শহীদ শাহরিয়ারের বাবা বললেন: আমার সন্তানের জীবনের বিনিময়ে দেশটা যেন সুন্দর হয় by ফাহিমা আক্তার সুমি

শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। গত ১৮ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি ডান চোখের উপরে লেগে মস্তিষ্কে বিদ্ধ হয়। দু’দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় শাহরিয়ার এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। পড়তেন ময়মনসিংহ ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজে। বাবা ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। পরিবার নিয়ে কুড়িল বিশ্বরোডে ভাড়া বাসায় থাকেন। শাহরিয়ার সুযোগ পেলেই ময়মনসিংহ থেকে বাবা-মা ও একমাত্র বোনের কাছে ছুটে আসতেন। সন্তানকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন বাবা-মা। একমাত্র বোন ভাইকে দিন-রাত খুঁজে ফিরছেন।   

শাহরিয়ারের বাবা মো. আব্দুল মতিন মানবজমিনকে বলেন, আমার সন্তান মাধ্যমিকে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। যখনই সুযোগ পেতো তখন ঢাকায় চলে আসতো। ও আমাদের একমাত্র ছেলে ছিল, অনেক সাধনার ও আদরের ছিল সবার। তার এই অল্প বয়সে চলে যাওয়াটা আমাদের পরিবারের জন্য অনেক কষ্টের। সন্তান শহীদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্নও শহীদ হয়ে গেছে। আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি। সন্তান ছাড়া বেঁচে থাকাটা কষ্টের। সন্তানের স্মৃতি নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। ওর মা মমতাজ বেগম সারাদিন কাঁদতে থাকে, ওর একমাত্র বোন মুমতাহিনা বিনতে মতিন কাঁদতে কাঁদতে ভাইকে খোঁজে। আমাকে বলে আব্বু ভাইয়া কোথায় গেছে, ভাইয়াকে নিয়ে আসো। এই ছোট বাচ্চাটাকে কীভাবে বুঝাবো যে, ওর ভাই আর আসবে না। ওর মা ঘুমের ঘোরে কেঁদে কেঁদে উঠে। কী বলে সান্ত্বনা দিবো তাকে। সারা পৃথিবী এনে দিলেও সন্তানের শূন্যতা পূরণ হবে না।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ১৮ই জুলাই আমি গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ ছিলাম। মাগরিবের নামাজ পড়ছি- হঠাৎ আমার মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। নামাজ শেষে কল ব্যাক করে শুনতে পাই আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন আমি আমার ভাগ্নেকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাস্তায় নানা বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে রাত ১টায় ঢাকায় এসে পৌঁছাই। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখি আমার ছেলে আইসিইউতে ভর্তি। তার ডান চোখের উপরে গুলি লেগে মস্তিষ্ক বরাবর ঢুকে যায়। কোনো সিটিস্ক্যান করেনি, কিছু করেনি, খুব মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল আমার সন্তান। তখন তার দুই খালাতো ভাই সঙ্গে ছিল। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মিরপুরের স্থানীয় দু’টি হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। সেখানে ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দিলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। আমি মেডিকেলে গিয়ে চিকিৎসকদের অনেক রিকুয়েস্ট করি। তাদের বলি আমার সন্তানকে বাঁচাতে চাই, যেখানে নেয়া লাগে সেখানে আমার সন্তানকে নিবো। তারা বললেন, ‘দেখেন খুব একটা অবস্থা ভালো না।’ গুলিটি বেরিয়ে যাইনি মস্তিষ্কে গিয়ে লাগে। দুইদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ২০শে জুলাই মারা যায়। তিনি বলেন, একদিকে আমার সন্তান হারিয়েছি আরেক দিকে মরদেহ নিয়ে আরেক যুদ্ধ। সেদিন যে আমার সন্তানকে নিয়ে যাবো সেই সুযোগ ছিল না। জিডি করতে মিরপুর মডেল থানায় যাই- সেখানে জিডি নেয়নি। সেখান থেকে হতাশ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে গেলে পাশে থাকা এক ব্যক্তি শাহবাগ থানায় জিডি নিচ্ছে বলে জানায়। এ কথা শুনে ছুটে যাই শাহবাগ থানায়। সেখানে রাত হওয়ায় জিডি নেয়নি; সকালে যেতে বলেছিল। পরের দিন শাহবাগ থানায় জিডি করি এবং রাত আটটার সময় আমার সন্তানের মরদেহ বুঝে পাই। সেখান থেকে রাতে ময়মনসিংহ নিয়ে যাই। পরের দিন সকালে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আমার আদরের সন্তানকে। ওর স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে বড় ব্যবসায়ী হবে। আমিও তাকে অনুপ্রেরণা দিতাম। অনেক মেধাবী ছিল আমার সন্তান। সেদিন শাহরিয়ার প্রথম আন্দোলনে যায়। ১৬ই জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনের বিষয়টি তার মাথায় ছিল না। পরে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে নেমে যায়। মাত্র ৫টা পরীক্ষা দিতে পেরেছিল। ২০০৫ সালে ঢাকাতেই ওর জন্ম হয়। আমাদের প্রথম সন্তান ছিল শাহরিয়ার।       
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে বড় ছিল আর মেয়ে ছোট। আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। শাহরিয়ার ময়মনসিংহ ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছিলো। গত ৯ই জুলাই মাত্র পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। ১০ থেকে ২০শে জুলাই পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকায় এই সুযোগে চলে আসে ঢাকায়। তার মাও তাকে চলে আসতে বলে। কুড়িল বিশ্বরোডে ভাড়া বাসায় থাকি পরিবার নিয়ে। আমি গ্রামে গিয়েছিলাম তার মা ও বোন বাসায় ছিল। ১৬ই জুলাই ছেলে সারাদিন বাসায় ছিল; সন্ধ্যার দিকে চলে যায় মিরপুর-২ তার খালার বাসায়। সেখান থেকে ১৮ই জুলাই তার খালাতো ভাইদের নিয়ে আন্দোলনে যায়। সেদিনই গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি। তিনি বলেন, তবে সান্ত্বনাটুকু হলো আমার সন্তান দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, ভালো কাজে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছে। আমরা চাই- আমার সন্তানসহ অন্য শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এই অর্জিত স্বাধীনতার মাধ্যমে দেশটা সুন্দর হোক। এখন দুর্নীতি এবং বৈষম্যবিহীন একটি রাষ্ট্র তৈরি হলে আমার সন্তান ও বাকি শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.