আব্দুস শহীদ উপাখ্যান: মৌলভীবাজারে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও কোন্দল সৃষ্টির ‘মাস্টার মাইন্ড’

একাধিক হত্যা মামলায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার ও বাসায় পাওয়া নগদ দেশি ও বিদেশি কয়েক কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধারের খবরে সবার চোখ ছানাবড়া। তবে কি তাকে নিয়ে আগে থেকেই বয়ে চলা নানা মন্তব্য সঠিক। এখন জেলা জুড়ে অবৈধপন্থায় হঠাৎ ধনকুবের বনে যাওয়া পতিত সরকারের কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদকে নিয়ে চলছে এমন আলোচনা। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও দলীয় কোন্দল সৃষ্টির ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবেই নিজ জেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে তার পরিচিতি। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মামলা-হামলায় দমন নিপীড়নে তার ভূমিকা সবসময়ই সক্রিয়। তিনি উপাধ্যক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা, ড. মো. আব্দুস শহীদ। মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল) আসনের ৭ বারের এমপি। ছিলেন হুইপ, প্যানেল স্পিকার ও সর্বশেষ ৭ মাসের কৃষিমন্ত্রী। জেলা আওয়ামী লীগের এক মেয়াদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে থাকা সভাপতিও। নামের আগে উপাধ্যক্ষ ও সর্বশেষ যুক্ত ডক্টরেট এবং মুক্তিযোদ্ধা উপাধী নিয়ে জেলা জুড়ে রয়েছে নানা আলোচনা। তকমা আছে নিজ জেলার উন্নয়ন বিদ্বেষী হিসেবেও। দীর্ঘ মেয়াদে এমপি ও মন্ত্রী থাকার পরও নিজ এলাকায় নেই দৃশ্যমান উন্নয়ন। মেডিকেল কলেজ, চা নিলাম কেন্দ্র, শমসেরনগর বিমান বন্দরসহ বড় প্রকল্পের উন্নয়ন বাস্তবায়নে নেপথ্যে বাধার কারণ তিনি। এমন অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। এর অন্যতম কারণ নিজের আধিপত্য ধরে রাখা ও দলীয় কোন্দল জিইয়ে রাখা। ক্ষমতার দাপটে অবৈধপন্থায় নীরবে সরব ছিল তার টাকা উপার্জনের নানা ফন্দি ফিকির। দেশ ও বিদেশে বানিয়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ইশারা ছাড়া বাস্তবায়িত হতোনা সরকারি কোনো প্রকল্প।

অভিযোগ রয়েছে বালু মহাল, জলমহাল, সরকারি, বেসরকারি নানা প্রকল্প। এমনকি শ্রীমঙ্গলের ভুনবির, মির্জাপুরসহ অন্যান্য ইউনিয়নের অবৈধ বালু উত্তোলন থেকে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান গাছ কেটে বিক্রি পর্যন্ত। বৈধ ও অবৈধ ছোট-বড় সব কাজ ও আয় রোজগারের একটি বড় অংশের টাকার ভাগ আসতো তার হাতে। এর ব্যত্যয় হলেই নানা হয়রানি। এভাবেই তিনি হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। তার নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী করতে ৩ ভাই ও বড় মেয়েকে দলীয় পদ-পদবী দিয়ে নিয়ে আসেন জন সম্মুখে। প্রভাব খাটিয়ে তার ছোট ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান, ইফতেখার আহমদ বদরুলকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মোসাদ্দেক আহমদ মানিককে বানান মুক্তিযোদ্ধা ও কমলগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর বড় মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নাকে পদ দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের। উদ্দেশ্যে ছিল আগামীতে সংসদ নির্বাচনে সদস্য বানানো। এজন্য রাজনীতির মাঠে তার সঙ্গেই রাখতেন মেয়েকে। এ নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে তিনি পাত্তাই দিতেন না। বলা চলে সংসদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, শহীদ পরিবারের ছিল একক আধিপত্য।

সূত্রমতে, মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল) সংসদীয় আসনে ১৯৯১ সাল থেকে নানা কৌশলে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত টিকিয়ে রাখেন তার এমপিত্ব। জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকাকালে জেলা জুড়ে দলীয় অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং দ্বন্দ্ব ছিল চরমে। প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলীর সঙ্গে দলীয় দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্যে। ওই সময় দলের একটি বড় অংশকে কোনঠাসা করে রাখতে তিনি তটস্ত ছিলেন। নানা কূট কৌশলে দীর্ঘদিন জেলার শীর্ষ দলীয় পদ ধরে রাখেন। আর ওই ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েন। এমন অভিযোগ দলীয় নেতাকর্মীসহ জেলাবাসীর। এ ছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে চা-বাগান গড়ে তুলে উদ্যানের ৭-৮ একর পাহাড়ি জমি দখলে নেন। সরকারি খরচে ওই বাগানে বিদ্যুৎ সংযোগসহ স্থাপন করেন ১৫-২০টি ডিপটিউবওয়েল। কাঁঠালকান্দিতে ১০-১৫ একর পাহাড়ি এলাকায় বাগান বাড়ি। সেখানে সরকারি খরচে ডিপটিউবওয়েল ও সৌর প্ল্যান্ট নির্মাণ। হাইল হাওরে বাইক্কা বিলের পাশে প্রায় ১৫-২০ একর জমির বিশাল মৎস্য খামার।

অভিযোগ রয়েছে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে পাখি ও মাছের নিরাপদ অভায়াশ্রম বাইক্কা বিলের কান্দি থেকে এক্সেভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটে পাড় তৈরি করেন ওই খামারের। কমলগঞ্জ মাঝেরছড়ায় কয়েকশ’ বিঘা টিলায় লেবু বাগান। রাজধানীর উত্তরা ১০নং সেক্টর, ২নং রোড ৩৫নং বাসা, ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের জগদীশপুর পেট্রোল পাম্প, ঢাকার ফার্মগেইট এলাকায় ঘরসহ জমি ও দোকান। শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের দিলবরনগরে প্রায় ১০ একর জমিতে লেবু বাগান। শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোডে পাঁচতলা ভবন। মৌলভীবাজার রোডে হাউজিং এস্টেটে বাসার জায়গা। কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন বাসা। গ্রামের বাড়িতে সরকারি খরচে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে সোলার লাইট স্থাপন ও পুকুর খনন। এ ছাড়া লোক মুখে প্রচলিত আছে তার নামে-বেনামে কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে বাড়ি রয়েছে। ২০১২ সালে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তার চাহিদানুযায়ী বিধি লঙ্ঘন করে গ্রামের বাড়িতে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্যাস লাইন দেয়। ২৯শে অক্টোবর তার গ্রেপ্তারের খবরে নিজ নির্বাচনী এলাকার নির্যাতিত মানুষসহ জেলা জুড়ে আনন্দ মিছিল করে জনতা। এ সময় তারা তার অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.