সাড়ে চার শ বছর আগের এক অনন্য মসজিদ by মোহাম্মাদ মোরশেদ হোসেন
মসজিদে প্রবেশের তিনটি দরজার মধ্যে মাঝখানের প্রধান দরজার ওপরে আরবিতে লেখা তিন লাইনের একটি শিলালিপি রয়েছে। ওই শিলালিপিতে লেখা আছে, ‘এই পবিত্র মসজিদ জাতি এবং ধর্মের খুঁটি। সুলতান সম্রাট সোলাইমান খান কররানীর আমলে নির্মিত এই মসজিদ। আল্লাহ তাঁকে সব আপদ বিপদ থেকে নিরাপদ রাখুন।’
শিলালিপির বক্তব্যমতে, এই মসজিদ সুলতান সোলাইমান খান কররানির (শাসনকাল: ১৫৬৫-১৫৭২) আমলে তৈরি। তবে লোকমুখে বখশি হামিদ মসজিদ বলে পরিচিতি পেয়েছে এটি।
এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি এবং ইতিহাসবিদেরা জানান, বখশি হামিদের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদুল হামিদ। বখশি ছিল তাঁর উপাধি। বখশি ফারসি শব্দ। আর এর অর্থ কালেক্টর বা করগ্রহীতা। তৎকালীন সময়ে আবদুল হামিদ এ অঞ্চলের কালেক্টর বা প্রশাসক ছিলেন। তিনি এলাকার শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। তিনিই এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা।
বখশি হামিদ মসজিদ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ইট, পাথর ও সুরকি। মসজিদের পূর্ব পাশে শানবাঁধানো ঘাট ও বড় পুকুর রয়েছে। ওই পুকুরের ঘাটেও নির্মাণ করা হয় মসজিদ নির্মাণের সময়। তবে ওই ঘাট সংস্কার করায় পুরোনো ইটের ওপর টাইলস শোভা পাচ্ছে। মসজিদের পশ্চিমে কবরস্থান, পূর্বে–উত্তরে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা, এতিমখানা ও ইসলামি কমপ্লেক্স।
জানা গেছে, ১৯৭০ সালে সরকার বখশি মসজিদকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। প্রত্ন বিভাগের তালিকায় তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদকে মোগল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালে এটি সংরক্ষিত (প্রটেক্টেড মনুমেন্ট অ্যান্ড মৌন্ডস) তালিকায় স্থান পাওয়ায় কিছু সংস্কার হয়েছিল। মোগল স্থাপত্যকৌশলে নির্মিত এ মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট, মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং ছোট গম্বুজ দুটি ধনুকের মতো করে ছাদের সঙ্গে যুক্ত। মসজিদটি ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৩ ফুট প্রস্থ।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের ভেতর থেকে ওপরের দিকে তাকালে বড়–ছোট মিলিয়ে তিনটি গম্বুজ। গম্বুজের ভেতরে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন রকমের অলংকরণ। মসজিদের সামনে দিঘির পাড়ে বখশি হামিদের সমাধি। সমাধির পাশে বটগাছ। মসজিদের সামনে সরকারের জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। সাইনবোর্ডে এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, মাঝখানে একবার মসজিদের মূল নকশা পরিবর্তন করে রং করায় আপত্তি জানিয়েছিল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এরপর মসজিদে শেওলা জমে গেলেও স্থানীয়রা আর সংস্কারে হাত দেননি। বর্তমানে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির অর্থসচিব শহীদুল ইসলাম বলেন, মসজিদে ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার ওপর খরচ হয়। মসজিদের দানবাক্সে পাওয়া অর্থ ও স্থানীয়দের সহায়তায় এসব খরচ মেটানো হয়।
শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, বর্তমানে সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এ মসজিদ দেখতে আসেন। ওই দুই দিন মুসল্লিও বেশি হয় মসজিদে।
বাঁশখালী উপজেলার গুনাগরী গ্রামের বাসিন্দা ও গবেষক আলমগীর মোহাম্মদ বলেন, ‘সাড়ে চার শ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদ মোগল স্থাপত্যরীতির এক অনন্য নিদর্শন। তবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শিগগিরই বখশি হামিদ মসজিদের সৌন্দর্য ক্ষয়ে পড়তে পারে। আমরা আশা করব সরকার এই নান্দনিক মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে। এর পরিচর্যায় দ্রুত লোকবল নিয়োগ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
যেভাবে যাওয়া যায়: শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে যেকোনো পরিবহনে পিএবি সড়ক (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) দিয়ে বাঁশখালী উপজেলার গুনাগরী খাসমহল এলাকায় নামতে হবে। সেখান থেকে পশ্চিমে মোশারফ আলী সড়ক হয়ে দুই কিলোমিটার গেলে মধ্য ইলশা গ্রামে ছায়াসুনিবিড় গ্রামে বখশি হামিদ মসজিদটির দেখা মিলবে।
![]() |
সুলতানি আমলে নির্মিত এই মসজিত সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মধ্য ইলশা গ্রামে। প্রথম আলো |
No comments