গল্প- শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ by সুশান্ত মজুমদার
সুনীলের
জীবনে সেই একসময় এসেছিল চারপাশে যখন চরম মৃত্যু। মফস্বল ছেড়ে নদী পার
হওয়ার কালে সে জলে মানুষের গলিত শব দেখেছিল। তিনদিন সুনীল ঘুমাতে পারেনি।
গুলি-আগুন-হত্যাযজ্ঞ-ভস্মীভূত চরাচর দেখে সুনীল হয়ে উঠেছিল সহ্যক্ষম নিরেট
প্রতিবাদী লোহা। নিজে বাঁচতে, মানুষ বাঁচাতে এবং দেশের মাটির দখল রাখতে সে
হয় সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় বহন করে সে ফিরে এসেছিল ধ্বংসত্মূপের নিচে
চাপাপড়া নিজের শহরে। তাদের ঘর-দরজা উধাও – ভিটে চাষ করে সস্তা তরকারির গাছ
লাগিয়েছিল দুশমন রাজাকাররা। স্বাধীনতার জন্য মানুষকে ত্যাগ-বিসর্জন দিতে
হয়। বারোয়ারি সুনীল সামর্থ্য, প্রতিষ্ঠা, আশ্রয় উৎসর্গ করে মিশে যায়
মানুষের ভিড়ে। সময়ের স্রোতে ঘাটে ঘাটে ঘুরে হয় এক অফিসের কর্মচারী। মাথার
ওপর ভাঁড়ার ছাউনি, লবণাক্ত পুরনো দেয়াল, গোঁজামিল দেওয়া কৌটার দাম্পত্য
সম্পর্ক নিয়ে সুনীলের দিনযাপন। তার বর্তমান আখ্যানের একটি টুকরো এখানে
বিবৃত হলো।
মাঝারি গোছের রোজগেরের আবার গোছালো ড্রয়িংরুম; গোঁজামিলে ভরা গৃহস্থের ওই বিশেষ নামের সামনের রুমের অল্প পরিসরে তিন বেলা খাওয়ার, অষ্টপ্রহর বসার সুযোগ; আর রাতে হাত-পা ছড়িয়ে এর মেঝেতে চাদর বা কাঁথা পেতে ব্যবস্থা হয় আঠালো ঘুমের। রুমের উত্তর-পূর্ব কোণে পাতা সাধারণ একটা ডাইনিং টেবিল, তিনটি ফালতু চেয়ার, এ-পাশে রাখা রংজ্বলা মোটা কাপড়ে আঁটা ছোট্ট দুটো সস্তা সোফা। ভেতরের রুমে ঢোকার দরজার পাশের এমন একটা সোফায় সুনীল গা ছেড়ে বসা। সিঁড়ি থেকে পায়ের শব্দ উঠে আসছে। ভেজানো দরজা ঠেলে দীপু ভেতরে ঢোকে। বয়সের চেয়ে পুষ্ট অপেক্ষাকৃত লম্বা বাসার এই ছোট ছেলেটা বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই মিষ্টি করে হাসে। পাশ কেটে সে ভেতরে চলে যায়। ব্যাপার কী! মুহূর্তে ভুরু বেঁকে আসে সুনীলের। ছেলের শরীর থেকে যেন সিগারেটের গন্ধ ভেসে এলো। এবার লম্বা করে সে শ্বাস টানে – হ্যাঁ নির্ভুল, গন্ধ সিগারেটেরই। তাজ্জব হয়ে সুনীল ধীরে ধীরে জমে যেতে থাকে – বয়স কেবল উনিশ, সেদিনের ছেলে, আরে মুখ থেকে যার পুরোপুরি দুধের গন্ধ যায়নি, এই সে বাবা-মার চোখের আড়ালে দিব্যি সিগারেট টানছে!
ভাবতেই সুনীলের মাথার মধ্যে সহসা খর প্রশ্ন ছোঁ মারে – এত তাড়াতাড়ি এই বয়সে একা একা তো নেশা জমে না, নিশ্চয় সঙ্গদোষ। তা-ই যদি হয়, কাদের সঙ্গে ছেলে মিশছে, বন্ধুবান্ধব কারা, খোঁজখবর নেওয়া জরুরি। এ-সময় আরতি ভেতর থেকে জলভর্তি একটা জগ এনে টেবিলে রাখে। ছেলের মা থাকে সর্বক্ষণ বাসায়, সে কি আদৌ জানে না? টের পায়নি? ছোট ছেলের মৌতাত বিষয়ে কথা শোনা ও শোনানোর এই তো সুযোগ। রাগ জুড়িয়ে যাওয়ার আগে আগে দু-চারটা গরম বাক্য না রাখলে মন ঠান্ডা হবে না। সুনীলের স্বর যেন বর্শা ছুড়ে মারে – ‘তুমি জানো কিছু?’
স্বামীর শক্ত গলার অমন ঘণ্টা আওয়াজে আরতি ঘুরে দাঁড়ায়। কী জানব? হঠাৎ জানাজানির ঘটনা কী! তার চোখেমুখে জিজ্ঞাসা ফুটে ওঠে – মানুষটা কী বলতে চায়?
সুনীলের নজর খসে নিচে পড়লে সে দেখে, আরতির ডান হাতের আঙুল হলুদ। ও, এখন রান্না করছে। ছোট ছেলের সিগারেট টানাটানি নিয়ে কথা ঘোলা করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। আরতিকে চলে যেতে সুনীল ইশারা করে।
কখনো কি সে সিগারেট টেনেছে? হারানো-ফুরানো স্মৃতি খুঁড়ে তুলতে নিজের স্মরণের ওপর চাপ রাখে সুনীল। না, স্কুলজীবনে গোঁফের রেখা ফুটে ওঠার আগে-পরে ক্লাসের কেউই ধূমপানে ছিল না। ওপরের ক্লাসের কোনো ছেলেকেও ছুটিছাটায়, কি দুষ্টুমি করে সিগারেট টানতে সে দেখেনি। বয়স হলে কেবল বড়দের কেউ কেউ বিড়ি-সিগারেট খায়, এমন ধারণা চালু ছিল। কলেজে পড়াকালে তাও বিএ পড়ার সময় বন্ধুরা আড্ডা মারতে মারতে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ঘুরে ঘুরে তার আঙুলে এলে জোরে টান দিয়েছিল সুনীল। ব্যস, কণ্ঠার কাছে ধোঁয়া আটকে গেলে শুরু হয় বেজায় খকখক কাশি, জল জমে যায় চোখে। ওই প্রথম ওই শেষ তার সিগারেট টানা। মফস্বলবাসী তার বড় ভাই, সত্তরের কাছাকাছি যার বয়স, এখনো শক্তসমর্থ, আজো বাসার বাজার সে নিজ হাতে করে, রান্নার কাঠ ফাড়তে কুড়াল তুলে সে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। কই, তার সিগারেট কেন, শখ করে হুক্কা টানার কথাও কখনো শোনা যায়নি। তাহলে? তার বড়-ছোট দুই ছেলে কি বাপ-জ্যাঠা থেকে কিছুই শেখেনি? নাকি তার ভুল – ঠিকঠাক চালচলন, জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে সে ব্যর্থ হয়েছে?
সুনীলের খুব ভেতরে, দৃষ্টির অগোচর বিভিন্ন কোটরে টান পড়ে। তাৎক্ষণিক জখমবোধ জেগে উঠতে উঠতে থমকে যায়। তার বদলে মন দখল করা জিদের উদয় হয়। ছেলের সঙ্গে কি ঝাঁজালো বাক্যে বোঝাপড়া করবে? নাকি এবারের মতো এড়িয়ে হাতেনাতে সিগারেট ধরার জন্য সে অপেক্ষা করবে? নাকি কিছুই দেখিনি, কিছুই বুঝিনি গোছের মুখ তার নিরীহ রাখবে? আপত্তি করার ভঙ্গিতে নিজে নিজে মাথা নাড়ে সুনীল – না, চুপ থাকার সুবাদে ছেলের সাহস ক্রমাগত বেড়ে যেতে পারে। দেখা গেল, হাত নামমাত্র আড়ালে রেখে কিংবা বাবা যখন বাসাতে নেই দীপু তখন রুমেই সিগারেট টানছে। অবস্থা হচ্ছে, ও সিগারেট খায়, বাবা তো জানে। আর মা, ধুস কোনো ব্যাপার হলো।
সুনীল টের পায় তার মেজাজে উষ্ণতা ক্রমশ জ্বাল পাচ্ছে। না, কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। শাসনে না-রাখলে এমন কাঁচা বয়স থেকেই ছেলেপেলে উচ্ছন্নে যায়। এখুনি লাগাম না পরালে সর্বনাশ, কালে কালে আরো মন্দ আচরণে ছেলে সাহসী হতে পারে। পুরোপুরি নেশাভাংয়ে জড়িয়ে গেলে ছেলে নিজের ভবিষ্যৎ পয়মাল করে ফেলবে। তাহলে উড়নচন্ডী স্বভাবের বড় ছেলে নিপু, যে এখন পূর্ণ যুবক, যার সর্বাঙ্গে সিগারেটের গন্ধ, যার গা-ঘেঁষে কেবল হেঁটেই গেলে যে কারো নেশা হয়ে যাবে, এই তাকে কেন সদয় প্রশ্রয় দেওয়া? ভেন্টিলেটরের গস্নাসভাঙা বারান্দার বাথরুমে রাতে ফস করে ম্যাচকাঠি জ্বলে কোন হিম্মতে? বারিধারার ওদিকে পরিচ্ছন্ন বাড়ির এক অ্যাড ফার্মে তার চাকরি। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে শান্তিনগর থেকে সকালে যায় – রাতে ফেরে। কোনো কোনো রাতে সুনীল ঘুমিয়ে পড়ার পর ছেলে আসে। পরদিন আরতির থমথমে মুখ দেখে সে পরিষ্কার অনুমান করে – বেসামাল ছিল নিপু। মাসের পয়লা সপ্তাহে মায়ের স্নেহময় হাতে, হাজার দশেক টাকা দিচ্ছে বলে তার নেশা-চড়ানো আরাম দেখে-শুনে-বুঝে নীরবে অনুমোদন করা ন্যায্য কথা নয়। এই এলোমেলো চালচরিত্র নিয়ে বড়ভাই কেমনে তার বছর পাঁচেকের ছোটভাইকে গাইড করবে? ভাইকে করবে সে দেখভাল? অসম্ভব। পারে তো তিনতলা থেকে দৌড়ে নেমে ফুটপাথের টং দোকান থেকে রাতে সিগারেট আনতে ছোটভাইকে সে অর্ডার দেয়। অসাধ্য কিছু না, জ্বলন্ত অর্ধেক সিগারেট নিপু ছোটভাইয়ের ঠোঁটে গুঁজে দিতে পারে।
খুব ভেতরের নিবিড় জখম বোধে সুনীল সহসা উতলা হয়ে ওঠে। অবশ্যই তারও অনুচিত হচ্ছে, নিপুর আয়ের অংশে সংসার খরচের সংস্থান হয় জেনে ছেলের তৈরি করা ত্রুটি মুখ বন্ধ রেখে দেখে যাওয়া। সন্তানের জন্মদাতা সে, এদের ভরণপোষণ শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার দায়িত্ব তার। তুমুল টানাটানির কারণে ক্লান্ত হলেও এই গুরুভার বহনে পারতপক্ষে সুনীল কার্পণ্য করেনি। সন্তানের সাধ-আহ্লাদ-দাবি-চাহিদা সব আবদার পূরণ করলে তাদের কার্যকলাপের জবাবে ন্যায্যকথা শুনিয়ে দেওয়ারও অভিভাবক সে।
সুনীল বোঝে, নিপু তার দোষ ওয়াকিফ বলে আগে থেকেই বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস সে হারিয়েছে। কখনো সামনে পড়লে এমন দৌড়চালে বাবার নজরের বাইরে সরে যায় যেন বাথরুমে যাওয়ার চাপে আছে সে। ছেলের রুম দিয়ে যেতে যেতে সুনীল থমকে কখনো দৃষ্টি দিলে দেখা গেল নিপু কম্পিউটারে এমন মনোযোগ ধরে রেখেছে যে, কোনো মানুষের উপস্থিতি আদৌ সে টের পাচ্ছে না। চোখ কম্পিউটারের টার্মিনালে স্থির। বাকি থাকে যে দুই কান তাও গান বা সিনেমার সাউন্ড উপযুক্তভাবে শোনার জন্য হেডফোন দিয়ে ঢাকা। কোনো ডাকাডাকি ছেলের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। সময় যায়, খেতে আসার জন্য মায়ের এতো নরম-গরম, সরু-মোটা চেঁচামেচি করা স্বর, কীসের কী, সব বৃথা। হেডফোন লাগিয়ে এমন মানুষ অগ্রাহ্য সুনীলের কাছে রীতিমতো বেয়াদবি মনে হয়।
ভাবতেই তার মাথা থেকে গরমের চড়া আঁচ নেমে আসে। খানিক ঝিম মেরে নিজের ত্রাণ নিজে ধরে রাখতে সে কৌশল নেয়। তার পজিশন নস্যাৎ করে গোঁয়ার অশিষ্টতা সে দেখাতে যাবে কেন? হোক তার সন্তান, এই জামানার কা-জ্ঞানহীন ছেলেপেলের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া আলাপ না-করাই উত্তম। এর ফল হয়েছে : বড় ছেলের সঙ্গে সুনীলের বাক্যালাপ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। উভয়ের মধ্যে পাতলা হলেও অদৃশ্য একটা দেয়াল উঠেছে। ছেলে ভাবছে, এটা বুঝি তার জন্য দারুণ সুবিধার – বাবা তো কিছু বলছে না। ইচ্ছামতো রাতে সে বাসায় ফিরছে। তার যাওয়া-আসা দিনযাপনের সঙ্গে বাবার কোনো সম্পর্ক নেই। কী মজা! যত ঘোরালো-প্যাঁচালো কথা হোক, কি স্বর মোলায়েম করে কিছু আদায় করার মতলব হোক, সব তার মায়ের সঙ্গে। মাও ছেলের পর্ব স্বামীর কাছে তোলে না। আরতি জানে, নিপু প্রসঙ্গে পেশ করলে সুনীলের এক কথা – ‘ভাত বন্ধ করে দাও।’ আরতি তখন কোন্দল করা অসমেত্মাষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় – ‘তুমি দাও। তোমার বাসা। আমার কী, ছেলে তো আমার একার না।’ এরপরই আরতির স্বরে মেঘোদয় হয় – ‘গত জন্মে মনে হয় পাপ করেছিলাম। এ জন্মে তাই প্রায়শ্চিত্ত করছি।’ বোঝো এবার, ঘরের বউয়ের খেদ-আক্ষেপ, হা-হুতাশে যদি জোর বাড়ে, তার চিল-চেঁচানি আশপাশের জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে যায়, তবে মানুষজন ভাববে কী – স্বামীটা নির্ঘাৎ ইতর, বউয়ের সঙ্গে খালি দুর্ব্যবহার করে।
সুনীলের মানহীন মলিন ভাড়া বাসাটা শান্তিনগরের এক গলি রাস্তার ভেতর দিকের পুরনো তিনতলায়। সিলিং-দেয়াল-বাথরুম-রান্নাঘর সবখানে এখন বাসিগন্ধের প্রলেপ। স্বাস্থ্যহানিকর দাগি বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও একখানা আরাম কুরসিতে বসবে এমন সামর্থ্য তার নেই। এদিকে পরিচয়দানে অযোগ্য যে চাকরির কলম পিষে কালো চুল সাদা করে এনেছে সেখানে বেতন বাড়ছে না। হাজার হাজার বেকার থেকে সুলভে অফিসে লোক পাওয়া দুষ্কর নয়। মালিক মহোদয় এখনো তাকে এই বয়সেও কাজে রেখে বেতন দিয়ে যেন ধন্য করছেন। তার মনোভাব এমন : পুরনো কর্মচারী, পয়লা থেকে আছে, কী আর করা।
সুনীলদের মুখোমুখি সামান্য দূরে নতুন একটা বিল্ডিংয়ের চারতলার ছিমছাম ফ্ল্যাটের ফর্সা ভদ্রলোক সম্প্রতি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। পেনশন বাবদ তিনি মোটা অংক – লাখ লাখ টাকা পাবেন। হাওয়ায় উড়ে আসা এমন লোভনীয় খবর শুনে আরতি স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিল, তার অফিসেও পেনশনের সুব্যবস্থা আছে কিনা। সুনীল দুর্বোধ্য চাহনি দেয়, যেন ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। বছরে দুবার তার চাকরিতে বেতনের সিক্সটি পার্সেন্ট বোনাস ছাড়া আর কোনো আর্থিক সুবিধা নেই। বউয়ের জিজ্ঞাসার সামনে ঠোঁটে আঠা জমিয়ে সে চুপ করে আছে দেখে শুরু হয় আরতির ঠেসবাক্য। তাহলে আগামী দিনগুলো সচল বলো কি জীবিত বলো নির্ভর করতে হচ্ছে ছেলের চাকরির ওপর। দাঁড়াচ্ছে কী, ছেলের পেছনে খরচ করেছি, এখন অন্নজলের জোগান দিক সে। ছেলে তখন চাটি মারলেও তা হজম করো। ধুর, তীব্র আপত্তি সুনীলের মাথার মধ্যে শোর তোলে। মেরুদ–বাঁকা জীবন তার কাম্য নয়। আচ্ছা, গড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই সংসারে মাত্র চারটি প্রাণী। দেখো, এদের চার চরিত্র। ভাবতেই বড়ছেলের আরেকটা দোষ সুনীলের সামনে খাড়া হয়। সবকিছুতেই ছেলের তাড়াহুড়ো। এতো ডাকাডাকি, আসে না আসে না, হঠাৎ খাওয়ার টেবিলে এসে হামলে পড়ে সে। টেবিলে খাওয়ার কী কী আছে সব ঢাকনা তুলে সে তদন্ত করে। মেঘবাদল না থাকলে ভোরে সুনীল হাঁটতে বের হয় – অনেক দিনের অভ্যাস। রমনা পার্কে চক্কর মেরে ফেরার সময় বেইলি রোডে বসা ভাসমান বাজারের মাছ-তরকারি সে প্রায়ই কিনে আনে। তরকারির দাম নাগালের মধ্যে থাকলেও তার মতো নির্দিষ্ট উপার্জনের মানুষের মাছ কেনার ক্ষমতা দিনে দিনে ক্ষয়ে আসছে। সাধারণ গুঁড়ো মাছের দাম পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে এখন। খদ্দেরদের ওপর মাছ-বিক্রেতার এমন দৃষ্টি – কিনবেন না, বেশ, মাছের ওপর চোখ দেওয়ার কারণে পারলে কিছু পয়সা দিয়ে যান। খরচের নাগালে থাকা মাছ ছাড়া কী কিনবে সে। দেখো, তেলাপিয়া মাছের রান্না, উঁহু, ধুস – মুখে ভেংচি রেখে নিপু নিজস্ব অপছন্দের আওয়াজ রুমে ছুড়েই যায় – ‘এসব হাবিজাবি খাওয়া যায়? হলিডে, কোথায় বেটার কিছু থাকবে।’ অসাধ্য এক উত্তেজনা মুহূর্তে সুনীলকে দখল করে; আর তা বেরিয়ে আসতে আসতে কণ্ঠে পাথুরে শব্দ হয়ে যায় – ‘ভালো কিছু বাজার থেকে আনলে হয়। কখনো তো দেখলাম না।’
শেষবাক্যের জবাবে জোর পদক্ষেপে নিপু রুম ছেড়ে যায়। এ-সময় ভাতের গামলা হাতে আরতি কেবল রুমে ঢুকেছে, বড়ছেলে অমন অন্ধকার মুখে চলে যাচ্ছে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর ওপর সে বাঘাটে চাহনি তুলে ধরে। তার চালু খরখরে স্বরের ধারে সুনীল এবার চেরাই হতে থাকে – ‘ছেলেটার পেটে আছে কিছু, সেই সকালে এককাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছে। এখন খাবে ভাত। তা না, ছেলেটাকে তিনি তাড়িয়ে ছেড়েছে।’ ভয়ংকরী রূপ ধারণে পায়ের শব্দ কিছুতেই আসেত্ম হয় না। হড়বড়ে পায়ে আরতি ভেতরে যায়।
এই ঘটনার সাত-আটদিন গেছে। বাবার মুখোমুখি পড়লে নিঃশব্দে নিপু পাশ কেটেছে – কথা বলেনি। হতে পারে, তার ভেতরে বলার মতো কোনো কথা জমেনি। কিন্তু চেহারাছবিতে পরিষ্কার সমেত্মাষ, আগের মতোই স্বাভাবিক। যথারীতি নিত্য অভ্যাসে ছোট পুত্তুর দীপু তার কথার ফোয়ারা চালু রেখেছে। আজগুবি থেকে নির্ভেজাল কত তার কথা। – ‘বুঝলে বাবা, আর দুদিন বাকি অ্যালান টিউরিংয়ের জন্মশতবার্ষিকীর।’
হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ, আর টিউরিং বা কার নাম! সুনীল হা-মুখে স্থির চেয়ে থাকে। কোন কথা থেকে কোন কথায় যে ছেলেটা চলে যায়। বাবার অবুঝ ফাঁপা-চাহনি দেখে দীপু নরম করে হাসে – ‘মাই ওল্ড ড্যাড। অ্যালান টিউরিংকে তুমি কেমনে জানবে? হ্যান্ড্রেড ইয়ার্স হলো, লন্ডনের প্যাডিংটন হসপিটালে কম্পিউটার সায়েন্সের এই ফাদারের জন্ম। দুঃখ কী জানো, বয়স ফর্টি টু হওয়ার আগেই সুইসাইড করে সে। তার ডেডবডির পাশে কামড় দেওয়া একটা আপেল পাওয়া যায়। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট : আপেলের সঙ্গে সায়ানাইড মেশানো ছিল।’
হঠাৎ দীপুর কম্পিউটার সায়েন্টিস্টের সুইসাইডের কথা কেন? আগেও কখনো কখনো কথাচ্ছলে জানা-অজানা মানুষের মৃত্যু নিয়ে সে বলেছে। ফিজিক্স হচ্ছে দীপুর প্রিয় বিষয়। এই ফিজিক্সের উদাহরণই সে বেশি বেশি টেনে আনে। তাহলে দাঁড়ালো কী, সুনীলের গত ও বর্তমান মিলিয়ে আটপৌরে জীবন, জানাজানি কম, শ্রোতা হওয়া ছাড়া কথকের খুব একটা সুযোগ তার হয় না। কিন্তু সুইসাইডের উদাহরণ তুলে প্রকারান্তরে সুনীলকে কি ভয় দেখায় দীপু? ছেলের মুখে আত্মহত্যার গল্প শুনলে ধীরে ধীরে শরীরে তার হিম ভেঙে আসে।
কেবল ছুটিছাটার দিনেই চার চেহারা খাওয়ার টেবিলে একত্র হয়। ছুটির কোনো কোনো ঝকঝকে দুপুরে টেবিলের একটা চেয়ার ফাঁকা থাকে। বড়ছেলের শখ নয়ন-নন্দন ছবি তোলার। ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর গড়িয়ে যায়। কোথায় নিজের রুমে বসে বিশ্রাম করবে, তা না, ছোটভাইকে পেলে তো কথাই নেই, শুরু হয় তার অনর্গল উচ্ছ্বাস – ‘বুঝলি, অফিসার্স ক্লাবের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ক্যামেরা অন করেছি, ও মা, পাশে দেখি মানুষ, ক্যামেরা দেখলেই ভিড়।’
নিপু গ্রাফিকসে মাস্টার্স। তার এক্সট্রা যোগ্যতার জন্য ডিএসএলআর ক্যামেরা চাই। ভালো, তার বেতনের টাকা জমিয়ে সে ক্যামেরা কিনবে – কিনুক। কিন্তু দাঁড়ালো কী, সংসারের এ-খরচ ও-খরচ ছাঁটাই করে হাজার দশেক টাকা ছেলের ক্যামেরার জন্য সুনীলকে দিতে হলো। কষ্টের এই ভোগ ছেলে কি বোঝে? বাবার মন ভেজাতে কিছু টাকা মাসে মাসে সে ফিরিয়ে দেবে বললেও ছেলের প্রতিশ্রম্নতির ওপর সুনীল আস্থা রাখেনি।
দীপু ছোট হলেও তার কথায় থাকে বিভিন্ন মোচড়। চালচলনে কোথায় জানি তার সেয়ানা ভাব। তার চাহিদা সে গচ্ছিত রেখেছে ভবিষ্যতের কাছে। বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা এখনো তৈরি হয়নি বলে বাবার ওপর বর্তমানে তার কোনো প্রেসার নেই। তবে এশিয়া-ইউরোপ না, উত্তর আমেরিকায় উড়ে যাবে, সেটেল সে ওখানে হতে চায়। ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় হলে কাজের ফাঁকে লেখাপড়া করবে। কানাডার এডুকেশন নাকি বেটার। ভ্যালু আছে, লেখাপড়া জানলে সব সহজ ওখানে। খুশি খুশি ভাব নিয়ে সে একাধিকবার বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে – ‘তুমি বলেছিলে তোমার কাস্টমসের রিটায়ার্ড কোন বন্ধু আছে, তার মেয়ে-জামাই দুজনে টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে আছে, যোগাযোগ রেখো, কাজে লাগবে।’ দীপুর ধারণা, এদেশে এখন চরম ডার্ক পিরিয়ড চলছে। কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই – ফিউচার জিরো।
বিস্ময়ে ছোটছেলের ওপর থেকে সুনীল চোখ সরাতে পারে না। এসব কি দীপুর নিজের কথা? দীপু জানে না ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কোনো সামর্থ্য তার বাবার নেই। বড়লোকের ছেলেপেলে বন্ধু হলে তাদের যাবতীয় সঙ্গদোষ মধ্যবিত্তের মধ্যে চালান হয়ে আসে। মেজাজ-মর্জি, চালচলন তখন ফুলে-ফেঁপে ঢোল। নিজের সীমানা নিয়ে সঠিক ধারণা থাকে না।
টিভি অন করে সুনীল। সাউন্ড কমিয়ে খবর শুনতে শুনতে পেস্নটে সে ভাত তুলে নেয়। দীপু বড়ভাইয়ের মুখে রগড়ে চাহনি দিয়ে এবার বাবার মুখ পড়তে তৎপর হয়। তার মুখে যথারীতি মিঠেল হাসি জ্বলছে। নিপু তার স্বভাব মোতাবেক বিরক্ত, খাওয়া নিয়ে সেই খিটিমিটি আছেই – ‘হাইব্রিড কই মাছ মানুষ ক্যামনে খায়? টেস্ট নেই – কাঁটা শক্ত।’ পারলে কই মাছ, এই মাছের গুষ্টি-গোত্র, এমনকি এই মাছের ক্রেতার ওপর দিয়ে সে মনের ঝাল মিটিয়ে নেয়।
ডাইনিং টেবিলে কোনো ছুতানাতায় নিপু তার অসমেত্মাষ ছড়িয়ে খাওয়ার পরিবেশ বিস্বাদ করে দিতে পারে ভেবে সুনীল সতর্ক থাকে।
টিভিতে সরকারের খবরের পর এবার বিরোধীদলের সংবাদ পড়া হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। সুনীলের পেস্নটে হাত, ঘাড়ে চাপ, চোখ টিভি স্ক্রিনের ওপর ধরা দেখে দীপুর বিরাগ স্বর উড়িয়ে বাবার মনোযোগ টলিয়ে দিতে চায়। – ‘বাজে প্যাঁচাল। ডার্টি পলিটিক্সের কী শোনো তুমি? বোর ফিল করো না?’ বড়ভাইয়ের সমর্থন আদায়ে দীপু তার আঙুলে টিপ দেয়।
নিপু অনেক অতলে বুঝি ডুবে ছিল, এতোক্ষণে তার হুঁশ ফিরেছে – ‘ও টিভি নিউজ রাবিশ’ বাবার উদ্দেশে এবার তার মোটা স্বর – ‘এত খবর দেখলে, নিজে কখনো খবর হলে না।’
পেস্নটে রাখা সুনীলের হাত এবার জমেই যায়। তাকে কি নিপু ব্যঙ্গ করছে? না এটা বাবার নিরুপদ্রব গোবেচারা জীবন নিয়ে সমব্যথী হওয়া ছেলের নিরীহ উক্তি – কোনটি? যেটাই হোক, একটা বিষয় পরিষ্কার – ছেলে বাবার পুরনো ডালে কিছুতেই বসার পক্ষপাতী নয়। ডানা সে ঝাপটাবে – উড়াল দেবে। ভালো ভালো।
– ‘টিভি বন্ধ করে দিই বাবা। কেউ তো দেখছে না।’ দীপু রিমোট টিপতে যাবে, তখুনি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে খবর শুরু হলে সুনীল হাত তুলে ছোট ছেলেকে নিবৃত্ত করে।
– ‘এই আর এক সাবজেক্ট!’
দীপুর বাঁকা কণ্ঠে সুনীলের অবাক হওয়ার পালা। ছেলেটা কি অসময়ে সাবালক হয়ে গেছে, নচেৎ অত কথা, কিংবা ঘটনার সঙ্গে অত জড়িয়ে পড়া কেন। বয়স্কদের মতো মুখভঙ্গি, বিষয় জটিল করে তোলা এত তাড়াতাড়ি শিখল কীভাবে? একেই তবে ইঁচড়েপাকা বলে। উত্তম, এক ছেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছে, আরেক ছেলে এই বয়সেই স্নব – দেশের কোনো কিছু ভালো লাগে না। মাথার মধ্যে পরবাসী হওয়ার ভাবনা।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। চক্রান্ত করে এই বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।’ – সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সচিত্র সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। দীপু এঁটো ডানহাত সামান্য তুলে হিসাব করে – ‘দুই হাজার উনিশ সাল এখন। যুদ্ধ হয়েছে উনিশশো একাত্তরে, আটচলিস্নশ বছর হলো, এতদিন আগের, এর ওপর তো ধুলো পড়ে গেছে বাবা -।’
দীপুর গাঢ় হিসেবি স্বর ও ধুলোর নির্যাতনের সম্ভাবনা টেবিলে-পেস্নটে-ফ্লোরে পড়ে ছড়িয়ে যায় – ‘তোমরা যারা ফ্রিডম ফাইটার, এখন কি মনে হয় যুদ্ধ করে ভুল করেছো?’
সুনীলের কশেরুকায় ঝাঁঝাঁ বেগে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ করে ভুল? কিসের ভুল? বলে কী ছেলে! মুক্তিযুদ্ধ না-হলে সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধেই তো তাদের উদ্বাস্ত্ত হতে হতো। কিংবা এতদিন পাকিস্তান নামের ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রের থার্ড ক্লাস নাগরিকের হীন পরিচয়ে থাকতে হতো। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা না-হলে কোথায় জন্মাত এই ছেলেপেলে। মুক্তিযুদ্ধ, অমন শ্রেষ্ঠ কীর্তির ওপর কেমনে ধুলো পড়ে।
‘ইম্পসিবল’ সুনীলের কণ্ঠছেঁড়া আওয়াজের প্রতাপে নিপু-দীপুর দুজনই বিস্ময়ে বাবাকে দেখে। অমন বাঁচা-মরার যুদ্ধের ওপর ধুলো, উঁহু, হতেই পারে না। সুনীল তার নাগালের টেবিলের অংশে দুহাত এগিয়ে ধুলো সরাতে সক্রিয় হয়।
মাঝারি গোছের রোজগেরের আবার গোছালো ড্রয়িংরুম; গোঁজামিলে ভরা গৃহস্থের ওই বিশেষ নামের সামনের রুমের অল্প পরিসরে তিন বেলা খাওয়ার, অষ্টপ্রহর বসার সুযোগ; আর রাতে হাত-পা ছড়িয়ে এর মেঝেতে চাদর বা কাঁথা পেতে ব্যবস্থা হয় আঠালো ঘুমের। রুমের উত্তর-পূর্ব কোণে পাতা সাধারণ একটা ডাইনিং টেবিল, তিনটি ফালতু চেয়ার, এ-পাশে রাখা রংজ্বলা মোটা কাপড়ে আঁটা ছোট্ট দুটো সস্তা সোফা। ভেতরের রুমে ঢোকার দরজার পাশের এমন একটা সোফায় সুনীল গা ছেড়ে বসা। সিঁড়ি থেকে পায়ের শব্দ উঠে আসছে। ভেজানো দরজা ঠেলে দীপু ভেতরে ঢোকে। বয়সের চেয়ে পুষ্ট অপেক্ষাকৃত লম্বা বাসার এই ছোট ছেলেটা বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই মিষ্টি করে হাসে। পাশ কেটে সে ভেতরে চলে যায়। ব্যাপার কী! মুহূর্তে ভুরু বেঁকে আসে সুনীলের। ছেলের শরীর থেকে যেন সিগারেটের গন্ধ ভেসে এলো। এবার লম্বা করে সে শ্বাস টানে – হ্যাঁ নির্ভুল, গন্ধ সিগারেটেরই। তাজ্জব হয়ে সুনীল ধীরে ধীরে জমে যেতে থাকে – বয়স কেবল উনিশ, সেদিনের ছেলে, আরে মুখ থেকে যার পুরোপুরি দুধের গন্ধ যায়নি, এই সে বাবা-মার চোখের আড়ালে দিব্যি সিগারেট টানছে!
ভাবতেই সুনীলের মাথার মধ্যে সহসা খর প্রশ্ন ছোঁ মারে – এত তাড়াতাড়ি এই বয়সে একা একা তো নেশা জমে না, নিশ্চয় সঙ্গদোষ। তা-ই যদি হয়, কাদের সঙ্গে ছেলে মিশছে, বন্ধুবান্ধব কারা, খোঁজখবর নেওয়া জরুরি। এ-সময় আরতি ভেতর থেকে জলভর্তি একটা জগ এনে টেবিলে রাখে। ছেলের মা থাকে সর্বক্ষণ বাসায়, সে কি আদৌ জানে না? টের পায়নি? ছোট ছেলের মৌতাত বিষয়ে কথা শোনা ও শোনানোর এই তো সুযোগ। রাগ জুড়িয়ে যাওয়ার আগে আগে দু-চারটা গরম বাক্য না রাখলে মন ঠান্ডা হবে না। সুনীলের স্বর যেন বর্শা ছুড়ে মারে – ‘তুমি জানো কিছু?’
স্বামীর শক্ত গলার অমন ঘণ্টা আওয়াজে আরতি ঘুরে দাঁড়ায়। কী জানব? হঠাৎ জানাজানির ঘটনা কী! তার চোখেমুখে জিজ্ঞাসা ফুটে ওঠে – মানুষটা কী বলতে চায়?
সুনীলের নজর খসে নিচে পড়লে সে দেখে, আরতির ডান হাতের আঙুল হলুদ। ও, এখন রান্না করছে। ছোট ছেলের সিগারেট টানাটানি নিয়ে কথা ঘোলা করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। আরতিকে চলে যেতে সুনীল ইশারা করে।
কখনো কি সে সিগারেট টেনেছে? হারানো-ফুরানো স্মৃতি খুঁড়ে তুলতে নিজের স্মরণের ওপর চাপ রাখে সুনীল। না, স্কুলজীবনে গোঁফের রেখা ফুটে ওঠার আগে-পরে ক্লাসের কেউই ধূমপানে ছিল না। ওপরের ক্লাসের কোনো ছেলেকেও ছুটিছাটায়, কি দুষ্টুমি করে সিগারেট টানতে সে দেখেনি। বয়স হলে কেবল বড়দের কেউ কেউ বিড়ি-সিগারেট খায়, এমন ধারণা চালু ছিল। কলেজে পড়াকালে তাও বিএ পড়ার সময় বন্ধুরা আড্ডা মারতে মারতে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ঘুরে ঘুরে তার আঙুলে এলে জোরে টান দিয়েছিল সুনীল। ব্যস, কণ্ঠার কাছে ধোঁয়া আটকে গেলে শুরু হয় বেজায় খকখক কাশি, জল জমে যায় চোখে। ওই প্রথম ওই শেষ তার সিগারেট টানা। মফস্বলবাসী তার বড় ভাই, সত্তরের কাছাকাছি যার বয়স, এখনো শক্তসমর্থ, আজো বাসার বাজার সে নিজ হাতে করে, রান্নার কাঠ ফাড়তে কুড়াল তুলে সে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। কই, তার সিগারেট কেন, শখ করে হুক্কা টানার কথাও কখনো শোনা যায়নি। তাহলে? তার বড়-ছোট দুই ছেলে কি বাপ-জ্যাঠা থেকে কিছুই শেখেনি? নাকি তার ভুল – ঠিকঠাক চালচলন, জীবনযাপনের শিক্ষা দিতে সে ব্যর্থ হয়েছে?
সুনীলের খুব ভেতরে, দৃষ্টির অগোচর বিভিন্ন কোটরে টান পড়ে। তাৎক্ষণিক জখমবোধ জেগে উঠতে উঠতে থমকে যায়। তার বদলে মন দখল করা জিদের উদয় হয়। ছেলের সঙ্গে কি ঝাঁজালো বাক্যে বোঝাপড়া করবে? নাকি এবারের মতো এড়িয়ে হাতেনাতে সিগারেট ধরার জন্য সে অপেক্ষা করবে? নাকি কিছুই দেখিনি, কিছুই বুঝিনি গোছের মুখ তার নিরীহ রাখবে? আপত্তি করার ভঙ্গিতে নিজে নিজে মাথা নাড়ে সুনীল – না, চুপ থাকার সুবাদে ছেলের সাহস ক্রমাগত বেড়ে যেতে পারে। দেখা গেল, হাত নামমাত্র আড়ালে রেখে কিংবা বাবা যখন বাসাতে নেই দীপু তখন রুমেই সিগারেট টানছে। অবস্থা হচ্ছে, ও সিগারেট খায়, বাবা তো জানে। আর মা, ধুস কোনো ব্যাপার হলো।
সুনীল টের পায় তার মেজাজে উষ্ণতা ক্রমশ জ্বাল পাচ্ছে। না, কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। শাসনে না-রাখলে এমন কাঁচা বয়স থেকেই ছেলেপেলে উচ্ছন্নে যায়। এখুনি লাগাম না পরালে সর্বনাশ, কালে কালে আরো মন্দ আচরণে ছেলে সাহসী হতে পারে। পুরোপুরি নেশাভাংয়ে জড়িয়ে গেলে ছেলে নিজের ভবিষ্যৎ পয়মাল করে ফেলবে। তাহলে উড়নচন্ডী স্বভাবের বড় ছেলে নিপু, যে এখন পূর্ণ যুবক, যার সর্বাঙ্গে সিগারেটের গন্ধ, যার গা-ঘেঁষে কেবল হেঁটেই গেলে যে কারো নেশা হয়ে যাবে, এই তাকে কেন সদয় প্রশ্রয় দেওয়া? ভেন্টিলেটরের গস্নাসভাঙা বারান্দার বাথরুমে রাতে ফস করে ম্যাচকাঠি জ্বলে কোন হিম্মতে? বারিধারার ওদিকে পরিচ্ছন্ন বাড়ির এক অ্যাড ফার্মে তার চাকরি। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে শান্তিনগর থেকে সকালে যায় – রাতে ফেরে। কোনো কোনো রাতে সুনীল ঘুমিয়ে পড়ার পর ছেলে আসে। পরদিন আরতির থমথমে মুখ দেখে সে পরিষ্কার অনুমান করে – বেসামাল ছিল নিপু। মাসের পয়লা সপ্তাহে মায়ের স্নেহময় হাতে, হাজার দশেক টাকা দিচ্ছে বলে তার নেশা-চড়ানো আরাম দেখে-শুনে-বুঝে নীরবে অনুমোদন করা ন্যায্য কথা নয়। এই এলোমেলো চালচরিত্র নিয়ে বড়ভাই কেমনে তার বছর পাঁচেকের ছোটভাইকে গাইড করবে? ভাইকে করবে সে দেখভাল? অসম্ভব। পারে তো তিনতলা থেকে দৌড়ে নেমে ফুটপাথের টং দোকান থেকে রাতে সিগারেট আনতে ছোটভাইকে সে অর্ডার দেয়। অসাধ্য কিছু না, জ্বলন্ত অর্ধেক সিগারেট নিপু ছোটভাইয়ের ঠোঁটে গুঁজে দিতে পারে।
খুব ভেতরের নিবিড় জখম বোধে সুনীল সহসা উতলা হয়ে ওঠে। অবশ্যই তারও অনুচিত হচ্ছে, নিপুর আয়ের অংশে সংসার খরচের সংস্থান হয় জেনে ছেলের তৈরি করা ত্রুটি মুখ বন্ধ রেখে দেখে যাওয়া। সন্তানের জন্মদাতা সে, এদের ভরণপোষণ শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার দায়িত্ব তার। তুমুল টানাটানির কারণে ক্লান্ত হলেও এই গুরুভার বহনে পারতপক্ষে সুনীল কার্পণ্য করেনি। সন্তানের সাধ-আহ্লাদ-দাবি-চাহিদা সব আবদার পূরণ করলে তাদের কার্যকলাপের জবাবে ন্যায্যকথা শুনিয়ে দেওয়ারও অভিভাবক সে।
সুনীল বোঝে, নিপু তার দোষ ওয়াকিফ বলে আগে থেকেই বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস সে হারিয়েছে। কখনো সামনে পড়লে এমন দৌড়চালে বাবার নজরের বাইরে সরে যায় যেন বাথরুমে যাওয়ার চাপে আছে সে। ছেলের রুম দিয়ে যেতে যেতে সুনীল থমকে কখনো দৃষ্টি দিলে দেখা গেল নিপু কম্পিউটারে এমন মনোযোগ ধরে রেখেছে যে, কোনো মানুষের উপস্থিতি আদৌ সে টের পাচ্ছে না। চোখ কম্পিউটারের টার্মিনালে স্থির। বাকি থাকে যে দুই কান তাও গান বা সিনেমার সাউন্ড উপযুক্তভাবে শোনার জন্য হেডফোন দিয়ে ঢাকা। কোনো ডাকাডাকি ছেলের কর্ণকুহরে পৌঁছে না। সময় যায়, খেতে আসার জন্য মায়ের এতো নরম-গরম, সরু-মোটা চেঁচামেচি করা স্বর, কীসের কী, সব বৃথা। হেডফোন লাগিয়ে এমন মানুষ অগ্রাহ্য সুনীলের কাছে রীতিমতো বেয়াদবি মনে হয়।
ভাবতেই তার মাথা থেকে গরমের চড়া আঁচ নেমে আসে। খানিক ঝিম মেরে নিজের ত্রাণ নিজে ধরে রাখতে সে কৌশল নেয়। তার পজিশন নস্যাৎ করে গোঁয়ার অশিষ্টতা সে দেখাতে যাবে কেন? হোক তার সন্তান, এই জামানার কা-জ্ঞানহীন ছেলেপেলের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া আলাপ না-করাই উত্তম। এর ফল হয়েছে : বড় ছেলের সঙ্গে সুনীলের বাক্যালাপ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। উভয়ের মধ্যে পাতলা হলেও অদৃশ্য একটা দেয়াল উঠেছে। ছেলে ভাবছে, এটা বুঝি তার জন্য দারুণ সুবিধার – বাবা তো কিছু বলছে না। ইচ্ছামতো রাতে সে বাসায় ফিরছে। তার যাওয়া-আসা দিনযাপনের সঙ্গে বাবার কোনো সম্পর্ক নেই। কী মজা! যত ঘোরালো-প্যাঁচালো কথা হোক, কি স্বর মোলায়েম করে কিছু আদায় করার মতলব হোক, সব তার মায়ের সঙ্গে। মাও ছেলের পর্ব স্বামীর কাছে তোলে না। আরতি জানে, নিপু প্রসঙ্গে পেশ করলে সুনীলের এক কথা – ‘ভাত বন্ধ করে দাও।’ আরতি তখন কোন্দল করা অসমেত্মাষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় – ‘তুমি দাও। তোমার বাসা। আমার কী, ছেলে তো আমার একার না।’ এরপরই আরতির স্বরে মেঘোদয় হয় – ‘গত জন্মে মনে হয় পাপ করেছিলাম। এ জন্মে তাই প্রায়শ্চিত্ত করছি।’ বোঝো এবার, ঘরের বউয়ের খেদ-আক্ষেপ, হা-হুতাশে যদি জোর বাড়ে, তার চিল-চেঁচানি আশপাশের জানালার ফাঁক দিয়ে উড়ে যায়, তবে মানুষজন ভাববে কী – স্বামীটা নির্ঘাৎ ইতর, বউয়ের সঙ্গে খালি দুর্ব্যবহার করে।
সুনীলের মানহীন মলিন ভাড়া বাসাটা শান্তিনগরের এক গলি রাস্তার ভেতর দিকের পুরনো তিনতলায়। সিলিং-দেয়াল-বাথরুম-রান্নাঘর সবখানে এখন বাসিগন্ধের প্রলেপ। স্বাস্থ্যহানিকর দাগি বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও একখানা আরাম কুরসিতে বসবে এমন সামর্থ্য তার নেই। এদিকে পরিচয়দানে অযোগ্য যে চাকরির কলম পিষে কালো চুল সাদা করে এনেছে সেখানে বেতন বাড়ছে না। হাজার হাজার বেকার থেকে সুলভে অফিসে লোক পাওয়া দুষ্কর নয়। মালিক মহোদয় এখনো তাকে এই বয়সেও কাজে রেখে বেতন দিয়ে যেন ধন্য করছেন। তার মনোভাব এমন : পুরনো কর্মচারী, পয়লা থেকে আছে, কী আর করা।
সুনীলদের মুখোমুখি সামান্য দূরে নতুন একটা বিল্ডিংয়ের চারতলার ছিমছাম ফ্ল্যাটের ফর্সা ভদ্রলোক সম্প্রতি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। পেনশন বাবদ তিনি মোটা অংক – লাখ লাখ টাকা পাবেন। হাওয়ায় উড়ে আসা এমন লোভনীয় খবর শুনে আরতি স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিল, তার অফিসেও পেনশনের সুব্যবস্থা আছে কিনা। সুনীল দুর্বোধ্য চাহনি দেয়, যেন ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। বছরে দুবার তার চাকরিতে বেতনের সিক্সটি পার্সেন্ট বোনাস ছাড়া আর কোনো আর্থিক সুবিধা নেই। বউয়ের জিজ্ঞাসার সামনে ঠোঁটে আঠা জমিয়ে সে চুপ করে আছে দেখে শুরু হয় আরতির ঠেসবাক্য। তাহলে আগামী দিনগুলো সচল বলো কি জীবিত বলো নির্ভর করতে হচ্ছে ছেলের চাকরির ওপর। দাঁড়াচ্ছে কী, ছেলের পেছনে খরচ করেছি, এখন অন্নজলের জোগান দিক সে। ছেলে তখন চাটি মারলেও তা হজম করো। ধুর, তীব্র আপত্তি সুনীলের মাথার মধ্যে শোর তোলে। মেরুদ–বাঁকা জীবন তার কাম্য নয়। আচ্ছা, গড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই সংসারে মাত্র চারটি প্রাণী। দেখো, এদের চার চরিত্র। ভাবতেই বড়ছেলের আরেকটা দোষ সুনীলের সামনে খাড়া হয়। সবকিছুতেই ছেলের তাড়াহুড়ো। এতো ডাকাডাকি, আসে না আসে না, হঠাৎ খাওয়ার টেবিলে এসে হামলে পড়ে সে। টেবিলে খাওয়ার কী কী আছে সব ঢাকনা তুলে সে তদন্ত করে। মেঘবাদল না থাকলে ভোরে সুনীল হাঁটতে বের হয় – অনেক দিনের অভ্যাস। রমনা পার্কে চক্কর মেরে ফেরার সময় বেইলি রোডে বসা ভাসমান বাজারের মাছ-তরকারি সে প্রায়ই কিনে আনে। তরকারির দাম নাগালের মধ্যে থাকলেও তার মতো নির্দিষ্ট উপার্জনের মানুষের মাছ কেনার ক্ষমতা দিনে দিনে ক্ষয়ে আসছে। সাধারণ গুঁড়ো মাছের দাম পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে এখন। খদ্দেরদের ওপর মাছ-বিক্রেতার এমন দৃষ্টি – কিনবেন না, বেশ, মাছের ওপর চোখ দেওয়ার কারণে পারলে কিছু পয়সা দিয়ে যান। খরচের নাগালে থাকা মাছ ছাড়া কী কিনবে সে। দেখো, তেলাপিয়া মাছের রান্না, উঁহু, ধুস – মুখে ভেংচি রেখে নিপু নিজস্ব অপছন্দের আওয়াজ রুমে ছুড়েই যায় – ‘এসব হাবিজাবি খাওয়া যায়? হলিডে, কোথায় বেটার কিছু থাকবে।’ অসাধ্য এক উত্তেজনা মুহূর্তে সুনীলকে দখল করে; আর তা বেরিয়ে আসতে আসতে কণ্ঠে পাথুরে শব্দ হয়ে যায় – ‘ভালো কিছু বাজার থেকে আনলে হয়। কখনো তো দেখলাম না।’
শেষবাক্যের জবাবে জোর পদক্ষেপে নিপু রুম ছেড়ে যায়। এ-সময় ভাতের গামলা হাতে আরতি কেবল রুমে ঢুকেছে, বড়ছেলে অমন অন্ধকার মুখে চলে যাচ্ছে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর ওপর সে বাঘাটে চাহনি তুলে ধরে। তার চালু খরখরে স্বরের ধারে সুনীল এবার চেরাই হতে থাকে – ‘ছেলেটার পেটে আছে কিছু, সেই সকালে এককাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েছে। এখন খাবে ভাত। তা না, ছেলেটাকে তিনি তাড়িয়ে ছেড়েছে।’ ভয়ংকরী রূপ ধারণে পায়ের শব্দ কিছুতেই আসেত্ম হয় না। হড়বড়ে পায়ে আরতি ভেতরে যায়।
এই ঘটনার সাত-আটদিন গেছে। বাবার মুখোমুখি পড়লে নিঃশব্দে নিপু পাশ কেটেছে – কথা বলেনি। হতে পারে, তার ভেতরে বলার মতো কোনো কথা জমেনি। কিন্তু চেহারাছবিতে পরিষ্কার সমেত্মাষ, আগের মতোই স্বাভাবিক। যথারীতি নিত্য অভ্যাসে ছোট পুত্তুর দীপু তার কথার ফোয়ারা চালু রেখেছে। আজগুবি থেকে নির্ভেজাল কত তার কথা। – ‘বুঝলে বাবা, আর দুদিন বাকি অ্যালান টিউরিংয়ের জন্মশতবার্ষিকীর।’
হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ, আর টিউরিং বা কার নাম! সুনীল হা-মুখে স্থির চেয়ে থাকে। কোন কথা থেকে কোন কথায় যে ছেলেটা চলে যায়। বাবার অবুঝ ফাঁপা-চাহনি দেখে দীপু নরম করে হাসে – ‘মাই ওল্ড ড্যাড। অ্যালান টিউরিংকে তুমি কেমনে জানবে? হ্যান্ড্রেড ইয়ার্স হলো, লন্ডনের প্যাডিংটন হসপিটালে কম্পিউটার সায়েন্সের এই ফাদারের জন্ম। দুঃখ কী জানো, বয়স ফর্টি টু হওয়ার আগেই সুইসাইড করে সে। তার ডেডবডির পাশে কামড় দেওয়া একটা আপেল পাওয়া যায়। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট : আপেলের সঙ্গে সায়ানাইড মেশানো ছিল।’
হঠাৎ দীপুর কম্পিউটার সায়েন্টিস্টের সুইসাইডের কথা কেন? আগেও কখনো কখনো কথাচ্ছলে জানা-অজানা মানুষের মৃত্যু নিয়ে সে বলেছে। ফিজিক্স হচ্ছে দীপুর প্রিয় বিষয়। এই ফিজিক্সের উদাহরণই সে বেশি বেশি টেনে আনে। তাহলে দাঁড়ালো কী, সুনীলের গত ও বর্তমান মিলিয়ে আটপৌরে জীবন, জানাজানি কম, শ্রোতা হওয়া ছাড়া কথকের খুব একটা সুযোগ তার হয় না। কিন্তু সুইসাইডের উদাহরণ তুলে প্রকারান্তরে সুনীলকে কি ভয় দেখায় দীপু? ছেলের মুখে আত্মহত্যার গল্প শুনলে ধীরে ধীরে শরীরে তার হিম ভেঙে আসে।
কেবল ছুটিছাটার দিনেই চার চেহারা খাওয়ার টেবিলে একত্র হয়। ছুটির কোনো কোনো ঝকঝকে দুপুরে টেবিলের একটা চেয়ার ফাঁকা থাকে। বড়ছেলের শখ নয়ন-নন্দন ছবি তোলার। ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে তার দুপুর গড়িয়ে যায়। কোথায় নিজের রুমে বসে বিশ্রাম করবে, তা না, ছোটভাইকে পেলে তো কথাই নেই, শুরু হয় তার অনর্গল উচ্ছ্বাস – ‘বুঝলি, অফিসার্স ক্লাবের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ক্যামেরা অন করেছি, ও মা, পাশে দেখি মানুষ, ক্যামেরা দেখলেই ভিড়।’
নিপু গ্রাফিকসে মাস্টার্স। তার এক্সট্রা যোগ্যতার জন্য ডিএসএলআর ক্যামেরা চাই। ভালো, তার বেতনের টাকা জমিয়ে সে ক্যামেরা কিনবে – কিনুক। কিন্তু দাঁড়ালো কী, সংসারের এ-খরচ ও-খরচ ছাঁটাই করে হাজার দশেক টাকা ছেলের ক্যামেরার জন্য সুনীলকে দিতে হলো। কষ্টের এই ভোগ ছেলে কি বোঝে? বাবার মন ভেজাতে কিছু টাকা মাসে মাসে সে ফিরিয়ে দেবে বললেও ছেলের প্রতিশ্রম্নতির ওপর সুনীল আস্থা রাখেনি।
দীপু ছোট হলেও তার কথায় থাকে বিভিন্ন মোচড়। চালচলনে কোথায় জানি তার সেয়ানা ভাব। তার চাহিদা সে গচ্ছিত রেখেছে ভবিষ্যতের কাছে। বড় কোনো আকাঙ্ক্ষা এখনো তৈরি হয়নি বলে বাবার ওপর বর্তমানে তার কোনো প্রেসার নেই। তবে এশিয়া-ইউরোপ না, উত্তর আমেরিকায় উড়ে যাবে, সেটেল সে ওখানে হতে চায়। ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় হলে কাজের ফাঁকে লেখাপড়া করবে। কানাডার এডুকেশন নাকি বেটার। ভ্যালু আছে, লেখাপড়া জানলে সব সহজ ওখানে। খুশি খুশি ভাব নিয়ে সে একাধিকবার বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে – ‘তুমি বলেছিলে তোমার কাস্টমসের রিটায়ার্ড কোন বন্ধু আছে, তার মেয়ে-জামাই দুজনে টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে আছে, যোগাযোগ রেখো, কাজে লাগবে।’ দীপুর ধারণা, এদেশে এখন চরম ডার্ক পিরিয়ড চলছে। কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই – ফিউচার জিরো।
বিস্ময়ে ছোটছেলের ওপর থেকে সুনীল চোখ সরাতে পারে না। এসব কি দীপুর নিজের কথা? দীপু জানে না ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কোনো সামর্থ্য তার বাবার নেই। বড়লোকের ছেলেপেলে বন্ধু হলে তাদের যাবতীয় সঙ্গদোষ মধ্যবিত্তের মধ্যে চালান হয়ে আসে। মেজাজ-মর্জি, চালচলন তখন ফুলে-ফেঁপে ঢোল। নিজের সীমানা নিয়ে সঠিক ধারণা থাকে না।
টিভি অন করে সুনীল। সাউন্ড কমিয়ে খবর শুনতে শুনতে পেস্নটে সে ভাত তুলে নেয়। দীপু বড়ভাইয়ের মুখে রগড়ে চাহনি দিয়ে এবার বাবার মুখ পড়তে তৎপর হয়। তার মুখে যথারীতি মিঠেল হাসি জ্বলছে। নিপু তার স্বভাব মোতাবেক বিরক্ত, খাওয়া নিয়ে সেই খিটিমিটি আছেই – ‘হাইব্রিড কই মাছ মানুষ ক্যামনে খায়? টেস্ট নেই – কাঁটা শক্ত।’ পারলে কই মাছ, এই মাছের গুষ্টি-গোত্র, এমনকি এই মাছের ক্রেতার ওপর দিয়ে সে মনের ঝাল মিটিয়ে নেয়।
ডাইনিং টেবিলে কোনো ছুতানাতায় নিপু তার অসমেত্মাষ ছড়িয়ে খাওয়ার পরিবেশ বিস্বাদ করে দিতে পারে ভেবে সুনীল সতর্ক থাকে।
টিভিতে সরকারের খবরের পর এবার বিরোধীদলের সংবাদ পড়া হচ্ছে। দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। সুনীলের পেস্নটে হাত, ঘাড়ে চাপ, চোখ টিভি স্ক্রিনের ওপর ধরা দেখে দীপুর বিরাগ স্বর উড়িয়ে বাবার মনোযোগ টলিয়ে দিতে চায়। – ‘বাজে প্যাঁচাল। ডার্টি পলিটিক্সের কী শোনো তুমি? বোর ফিল করো না?’ বড়ভাইয়ের সমর্থন আদায়ে দীপু তার আঙুলে টিপ দেয়।
নিপু অনেক অতলে বুঝি ডুবে ছিল, এতোক্ষণে তার হুঁশ ফিরেছে – ‘ও টিভি নিউজ রাবিশ’ বাবার উদ্দেশে এবার তার মোটা স্বর – ‘এত খবর দেখলে, নিজে কখনো খবর হলে না।’
পেস্নটে রাখা সুনীলের হাত এবার জমেই যায়। তাকে কি নিপু ব্যঙ্গ করছে? না এটা বাবার নিরুপদ্রব গোবেচারা জীবন নিয়ে সমব্যথী হওয়া ছেলের নিরীহ উক্তি – কোনটি? যেটাই হোক, একটা বিষয় পরিষ্কার – ছেলে বাবার পুরনো ডালে কিছুতেই বসার পক্ষপাতী নয়। ডানা সে ঝাপটাবে – উড়াল দেবে। ভালো ভালো।
– ‘টিভি বন্ধ করে দিই বাবা। কেউ তো দেখছে না।’ দীপু রিমোট টিপতে যাবে, তখুনি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে খবর শুরু হলে সুনীল হাত তুলে ছোট ছেলেকে নিবৃত্ত করে।
– ‘এই আর এক সাবজেক্ট!’
দীপুর বাঁকা কণ্ঠে সুনীলের অবাক হওয়ার পালা। ছেলেটা কি অসময়ে সাবালক হয়ে গেছে, নচেৎ অত কথা, কিংবা ঘটনার সঙ্গে অত জড়িয়ে পড়া কেন। বয়স্কদের মতো মুখভঙ্গি, বিষয় জটিল করে তোলা এত তাড়াতাড়ি শিখল কীভাবে? একেই তবে ইঁচড়েপাকা বলে। উত্তম, এক ছেলে ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছে, আরেক ছেলে এই বয়সেই স্নব – দেশের কোনো কিছু ভালো লাগে না। মাথার মধ্যে পরবাসী হওয়ার ভাবনা।
‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। চক্রান্ত করে এই বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।’ – সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সচিত্র সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। দীপু এঁটো ডানহাত সামান্য তুলে হিসাব করে – ‘দুই হাজার উনিশ সাল এখন। যুদ্ধ হয়েছে উনিশশো একাত্তরে, আটচলিস্নশ বছর হলো, এতদিন আগের, এর ওপর তো ধুলো পড়ে গেছে বাবা -।’
দীপুর গাঢ় হিসেবি স্বর ও ধুলোর নির্যাতনের সম্ভাবনা টেবিলে-পেস্নটে-ফ্লোরে পড়ে ছড়িয়ে যায় – ‘তোমরা যারা ফ্রিডম ফাইটার, এখন কি মনে হয় যুদ্ধ করে ভুল করেছো?’
সুনীলের কশেরুকায় ঝাঁঝাঁ বেগে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ করে ভুল? কিসের ভুল? বলে কী ছেলে! মুক্তিযুদ্ধ না-হলে সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধেই তো তাদের উদ্বাস্ত্ত হতে হতো। কিংবা এতদিন পাকিস্তান নামের ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রের থার্ড ক্লাস নাগরিকের হীন পরিচয়ে থাকতে হতো। যুদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা না-হলে কোথায় জন্মাত এই ছেলেপেলে। মুক্তিযুদ্ধ, অমন শ্রেষ্ঠ কীর্তির ওপর কেমনে ধুলো পড়ে।
‘ইম্পসিবল’ সুনীলের কণ্ঠছেঁড়া আওয়াজের প্রতাপে নিপু-দীপুর দুজনই বিস্ময়ে বাবাকে দেখে। অমন বাঁচা-মরার যুদ্ধের ওপর ধুলো, উঁহু, হতেই পারে না। সুনীল তার নাগালের টেবিলের অংশে দুহাত এগিয়ে ধুলো সরাতে সক্রিয় হয়।
No comments