো শিক্ষার জন্য অর্থায়ন। শিক্ষায় বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি লাভজনক—কথাটা একেবারে নতুন নয়। প্রত্যাশিত মানসম্মত শিক্ষা যদি পেতে হয়, তাহলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে, এমনকি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর তুলনায়ও।
বিস্তারিত প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। একটা অত্যন্ত কঠিন কাজের সূত্রপাত হয়েছে মাত্র—শিক্ষা সংস্কার। তবে সূচনা যেভাবে হয়েছে, তা আশাব্যঞ্জক। আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন সাইফুর রহমান, সেটা স্থায়িত্বের দিক দিয়ে যেমন অতুলনীয়, গুরুত্বের দিক দিয়েও সমান গুরুত্বের দাবিদার—বেশ বোঝা যায়। এই দায়িত্ব পালনে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন যেমন, তেমনি যোগ্যতারও পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির বুনিয়াদ তিনিই তৈরি করে দিয়েছেন, এমন কথাও বলেছেন অনেকে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সঙ্গে তিনি যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ছিল পুরোদস্তুর দ্বান্দ্বিক। ওরা ওদের কথা বলেছে, তিনি তাঁর কথা বলেছেন; এবং শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় পৌঁছেছেন, যেখানে সাধ্যমতো তিনি দেশের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এই হচ্ছে সাধারণ ধারণা। দাতাপক্ষের চাপের কাছে তিনি সহজে নতি স্বীকার করেননি। যখন করেছেন, যেমন আদমজী জুট মিল বন্ধ করার বেলায়, সেখানে আর কোনো বিকল্প ছিল কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শেষ কথা, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেষ হবে না। বিএনপির দুই মেয়াদে শাসনকালে, সরকারের একটি প্রধান স্তম্ভ ছিলেন তিনি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একটি দৃঢ় ভূমিকা পালন করেছেন। এ জন্য দল তাঁর অভাব অনুভব করবে সামনের দিনগুলোতে। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করা সহজ হবে না।
নিজের জেলা মৌলভীবাজার ও বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নে তাঁর ছিল বিশেষ আগ্রহ। সে জন্য দলমতনির্বিশেষে সিলেটবাসী তাঁর প্রয়াণে শোকাভিভূত হয়েছে। জীবিতকালে তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রমে যত সমালোচনা হয়েছে, তাঁর মৃত্যুর আকস্মিকতায় সব মূক হয়ে গেছে। কথায় আছে, তাঁতির হাতে রং লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাবান রাজনীতিকের নামে যত নিন্দা, তা এই তাঁতির হাতে রং লাগার অনিবার্যতার কথা মনে করায়।
সব দোষগুণ নিয়ে সাইফুর রহমান ছিলেন একজন বর্ণাঢ্য মানুষ। তাঁর স্পষ্টবাদিতা, তাঁর নিজস্ব কৌতুক পরায়ণতা, দলের হয়েও নিজের মাথা উঁচু করে চলার ক্ষমতা তাঁকে তাঁর বিশিষ্টতা দিয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও সেটা মানতে বাধ্য হয়েছে; এবং তাঁর মৃত্যুতে সাধারণ শোকে, সাধারণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশে, সাধারণ সম্মানদানে শরিক হয়েছে। আমাদের সমাজে এ দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্প্রতি আরও একটি মৃত্যু একটা শূন্যতা রেখে গেল। বাংলাদেশে নয়, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে। এডওয়ার্ড কেনেডি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—কীভাবে একজন রাজনীতিক একটি দলের হয়েও সবার শ্রদ্ধেয় হয়ে যান। তাঁর জ্যেষ্ঠ দুই ভাইয়ের একজন—জন এফ কেনেডি—রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে (১৯৬৩), আরেক ভাই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রাক্কালে আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। কেনেডি পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এমনই মজবুত ছিল ওই সময়ে যে এরপর এডওয়ার্ড কেনেডিরও ডেমোক্রেটিক পার্টির টিকিটে প্রেসিডেন্ট হওয়া ছিল এক সাধারণ প্রত্যাশা। ব্যক্তিগত কারণে সে প্রত্যাশা পূরণের পথে তিনি যাননি। না গেলেও দেশের রাজনীতিতে, একজন সিনেটর হিসেবে তিনি এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিতদের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের স্বার্থরক্ষায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। এ কাজে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন তিনি জানতেন, আর সংলাপের মাধ্যমে ওদের বিরোধিতাকে জয় করে, ওদের সমর্থন আদায় করে তিনি তাঁর উদ্যোগের সফলতা নিশ্চিত করেছেন। এটা তাঁর বিশেষ ক্ষমতা, বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ গণতন্ত্রের এক মূল শর্ত। সংবিধানে সেই ব্যবস্থাই থাকে। কিন্তু অপরিণত গণতন্ত্র—এবং বাংলাদেশে যা হয়েছে, প্রকটভাবে সক্রিয় দলতন্ত্র গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ আগলে রেখেছে—এই সংলাপের সুস্থ ধারা বাধাগ্রস্ত। যেখানে জাতীয় স্বার্থ জড়িত, সেখানে রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে গিয়ে, এক জায়গায় দাঁড়ানো যে কতটা জরুরি, এ দেশে আমরা এখনো সেটা বুঝিনি। এডওয়ার্ড কেনেডি দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থে, দলীয় বিভাজন অস্বীকার করে কীভাবে বিপক্ষের সহায়তা নিয়ে কাজ করা সম্ভব। তাঁর মৃত্যুর পর যে শোক প্রকাশ করা হয়েছে, সেটা জাতীয়ভাবেই হয়েছে, দলীয়ভাবে নয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের চরম দুঃসময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, তখন মহত্ প্রাণের মানুষ এডওয়ার্ড কেনেডি, রাষ্ট্রীয় নীতি উপেক্ষা করে মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। একথা কৃতজ্ঞ বাঙালি কোনো দিন ভুলবে না।
বাহাত্তরের এক শীতের সকালে এডওয়ার্ড কেনেডিকে আমরা পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাঙ্গণে। কী কারণে আমি ভুলে গেছি, আমিও উপস্থিত ছিলাম সেদিন ঘটনাস্থলে। এডওয়ার্ড কেনেডিকে ঘিরে ভিড় জমিয়েছিল ছাত্ররা। আমি বরাবর ভিড়কে ভয় করেছি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কলাভবন প্রাঙ্গণের যে বটগাছটি পাকিস্তানি বাহিনী ভূমিসাত্ করেছিল, ঠিক সেই জায়গাটিতেই তিনি দাঁড়িয়ে। বোধহয় তখনই সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, ঠিক ওই জায়গায় তিনি একটি বটের চারা রোপণ করবেন। তা-ই করেছিলেন তিনি। সেই চারাটি এত দিনে বড় হয়েছে; ও কেনেডির কথা বলছে।
কেনেডি প্রেসিডেন্ট হননি, কিন্তু মৃত্যুর পর যে সম্মান তিনি পেলেন সব পক্ষের, সব মতের মানুষের, সে প্রশংসা কয়জন প্রেসিডেন্ট পেয়েছেন তাঁদের মৃত্যুর পর? মহত্ত্বের কোন চূড়ায় পৌঁছালে একজন মানুষ সবার বরণীয় মানুষে পরিণত হন? বাংলাদেশ কীভাবে, কৃতজ্ঞতার চেয়েও যা বড়, সম্মান জানাতে পারে এই দুর্দিনের বন্ধুকে? চলমান সংসদীয় অধিবেশনে শোক প্রকাশের তালিকায় সাইফুর রহমান কি ছিলেন? আশা করি সংসদ ভুল করেনি। তার পরও বোধহয় কিছু করার থাকে। আশা করি সংসদ এটা বিবেচনা করবে।
শিক্ষা সংস্কার কমিটি মন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছে তাদের খসড়া প্রতিবেদন। কাজটি বেশ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে কমিটি। এ ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম করল এ কমিটি, কারণ অতীতে দেখা গেছে, বারবার অতিরিক্ত সময় প্রার্থনাই এ দেশে কমিটিগুলোর রীতি। এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৃতিত্ব মন্ত্রীকেও দিতে হয়। তাঁর চাহিদার জোর ছিল, তাই কমিটিও সেভাবে সাড়া দিয়েছে। এরপর, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর, কালবিলম্ব না করে মন্ত্রী তাঁর হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেদনের ব্যাপক প্রচারের ও মতামত সংগ্রহের ওপর জোর দিয়েছেন।
প্রতিবেদনের মূল সুপারিশগুলোর ওপর ভিত্তি করে যে গোলটেবিল করেছে সমকাল, সেখানে উপস্থিত হয়ে একটি লাভ হয়েছে আমার—আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত উচ্চ পদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ পেয়েছি। এঁরা চালু ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। জুতো যার পায়ে, সে-ই জানে কোথায় খোঁচাটা বিঁধছে। মন্ত্রী মহোদয় নিজে প্রধান অতিথি ছিলেন, তিনিও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কোথায় গলদ এবং কী পরিমাণ দুর্নীতি এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে।
যেটা লক্ষ করে আমি খুশি তা হলো, শিক্ষার মানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছে। মান এমন একটা বিষয়, যার তল খুঁঁজে পাওয়া যায় না। কীভাবে মান অর্জিত হয়, কীভাবে সেটা আঙুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যায়, কীভাবে তাকে পুনরুদ্ধার করা যায়—এ নিয়ে আজও এ দেশে কোনো গভীর পর্যালোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ জন্য প্রয়োজন একটা সত্যিকার মগজ-ঝাঁকানো—ব্রেইন স্টর্মি—বৈঠক। তেমন একটা বৈঠক যদি হয়, আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করব।
আরও একটি বিষয় রীতিমতো গুরুত্ব পেয়েছে ওই গোলটেবিলে, সেটা হলো শিক্ষার জন্য অর্থায়ন। শিক্ষায় বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি লাভজনক—কথাটা একেবারে নতুন নয়। প্রত্যাশিত মানসম্মত শিক্ষা যদি পেতে হয়, তাহলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে, এমনকি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর তুলনায়ও।
বিস্তারিত প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। একটা অত্যন্ত কঠিন কাজের সূত্রপাত হয়েছে মাত্র—শিক্ষা সংস্কার। তবে সূচনা যেভাবে হয়েছে, তা আশাব্যঞ্জক। আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments