আদিবাসীদের গৌরবময় ইতিহাসের মূল্যায়ন চাই -আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস by ইলিরা দেওয়ান
আজ ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’। সরকারিভাবে পালিত না হলেও কয়েক বছর ধরে বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি বেশ ঘটা করে পালিত হচ্ছে। কিন্তু কেবল আদিবাসী দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আদিবাসীদের গৌরবময় ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ভাষাকে কীভাবে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে বিষয়টি সবার আগে ভাবতে হবে।
আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ‘চাকমা বিদ্রোহ’ বা ‘কার্পাস বিদ্রোহ’ (১৭৭৬-১৭৮৭), ময়মনসিংহের গারো জাগরণ ও তিন দফায় সংঘটিত বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭, ১৮৩২-৩৩, ১৮৩৭-৮২), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহ, ত্রিপুরা বিদ্রোহসহ (১৮৪৪-৯০) অনেক বিদ্রোহের ঘটনা দেখি, যেগুলো ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
মূলত ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী, জমিদার ও জোতদার শ্রেণীর শোষণের কবল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আদিবাসীরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেছিল। এ সংগ্রামে অনেকে শাসকশ্রেণীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল, আবার অনেকে আমরণ স্বাধিকার সংগ্রাম করে গিয়েছিল। ইংরেজদের মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের কাছে আদিবাসীদের আদি অস্ত্র তীর-ধনুক ছিল ঠুনকো। কিন্তু তবুও তারা এ অস্ত্র দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং তাদের অস্তিত্বের কথা, প্রতিবাদের ভাষা জানিয়ে দিয়েছিল। আধুনিক অস্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও জাতীয়তার অধিকার থেকে সরে আসেনি। ইংরেজ শাসক ও জোতদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের এ সংগ্রামের ইতিহাস তাদের লড়াকু চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকেই বহন করে।
এ লড়াকু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ দুই যুগ আন্দোলন করেছিল। অবশেষে সরকার পার্বত্য সমস্যা সমাধান ও স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পাহাড়ি নেতৃত্বের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তিটি পার্বত্য অঞ্চলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। তবে অনেকের মতে, চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের একটি বড় ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
ইতিহাসে আমরা দেখি, শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শুধু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের সরলতার সুযোগে তাদের ওপর রাজস্ব আদায়ের নামে অন্যায়ভাবে করের বোঝা চাপানো হয়েছিল। এই আরোপিত কর পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের আজীবন দাসত্ব বরণও করতে হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে দেখা যায়, মুঘল সরকারের সঙ্গে চাকমা রাজাদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এর মূলে ছিল, রাজার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মুঘলদের হস্তক্ষেপ না করার নীতি। ১৭৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চলে আসার পর থেকে কোম্পানিকে পার্বত্যবাসীদের কর প্রদান করতে হতো। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সনাতনী জীবনে (সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে) অস্থিরতা তৈরি হয়। কোম্পানিকে কর পরিশোধ করার পর অবশিষ্ট যে দ্রব্য থাকত তাতে চাকমাদের সারা বছরের অন্নের জোগান হতো না। এতে কোম্পানির প্রতি ক্রমেই অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে এবং ১৭৭৬ সাল থেকে চাকমারা কর প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে ইংরেজ কর্মচারী ও তাদের অনুগত লোকদের বিতাড়িত করে দেয়। এ সময় ইংরেজরা চাকমাদের নানা কৌশলে দমন করার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়। ফলে তারা (ইংরেজরা) ১৭৮১ সালে ভিন্ন কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে দেয়। অন্যদিকে চাকমারাও পাল্টা অবরোধ ঘোষণা করে। কেননা কোম্পানির আয়ের অন্যতম উত্স ছিল লবণ। আর এ লবণ তৈরিতে যে জ্বালানি কাঠ ব্যবহূত হতো তার প্রায় ষোল আনাই আসত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। এভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় এক দশক ধরে যুদ্ধ চলে। যেটি ইতিহাসে ‘চাকমা বিদ্রোহ’ বা ‘কার্পাস বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। অবশেষে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। যেই সন্ধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ময়মনসিংহের শেরপুর-সুসঙ্গ অঞ্চলে গারোদের মধ্যে জাগরণ শুরু হয় এবং ১৮২৫ ও ১৮৩৩ সালে তা সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। যা ‘পাগলপন্থী বিদ্রোহ’ বা ‘গারো বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। প্রথম পাগলপন্থী বিদ্রোহে টিপু গারোর নেতৃত্বে গারোরা সুসঙ্গের জমিদারকে বিতাড়িত করে স্বল্প সময়ের জন্য (প্রায় দুই বছর) স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। প্রথম বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও আট বছর পর টিপুর সহযোদ্ধা গুমানু সরকারের নেতৃত্বে গারোরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ১৮৩৩ সালে ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এভাবে খণ্ডে খণ্ডে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৮৭১ সালে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৮৫৫-৫৭) সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এই সাঁওতাল বিদ্রোহের মূলে ছিল জমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। এই বিদ্রোহের প্রভাব দুই বছর পর সিপাহী বিদ্রোহেও বিরাট প্রেরণা জুগিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহে প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো সাঁওতাল প্রাণ হারিয়েছিলেন।
২.
ইতিহাসে এ বিদ্রোহগুলো জায়গা করে নিলেও পাঠ্যবইতে এ বিষয়ে খুব কমই লেখালেখি হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে দেশের পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ থাকলেও চাকমা বিদ্রোহ, গারো বিদ্রোহ বা পাগলপন্থী বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, ত্রিপুরা বিদ্রোহ সম্পর্কে তেমন কোনো উল্লেখ নেই। অথচ এ বিদ্রোহগুলোই কৃষক বিদ্রোহের মূল ভিত্তি রচনাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
চাকমা, গারো বা সাঁওতালরা যেমন ইংরেজ শাসক ও শোষকশ্রেণীর কবল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, তেমনি ফরায়েজী আন্দোলনের নায়ক দুদুমিয়া কিংবা ওয়াহাবী বিদ্রোহের নায়ক তিতুমীরও শোষক শ্রেণী থেকে সাধারণ জনগণকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফরায়েজী বিদ্রোহ বা ওয়াহাবী বিদ্রোহসমূহ পাঠ্যবইয়ে যতটা গুরুত্ব পায়, ঠিক ততটা চাকমা বিদ্রোহ বা গারো বিদ্রোহগুলো উপেক্ষিত থাকে।
আদিবাসীদের অতীতের ইতিহাস শোষকশ্রেণী ও পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তির ইতিহাস। বর্তমানে যারা নিজেদের সভ্য ভাবছে তারাই একসময় আদিবাসীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শিক্ষাটা গ্রহণ করেছিল। অতীতে ও বর্তমানে আদিবাসীরা লড়েই প্রমাণ করছে তারা লড়াকু জাতি। কাজেই আমরা আশা করব, বর্তমান সময়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার অচিরেই নিশ্চিত করা হবে। আর বিদ্রোহ নয়, আমরা চাই শান্তি। কাজেই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সরকারকে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকার কর্মী; হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
iliradewan@yahoo.com
আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ‘চাকমা বিদ্রোহ’ বা ‘কার্পাস বিদ্রোহ’ (১৭৭৬-১৭৮৭), ময়মনসিংহের গারো জাগরণ ও তিন দফায় সংঘটিত বিদ্রোহ (১৮২৫-২৭, ১৮৩২-৩৩, ১৮৩৭-৮২), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহ, ত্রিপুরা বিদ্রোহসহ (১৮৪৪-৯০) অনেক বিদ্রোহের ঘটনা দেখি, যেগুলো ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
মূলত ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী, জমিদার ও জোতদার শ্রেণীর শোষণের কবল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আদিবাসীরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেছিল। এ সংগ্রামে অনেকে শাসকশ্রেণীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল, আবার অনেকে আমরণ স্বাধিকার সংগ্রাম করে গিয়েছিল। ইংরেজদের মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের কাছে আদিবাসীদের আদি অস্ত্র তীর-ধনুক ছিল ঠুনকো। কিন্তু তবুও তারা এ অস্ত্র দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং তাদের অস্তিত্বের কথা, প্রতিবাদের ভাষা জানিয়ে দিয়েছিল। আধুনিক অস্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও জাতীয়তার অধিকার থেকে সরে আসেনি। ইংরেজ শাসক ও জোতদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের এ সংগ্রামের ইতিহাস তাদের লড়াকু চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকেই বহন করে।
এ লড়াকু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ দুই যুগ আন্দোলন করেছিল। অবশেষে সরকার পার্বত্য সমস্যা সমাধান ও স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পাহাড়ি নেতৃত্বের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তিটি পার্বত্য অঞ্চলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। তবে অনেকের মতে, চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের একটি বড় ভিত্তি তৈরি করেছে। যদিও পার্বত্য চুক্তির বেশির ভাগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
ইতিহাসে আমরা দেখি, শত শত বছর ধরে আদিবাসীরা শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শুধু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আদিবাসীদের সরলতার সুযোগে তাদের ওপর রাজস্ব আদায়ের নামে অন্যায়ভাবে করের বোঝা চাপানো হয়েছিল। এই আরোপিত কর পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের আজীবন দাসত্ব বরণও করতে হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে দেখা যায়, মুঘল সরকারের সঙ্গে চাকমা রাজাদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এর মূলে ছিল, রাজার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মুঘলদের হস্তক্ষেপ না করার নীতি। ১৭৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চলে আসার পর থেকে কোম্পানিকে পার্বত্যবাসীদের কর প্রদান করতে হতো। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সনাতনী জীবনে (সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে) অস্থিরতা তৈরি হয়। কোম্পানিকে কর পরিশোধ করার পর অবশিষ্ট যে দ্রব্য থাকত তাতে চাকমাদের সারা বছরের অন্নের জোগান হতো না। এতে কোম্পানির প্রতি ক্রমেই অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে এবং ১৭৭৬ সাল থেকে চাকমারা কর প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে ইংরেজ কর্মচারী ও তাদের অনুগত লোকদের বিতাড়িত করে দেয়। এ সময় ইংরেজরা চাকমাদের নানা কৌশলে দমন করার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হয়। ফলে তারা (ইংরেজরা) ১৭৮১ সালে ভিন্ন কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে দেয়। অন্যদিকে চাকমারাও পাল্টা অবরোধ ঘোষণা করে। কেননা কোম্পানির আয়ের অন্যতম উত্স ছিল লবণ। আর এ লবণ তৈরিতে যে জ্বালানি কাঠ ব্যবহূত হতো তার প্রায় ষোল আনাই আসত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। এভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় এক দশক ধরে যুদ্ধ চলে। যেটি ইতিহাসে ‘চাকমা বিদ্রোহ’ বা ‘কার্পাস বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। অবশেষে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। যেই সন্ধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ময়মনসিংহের শেরপুর-সুসঙ্গ অঞ্চলে গারোদের মধ্যে জাগরণ শুরু হয় এবং ১৮২৫ ও ১৮৩৩ সালে তা সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। যা ‘পাগলপন্থী বিদ্রোহ’ বা ‘গারো বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। প্রথম পাগলপন্থী বিদ্রোহে টিপু গারোর নেতৃত্বে গারোরা সুসঙ্গের জমিদারকে বিতাড়িত করে স্বল্প সময়ের জন্য (প্রায় দুই বছর) স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। প্রথম বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও আট বছর পর টিপুর সহযোদ্ধা গুমানু সরকারের নেতৃত্বে গারোরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ১৮৩৩ সালে ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এভাবে খণ্ডে খণ্ডে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৮৭১ সালে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৮৫৫-৫৭) সাঁওতাল বিদ্রোহ কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এই সাঁওতাল বিদ্রোহের মূলে ছিল জমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। এই বিদ্রোহের প্রভাব দুই বছর পর সিপাহী বিদ্রোহেও বিরাট প্রেরণা জুগিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহে প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো সাঁওতাল প্রাণ হারিয়েছিলেন।
২.
ইতিহাসে এ বিদ্রোহগুলো জায়গা করে নিলেও পাঠ্যবইতে এ বিষয়ে খুব কমই লেখালেখি হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে দেশের পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ থাকলেও চাকমা বিদ্রোহ, গারো বিদ্রোহ বা পাগলপন্থী বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, ত্রিপুরা বিদ্রোহ সম্পর্কে তেমন কোনো উল্লেখ নেই। অথচ এ বিদ্রোহগুলোই কৃষক বিদ্রোহের মূল ভিত্তি রচনাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
চাকমা, গারো বা সাঁওতালরা যেমন ইংরেজ শাসক ও শোষকশ্রেণীর কবল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, তেমনি ফরায়েজী আন্দোলনের নায়ক দুদুমিয়া কিংবা ওয়াহাবী বিদ্রোহের নায়ক তিতুমীরও শোষক শ্রেণী থেকে সাধারণ জনগণকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফরায়েজী বিদ্রোহ বা ওয়াহাবী বিদ্রোহসমূহ পাঠ্যবইয়ে যতটা গুরুত্ব পায়, ঠিক ততটা চাকমা বিদ্রোহ বা গারো বিদ্রোহগুলো উপেক্ষিত থাকে।
আদিবাসীদের অতীতের ইতিহাস শোষকশ্রেণী ও পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্তির ইতিহাস। বর্তমানে যারা নিজেদের সভ্য ভাবছে তারাই একসময় আদিবাসীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের শিক্ষাটা গ্রহণ করেছিল। অতীতে ও বর্তমানে আদিবাসীরা লড়েই প্রমাণ করছে তারা লড়াকু জাতি। কাজেই আমরা আশা করব, বর্তমান সময়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাসকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার অচিরেই নিশ্চিত করা হবে। আর বিদ্রোহ নয়, আমরা চাই শান্তি। কাজেই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সরকারকে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকার কর্মী; হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
iliradewan@yahoo.com
No comments