সেনা স্থানান্তর ও পাহাড়ে শান্তির খোঁজ by ফিরোজ জামান চৌধুরী
সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে ‘সেনা প্রত্যাহার’ বা ‘সেনা স্থানান্তর’ নিয়ে আলোচনা আর বির্তকের শেষ নেই। অনেকেরই আশঙ্কা, সেনা প্রত্যাহার হলে পার্বত্যাঞ্চলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে, ওখানে আর কেউ বাস করতে পারবে না। আবার অনেকে ভাবছে, সেনা ছাউনি সরিয়ে নিলেই তবে সেখানকার নাগরিকেরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে খতিয়ে দেখা যাক পার্বত্যাঞ্চলে সেনা-সংস্কৃতির ভালো-মন্দ এবং রাষ্ট্রের মনোজগতে এর অবস্থান।
সরকারি সূত্র দাবি করছে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর থেকে অদ্যাবধি প্রায় ৩০০ সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং এ বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩৫টি সেনাক্যাম্পসহ একটি ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ক্যাম্প স্থানান্তর করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য লক্ষ করার মতো। ১৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শামীম চৌধুরী বলেছেন, ‘১৯৯৮ সালে ১০টি ক্যাম্প সরানোর মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয় এবং ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ ৬৩টি ক্যাম্প সরানো হয়েছে। এ বছর ৩৫টি ক্যাম্প সরানো হচ্ছে।’ (প্রথম আলো ২০ আগস্ট)।
এখানে ‘২০০৪ সাল’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওই সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এ যাবত্ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যত সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৬৩টি) সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০০৪ সালে—বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে। তাহলে এখন বিএনপি কেন এই ইস্যুতে ভিন্নমত পোষন করছে? বিএনপির অনেক নেতা তো এর ফলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের কাছে প্রশ্ন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যখন সেনা প্রত্যাহার করেছিল, তখন কি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল? যদি না পড়ে থাকে, তাহলে এখন কেন সে প্রসঙ্গ আসছে?
পার্বত্যবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় দুই দশক (১৯৭৭—১৯৯৭) ধরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির (যা ‘শান্তিচুক্তি’ নামে অধিক পরিচিত) পর থেকে তিন পার্বত্য জেলাতেই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের অন্য অঞ্চলের মতো ওখানেও কিছু বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির পর কোনো ব্যক্তি বা বিবাদমান কোনো পক্ষ, রাজনৈতিক দল বা সংস্থা একবারের জন্যও বলেনি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধাবস্থা চলছে। তাহলে কেন সেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘কৃত্রিম যুদ্ধাপরিস্থিতি’ বজায় রাখা হবে?
বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাসহ সারা দেশে অসংখ্য হামলা বা জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভয়াবহ ওই সব ঘটনার পর কোথাও সেনা শাসন জারির প্রয়োজন পড়েনি। সিভিল প্রশাসনই সব পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। যশোর, খুলনা, নওগাঁসহ দেশের অনেক অঞ্চলে সর্বহারা কর্তৃক অপহরণের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু কই, সেখানে তো সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন পড়ে না। পার্বত্যাঞ্চলে ছোটখাটো চাঁদাবাজি বা বিচ্ছিন্ন কোনো অপহরণের ঘটনাকেও সেভাবে দেখা উচিত। নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখলেও বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন সার্বক্ষণিক সেনা উপস্থিতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
পার্বত্য নেতৃত্বের অনেকে বলছেন, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ক্যান্টনমেন্টসহ সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে। তাঁদের এ মত কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, দেশের অন্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও পর্যাপ্ত ক্যান্টনমেন্ট থাকতে হবে। এমনকি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান ছয়টি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা অবিকৃত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পাড়ায় পাড়ায় এবং পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সেনাক্যাম্প রেখে নাগরিকজীবনের স্বস্তি নষ্ট করার কোনো মানে থাকতে পারে না। তাই বলব, পর্যায়ক্রমে সব সেনাক্যাম্প গুটিয়ে সব সেনাসদস্যকে পার্বত্য এলাকার ছয়টি ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা হোক। যদি কোনো স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা ইউনিয়নে সেনা প্রেরণ করার সহজ সুযোগ তো রইলই।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৯৭-এর পার্বত্য চুক্তির আলোকেই সরকারিভাবে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের অনুমান, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের জিওসি যেমন বলেছেন, ‘আগে পাহাড়ের অনেক এলাকায় রাস্তাঘাট ছিল না, যোগাযোগব্যবস্থা ছিল দুর্গম। এখন ওসব এলাকায় ভালো সড়ক যোগাযোগ, এমনকি মোবাইল টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে সেসব জায়গায় অর্থহীন ক্যাম্প রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।’ (প্রথম আলো ২০ আগস্ট)। জিওসির এই বক্তব্য খুবই দূরদর্শী বলে মনে হয়। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে চাই, তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলার অলিগলিতে সেনা অবস্থান করানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহার করে নিয়ে সিভিল প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
সেনা স্থানান্তরের ফলে এতদিন সেনা নিরাপত্তায় থাকা বসতি স্থাপনকারী উদ্বাস্তু বাঙালিরা নিজেদের ভবিষ্যত্ নিয়ে সংগত কারণেই উত্কণ্ঠিত। দেশের যেকোনো এলাকার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি সবার নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে পুলিশ-আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশ বাহিনীর মতো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘পার্বত্য পুলিশ বাহিনী’ গঠন করা যেতে পারে।
২.
সেনা স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বসতি স্থাপনকারী (সেটেলার) বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের বিষয়টিও জড়িত। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের তিন ভাগে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন: পাহাড়ি আদিবাসী, স্থায়ী বাঙালি এবং সেটেলার বা বসতি স্থাপনকারী বাঙালি। একটি পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যাক। ১৯৫১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৭০ জন (মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ)। আর ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার ৩০১ (মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ)। জ্যামিতিক হারে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে মূলত আশির দশকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন জেলার ছিন্নমূল বাঙালিদের অবৈধ বসতি স্থাপনের ফলে।
স্থায়ী বাঙালিদের নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন বা নেতারা একবারের জন্যও প্রশ্ন তোলেননি। মূল সমস্যা সেটেলার বা বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের নিয়ে। কারণ এরা অবৈধ অধিবাসী। এরা কেউ কখনো ওখানে জমি কিনে বসবাস শুরু করেনি। জিয়া ও এরশাদের আমলে সরকারের দেখানো লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিল সারা দেশের অজস্র হতদরিদ্র উদ্বাস্তু বাঙালি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ের জায়গা-জমি দখল করে তাদের অবৈধভাবে বসবাস করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের অনেককে দেওয়া হয়েছিল খাসজমির মিথ্যা দলিল।
পার্বত্য অঞ্চলের কোনো গুচ্ছগ্রামে গিয়ে যদি কোনো সেটেলার বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, কুড়িগ্রাম, মুক্তাগাছা, ফেনী, ভোলা বা অন্য কোনো এলাকার নাম। তাঁর মন পড়ে আছে নদীভাঙা কোনো গ্রামে, দেহটা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, পার্বত্যাঞ্চলের সেটেলার বাঙালিদের প্রায় ৩০ বছর ধরে সরকার রেশন দিয়ে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে রেশন দিয়ে তাদের পার্বত্যাঞ্চলে লালন-পালন করতে হবে? সেটেলার বাঙালিদের রেশন ও নিরাপত্তা বাবদ প্রতিবছর কত শত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে? আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দেওয়া করের টাকা কেন এভাবে নষ্ট হবে? সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। তবে শুধু বাঙালি নয়, পাহাড়ি উদ্বাস্তুদেরও গণহারে রেশন দেওয়া চলবে না। রেশনের নামে সরকারি টাকা তছরুপ কোনো বিবেচনায়ই সমর্থনযোগ্য নয়।
পাহাড়ের অপরিচিত আঙিনায় সেটেলার বাঙালিদের অধিকাংশই বিভিন্ন গুচ্ছগ্রাম বা নিকটবর্তী পাহাড় দখল করে বসবাস করছে। উদ্বাস্তু এসব বাঙালির মানবেতর জীবন কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কীভাবে অবৈধ বসবাসকারী উদ্বাস্তু এই বাঙালিদের পুনর্বাসন করা যাবে?
এ বিষয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিদের বেশির ভাগই দরিদ্র। যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসিত করা যেতে পারে। যদি ভূমি কমিশন রায় দিয়ে বলে, সরকার তাদের যে দলিল দিয়েছিল তা বেআইনি, তাহলে গুচ্ছগ্রামবাসীর যথাযথ পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। ...তাদের পার্বত্যাঞ্চলে পুনর্বাসিত না করে অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা যেতে পারে। ...ইউরোপীয় কমিশন এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। (মুক্তপ্রকাশ, আর্টিক্যাল-১৯ ও এমএমসি প্রকাশনা, জুন ২০০৯)।
আমাদের সামনে পার্বত্য সমস্যা সমাধানে অনেক রাজনৈতিক পথ খোলা রয়েছে। তার মধ্য থেকেই কোনো একটা বেছে নিতে হবে। বলপ্রয়োগ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করেই সমাধান সূত্র খুঁজতে হবে। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সরকারের উচিত হবে, দ্রুতই সেটেলার বাঙালিদের দেশের বিভিন্ন স্থানে খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে সম্মানজনক পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা। তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিদেশিদের অর্থের দিকে চেয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। সেটেলার বাঙালির জীবনধারণের জন্য রেশন ও নিরাপত্তা বাবদ সরকারের প্রতি মাসে যত কোটি টাকা ব্যয় হয়, তা দিয়েই খাসজমিতে তাদের জন্য বসতভিটা নির্মাণ এবং পুনর্বাসনের জন্য এককালীন আর্থিক সাহায্য প্রদান করা সম্ভব। এক টুকরো জমি ও এককালীন আর্থসাহায্য পেলে উদ্বাস্তু সেটেলার বাঙালিদের অনেকেই যে সমতলে নিজের এলাকায় ফিরে আসতে আগ্রহী হবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে সব কথার শেষ কথা, ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকা বাঙালি নেতৃবৃন্দ ‘দখলদারি মনস্তত্ত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পার্বত্য সমস্যার সমাধান সুদূর স্বপ্নই থেকে যাবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ যেন আগের শাসনামলের (১৯৯৬—২০০১) মতো ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে না পারে, সে জন্য পাহাড়ি নেতৃত্ব ও বাঙালি নাগরিকসমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
সরকারি সূত্র দাবি করছে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর থেকে অদ্যাবধি প্রায় ৩০০ সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং এ বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩৫টি সেনাক্যাম্পসহ একটি ব্রিগেড সেনা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ক্যাম্প স্থানান্তর করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য লক্ষ করার মতো। ১৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ শামীম চৌধুরী বলেছেন, ‘১৯৯৮ সালে ১০টি ক্যাম্প সরানোর মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয় এবং ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ ৬৩টি ক্যাম্প সরানো হয়েছে। এ বছর ৩৫টি ক্যাম্প সরানো হচ্ছে।’ (প্রথম আলো ২০ আগস্ট)।
এখানে ‘২০০৪ সাল’টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওই সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এ যাবত্ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যত সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৬৩টি) সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে ২০০৪ সালে—বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে। তাহলে এখন বিএনপি কেন এই ইস্যুতে ভিন্নমত পোষন করছে? বিএনপির অনেক নেতা তো এর ফলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের কাছে প্রশ্ন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে যখন সেনা প্রত্যাহার করেছিল, তখন কি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল? যদি না পড়ে থাকে, তাহলে এখন কেন সে প্রসঙ্গ আসছে?
পার্বত্যবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় দুই দশক (১৯৭৭—১৯৯৭) ধরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির (যা ‘শান্তিচুক্তি’ নামে অধিক পরিচিত) পর থেকে তিন পার্বত্য জেলাতেই স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের অন্য অঞ্চলের মতো ওখানেও কিছু বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির পর কোনো ব্যক্তি বা বিবাদমান কোনো পক্ষ, রাজনৈতিক দল বা সংস্থা একবারের জন্যও বলেনি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধাবস্থা চলছে। তাহলে কেন সেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘কৃত্রিম যুদ্ধাপরিস্থিতি’ বজায় রাখা হবে?
বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাসহ সারা দেশে অসংখ্য হামলা বা জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভয়াবহ ওই সব ঘটনার পর কোথাও সেনা শাসন জারির প্রয়োজন পড়েনি। সিভিল প্রশাসনই সব পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। যশোর, খুলনা, নওগাঁসহ দেশের অনেক অঞ্চলে সর্বহারা কর্তৃক অপহরণের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু কই, সেখানে তো সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন পড়ে না। পার্বত্যাঞ্চলে ছোটখাটো চাঁদাবাজি বা বিচ্ছিন্ন কোনো অপহরণের ঘটনাকেও সেভাবে দেখা উচিত। নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখলেও বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন সার্বক্ষণিক সেনা উপস্থিতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
পার্বত্য নেতৃত্বের অনেকে বলছেন, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ক্যান্টনমেন্টসহ সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে। তাঁদের এ মত কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, দেশের অন্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও পর্যাপ্ত ক্যান্টনমেন্ট থাকতে হবে। এমনকি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান ছয়টি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্টনমেন্টের সংখ্যা অবিকৃত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পাড়ায় পাড়ায় এবং পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সেনাক্যাম্প রেখে নাগরিকজীবনের স্বস্তি নষ্ট করার কোনো মানে থাকতে পারে না। তাই বলব, পর্যায়ক্রমে সব সেনাক্যাম্প গুটিয়ে সব সেনাসদস্যকে পার্বত্য এলাকার ছয়টি ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনা হোক। যদি কোনো স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা ইউনিয়নে সেনা প্রেরণ করার সহজ সুযোগ তো রইলই।
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৯৭-এর পার্বত্য চুক্তির আলোকেই সরকারিভাবে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের অনুমান, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের জিওসি যেমন বলেছেন, ‘আগে পাহাড়ের অনেক এলাকায় রাস্তাঘাট ছিল না, যোগাযোগব্যবস্থা ছিল দুর্গম। এখন ওসব এলাকায় ভালো সড়ক যোগাযোগ, এমনকি মোবাইল টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে সেসব জায়গায় অর্থহীন ক্যাম্প রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।’ (প্রথম আলো ২০ আগস্ট)। জিওসির এই বক্তব্য খুবই দূরদর্শী বলে মনে হয়। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে বলতে চাই, তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলার অলিগলিতে সেনা অবস্থান করানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহার করে নিয়ে সিভিল প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
সেনা স্থানান্তরের ফলে এতদিন সেনা নিরাপত্তায় থাকা বসতি স্থাপনকারী উদ্বাস্তু বাঙালিরা নিজেদের ভবিষ্যত্ নিয়ে সংগত কারণেই উত্কণ্ঠিত। দেশের যেকোনো এলাকার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি সবার নিরাপত্তার স্বার্থে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে পুলিশ-আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশ বাহিনীর মতো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘পার্বত্য পুলিশ বাহিনী’ গঠন করা যেতে পারে।
২.
সেনা স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বসতি স্থাপনকারী (সেটেলার) বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের বিষয়টিও জড়িত। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের তিন ভাগে শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন: পাহাড়ি আদিবাসী, স্থায়ী বাঙালি এবং সেটেলার বা বসতি স্থাপনকারী বাঙালি। একটি পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যাক। ১৯৫১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ হাজার ৭০ জন (মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ)। আর ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার ৩০১ (মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ)। জ্যামিতিক হারে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে মূলত আশির দশকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন জেলার ছিন্নমূল বাঙালিদের অবৈধ বসতি স্থাপনের ফলে।
স্থায়ী বাঙালিদের নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন বা নেতারা একবারের জন্যও প্রশ্ন তোলেননি। মূল সমস্যা সেটেলার বা বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের নিয়ে। কারণ এরা অবৈধ অধিবাসী। এরা কেউ কখনো ওখানে জমি কিনে বসবাস শুরু করেনি। জিয়া ও এরশাদের আমলে সরকারের দেখানো লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিল সারা দেশের অজস্র হতদরিদ্র উদ্বাস্তু বাঙালি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ের জায়গা-জমি দখল করে তাদের অবৈধভাবে বসবাস করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের অনেককে দেওয়া হয়েছিল খাসজমির মিথ্যা দলিল।
পার্বত্য অঞ্চলের কোনো গুচ্ছগ্রামে গিয়ে যদি কোনো সেটেলার বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, কুড়িগ্রাম, মুক্তাগাছা, ফেনী, ভোলা বা অন্য কোনো এলাকার নাম। তাঁর মন পড়ে আছে নদীভাঙা কোনো গ্রামে, দেহটা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, পার্বত্যাঞ্চলের সেটেলার বাঙালিদের প্রায় ৩০ বছর ধরে সরকার রেশন দিয়ে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে রেশন দিয়ে তাদের পার্বত্যাঞ্চলে লালন-পালন করতে হবে? সেটেলার বাঙালিদের রেশন ও নিরাপত্তা বাবদ প্রতিবছর কত শত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে? আমাদের মতো সাধারণ জনগণের দেওয়া করের টাকা কেন এভাবে নষ্ট হবে? সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। তবে শুধু বাঙালি নয়, পাহাড়ি উদ্বাস্তুদেরও গণহারে রেশন দেওয়া চলবে না। রেশনের নামে সরকারি টাকা তছরুপ কোনো বিবেচনায়ই সমর্থনযোগ্য নয়।
পাহাড়ের অপরিচিত আঙিনায় সেটেলার বাঙালিদের অধিকাংশই বিভিন্ন গুচ্ছগ্রাম বা নিকটবর্তী পাহাড় দখল করে বসবাস করছে। উদ্বাস্তু এসব বাঙালির মানবেতর জীবন কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কীভাবে অবৈধ বসবাসকারী উদ্বাস্তু এই বাঙালিদের পুনর্বাসন করা যাবে?
এ বিষয়ে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘গুচ্ছগ্রামে বসবাসকারী বাঙালিদের বেশির ভাগই দরিদ্র। যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসিত করা যেতে পারে। যদি ভূমি কমিশন রায় দিয়ে বলে, সরকার তাদের যে দলিল দিয়েছিল তা বেআইনি, তাহলে গুচ্ছগ্রামবাসীর যথাযথ পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। ...তাদের পার্বত্যাঞ্চলে পুনর্বাসিত না করে অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা যেতে পারে। ...ইউরোপীয় কমিশন এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। (মুক্তপ্রকাশ, আর্টিক্যাল-১৯ ও এমএমসি প্রকাশনা, জুন ২০০৯)।
আমাদের সামনে পার্বত্য সমস্যা সমাধানে অনেক রাজনৈতিক পথ খোলা রয়েছে। তার মধ্য থেকেই কোনো একটা বেছে নিতে হবে। বলপ্রয়োগ কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করেই সমাধান সূত্র খুঁজতে হবে। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সরকারের উচিত হবে, দ্রুতই সেটেলার বাঙালিদের দেশের বিভিন্ন স্থানে খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে সম্মানজনক পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা। তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিদেশিদের অর্থের দিকে চেয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। সেটেলার বাঙালির জীবনধারণের জন্য রেশন ও নিরাপত্তা বাবদ সরকারের প্রতি মাসে যত কোটি টাকা ব্যয় হয়, তা দিয়েই খাসজমিতে তাদের জন্য বসতভিটা নির্মাণ এবং পুনর্বাসনের জন্য এককালীন আর্থিক সাহায্য প্রদান করা সম্ভব। এক টুকরো জমি ও এককালীন আর্থসাহায্য পেলে উদ্বাস্তু সেটেলার বাঙালিদের অনেকেই যে সমতলে নিজের এলাকায় ফিরে আসতে আগ্রহী হবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে সব কথার শেষ কথা, ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকা বাঙালি নেতৃবৃন্দ ‘দখলদারি মনস্তত্ত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পার্বত্য সমস্যার সমাধান সুদূর স্বপ্নই থেকে যাবে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ যেন আগের শাসনামলের (১৯৯৬—২০০১) মতো ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে না পারে, সে জন্য পাহাড়ি নেতৃত্ব ও বাঙালি নাগরিকসমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
No comments