ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য by ড. ইউসুফ আলকারযাভি
ব্যবসা-বাণিজ্যের
সহজাত প্রবৃত্তি হলো তা ব্যবসায়ীকে মূলধন ও লাভের অংশের ঘূর্ণাবর্তে
নিমজ্জিত করে ফেলে। এমনকি আমরা মহানবী (সা.) এর যুগের একটি কাফেলাকে দেখতে
পাই যারা ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়েছিল। ওই সময় রাসুলুল্লাহ
(সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন শ্রবণকারীদের অনেকেই খুতবা না শুনে অমনোযোগী
হয়ে সেদিকে চলে যান। তাই তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ তায়ালার এ বাণী
উচ্চারিত হয়, ‘তারা যখন কোনো ব্যবসায়ের সুযোগ অথবা ক্রীড়া-কৌতুক দেখে তখন
আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে তারা সেদিকে ছুটে যায়। বলুন : আল্লাহর কাছে যা
আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সর্বোত্তম
রিজিকদাতা।’ (সূরা জুমুআ : ১১)
ইসলাম কোরআনের স্পষ্ট ভাষ্য এবং মহানবী (সা.) এর বাণীর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্যটন ও ভ্রমণ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। কোরআন ব্যবসাকে আল্লাহর অনুগ্রহ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং যারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে, তাদের আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও সংগ্রামকারীদের সমান্তরালে উল্লেখ করেছে। মহাগ্রন্থ কোরআনের এ বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুন, ‘কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে।’ (সূরা মুয্যাম্মিল : ২০)।
মহাগ্রন্থ কোরআনে এসেছে, সবসময় বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম উপায় সামুুদ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারগুলো উন্মুক্ত করে মানুষের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। সমুদ্রকে মানুষের অনুগত করা এবং তাতে নৌযান চলাচল করার বিষয়টি সহজ করে দেওয়া আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ। কোরআন শরিফের ভাষ্য হলো, ‘তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা ফাতির : ১২)। এর সঙ্গে কখনও কখনও বাতাস প্রবাহিত করার বিষয়টিকে এভাবে উল্লেখ করেছে, ‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তার অনুগ্রহ তোমাদের আস্বাদন করান এবং যাতে তার নির্দেশে জাহাজগুলো বিচরণ করে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ তালাশ করো এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা রোম : ৪৬)।
কোরআন শরিফ এ বিষয়টির নেয়ামত স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং এর উপকারিতার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বারবার আলোচনা করেছে। এমনকি মহাগ্রন্থ কোরআন নৌযানকে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, শক্তিমত্তা ও প্রজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিতবাহী নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘এবং নদীতে নৌকাগুলোর চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘সমুদ্রে ভাসমান পর্বতসম জাহাজগুলো তার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা শূরা : ৩২)।
আল্লাহ তায়ালা মক্কাবাসীর ওপর অনুগ্রহ করেছেন। কেননা তিনি তাদের জন্য এমন সব উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করেছেন যে, মক্কা শহরকে আরব উপদ্বীপে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র বানিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কি তাদের জন্য একটি নিরাপদ শহর-হরম প্রতিষ্ঠিত করিনি? এখানে সব ধরনের ফলমূল আমদানি হয় আমার দেওয়া রিজিকস্বরূপ।’ (সূরা কাসাস : ৫৭)। এর মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া সত্যে পরিণত হয়েছে। তিনি এই বলে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামাজ কায়েম রাখে। এরপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন, সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)।
প্রতি বছর ব্যবসাসংক্রান্ত দুটি ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরাইশদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। তারা শীতকালে ইয়ামান অভিমুখে একটি ভ্রমণ করত এবং গ্রীষ্মকালে শাম অভিমুখে একটি সফর করত। তারা বাইতুল্লাহর তত্ত্বাবধান ও দেখাশোনা করার ফলে এ দুই ঋতুতে নিরাপদে সফর করত। সুতরাং তাদের জন্য উচিত হলো তারা যেন এ ঘরের মালিক ও প্রতিপালক এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার মাধ্যমে এ মহা নেয়ামতের শোকর আদায় করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেহেতু কোরাইশের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরেরÑ অতএব, তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের মালিকের, যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা কোরাইশ : ১, ২, ৩, ৪)।
ইসলাম মুসলমানদের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে হজের মৌসুমে পারস্পরিক ব্যবসা-বিনিময় করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কেননা হজের মৌসুমে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ও দিগ-দিগন্ত থেকে অনেক মানুষ বাইতুল্লাহয় সমবেত হয়ে থাকেন। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’ (সূরা হজ : ২৭, ২৮)।
আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আয়াতের মধ্যকার উপকারিতা ও কল্যাণ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, মুসলমানরা হজের মৌসুমে ব্যবসা করা থেকে দূরে থাকতেন। তারা ভাবতেন, এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা তাদের নির্ভেজাল নিয়তকে কলঙ্কিত করবে এবং তাদের ইবাদত-বন্দেগির স্বচ্ছতাকে মলিন করে দেবে। মহাগ্রন্থ কোরআন তাদের এ চিন্তাধারার অপনোদন করে বলেছে, ‘তোমাদের ওপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোনো পাপ নেই।’ (সূরা বাকারা : ১৯৮)।
সপ্রশংস তসবিহ পাঠ করে যারা সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে আগমন করে তাদের প্রশংসা করে কোরআন শরিফ বলেছে, ‘এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ (সূরা নুর : ৩৭)।
সুতরাং কোরআনের আলোকে তারাই শুধু মোমিন নয় যারা মোটা কাপড় পরে মসজিদে বসে থাকে কিংবা গদিতে হেলান দিয়ে দরবেশি ভাব ধরে অথবা খানকায় বসে সন্ন্যাসী-জীবন অবলম্বন করে, বরং ইসলাম তাদেরই মোমিন বলে অভিহিত করেছে, যাদের পার্থিব কাজকর্ম সম্পাদন পরকালীন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এতক্ষণ আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলাম।
অনুরূপভাবে মহানবী (সা.) এর বাণী সুন্নাহতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং এর মূলনীতিগুলোকে তার উক্তি, কর্ম ও সমর্থনের মাধ্যমে সুদৃঢ় করেছেন। তার প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী থেকে শুনতে পাই, ‘সত্যবাদী, বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৩৯)। মহানবী (সা.) আর বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী ব্যক্তি নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ১২০৯)।
আপনি এ কারণে আশ্চর্য হবেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীকে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামকারী মুজাহিদ ও এ পথে শাহাদাত বরণকারী ব্যক্তির মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। কেননা আমাদের এমন কতক অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, জিহাদ শুধু যুদ্ধের ময়দানেই হয় না, বরং অর্থনীতির ময়দানেও সংগ্রাম এবং জিহাদ অব্যাহত রয়েছে। সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ মহা মর্যাদা ও প্রচুর সওয়াব দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য সাধারণত লোভ-লালসার সৃষ্টি করে এবং যে কোনো পন্থায় লাভ উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করে। সম্পদ সম্পদের জন্ম দেয় এবং লাভ আরও প্রচুর লাভের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। সুতরাং এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে সে এমন এক মুজাহিদ, যে অনৈতিক লালসার ময়দানে বিজয়ী হয়েছে; ফলে তার জন্য মুজাহিদদের মর্যাদা অর্জিত হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সহজাত প্রবৃত্তি হলো তা ব্যবসায়ীকে মূলধন ও লাভের অংশের ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জিত করে ফেলে। এমনকি আমরা মহানবী (সা.) এর যুগের একটি কাফেলাকে দেখতে পাই যারা ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়েছিল। ওই সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন শ্রবণকারীদের অনেকেই খুতবা না শুনে অমনোযোগী হয়ে সেদিকে চলে যান। তাই তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ তায়ালার এ বাণী উচ্চারিত হয়, ‘তারা যখন কোনো ব্যবসায়ের সুযোগ অথবা ক্রীড়া-কৌতুক দেখে তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে তারা সেদিকে ছুটে যায়। বলুন : আল্লাহর কাছে যা আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সর্বোত্তম রিজিকদাতা।’ (সূরা জুমুআ : ১১)।
সুতরাং বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশের এ ঘূর্ণাবর্তে যে ব্যক্তি শক্তিশালী বিশ্বাসের অধিকারী হয় এবং আল্লাহর ভয়ে অন্তরকে পূর্ণ এবং আল্লাহর স্মরণ দ্বারা তার জিহ্বাকে সতেজ রাখে; সে এর যোগ্য বলে বিবেচিত হয় যে, পরকালে নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এ কর্মই আমাদের জন্য যথেষ্ট যে, তিনি যেভাবে মানুষের আত্মার প্রতি লক্ষ্য করে তাকওয়া ও খোদাভীরুতার ওপর মসজিদে নববি নির্মাণ করেছেন; যাতে সেটা ইবাদত-বন্দেগির সমাবেশস্থল, ইলম ও জ্ঞানের বিদ্যালয়, দাওয়াতের আবাস এবং রাষ্ট্রের কেন্দ্র হতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে তিনি অর্থনীতির প্রতি লক্ষ্য করে নিরেট ইসলামি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইহুদিদের ক্ষমতা নিঃশেষ করেছেন; এর আগে বনি কাইনুকার বাজারে যেমন তাদের ক্ষমতা ছিল। মহানবী (সা.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাজারের মূলনীতি নিজে নির্ধারণ করেন এবং আপন শিক্ষামালা ও দিকনির্দেশনা দ্বারা সবসময় এর তত্ত্বাবধান করেন। এর ফল এই দাঁড়ায় যে, তার বাজারে ধোঁকা, প্রতারণা, মাপে কম দেওয়া ও বেশি নেওয়া, গুদামজাতকরণ এবং অন্যকে প্রতারিত করার মতো কোনো দুর্নীতি ছিল না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিদের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তাদের অনেকেই কালের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, দক্ষ কারিগর ও কৃষক এবং সব ধরনের শিল্প ও বৃত্তিতে নৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন। মহানবী (সা.) তাদের মাঝে ছিলেন। তার ওপর আল্লাহ তায়ালার বাণী অবতীর্ণ হচ্ছিল; আর তিনি সাহাবিদের আসমানের আহ্বান শোনাচ্ছিলেন। হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর ওহি ও প্রত্যাদেশ নিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় আগমন করতেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই অত্যধিক ভালোবাসার দরুন এক মুহূর্তের জন্যও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছ থেকে পৃথক হতে চাইতেন না। এতদসত্ত্বেও তাদের প্রত্যেককেই দেখতে পাই, তারা কাজে মশগুল এবং কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। একজন ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমিনে ভ্রমণ করছেন তো অন্যজন তার বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। একজন চাষবাস করছেন তো অন্যজন কারিগরি শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন। যদি কেউ উপস্থিত থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী ও শিক্ষা শুনতে না পারতেন, তাহলে যথাসম্ভব অন্যদের কাছে তা জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন। কেননা তাদের আদেশ করা হয়েছিল, তাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়।
আনসারদের অধিকাংশ ব্যক্তি কৃষক ছিলেন, আর মুহাজিরদের অধিকাংশ ব্যক্তি ব্যবসায়ী ছিলেন। মুহাজির আবদুর রহমান ইবনে আওফের কাছে তার আনসারি মুসলিম ভাই সাদ ইবনে রবি এ দরখাস্ত পেশ করেন, যেন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) তার সম্পদ দুটি ঘর সমানভাগে ভাগাভাগি করে অর্ধেক নিয়ে নেন এবং তার দুই স্ত্রীর কোনো একজনকে পছন্দ করেন; তাহলে তিনি তাকে তালাক দিয়ে দেবেন! আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন : আমি তার অসাধারণ এ পরার্থপরায়ণতাকে অত্যন্ত সংযম ও মহত্ত্বের সঙ্গে এ কথা বলে ফিরিয়ে দিই যে, আল্লাহ আপনার সম্পদ ও পরিজনের মধ্যে বরকত দান করুন। এসবে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যবসা করা যায় এমন কোনো বাজার থাকলে বলুন। তখন সাদ (রা.) বললেন, হ্যাঁ! বনি কাইনুকার বাজার রয়েছে, যেখানে ব্যবসা করা যায়। এর পরদিন আবদুর রহমান ইবনে আওফ ঘি ও পনির নিয়ে বাজারে যান এবং এগুলো ক্রয়-বিক্রয় করেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে বাজারে যেতে থাকেন। এক সময় তিনি মুসলমানদের মধ্যে একজন বড় সম্পদশালী হয়ে যান! মৃত্যুবরণ করার সময় তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে যান।
হজরত আবু বকর (রা.) সবসময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি যেদিন তিনি খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেদিনও তার পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহের জন্য বাজারে যেতে চেয়েছিলেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, বাজার আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী শোনা থেকে বিরত রেখেছে। হজরত উসমান (রা.) সহ অনেকেই বিভিন্ন পেশায় অভ্যস্ত ছিলেন।
অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ
ইসলাম কোরআনের স্পষ্ট ভাষ্য এবং মহানবী (সা.) এর বাণীর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্যটন ও ভ্রমণ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। কোরআন ব্যবসাকে আল্লাহর অনুগ্রহ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং যারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে, তাদের আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও সংগ্রামকারীদের সমান্তরালে উল্লেখ করেছে। মহাগ্রন্থ কোরআনের এ বাণীর প্রতি লক্ষ্য করুন, ‘কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে।’ (সূরা মুয্যাম্মিল : ২০)।
মহাগ্রন্থ কোরআনে এসেছে, সবসময় বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম উপায় সামুুদ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারগুলো উন্মুক্ত করে মানুষের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। সমুদ্রকে মানুষের অনুগত করা এবং তাতে নৌযান চলাচল করার বিষয়টি সহজ করে দেওয়া আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ। কোরআন শরিফের ভাষ্য হলো, ‘তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা ফাতির : ১২)। এর সঙ্গে কখনও কখনও বাতাস প্রবাহিত করার বিষয়টিকে এভাবে উল্লেখ করেছে, ‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তার অনুগ্রহ তোমাদের আস্বাদন করান এবং যাতে তার নির্দেশে জাহাজগুলো বিচরণ করে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ তালাশ করো এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা রোম : ৪৬)।
কোরআন শরিফ এ বিষয়টির নেয়ামত স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং এর উপকারিতার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বারবার আলোচনা করেছে। এমনকি মহাগ্রন্থ কোরআন নৌযানকে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, শক্তিমত্তা ও প্রজ্ঞার প্রতি ইঙ্গিতবাহী নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘এবং নদীতে নৌকাগুলোর চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, ‘সমুদ্রে ভাসমান পর্বতসম জাহাজগুলো তার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা শূরা : ৩২)।
আল্লাহ তায়ালা মক্কাবাসীর ওপর অনুগ্রহ করেছেন। কেননা তিনি তাদের জন্য এমন সব উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করেছেন যে, মক্কা শহরকে আরব উপদ্বীপে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র বানিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কি তাদের জন্য একটি নিরাপদ শহর-হরম প্রতিষ্ঠিত করিনি? এখানে সব ধরনের ফলমূল আমদানি হয় আমার দেওয়া রিজিকস্বরূপ।’ (সূরা কাসাস : ৫৭)। এর মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া সত্যে পরিণত হয়েছে। তিনি এই বলে দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামাজ কায়েম রাখে। এরপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন, সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)।
প্রতি বছর ব্যবসাসংক্রান্ত দুটি ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরাইশদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। তারা শীতকালে ইয়ামান অভিমুখে একটি ভ্রমণ করত এবং গ্রীষ্মকালে শাম অভিমুখে একটি সফর করত। তারা বাইতুল্লাহর তত্ত্বাবধান ও দেখাশোনা করার ফলে এ দুই ঋতুতে নিরাপদে সফর করত। সুতরাং তাদের জন্য উচিত হলো তারা যেন এ ঘরের মালিক ও প্রতিপালক এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার মাধ্যমে এ মহা নেয়ামতের শোকর আদায় করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেহেতু কোরাইশের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরেরÑ অতএব, তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের মালিকের, যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা কোরাইশ : ১, ২, ৩, ৪)।
ইসলাম মুসলমানদের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে হজের মৌসুমে পারস্পরিক ব্যবসা-বিনিময় করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কেননা হজের মৌসুমে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ও দিগ-দিগন্ত থেকে অনেক মানুষ বাইতুল্লাহয় সমবেত হয়ে থাকেন। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’ (সূরা হজ : ২৭, ২৮)।
আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আয়াতের মধ্যকার উপকারিতা ও কল্যাণ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, মুসলমানরা হজের মৌসুমে ব্যবসা করা থেকে দূরে থাকতেন। তারা ভাবতেন, এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা তাদের নির্ভেজাল নিয়তকে কলঙ্কিত করবে এবং তাদের ইবাদত-বন্দেগির স্বচ্ছতাকে মলিন করে দেবে। মহাগ্রন্থ কোরআন তাদের এ চিন্তাধারার অপনোদন করে বলেছে, ‘তোমাদের ওপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোনো পাপ নেই।’ (সূরা বাকারা : ১৯৮)।
সপ্রশংস তসবিহ পাঠ করে যারা সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে আগমন করে তাদের প্রশংসা করে কোরআন শরিফ বলেছে, ‘এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।’ (সূরা নুর : ৩৭)।
সুতরাং কোরআনের আলোকে তারাই শুধু মোমিন নয় যারা মোটা কাপড় পরে মসজিদে বসে থাকে কিংবা গদিতে হেলান দিয়ে দরবেশি ভাব ধরে অথবা খানকায় বসে সন্ন্যাসী-জীবন অবলম্বন করে, বরং ইসলাম তাদেরই মোমিন বলে অভিহিত করেছে, যাদের পার্থিব কাজকর্ম সম্পাদন পরকালীন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এতক্ষণ আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলাম।
অনুরূপভাবে মহানবী (সা.) এর বাণী সুন্নাহতেও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং এর মূলনীতিগুলোকে তার উক্তি, কর্ম ও সমর্থনের মাধ্যমে সুদৃঢ় করেছেন। তার প্রজ্ঞাপূর্ণ বাণী থেকে শুনতে পাই, ‘সত্যবাদী, বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৩৯)। মহানবী (সা.) আর বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী ব্যক্তি নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ১২০৯)।
আপনি এ কারণে আশ্চর্য হবেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীকে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামকারী মুজাহিদ ও এ পথে শাহাদাত বরণকারী ব্যক্তির মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। কেননা আমাদের এমন কতক অভিজ্ঞতা রয়েছে যে, জিহাদ শুধু যুদ্ধের ময়দানেই হয় না, বরং অর্থনীতির ময়দানেও সংগ্রাম এবং জিহাদ অব্যাহত রয়েছে। সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ মহা মর্যাদা ও প্রচুর সওয়াব দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য সাধারণত লোভ-লালসার সৃষ্টি করে এবং যে কোনো পন্থায় লাভ উপার্জনের প্রতি উৎসাহিত করে। সম্পদ সম্পদের জন্ম দেয় এবং লাভ আরও প্রচুর লাভের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। সুতরাং এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে সে এমন এক মুজাহিদ, যে অনৈতিক লালসার ময়দানে বিজয়ী হয়েছে; ফলে তার জন্য মুজাহিদদের মর্যাদা অর্জিত হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সহজাত প্রবৃত্তি হলো তা ব্যবসায়ীকে মূলধন ও লাভের অংশের ঘূর্ণাবর্তে নিমজ্জিত করে ফেলে। এমনকি আমরা মহানবী (সা.) এর যুগের একটি কাফেলাকে দেখতে পাই যারা ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়েছিল। ওই সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন শ্রবণকারীদের অনেকেই খুতবা না শুনে অমনোযোগী হয়ে সেদিকে চলে যান। তাই তাদের তিরস্কার করে আল্লাহ তায়ালার এ বাণী উচ্চারিত হয়, ‘তারা যখন কোনো ব্যবসায়ের সুযোগ অথবা ক্রীড়া-কৌতুক দেখে তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে তারা সেদিকে ছুটে যায়। বলুন : আল্লাহর কাছে যা আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সর্বোত্তম রিজিকদাতা।’ (সূরা জুমুআ : ১১)।
সুতরাং বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশের এ ঘূর্ণাবর্তে যে ব্যক্তি শক্তিশালী বিশ্বাসের অধিকারী হয় এবং আল্লাহর ভয়ে অন্তরকে পূর্ণ এবং আল্লাহর স্মরণ দ্বারা তার জিহ্বাকে সতেজ রাখে; সে এর যোগ্য বলে বিবেচিত হয় যে, পরকালে নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদের সঙ্গে থাকবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর এ কর্মই আমাদের জন্য যথেষ্ট যে, তিনি যেভাবে মানুষের আত্মার প্রতি লক্ষ্য করে তাকওয়া ও খোদাভীরুতার ওপর মসজিদে নববি নির্মাণ করেছেন; যাতে সেটা ইবাদত-বন্দেগির সমাবেশস্থল, ইলম ও জ্ঞানের বিদ্যালয়, দাওয়াতের আবাস এবং রাষ্ট্রের কেন্দ্র হতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে তিনি অর্থনীতির প্রতি লক্ষ্য করে নিরেট ইসলামি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইহুদিদের ক্ষমতা নিঃশেষ করেছেন; এর আগে বনি কাইনুকার বাজারে যেমন তাদের ক্ষমতা ছিল। মহানবী (সা.) তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাজারের মূলনীতি নিজে নির্ধারণ করেন এবং আপন শিক্ষামালা ও দিকনির্দেশনা দ্বারা সবসময় এর তত্ত্বাবধান করেন। এর ফল এই দাঁড়ায় যে, তার বাজারে ধোঁকা, প্রতারণা, মাপে কম দেওয়া ও বেশি নেওয়া, গুদামজাতকরণ এবং অন্যকে প্রতারিত করার মতো কোনো দুর্নীতি ছিল না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবিদের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তাদের অনেকেই কালের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, দক্ষ কারিগর ও কৃষক এবং সব ধরনের শিল্প ও বৃত্তিতে নৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন। মহানবী (সা.) তাদের মাঝে ছিলেন। তার ওপর আল্লাহ তায়ালার বাণী অবতীর্ণ হচ্ছিল; আর তিনি সাহাবিদের আসমানের আহ্বান শোনাচ্ছিলেন। হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর ওহি ও প্রত্যাদেশ নিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় আগমন করতেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই অত্যধিক ভালোবাসার দরুন এক মুহূর্তের জন্যও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছ থেকে পৃথক হতে চাইতেন না। এতদসত্ত্বেও তাদের প্রত্যেককেই দেখতে পাই, তারা কাজে মশগুল এবং কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। একজন ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমিনে ভ্রমণ করছেন তো অন্যজন তার বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। একজন চাষবাস করছেন তো অন্যজন কারিগরি শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন। যদি কেউ উপস্থিত থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী ও শিক্ষা শুনতে না পারতেন, তাহলে যথাসম্ভব অন্যদের কাছে তা জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন। কেননা তাদের আদেশ করা হয়েছিল, তাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়।
আনসারদের অধিকাংশ ব্যক্তি কৃষক ছিলেন, আর মুহাজিরদের অধিকাংশ ব্যক্তি ব্যবসায়ী ছিলেন। মুহাজির আবদুর রহমান ইবনে আওফের কাছে তার আনসারি মুসলিম ভাই সাদ ইবনে রবি এ দরখাস্ত পেশ করেন, যেন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) তার সম্পদ দুটি ঘর সমানভাগে ভাগাভাগি করে অর্ধেক নিয়ে নেন এবং তার দুই স্ত্রীর কোনো একজনকে পছন্দ করেন; তাহলে তিনি তাকে তালাক দিয়ে দেবেন! আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন : আমি তার অসাধারণ এ পরার্থপরায়ণতাকে অত্যন্ত সংযম ও মহত্ত্বের সঙ্গে এ কথা বলে ফিরিয়ে দিই যে, আল্লাহ আপনার সম্পদ ও পরিজনের মধ্যে বরকত দান করুন। এসবে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যবসা করা যায় এমন কোনো বাজার থাকলে বলুন। তখন সাদ (রা.) বললেন, হ্যাঁ! বনি কাইনুকার বাজার রয়েছে, যেখানে ব্যবসা করা যায়। এর পরদিন আবদুর রহমান ইবনে আওফ ঘি ও পনির নিয়ে বাজারে যান এবং এগুলো ক্রয়-বিক্রয় করেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে বাজারে যেতে থাকেন। এক সময় তিনি মুসলমানদের মধ্যে একজন বড় সম্পদশালী হয়ে যান! মৃত্যুবরণ করার সময় তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ রেখে যান।
হজরত আবু বকর (রা.) সবসময় ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি যেদিন তিনি খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেদিনও তার পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহের জন্য বাজারে যেতে চেয়েছিলেন। হজরত ওমর (রা.) বলেন, বাজার আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণী শোনা থেকে বিরত রেখেছে। হজরত উসমান (রা.) সহ অনেকেই বিভিন্ন পেশায় অভ্যস্ত ছিলেন।
অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ
No comments