এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রড্রিগো দুতের্তে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) অধীনে জেল খেটেছেন একরাত। এই রিপোর্ট যখন শুক্রবার পাঠকের হাতে যাবে, তখন এই জেল খাটার মেয়াদ হয়তো দু’দিন হয়ে যাবে। সেখানেই তাকে বন্দিশিবিরে এ মাসে ৮০তম জন্মদিন পালন করতে হবে। হেগে অবস্থিত ওই জেলখানা এক সময় ছিল নাৎসিদের জেলখানা। সেখানে যাদেরকে আটক রাখা হয়, তারা সবাই একটি করে প্রাইভেট সেল, কমপিউটার, একটি লাইব্রেরি এবং খেলাধুলার সুযোগ পান। জেল কর্তৃপক্ষের দেয়া খাবার যদি পছন্দ না হয়, তাহলে জেলখানার কেন্দ্রীয় কিচেন থেকে শপিং লিস্ট ধরে জিনিস নিয়ে তিনি নিজেই নিজের খাবার রান্না করে খেতে পারবেন। হেগে বন্দি অবস্থায় তিনি চিকিৎসা সুবিধা, আইনজীবী এবং ভিজিটরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। দুতের্তেকে গ্রেপ্তারের পর বুধবারই তাকে নিয়ে বিমান আকাশে ওড়ে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছার পর দুতের্তেকে রাখা হয় জেলে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তাতে প্রাথমিকভাবে আদালতে হাজির করার কথা। সেখানে তিনি নিজের পরিচয় নিশ্চিত করবেন। আদালতে কোন ভাষায় বিচারকার্যক্রম অনুসরণ করতে চান, তা বাছাই করবেন। এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে যুক্তি-তর্ক তুলে ধরবেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। বুধবার ফিলিপাইনের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তেকে আইসিসির বন্দিশিবিরে নিয়ে গেলে সেখানে তার বেশ কিছু সমর্থক সমবেত হন। তারা জাতীয় পতাকা দুলিয়ে চিৎকার করতে থাকেন- ‘তাকে ছেড়ে দাও’। কিন্তু তাকে বহনকারী গাড়ি দ্রুতগতিতে লোহার গেট অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করে। ৭৯ বছর বয়সী দুতের্তে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছেন, তার জন্য তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তিনি ক্ষমা চাননি। তাকে নিয়ে বিমান নেদারল্যান্ডসে পৌঁছার পরপরই আইসিসি বলেছে, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে তার বিরুদ্ধে যৌক্তিক তথ্যপ্রমাণ আছে। তিনি প্রথমে ডাভাও-এর মেয়র ছিলেন। পরে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু এই দুই সময়েই তিনি মাদকের ডিলার, ব্যবহারকারী ও মাদকের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেন। সরকারি হিসাবে এভাবে হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৬ হাজার মানুষকে। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা হাজার হাজার হতে পারে। এর স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন দুতের্তে। তিনি বলেছেন, দেশের রাস্তাগুলোকে অপরাধমুক্ত রাখতে মাদকের ডিলারদের বিরুদ্ধে ছিল তার অভিযান। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো তার যুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছে। তারা বলেছে, দুতের্তের অভিযানের সময় পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। শহুরে গরিব যুবকদের টার্গেট করেছে তারা।
উল্লেখ্য, আইসিসিতে প্রথম কোনো এশিয়ান সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাচ্ছেন দুতের্তে। তিন বছরের মধ্যে সন্দেহজনকভাবে তাকেই প্রথম দ্য হেগে উড়িয়ে নেয়া হয়েছে। সোমবার হংকং থেকে রাজধানী ম্যানিলা বিমানবন্দরে অবতরণ করলেই গ্রেপ্তার করা হয় দুতের্তেকে। তার সমর্থকদের অভিযোগ, দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোসের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে আইসিসি। সবচেয়ে শক্তিধর যেসব ব্যক্তিকে জবাবদিহিতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না কোনো দেশের আদালতে বা তারা সেটা করার সক্ষমতা রাখে না অথবা করার ইচ্ছাও করে না, তাদের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল হলো আইসিসি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে হলে ওই দেশের সহযোগিতা লাগে। তাদের অনুমোদন লাগে। অনেক দেশই মাঝে মাঝে এমন গ্রেপ্তার দাবি প্রত্যাখ্যান করে। দুতের্তের ক্ষেত্রে আইসিসি যে বিচার করছে তা ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি যেসব কাজ করেছেন তার ভিত্তিতে। ২০২২ সালের নির্বাচনে রড্রিগো দুতের্তের মেয়ে সারা দুতের্তেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হবে এমন শর্তে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোসের সঙ্গে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শক্তিশালী জোট গঠন করে। ফলে কয়েক মাস আগেও আইসিসিকে সহযোগিতা করার ধারণাকে বাতিল করে দেন মারকোস। কিন্তু দুতের্তেকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং প্রত্যর্পণ করা হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওদিকে ম্যানিলা থেকে হেগে পৌঁছার পুরো পথে তার ওপর পাখির চোখ ছিল বিশ্ব মিডিয়ার। রড্রিগো দুতের্তের মেয়ে কিত্তি এবং দুতের্তে নিজে তার সহযোগীর মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদর্শন করেছেন। ফ্লাইট রাডারে সব থেকে বেশি চোখ ছিল তাকে বহনকারী বিমানে। ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে তিনি বলেন, আমি সেই ব্যক্তি- যে দেশের আইনপ্রয়োগকারী ও সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদেরকে সুরক্ষিত রাখবো। এসব কিছুর দায় আমি নিচ্ছি। দুতের্তেকে গ্রেপ্তারের এই ঘটনা শক্তিশালী একটি বার্তা দেয় যে, শক্তিধর ব্যক্তিদেরকেও তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে জাতীয় সার্বভৌত্বের সঙ্গে আইসিসির ভূমিকা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনের মতো আইসিসির সদস্য নয় এমন কিছু রাষ্ট্র এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ওদিকে দুটি হাইপ্রোফাইল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এখনো কার্যকর করতে পারেনি আইসিসি। তার একটি হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যজন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

No comments