মার্কিন বর্বরতার যে কলঙ্ক কখনও মুছবে না
১৯৮৮ সালের ৩ জুন ইরানের একটি যাত্রীবাহী বেসামরিক
বিমান ধ্বংস করে দেয় মার্কিন নৌবাহিনী। পারস্য উপসাগরে ইরান উপকূলের
সমুদ্রসীমায় ঢুকে ‘ভিনসেন্স’ নামের একটি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ওই সন্ত্রাসী
হামলা চালায়। ফলে বিমানটির ২৯৮ জন আরোহীর সবাই প্রাণ হারান।
ইরানের বেসামরিক ওই বিমানটিতে ছিল ৬৬টি শিশু ও ৫৩ জন মহিলা । বিদেশি নাগরিক ছিল ৪৬ জন।
সেদিনের ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:
বন্দর নগরী ‘বন্দর আব্বাস’ থেকে দুবাইগামী
বিমান বন্দরে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ইরান এয়ারের ৬৫৫ নম্বর ফ্লাইটের মাধ্যমে
মাত্র ত্রিশ মিনিটের এক নিয়মিত যাত্রায় দুবাই যাওয়ার জন্য ওই বিমানে আরোহণ
করেন। এ সময় পারস্য উপসাগরে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কিছু ঘটনা ঘটতে
থাকে।
আগ্রাসী মার্কিন রণতরীগুলোকে নিকটবর্তী
ইরানী গানবোটগুলোর ওপর হামলার আদেশ দেয়া হয় এবং মার্কিন হেলিকপ্টারগুলোও
ইরানী গানবোটগুলোর ওপর হামলা শুরু করে।
এদিকে বন্দর আব্বাস বিমান বন্দরে যাত্রীরা
বিমানের অভ্যন্তরে আসনের সাথে তাঁদের বেল্ট বেঁধে নেন এবং এর পরপরই বিমান
উড্ডয়ন করল। পারস্য উপসাগরে মোতায়েন মার্কিন ‘এস ভিনসেন্স’ সুপারক্রুজার তা
মনিটর করছে। আর ঐ সুপারক্রুজারের হেলিকপ্টারগুলো আগে থেকেই গুলি বিনিময়
করছিল ইরানী গানবোটগুলো সাথে।
ইতিমধ্যে একটি মার্কিন হেলিকপ্টার খোয়া
গেল এবং মার্কিন এস ভিনসেন্সের ক্যাপ্টেন ইরানের ঐ যাত্রীবাহী বিমানের ওপর
মিসাইল ছোঁড়ার আদেশ দেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অপকীর্তির
কালো রেকর্ড আরো কালো হয়। নিহত হন বিমান আরোহী ২৯৮ জন নিরপরাধ মানুষ।
ইরান এয়ারের বহু মূল্যবান এয়ার বাস এ-৩০০ বিমানটি যখন ধ্বংস হয় তখন তার ভেতরে ৫৩ জন মহিলার কোলে ছিল তাদের মাসুম বাচ্চারা।
পশ্চিমা মদদে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু
করে পরাজিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত সাদ্দামের মতো একজন অপরাধীকে রক্ষা
করতেই ইরানি ওই যাত্রীবাহী বিমানটি ভূপাতিত করা হয়। এমনিভাবে ইরানের
বিরুদ্ধে ইরাকের আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে মিসাইল ও রাসায়নিক
অস্ত্রের শিকার হয়েছে গ্রাম-শহরের অগণিত নিরপরাধ মানুষ। এটাই হলো শান্তির
প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভালোবাসা এবং মানবাধিকারের প্রতি তার অঙ্গীকারের
নমুনা। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার ওয়েন বার্গারের মতে অবশ্য
ঐ ‘মর্মন্তুদ ঘটনাটি হচ্ছে ইরানী জাতিকে মূল থেকে ধ্বংস করে দেয়ার
চক্রান্তেরই অংশ।’
বিশ্ববিবেক যুক্তরাষ্ট্রের এই অপরাধের
তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু মার্কিন নেতারা প্রথমে একটা দায়সারা
গোছের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, ভুলক্রমে ঘটনাটি ঘটেছে।
অবশ্য মার্কিন কর্মকর্তাদের এই মিথ্যাচার
খুব শিগগিরই স্পষ্ট হয় যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগান আমেরিকার ওই
যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন উইল রজার্সকে সাহসিকতার পদক হিসেবে একটি মেডেল
পরিয়ে দেন।
ওই হামলার বিষয়ে মার্কিন নেতারা কখনও কোনো দুঃখ প্রকাশতো করেইনি বরং
অমানবিক অবস্থান নিয়ে তারা ওই অপরাধের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ‘হোয়াট রিয়েলি
হেপেন্ড ডট কম’ ওয়েবসাইটের ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস
প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এই অপরাধযজ্ঞ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি কখনোই ওই ঘটনার
জন্য ক্ষমা চাইবো না। কী ঘটেছে এবং বাস্তবতা কী,এসবকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি
না।’ ওয়েব সাইটটি আরো লিখেছে, ইরানি বিমান ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত সবাইকে পদক
দেয়া হয়েছে। সে সময় ভিনসেন্স জাহাজে যারা ছিলেন তারা সবাই পুরস্কৃত হয়েছেন।
ওই ঘটনার পর ভিনসেন্স যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন উইলিয়াম রজার্স এক
সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি প্রয়োজনে শত শত বারও এ ধরনের নির্দেশ দিতে
কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
উল্লেখ্য, পরে এটা জানা গেছে যে, মার্কিন
যুদ্ধ জাহাজের যেই সেনাকে যাত্রীবাহী ইরানি বিমান টার্গেট করে
ক্ষেপণা্স্ত্র ছুঁড়তে বলা হয়েছিল সে প্রথমে ওই অমানবিক নির্দেশ শুনে হতবাক
হয়ে গিয়েছিল (কারণ, জাহাজের সবার কাছেই এটা স্পষ্ট ছিল যে ইরানি বিমানটি
ছিল একটি যাত্রীবাহী বিমান) এবং তাই সে ওই নির্দেশ মানতে প্রথমে অস্বীকৃতি
জানিয়েছিল। কিন্তু এরপর যখন তাকে কোর্ট মার্শাল করার তথা সামরিক আদালতে
বিচার করার হুমকি দেয়া হয় তখন সে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের নির্দেশ পালন করে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ভুলক্রমে নয় বরং যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বংসের ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক ও ইচ্ছাকৃত।
এরপর এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ইরান
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা
পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ কেবল দুঃখ প্রকাশ করে, যুক্তরাষ্ট্রের
বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাবও তারা গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল
সংস্থাও কেবল নিহত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে। তাদের দাবি,
বিমান বিধ্বংসের ঘটনাটি ভুলক্রমে ঘটেছে এবং এর পেছনে অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল
না।
যাইহোক, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে
ইরানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র নিহতদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ
দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আদেশ দেয়। ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা এ
অঞ্চলে মার্কিন সেনা উপস্থিতির নেতিবাচক পরিণতির একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। এ
দুঃখজনক ঘটনার দুই দশকেরও বেশি সময় পার হবার পরও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি
পশ্চিমা দেশ এ অঞ্চলের স্থল ও পানি সীমায় দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং
আরো বেশী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। অথচ তাদের উপস্থিতির ফলে এ অঞ্চলে
নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইরান সবসময়ই বলে আসছে বিদেশী সামরিক
উপস্থিতি এ অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী এবং আঞ্চলিক দেশগুলোই পারে
শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে।
No comments