কবিতার কোন মৃত্যু নেই : আল মাহমুদ by শাহীন রেজা
আল মাহমুদ |
আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ মৃত্যু বরণ করেন। তার
প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক,
প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। আধুনিক বাংলা
কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ,
নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে
পরম আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে এনেছেন তার কবিতায়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে
সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে
বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ। ১৯৬৮ সালে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্, ভঙ্গির সমন্বয়ে। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও বাংলা গল্পের এক আশ্চর্য সাহসী রূপকার আল মাহমুদ। এ মহান মানুষটির জন্মদিন উপলক্ষে সাহিত্য ও জীবন-যাপনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন- শাহীন রেজা। @মানবকণ্ঠ।
আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঢাকাই হচ্ছে বাংলা কবিতার রাজধানী। এখনো কি সেই বিশ্বাসে আপনি অবিচল আছেন?
অবশ্যই। বাংলা কবিতা নিয়ে আমি এ বাংলা ও বাংলা বিভাজনে যেতে চাই না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সারাবিশ্বে যেখানে যত বাংলা কবিতা রচিত হচ্ছে তার ক্ষেত্রভূমি এই ঢাকা। ঢাকাতে কবিতা নিয়ে যা হয়েছে এবং হচ্ছে তা বিশ্বের কোথাও হয়নি। তাই একে বাংলা কবিতার রাজধানী হিসেবে স্বীকার করে নিতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
সবকিছুরই সমাপ্তি আছে- কবিতারও কি?
না কবিতার কোনো মৃত্যু নেই, সমাপ্তি নেই। কবিতা কালের ধ্বনি। এর ধারা এককাল থেকে অন্যকালে ছড়ায়। চর্যাপদ থেকে আজকের কবিতা কোনোটাই হারানোর নয়। অতীতে যেমন হারায়নি আগামীতেও হারাবে না।
এবার মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আসি-
দেখো একটি জাতির জন্য এর চেয়ে গৌরবের আর কোনো ব্যাপার নেই। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা একটা মানচিত্র পেয়েছি, একটা পতাকা পেয়েছি। আমাদের যে জাতিসত্তা তা বিনির্মাণেও এর ভূমিকা অপরিসীম। তবে এর জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে।
একাত্তরে আপনার ভূমিকা প্রসঙ্গে যদি জানতে চাই-
আমার একাত্তরের ভূমিকা সবাই জানে। এটা আর নতুন করে বলতে চাই না। যদি তাঁবেদারি করতাম তাহলে এদেশে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বেশ ভালোভাবেই কাটাতে পারতাম। অনেকে সেটি করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর ভোল পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক সেজে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন। আমি তাঁবেদারি করিনি বলেই আমাকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে কলকাতা যেতে হয়েছে। এরপরের ইতিহাস তো সবাই জানে।
কিন্তু এখনো তো একশ্রেণির লোক আপনাকে মৌলবাদী বলে আখ্যা দেয়?
আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। নিয়মিত নামাজ পড়ি এবং রোজা রাখি। আমার এ বিশ্বাসকে যদি কেউ মৌলবাদী বলতে চায়, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি কারো কথায় আমার বিশ্বাস থেকে বেরুতে পারি না।
জীবনের শুরুতে আপনি বাম চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলেন আর এখন সম্পূর্ণ ঈশ্বরবাদী- এটাকে কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলা যায় না?
না যায় না। আমি এখনো একই বিশ্বাসে অবিচল। বাম চিন্তার প্রতি আমার অনুরাগের কারণ তাদের মানব মুক্তির স্লোগান। আমি মনে করেছিলাম সাম্য ও মানব মুক্তির জন্য তাদের পথ ও স্লোগানই সর্বোত্তম। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম, ইসলামই একমাত্র পথ যাতে এ চিন্তার সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে। তাই আল্লাহর পথেই সাম্য ও মানব মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে নিলাম।
কবি হতে হলে প্রথমেই কী কী জিনিস অর্জন করতে হয়।
প্রথমেই একটি তৃতীয় নয়ন। তারপরে ভাব ও ভাষাকে আয়ত্ত করা। ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান আর সবশেষে পাঠক মনে সহজেই প্রবিষ্ট হওয়ার কৌশল অর্জন।
এ মুহূর্তে যদি দেশের প্রধান কবি হিসেবে আপনাকে শনাক্ত করতে চাই তাহলে তার উত্তরে আপনি কী বলবেন?
আমি প্রধান কবি হওয়ার জন্য কোনোদিন কবিতা লিখিনি। আমি চিরকাল শুধু একজন কবি হতে চেয়েছি। আজ সর্বত্র বিশেষ করে এই উপমহাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীদের মুখে আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। এতে আমি অবাক হই না। এটা তো হতেই পারে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই আর উপভোগের কথা বলছেন- ভালোই তো লাগে। জীবন সায়াহ্নে তাদের এই উচ্চারণ আমাকে উজ্জীবিত করে, আপ্লুত করে।
কবিতার জন্য জীবন, নাকি জীবনের জন্য কবিতা?
মাহমুদ: ধরে নাও এটি একটি সংসার। কবিতা যদি রমণী হয় তাহলে জীবন পুরুষ। দুজনেই দুজনার। এদের আলাদা করার উপায় নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক।
আপনার দশকের একজন প্রভাবশালী কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সোনালী কাবিন’-এর জন্য কবি মাহমুদ নোবেল পাওয়ার যোগ্য। আপনি কী বলেন-
এটা যদি কেউ বলে তাহলে আমার কি আর বলার কিছু আছে? তবে পৃথিবীতে অনেক বড় কবি আছেন যারা নোবেল পাননি অথচ তাদের কবিতা আমাদের নিত্য-পাঠ্য। আমি মনে করি, কবিতা কবিতাই। কবিতা কখনোই কোনো নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষী নয়।
জীবনানন্দ দাশকে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবর্তক বলা হয়। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আধুনিক নন?
সন্দেহ নাই যে জীবনানন্দ দাশ আধুুনিক কবি। কিন্তু বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এক সময়ের প্রবল কবি ফররুখ আহমদ কিংবা জসীমউদ্দীন এখন অনেকটাই আড়ালে- বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আমি বিষয়টিকে মূল্যায়ন করি এভাবে- কালচক্রে যারা কবিতায় নতুনত্ব নিয়ে আসেন নিঃসন্দেহে জসীমউদ্দীন তাদের একজন। জসীমউদ্দীনের কবিতার একটি লাইন আমি বলছি- ‘কাল সে আসিবে মুখখানি যার নতুন চরের মতো’- এই পঙ্ক্তিটি বাংলা কাব্যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। এর আগে কেউ মাটির সঙ্গে, চরের সঙ্গে প্রিয়তম নারীর মুখের তুলনা দেয়নি। যত তুলনা এর আগে দেয়া হয়েছে সব চাঁদের সঙ্গে। জসীমউদ্দীন প্রথম এই ধারা ভঙ্গ করেন। কোনো সৃজনশীল কবি কখনোই আড়ালে যান না। হয়তো নতুনত্বের জোয়ারে তারা একটু পাশে সরে থাকেন। ফররুখ কিংবা জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে।
আমাদের দেশে কবিরা গোষ্ঠী বিভাজনে বিভক্ত- এটা কি আমাদের কবিতার জন্য ক্ষতিকর নয়?
এটা কখনো কখনো ক্ষতিকর হয় তবে এই গোষ্ঠী বিভাজন সব সময়ই ছিল। সব কালেই ছিল। নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিল কবির কোলাহল এবং কবির উচ্চারণই হলো ভাষার গতিবেগ নির্ধারণ। মানুষের ভাষা আছে আর কারো কোনো ভাষা নেই।
বোদ্ধারা বলেন, একজন কবির জীবনে প্রেমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
সব সময় হয়তো একমত হই না। তবে প্রেম কার না জীবনে আছে বলো? প্রেম আছে, একটি নারী আছে আত্মার ভেতরে।
সাহিত্যের সঙ্গে অর্থনীতির কোনো যোগসূত্র আছে কি?
আছে। কবিরাও মানুষ- তাদেরও খেতে হয়, বাসাভাড়া দিতে হয়।
একজন কবির প্রকৃত অর্জন কী- পুরস্কার, পদক নাকি মানুষের ভালোবাসা?
অবশ্যই মানুষের ভালোবাসা। তবে পুরস্কার বা পদক কবিকে উৎসাহিত করে।
একজন কবির চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
ছন্দের দোলা বুকে রেখে পঙ্ক্তি রচনা করা
তরুণ কবিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন-
কবিতা সব সময় তারুণ্যের মুখাপেক্ষী। তরুণরাই কাব্য, সাহিত্যে নতুন কিছু নিয়ে আসে। আমি সব সময় এটা মনে করি। তরুণদের বলি- সৎ হও, মানুষ হও। প্রকৃত কবি হয়ে বেড়ে ওঠো।
আপনার দীর্ঘ জীবনের স্বপ্ন, প্রাপ্তি ও অপূর্ণতা কী?
যখন কিছু মুখের কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করতে যাই তখন পারি না। নাম মনে থাকে না। ধাম হারিয়ে গেছে। সে জন্যই সম্ভবত আমার বাম দিকটা সবসময় শূন্যতার হাহাকারে ভরা।
আমি কবি। স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাই আমার কাজ। যদি দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে এভাবে একদিন অন্তিমে পৌঁছে যাব। এ কথা তো সবারই জানা যে, আমি সাধ্যমতো লিখেছি। কী লিখেছি সেটা আমিও জানতে চাই না। আজও এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখে কোথাও পৌঁছবার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তো জানি না, এটা কোন জায়গা। এখন কোথায় আছি। বলার মতো কথা হলো পথে আছি কিংবা হয়তো বা কোনো প্রান্তরে আছি। কোনো পরিসমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি না। তা বলে আমি তো পরিশ্রম কম করিনি। পৌঁছতে চাই। কিন্তু কোথায় পৌঁছব? আমার আগে যারা আমার মতো পথে-প্রান্তরে পরিশ্রম ঝরিয়ে চলে গেছেন তাদের ঘাম শুকানোর কোনো বিশ্রাম ছিল না। আমি বিশ্রাম চাই, বিরাম চাই, পরিণাম চাই।
আমার পরিশ্রম তো কবির পরিশ্রম। এটা বৃথা যেতে পারে না। আমি স্বপ্ন নির্মাণ করি এবং সত্যের কাছে এনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিই। এই তো হাত পেতেছি আমার প্রাপ্য আমাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দাও। আমি বেশি চাই না, কমও আমাকে দেয়া উচিত নয়। জগতে কবিকে বঞ্চিত রাখার মহৎ-ক্ষুদ্র-বৃহৎ ইতিহাস পাওয়া যায়। সে সব পর্যালোচনা করলে আজও পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কবির প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা নানা টালবাহানার পর যখন সত্যিই কবির বাসস্থানে এসে পৌঁছে তখন দেখা যায় অন্য গেট দিয়ে কবির লাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো জগতের কবিদের বঞ্চনার নিয়ম। কিন্তু কোনো কবিই এই নিয়মের আয়ত্তে আসতে সম্মত হননি। তিনি সোনার টাকার পরিবর্তে রুপোর টাকা গ্রহণ করতে সম্মত হননি। সব সুলতানই শেষ পর্যন্ত কবিকে ঠেকাতে গিয়ে জুলুমের ভাগী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সোনার টাকাই তাকে দিতে হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, কবি জীবিত থাকতে তা দেখে যেতে পারেননি। সোনার টাকা আসে মৃত্যুর পর।
লেখালেখির পথে আমার পরেও মানুষ আসবে। তারা আমার আগেও এসেছিলেন। এই জটিল লেনদেনের খেলায় কেবল কবিরাই চিরকাল বঞ্চিত থাকবে কেন? কেন তারা ছেড়ে দেবে তাদের সত্যিকার পাওনাটা। কম কেন নেবে? কারণ দম ফুরানোর আগে আমি তো বিশ্রাম নেইনি। বিরাম ছিল না আমার। কত বিভিন্ন রসে আমি রসসিক্ত করেছি বাংলাদেশের মাটিকে। তা না হলে কি তুমি ভাব বাংলাদেশ এত সবুজ হতো। এই শ্যামলিমা আমার রক্ত, মাংসের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছে। এর কোনো পরাজয় নেই। তবে জয়ের স্বীকৃতি স্বাভাবিকভাবে কবির করায়ত্ত হতে চায় না। কবি শুধু কবিই আর কিছু নন। কবি না থাকলে কী কী থাকবে না তা কি তুমি জান? যদি না জান তাহলে লিখে নাও, কবি না থাকলে স্বপ্ন থাকবে না, সবুজ থাকবে না, সংগীত থাকবে না আর থাকবে না ভালোবাসা। যার কথা তোমরা দিবস রজনী বলতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও।
তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। সম্পাদনা করেছেন দৈনিক গণকণ্ঠ। ১৯৬৮ সালে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্, ভঙ্গির সমন্বয়ে। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও বাংলা গল্পের এক আশ্চর্য সাহসী রূপকার আল মাহমুদ। এ মহান মানুষটির জন্মদিন উপলক্ষে সাহিত্য ও জীবন-যাপনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন- শাহীন রেজা। @মানবকণ্ঠ।
আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঢাকাই হচ্ছে বাংলা কবিতার রাজধানী। এখনো কি সেই বিশ্বাসে আপনি অবিচল আছেন?
অবশ্যই। বাংলা কবিতা নিয়ে আমি এ বাংলা ও বাংলা বিভাজনে যেতে চাই না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সারাবিশ্বে যেখানে যত বাংলা কবিতা রচিত হচ্ছে তার ক্ষেত্রভূমি এই ঢাকা। ঢাকাতে কবিতা নিয়ে যা হয়েছে এবং হচ্ছে তা বিশ্বের কোথাও হয়নি। তাই একে বাংলা কবিতার রাজধানী হিসেবে স্বীকার করে নিতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
সবকিছুরই সমাপ্তি আছে- কবিতারও কি?
না কবিতার কোনো মৃত্যু নেই, সমাপ্তি নেই। কবিতা কালের ধ্বনি। এর ধারা এককাল থেকে অন্যকালে ছড়ায়। চর্যাপদ থেকে আজকের কবিতা কোনোটাই হারানোর নয়। অতীতে যেমন হারায়নি আগামীতেও হারাবে না।
এবার মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আসি-
দেখো একটি জাতির জন্য এর চেয়ে গৌরবের আর কোনো ব্যাপার নেই। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা একটা মানচিত্র পেয়েছি, একটা পতাকা পেয়েছি। আমাদের যে জাতিসত্তা তা বিনির্মাণেও এর ভূমিকা অপরিসীম। তবে এর জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে।
একাত্তরে আপনার ভূমিকা প্রসঙ্গে যদি জানতে চাই-
আমার একাত্তরের ভূমিকা সবাই জানে। এটা আর নতুন করে বলতে চাই না। যদি তাঁবেদারি করতাম তাহলে এদেশে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বেশ ভালোভাবেই কাটাতে পারতাম। অনেকে সেটি করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর ভোল পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক সেজে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন। আমি তাঁবেদারি করিনি বলেই আমাকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে কলকাতা যেতে হয়েছে। এরপরের ইতিহাস তো সবাই জানে।
কিন্তু এখনো তো একশ্রেণির লোক আপনাকে মৌলবাদী বলে আখ্যা দেয়?
আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। নিয়মিত নামাজ পড়ি এবং রোজা রাখি। আমার এ বিশ্বাসকে যদি কেউ মৌলবাদী বলতে চায়, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি কারো কথায় আমার বিশ্বাস থেকে বেরুতে পারি না।
জীবনের শুরুতে আপনি বাম চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলেন আর এখন সম্পূর্ণ ঈশ্বরবাদী- এটাকে কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলা যায় না?
না যায় না। আমি এখনো একই বিশ্বাসে অবিচল। বাম চিন্তার প্রতি আমার অনুরাগের কারণ তাদের মানব মুক্তির স্লোগান। আমি মনে করেছিলাম সাম্য ও মানব মুক্তির জন্য তাদের পথ ও স্লোগানই সর্বোত্তম। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম, ইসলামই একমাত্র পথ যাতে এ চিন্তার সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে। তাই আল্লাহর পথেই সাম্য ও মানব মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে নিলাম।
কবি হতে হলে প্রথমেই কী কী জিনিস অর্জন করতে হয়।
প্রথমেই একটি তৃতীয় নয়ন। তারপরে ভাব ও ভাষাকে আয়ত্ত করা। ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান আর সবশেষে পাঠক মনে সহজেই প্রবিষ্ট হওয়ার কৌশল অর্জন।
এ মুহূর্তে যদি দেশের প্রধান কবি হিসেবে আপনাকে শনাক্ত করতে চাই তাহলে তার উত্তরে আপনি কী বলবেন?
আমি প্রধান কবি হওয়ার জন্য কোনোদিন কবিতা লিখিনি। আমি চিরকাল শুধু একজন কবি হতে চেয়েছি। আজ সর্বত্র বিশেষ করে এই উপমহাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীদের মুখে আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। এতে আমি অবাক হই না। এটা তো হতেই পারে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই আর উপভোগের কথা বলছেন- ভালোই তো লাগে। জীবন সায়াহ্নে তাদের এই উচ্চারণ আমাকে উজ্জীবিত করে, আপ্লুত করে।
কবিতার জন্য জীবন, নাকি জীবনের জন্য কবিতা?
মাহমুদ: ধরে নাও এটি একটি সংসার। কবিতা যদি রমণী হয় তাহলে জীবন পুরুষ। দুজনেই দুজনার। এদের আলাদা করার উপায় নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক।
আপনার দশকের একজন প্রভাবশালী কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সোনালী কাবিন’-এর জন্য কবি মাহমুদ নোবেল পাওয়ার যোগ্য। আপনি কী বলেন-
এটা যদি কেউ বলে তাহলে আমার কি আর বলার কিছু আছে? তবে পৃথিবীতে অনেক বড় কবি আছেন যারা নোবেল পাননি অথচ তাদের কবিতা আমাদের নিত্য-পাঠ্য। আমি মনে করি, কবিতা কবিতাই। কবিতা কখনোই কোনো নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষী নয়।
জীবনানন্দ দাশকে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবর্তক বলা হয়। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল আধুনিক নন?
সন্দেহ নাই যে জীবনানন্দ দাশ আধুুনিক কবি। কিন্তু বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এক সময়ের প্রবল কবি ফররুখ আহমদ কিংবা জসীমউদ্দীন এখন অনেকটাই আড়ালে- বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আমি বিষয়টিকে মূল্যায়ন করি এভাবে- কালচক্রে যারা কবিতায় নতুনত্ব নিয়ে আসেন নিঃসন্দেহে জসীমউদ্দীন তাদের একজন। জসীমউদ্দীনের কবিতার একটি লাইন আমি বলছি- ‘কাল সে আসিবে মুখখানি যার নতুন চরের মতো’- এই পঙ্ক্তিটি বাংলা কাব্যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। এর আগে কেউ মাটির সঙ্গে, চরের সঙ্গে প্রিয়তম নারীর মুখের তুলনা দেয়নি। যত তুলনা এর আগে দেয়া হয়েছে সব চাঁদের সঙ্গে। জসীমউদ্দীন প্রথম এই ধারা ভঙ্গ করেন। কোনো সৃজনশীল কবি কখনোই আড়ালে যান না। হয়তো নতুনত্বের জোয়ারে তারা একটু পাশে সরে থাকেন। ফররুখ কিংবা জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে।
আমাদের দেশে কবিরা গোষ্ঠী বিভাজনে বিভক্ত- এটা কি আমাদের কবিতার জন্য ক্ষতিকর নয়?
এটা কখনো কখনো ক্ষতিকর হয় তবে এই গোষ্ঠী বিভাজন সব সময়ই ছিল। সব কালেই ছিল। নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছিল কবির কোলাহল এবং কবির উচ্চারণই হলো ভাষার গতিবেগ নির্ধারণ। মানুষের ভাষা আছে আর কারো কোনো ভাষা নেই।
বোদ্ধারা বলেন, একজন কবির জীবনে প্রেমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আপনি কি এর সঙ্গে একমত?
সব সময় হয়তো একমত হই না। তবে প্রেম কার না জীবনে আছে বলো? প্রেম আছে, একটি নারী আছে আত্মার ভেতরে।
সাহিত্যের সঙ্গে অর্থনীতির কোনো যোগসূত্র আছে কি?
আছে। কবিরাও মানুষ- তাদেরও খেতে হয়, বাসাভাড়া দিতে হয়।
একজন কবির প্রকৃত অর্জন কী- পুরস্কার, পদক নাকি মানুষের ভালোবাসা?
অবশ্যই মানুষের ভালোবাসা। তবে পুরস্কার বা পদক কবিকে উৎসাহিত করে।
একজন কবির চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
ছন্দের দোলা বুকে রেখে পঙ্ক্তি রচনা করা
তরুণ কবিদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন-
কবিতা সব সময় তারুণ্যের মুখাপেক্ষী। তরুণরাই কাব্য, সাহিত্যে নতুন কিছু নিয়ে আসে। আমি সব সময় এটা মনে করি। তরুণদের বলি- সৎ হও, মানুষ হও। প্রকৃত কবি হয়ে বেড়ে ওঠো।
আপনার দীর্ঘ জীবনের স্বপ্ন, প্রাপ্তি ও অপূর্ণতা কী?
যখন কিছু মুখের কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করতে যাই তখন পারি না। নাম মনে থাকে না। ধাম হারিয়ে গেছে। সে জন্যই সম্ভবত আমার বাম দিকটা সবসময় শূন্যতার হাহাকারে ভরা।
আমি কবি। স্বপ্নের মধ্যে হাঁটাই আমার কাজ। যদি দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে এভাবে একদিন অন্তিমে পৌঁছে যাব। এ কথা তো সবারই জানা যে, আমি সাধ্যমতো লিখেছি। কী লিখেছি সেটা আমিও জানতে চাই না। আজও এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখে কোথাও পৌঁছবার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি তো জানি না, এটা কোন জায়গা। এখন কোথায় আছি। বলার মতো কথা হলো পথে আছি কিংবা হয়তো বা কোনো প্রান্তরে আছি। কোনো পরিসমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি না। তা বলে আমি তো পরিশ্রম কম করিনি। পৌঁছতে চাই। কিন্তু কোথায় পৌঁছব? আমার আগে যারা আমার মতো পথে-প্রান্তরে পরিশ্রম ঝরিয়ে চলে গেছেন তাদের ঘাম শুকানোর কোনো বিশ্রাম ছিল না। আমি বিশ্রাম চাই, বিরাম চাই, পরিণাম চাই।
আমার পরিশ্রম তো কবির পরিশ্রম। এটা বৃথা যেতে পারে না। আমি স্বপ্ন নির্মাণ করি এবং সত্যের কাছে এনে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিই। এই তো হাত পেতেছি আমার প্রাপ্য আমাকে কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়ে দাও। আমি বেশি চাই না, কমও আমাকে দেয়া উচিত নয়। জগতে কবিকে বঞ্চিত রাখার মহৎ-ক্ষুদ্র-বৃহৎ ইতিহাস পাওয়া যায়। সে সব পর্যালোচনা করলে আজও পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কবির প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা নানা টালবাহানার পর যখন সত্যিই কবির বাসস্থানে এসে পৌঁছে তখন দেখা যায় অন্য গেট দিয়ে কবির লাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। এটাই তো জগতের কবিদের বঞ্চনার নিয়ম। কিন্তু কোনো কবিই এই নিয়মের আয়ত্তে আসতে সম্মত হননি। তিনি সোনার টাকার পরিবর্তে রুপোর টাকা গ্রহণ করতে সম্মত হননি। সব সুলতানই শেষ পর্যন্ত কবিকে ঠেকাতে গিয়ে জুলুমের ভাগী হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সোনার টাকাই তাকে দিতে হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, কবি জীবিত থাকতে তা দেখে যেতে পারেননি। সোনার টাকা আসে মৃত্যুর পর।
লেখালেখির পথে আমার পরেও মানুষ আসবে। তারা আমার আগেও এসেছিলেন। এই জটিল লেনদেনের খেলায় কেবল কবিরাই চিরকাল বঞ্চিত থাকবে কেন? কেন তারা ছেড়ে দেবে তাদের সত্যিকার পাওনাটা। কম কেন নেবে? কারণ দম ফুরানোর আগে আমি তো বিশ্রাম নেইনি। বিরাম ছিল না আমার। কত বিভিন্ন রসে আমি রসসিক্ত করেছি বাংলাদেশের মাটিকে। তা না হলে কি তুমি ভাব বাংলাদেশ এত সবুজ হতো। এই শ্যামলিমা আমার রক্ত, মাংসের মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছে। এর কোনো পরাজয় নেই। তবে জয়ের স্বীকৃতি স্বাভাবিকভাবে কবির করায়ত্ত হতে চায় না। কবি শুধু কবিই আর কিছু নন। কবি না থাকলে কী কী থাকবে না তা কি তুমি জান? যদি না জান তাহলে লিখে নাও, কবি না থাকলে স্বপ্ন থাকবে না, সবুজ থাকবে না, সংগীত থাকবে না আর থাকবে না ভালোবাসা। যার কথা তোমরা দিবস রজনী বলতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও।
No comments