শেখ হাসিনা কি ভুল করেছেন by আব্দুল কাইয়ুম
আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে পুরোনো ও অভিজ্ঞ নেতারা বাদ পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরা সংস্কারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন বলেই এই শাস্তি কি না। এবং দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হওয়ার কারণেই তাঁদের এই দুর্গতি হলো কি না? কারণ কাউন্সিল তো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সর্বময় দায়িত্ব শেখ হাসিনার কাছেই নির্দ্বিধায় অর্পণ করে গেছে। তিনি অবশ্য সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শের কথা কাউন্সিলেই জানিয়ে দেন। কিন্তু পরামর্শ করলেও শেখ হাসিনার মতামত যে প্রাধান্য পাবে, তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কথা দাঁড়াল এই যে কমিটি গঠনে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই ছিল মূল এবং সেই কমিটিতে কথিত সংস্কারপন্থীদের প্রায় সবাই বাদ পড়েছেন, নতুনদের সেখানে আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন করে কি শেখ হাসিনা ভুল করেছেন?
সন্ধ্যায় নতুন কমিটি ঘোষণার পরপরই সবখানে আলোচনা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের ৬০ বছরের ইতিহাসে অভিজ্ঞ ও ডাক-সাইটে এত নেতার একসঙ্গে কার্যত বিদায়ের ঘটনা এই প্রথম। এর আগে আওয়ামী লীগের বড় অনেক নেতা দল ছেড়ে চলে গেছেন, তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবারের বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা দলে আছেন, সংসদে আছেন, সংসদীয় কমিটির সভাপতিও হয়েছেন অনেকে, কিন্তু দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিতে বাদ। তাঁদের কেউ কেউ দলের উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন, যেটা আসলে কোনো নীতিনির্ধারণী ফোরাম নয়, যদিও দলের নেতৃত্ব পর্যায়ের একটি স্তর। অর্থাত্ বাদ পড়া নেতারা কমিটিতে না থেকেও দলে আছেন। এবং দলে ভূমিকা রাখছেন।
মূল নেতাদের দলে থেকেও না থাকার এ বিষয়ে সেদিন রাতে লন্ডন থেকে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক কামাল আহমেদ টেলিফোনে আমার মন্তব্য জানতে চান। স্বাভাবিকভাবেই আমি বলি, যেকোনো দলের নেতৃত্বে নতুন ও অপেক্ষাকৃত তরুণদের আসাটাই স্বাভাবিক। তবে একসঙ্গে পুরোনোদের সবাইকে বাদ দেওয়ায় হয়তো সমস্যা হবে। অবশ্য পুরোনো নেতারা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুনদের সাহায্য করলে নতুন-পুরোনোর মিশ্রণের মতোই সুফল পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে আমি বলি, কাউন্সিলের আগে থেকেই সংস্কারপন্থী বলে কথিত নেতাদের একটু দূরে দূরে রাখা হয়েছে। তাঁদের মন্ত্রী করা হয়নি। তা সত্ত্বেও বিগত আট মাসের সরকারের কাজের অভিজ্ঞতা তো খুব খারাপ নয়। বরং পিলখানায় বিডিআরের রক্তক্ষয়ী ঘটনায় দেখা গেছে, সরকার মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। না হলে দেশব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কথা প্রসঙ্গে এ কথাও আসে যে তখন কথিত সংস্কারপন্থী নেতারাও একত্রে কাজ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সাহায্য করেছেন। সুতরাং শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব গঠনে ভুল করেছেন না ঠিক করেছেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে অভিজ্ঞ নেতারা বাদ পড়া সত্ত্বেও দলের প্রতি কতটা আনুগত্য নিয়ে কাজ করেন এবং তাঁরা নতুন ও তরুণ নেতৃত্বকে অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে কতটা প্রস্তুত, তার ওপর।
আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতার অবদান আওয়ামী লীগে অপরিসীম। বিগত সংসদে এক বক্তৃতায় বিএনপির একজন সাংসদ একবার তোফায়েল আহমেদের মাথায় বিরল কেশ নিয়ে কটূক্তি করায় তিনি একটা মোক্ষম উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় পাকিস্তান আমলের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে বিএনপির ওই সাংসদদের ‘পিতা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, একসময় তাঁর মাথাভরা চুল ছিল কিন্তু ওই ‘পিতা’ তথা আইয়ুবকে গদিচ্যুত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাঁর অনেক চুল পড়ে গেছে। এরপর বিএনপির সেই সাংসদ চুপ করেন। কারণ, কথা তো সত্য। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রচনা ও আইয়ুবের পতনের পেছনে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্ব ছিল অসাধারণ। স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার পরের বিভিন্ন পর্যায়েও নেতৃত্ব দানে তোফায়েল আহমেদের অবদান অনস্বীকার্য। তেমনি আবদুর রাজ্জাক বা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতার রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও দেশ গড়ে তোলায় অসাধারণ অবদান। তাঁরা আজ দলের নেতৃত্বের বাইরে। কিন্তু কেন?
আমরা বলি নেতৃত্বের পরিবর্তন আসতে হবে দলের ভেতর থেকে। বাইরে থেকে বা কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখব, কথিত সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়ার দাবিটি কাউন্সিলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্য থেকেই প্রবলভাবে এসেছে। একপর্যায়ে প্রতিনিধিরা মূল মঞ্চে উঠে তাঁদের বাদ দেওয়ার দাবি করতে থাকেন। সুতরাং সেই তৃণমূলের নেতাদের মনোভাবকে মূল্য দিয়ে যদি শেখ হাসিনা আলোচ্য প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়ে থাকেন, তাহলে তো তিনি ঠিকই করেছেন। বাদ না দিলেই বরং কথা উঠতে পারত যে শেখ হাসিনা মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কথার দাম দেন না ইত্যাদি।
তবে এটাও ঠিক যে শেখ হাসিনা নিজে কী চান তার ওপর নেতা-কর্মীদের চাওয়া না-চাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে। এবং তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের যে শেখ হাসিনা রাখতে চান না, সেটা গোপন কিছু নয়। শেখ হাসিনার এই মনোভাব কাউন্সিলের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে, সন্দেহ নেই। তা ছাড়া কাউন্সিলে প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির প্রস্তাবিত নামের একটি তালিকা দিয়ে যদি কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম আহ্বান করা হতো এবং খোলামেলা পরিবেশ থাকত, তাহলে হয়তো পুরোনো ও অভিজ্ঞ নেতাদের প্রকৃত জনপ্রিয়তা যাচাই হতে পারত। কাউন্সিলে সে সুযোগ না দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এতে দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চার অভাবটাই ফুটে উঠেছে।
কিন্তু তথাকথিত সংস্কারপন্থীরা যে দলের মধ্যে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো, এই নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছিলেন। এই পরিবর্তন তথা রাজনৈতিক সংস্কার ওপর থেকে বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। আর দুই নেত্রী এর বিরুদ্ধে জেল-জুলুম সহ্য করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীরাও শেখ হাসিনার এই প্রতিরোধে আন্তরিকতা নিয়ে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে অভিজ্ঞ নেতাদের সেনাসমর্থিত তথাকথিত সংস্কার তত্ত্বের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখে কর্মীরা খেপে যান। নির্বাচনেও দেখা যায় শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করতে মানুষ রাজি নয়। বরং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করে, তাঁকে ‘মাইনাস’ করার অপচেষ্টা দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব কারণেই দলের ভেতর তথাকথিত সংস্কারপন্থী নেতাদের আজ এই দুর্দশা।
বাঙালিরা স্বভাবজাতভাবে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর প্রধান কারণ পাকিস্তানি শাসন-শোষণ। ওরা বাঙালিদের পদানত রাখার জন্য প্রথমে পূর্ববাংলার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে তা বানচাল হয়ে যায়। এরপর আসে আইয়ুবি সামরিক শাসন। এর পরের ইতিহাস আমরা জানি। বাঙালিরা জন্মগতভাবে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবি সামরিক শাসন জারি হলে সামরিক কায়দায় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার শুরু হয়। এদের মধ্যে ভয়ঙ্কর একটি শাস্তি ছিল দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বেত্রাঘাত। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ন্যাপ নেতা কাজী বারীকে শুধু রাজনীতি করার অপরাধে এভাবে বেত্রাঘাত ও নির্যাতন করা হয়। তাঁর কানসহ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যায়। বাকি জীবন তিনি অনেক ভুগেছেন। এটা সামান্য একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর আরও ভয়ঙ্কর অত্যাচার হয়। সে সময় অত্যাচারিত কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন। তাঁরা জানেন সামরিক শাসন কী জিনিস!
এর পরও বাংলাদেশে দুবার সামরিক শাসন এসেছে। প্রতিবারই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার অবশ্য সামরিক শাসন ছিল না, ছিল সেনাসমর্থিত সরকার। কিন্তু নানা ঘটনায় মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সামান্য ঘটনার রেশ ধরে ২০০৭ সালের ২১-২৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে সেনাসদস্যদের মারাত্মক সংঘাত বেধে যায়। এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব এ দেশবাসী চায় না।
এ অবস্থায় কথিত সংস্কারপন্থী নেতারা রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্বের সমর্থকরূপে চিহ্নিত হওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে সংস্কার গৃহীত হয়েছে কিন্তু ‘সংস্কারপন্থীরা’ হননি। নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব গঠন, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে স্থানীয় পর্যায় থেকে মতামত গ্রহণ, নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অঙ্গসংগঠন বাদ দেওয়াসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। এগুলোই তো সংস্কার। অন্তত কাগজে-কলমে। সেগুলো বাস্তবে তারা মেনে চলবে কি না সেটা ভিন্ন বিষয়। ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। না মানলে দায় তাদেরই বহন করতে হবে। আপাতত বলা যায় কাউন্সিল ‘সংস্কার’ মাইনাস করেনি, মাইনাস করেছে তথাকথিত ‘সংস্কারপন্থী’দের।
শেখ হাসিনা এখানে ভুল করেননি, অন্তত কাউন্সিলের পরিবেশ ও দেশবাসীর মনোভাব কিন্তু এ রকমই ছিল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
সন্ধ্যায় নতুন কমিটি ঘোষণার পরপরই সবখানে আলোচনা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের ৬০ বছরের ইতিহাসে অভিজ্ঞ ও ডাক-সাইটে এত নেতার একসঙ্গে কার্যত বিদায়ের ঘটনা এই প্রথম। এর আগে আওয়ামী লীগের বড় অনেক নেতা দল ছেড়ে চলে গেছেন, তাতে দলের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবারের বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা দলে আছেন, সংসদে আছেন, সংসদীয় কমিটির সভাপতিও হয়েছেন অনেকে, কিন্তু দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিতে বাদ। তাঁদের কেউ কেউ দলের উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন, যেটা আসলে কোনো নীতিনির্ধারণী ফোরাম নয়, যদিও দলের নেতৃত্ব পর্যায়ের একটি স্তর। অর্থাত্ বাদ পড়া নেতারা কমিটিতে না থেকেও দলে আছেন। এবং দলে ভূমিকা রাখছেন।
মূল নেতাদের দলে থেকেও না থাকার এ বিষয়ে সেদিন রাতে লন্ডন থেকে বিবিসি বাংলার সাংবাদিক কামাল আহমেদ টেলিফোনে আমার মন্তব্য জানতে চান। স্বাভাবিকভাবেই আমি বলি, যেকোনো দলের নেতৃত্বে নতুন ও অপেক্ষাকৃত তরুণদের আসাটাই স্বাভাবিক। তবে একসঙ্গে পুরোনোদের সবাইকে বাদ দেওয়ায় হয়তো সমস্যা হবে। অবশ্য পুরোনো নেতারা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুনদের সাহায্য করলে নতুন-পুরোনোর মিশ্রণের মতোই সুফল পাওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে আমি বলি, কাউন্সিলের আগে থেকেই সংস্কারপন্থী বলে কথিত নেতাদের একটু দূরে দূরে রাখা হয়েছে। তাঁদের মন্ত্রী করা হয়নি। তা সত্ত্বেও বিগত আট মাসের সরকারের কাজের অভিজ্ঞতা তো খুব খারাপ নয়। বরং পিলখানায় বিডিআরের রক্তক্ষয়ী ঘটনায় দেখা গেছে, সরকার মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। না হলে দেশব্যাপী ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কথা প্রসঙ্গে এ কথাও আসে যে তখন কথিত সংস্কারপন্থী নেতারাও একত্রে কাজ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সাহায্য করেছেন। সুতরাং শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব গঠনে ভুল করেছেন না ঠিক করেছেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে অভিজ্ঞ নেতারা বাদ পড়া সত্ত্বেও দলের প্রতি কতটা আনুগত্য নিয়ে কাজ করেন এবং তাঁরা নতুন ও তরুণ নেতৃত্বকে অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে কতটা প্রস্তুত, তার ওপর।
আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতার অবদান আওয়ামী লীগে অপরিসীম। বিগত সংসদে এক বক্তৃতায় বিএনপির একজন সাংসদ একবার তোফায়েল আহমেদের মাথায় বিরল কেশ নিয়ে কটূক্তি করায় তিনি একটা মোক্ষম উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় পাকিস্তান আমলের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে বিএনপির ওই সাংসদদের ‘পিতা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, একসময় তাঁর মাথাভরা চুল ছিল কিন্তু ওই ‘পিতা’ তথা আইয়ুবকে গদিচ্যুত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাঁর অনেক চুল পড়ে গেছে। এরপর বিএনপির সেই সাংসদ চুপ করেন। কারণ, কথা তো সত্য। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান রচনা ও আইয়ুবের পতনের পেছনে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্ব ছিল অসাধারণ। স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার পরের বিভিন্ন পর্যায়েও নেতৃত্ব দানে তোফায়েল আহমেদের অবদান অনস্বীকার্য। তেমনি আবদুর রাজ্জাক বা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ নেতার রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও দেশ গড়ে তোলায় অসাধারণ অবদান। তাঁরা আজ দলের নেতৃত্বের বাইরে। কিন্তু কেন?
আমরা বলি নেতৃত্বের পরিবর্তন আসতে হবে দলের ভেতর থেকে। বাইরে থেকে বা কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখব, কথিত সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়ার দাবিটি কাউন্সিলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্য থেকেই প্রবলভাবে এসেছে। একপর্যায়ে প্রতিনিধিরা মূল মঞ্চে উঠে তাঁদের বাদ দেওয়ার দাবি করতে থাকেন। সুতরাং সেই তৃণমূলের নেতাদের মনোভাবকে মূল্য দিয়ে যদি শেখ হাসিনা আলোচ্য প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়ে থাকেন, তাহলে তো তিনি ঠিকই করেছেন। বাদ না দিলেই বরং কথা উঠতে পারত যে শেখ হাসিনা মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কথার দাম দেন না ইত্যাদি।
তবে এটাও ঠিক যে শেখ হাসিনা নিজে কী চান তার ওপর নেতা-কর্মীদের চাওয়া না-চাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে। এবং তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের যে শেখ হাসিনা রাখতে চান না, সেটা গোপন কিছু নয়। শেখ হাসিনার এই মনোভাব কাউন্সিলের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে, সন্দেহ নেই। তা ছাড়া কাউন্সিলে প্রকৃত অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির প্রস্তাবিত নামের একটি তালিকা দিয়ে যদি কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম আহ্বান করা হতো এবং খোলামেলা পরিবেশ থাকত, তাহলে হয়তো পুরোনো ও অভিজ্ঞ নেতাদের প্রকৃত জনপ্রিয়তা যাচাই হতে পারত। কাউন্সিলে সে সুযোগ না দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এতে দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চার অভাবটাই ফুটে উঠেছে।
কিন্তু তথাকথিত সংস্কারপন্থীরা যে দলের মধ্যে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, তা অস্বীকার করা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো, এই নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছিলেন। এই পরিবর্তন তথা রাজনৈতিক সংস্কার ওপর থেকে বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। আর দুই নেত্রী এর বিরুদ্ধে জেল-জুলুম সহ্য করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন সারা দেশে দলীয় নেতা-কর্মীরাও শেখ হাসিনার এই প্রতিরোধে আন্তরিকতা নিয়ে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে অভিজ্ঞ নেতাদের সেনাসমর্থিত তথাকথিত সংস্কার তত্ত্বের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখে কর্মীরা খেপে যান। নির্বাচনেও দেখা যায় শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করতে মানুষ রাজি নয়। বরং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করে, তাঁকে ‘মাইনাস’ করার অপচেষ্টা দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব কারণেই দলের ভেতর তথাকথিত সংস্কারপন্থী নেতাদের আজ এই দুর্দশা।
বাঙালিরা স্বভাবজাতভাবে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এর প্রধান কারণ পাকিস্তানি শাসন-শোষণ। ওরা বাঙালিদের পদানত রাখার জন্য প্রথমে পূর্ববাংলার বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে তা বানচাল হয়ে যায়। এরপর আসে আইয়ুবি সামরিক শাসন। এর পরের ইতিহাস আমরা জানি। বাঙালিরা জন্মগতভাবে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবি সামরিক শাসন জারি হলে সামরিক কায়দায় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার শুরু হয়। এদের মধ্যে ভয়ঙ্কর একটি শাস্তি ছিল দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বেত্রাঘাত। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ন্যাপ নেতা কাজী বারীকে শুধু রাজনীতি করার অপরাধে এভাবে বেত্রাঘাত ও নির্যাতন করা হয়। তাঁর কানসহ শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যায়। বাকি জীবন তিনি অনেক ভুগেছেন। এটা সামান্য একটি উদাহরণ। আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর আরও ভয়ঙ্কর অত্যাচার হয়। সে সময় অত্যাচারিত কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন। তাঁরা জানেন সামরিক শাসন কী জিনিস!
এর পরও বাংলাদেশে দুবার সামরিক শাসন এসেছে। প্রতিবারই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার অবশ্য সামরিক শাসন ছিল না, ছিল সেনাসমর্থিত সরকার। কিন্তু নানা ঘটনায় মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সামান্য ঘটনার রেশ ধরে ২০০৭ সালের ২১-২৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে সেনাসদস্যদের মারাত্মক সংঘাত বেধে যায়। এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব এ দেশবাসী চায় না।
এ অবস্থায় কথিত সংস্কারপন্থী নেতারা রাজনীতিতে সেনা কর্তৃত্বের সমর্থকরূপে চিহ্নিত হওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে সংস্কার গৃহীত হয়েছে কিন্তু ‘সংস্কারপন্থীরা’ হননি। নির্বাচনের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব গঠন, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে স্থানীয় পর্যায় থেকে মতামত গ্রহণ, নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অঙ্গসংগঠন বাদ দেওয়াসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। এগুলোই তো সংস্কার। অন্তত কাগজে-কলমে। সেগুলো বাস্তবে তারা মেনে চলবে কি না সেটা ভিন্ন বিষয়। ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। না মানলে দায় তাদেরই বহন করতে হবে। আপাতত বলা যায় কাউন্সিল ‘সংস্কার’ মাইনাস করেনি, মাইনাস করেছে তথাকথিত ‘সংস্কারপন্থী’দের।
শেখ হাসিনা এখানে ভুল করেননি, অন্তত কাউন্সিলের পরিবেশ ও দেশবাসীর মনোভাব কিন্তু এ রকমই ছিল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments