চুরি যাওয়া সৌদি যুবরাজের গহনার রহস্য: রক্তাক্ত এক অধ্যায়
সৌদি রাজপ্রাসাদ থেকে চুরি গিয়েছিল
সোনা-গহনা ও অমূল্য হীরার বিরাট সম্ভার। এই চুরির পর শুরু হয় এক রক্তাক্ত
অধ্যায়। চুরির ঘটনার প্রায় তিন দশকের পর নিজের মুখেই সেই চুরির কাহিনী
জানিয়েছেন ক্রিয়াংক্রাই তেচামং।
সময়টা ১৯৮৯ সাল। স্ত্রীকে নিয়ে
মাস তিনেকের জন্য ছুটিতে গিয়েছিলেন সৌদি বাদশাহ ফাহদের পুত্র যুবরাজ
ফয়সাল। এই সুযোগেই বহু অমূল্য গয়না নিয়ে পালানোর ফন্দি আঁটেন প্রাসাদের
বিশ্বস্ত কর্মচারী ক্রিয়াংক্রাই তেচামং।
প্রাসাদ পরিষ্কার রাখার
কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি হিসেবে প্রাসাদের প্রতিটি কোণ একেবারে স্পষ্টভাবে
চিনতেন তেচামং। তাছাড়া যুবরাজ যে প্রায়ই তার সিন্দুকের তালা খোলা রেখেই
চলে যান, সে কথাও তিনি ভালই জানেন।
যুবরাজের গয়না-গাঁটি চুরির ফলে জেলে বন্দী জীবন কাটাতে হতে পারে- একথা জানার পরেও তিনি চুরির ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
১৯৮৯ সালে সৌদি যুবরাজের ২০ মিলিয়ন মূল্যের গহনা চুরি করেছিলেন ক্রিয়াংক্রাই তেচামং |
একদিন সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এলে কোনো এক কায়দায় প্রাসাদে ঢুকে পড়েন
তেচামং। অন্য সব ব্যক্তিরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন।
তারপর সুযোগ বুঝে ঢুকে যান যুবরাজের শয়নকক্ষে।
ঘর ঢুকে বেশ কিছু
গয়না-গাঁটি নিজের শরীরের সাথে স্কচটেপ দিয় ভালোভাবে বেঁধে নেন। তাছাড়া
ঘর পরিষ্কার করার যন্ত্র ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ভেতরে করেও নিয়ে আসেন অনেক
অলঙ্কার।
তেচামং যত স্বর্ণালংকার ও গহনা চুরি করেছিলেন তার ওজন প্রায় ৩০ কেজি, যার অর্থ মূল্য দু'কেটি মার্কিন ডলার।
পরবর্তীতে সৌদি কর্তাব্যক্তিরা জানান যে, চুরি যাওয়া সেই সম্পদের মধ্যে ছিল বেশ কিছু স্বর্ণের ঘড়ি ও রুবি পাথরও।
এর মধ্যে একটি ছিল অত্যন্ত দামী হীরা। ৫০ ক্যারেট ওজনের একটি নীল হীরা, যার আকৃতি অনেকটা ডিমের মতো।
হীরা
বিশেষজ্ঞ অ্যালান হার্ট বলছেন, ১০ হাজার হীরার মধ্যে এরকম নীল হীরা মাত্র
একটি পাওয়া যায়। এ ধরনের নীল উপাদান তৈরি হতে পারে মাটির ছয়শো কিলোমিটার
নীচে থাকার কারণে। ফলে এ ধরনের হীরা অত্যন্ত বিরল।
উদ্ধার করা গহনা দেখাচ্ছে পুলিশ, পাশেই হাতকড়া পরা ক্রিয়াংক্রাই |
বিশ্বের অনেক নীল হীরা এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেটোরিয়ার খনি থেকে। কিন্তু সৌদি নীল হীরাটি কোথাকার তা কারো জানা নেই।
চুরি করা সকল সম্পদ সেই রাতে প্রাসাদের ভেতরেই নানা জায়গায় লুকিয়ে
রাখেন তেচামং। পরবর্তীতে মাস খানেকের বেশি সময় ধরে সেগুলোকে একটু-একটু করে
কার্গোতে স্থানান্তরিত করা হয় থাইল্যান্ডে পাঠানোর জন্য।
এই মহাচুরির খবর যখন জানাজানি হয় ততদিনে ক্রিয়াংক্রাই তেচামং নিজের দেশ থাইল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন।
তবে
বিপুল স্বর্ণালঙ্কার সমেত কার্গো পাঠাতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন তিনি।
কেননা থাই শুল্ক বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বিরাট চালান ঠিকঠাক ভাবে
পৌঁছানোটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
এই সমস্যারও একটা সমাধান বের করেন তেচামং।
চুরি যাওয়া গহনার নথিপত্র দেখাচ্ছেন মোহাম্মদ সাইদ খোজা |
তিনি
জানতেন, থাই শুল্ক কর্মকর্তারা বড় অঙ্কের ঘুষের টাকা ফেরাতে পারবে না।
তাই কার্গোর ভেতরে একটি খামে বেশ কিছু নগদ টাকা ও একটি চিরকুট লিখে রেখে
দেন। চিরকুটটিতে লেখা ছিল: এই কার্গোতে পর্নগ্রাফি বা যৌনতা সম্পৃক্ত বস্তু
রয়েছে। তাই সার্চ না করলে ভালো হয়।
তার পরিকল্পনা খুব নিপুণভাবে
কাজে আসে। হয়তো সে জেল-জরিমানাও এড়িয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ১৯৯০-এর
জানুয়ারি মাসে সে গ্রেফতার হয়ে যায়।
থাই ও সৌদি পুলিশের উদ্যোগে
অনুসন্ধান অভিযান চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সকল স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার
করা হয়। এমনকি যেগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল সেগুলোও সংগ্রহ করে পাঠানো
হয় সৌদি প্রাসাদের ঠিকানায়।
কিন্তু বহুমূল্য এই স্বর্ণালঙ্কার ফেরত পাঠানোর সময় ঘটে আরেকটি গুরুতর
অপরাধ। সোনা-দানা হাতে পেয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ জানায়, চুরি যাওয়া
গয়না-গাঁটির ৮০ শতাংশই উধাও। যেগুলোও বা ফেরত এসেছে সেগুলোর অধিকাংশই নকল।
তারপর হঠাৎ করেই এক কাণ্ড ঘটে। উচ্চ পর্যায়ের থাই এক কর্মকর্তার
স্ত্রীর গলায় এমন একটি অমূল্য হার দেখা যায় যেটি দেখতে অবিকল প্রাসাদ
থেকে চুরি যাওয়া হীরের হারের মতন।
সেটি ছিল প্রায় ডিমের সমান বড়, ৫০ ক্যারেটের অমূল্য দুষ্প্রাপ্য নীল হীরক।
নিজের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ক্রিয়াংক্রাই তেচামং |
খুব
অল্প কয়েক বছর জেল খাটার মধ্য দিয়েই হয়তো ক্রিয়াংক্রাই তেচামঙের এই
চুরি কাহিনীর সমাপ্তি হতে পারতো। কিন্তু তা না হয়ে পুরো কাহিনীটাই হয়ে
উঠলো এক রক্তাক্ত অধ্যায়।
১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি দূতাবাসের
ভিসা বিভাগের দু'জন কর্মকর্তা থাই কম্পাউন্ডের দিকে যাচ্ছিলো। কিন্তু
সেখানে যাবার আগেই তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং তাদের হত্যা করা হয়।
নিহত কর্মকর্তাদের আরেক সহকর্মীর বাসায়ও একই সময়ে হামলা হয় এবং তাকেও হত্যা করা হয়।
এ সমস্ত ঘটনার সপ্তাহ কয়েক পর, ঘটনার অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়ে
মোহাম্মদ আল-রুয়াইলি নামের এক ব্যবসায়ীকে থাইল্যান্ডে পাঠায় সৌদি আরব।
তাকেও অপহরণ করা হয় এবং তিনি আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। মনে করা হয় যে,
তাকেও খুন করা হয়েছে।
এসমস্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত
আছে। তবে ২০১০ সালে কূটনৈতিক এক গোপন নথিতে ব্যাংককের মার্কিন দূতাবাসের
ডেপুটি প্রধান জানান যে, এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের পেছনে আসলে আছে
'হেজবুল্লাহ'।
সেখানে লেবানিজ শিয়া মুসলিম জঙ্গি গ্রুপের কথা বলা
হয়। জানানো হয়, সৌদিদের সাথে শত্রুতার জেরেই এত খুন-খারাপি। এই নথিই পরে
উইকিলিকস ফাঁস করেছিল।
ঘটনার তদন্ত করতে পরবর্তীতে মোহাম্মদ সাইদ
খোজাকে ব্যাংককে পাঠায় সৌদি আরব। মাত্র মাস তিনেক থাইল্যান্ডের থাকার
জন্যে এসে পরবর্তীতে তিনি থেকে যান কয়েক বছর। তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন না।
ছিলেন শার্জ দা এফেয়ার্স-এর মতন একজন কর্মকর্তা।
এসময় সৌদি ও থাই
সম্পর্ক একেবারে তলানিতে নেমে আসে। থাই অভিবাসী শ্রমিকেরা যারা সৌদি আরবে
কাজ করতো তাদের সংখ্যা দুই লাখ থেকে কমে মোটে ১৫ হাজারে নেমে আসে। এর একটা
বড় ধরনের প্রভাব পরে থাই অর্থনীতিতেও।
তিন বছর একটি বৌদ্ধ মন্দিরে কাটিয়েছে ক্রিয়াংক্রাই তেচামং |
মি. খোঁজা এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে দাবী করেন, চুরি যাওয়া স্বর্ণালঙ্কারগুলো উদ্ধারের পর থাই পুলিশই সেগুলো আবার চুরি করেছিল।
থাই
পুলিশের ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে ১৯৯৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক
সাক্ষাৎকারে মি. খোঁজা মন্তব্য করেন, "থাই পুলিশ এখানে সরকারের চেয়েও
বড়।"
এরকম আরো অনেক সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন। তবে এই সাক্ষাৎকারটি দেয়া হয়েছিল বিশেষ আরেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর।
ক্রিয়াংক্রাই তেচামঙ থাইল্যান্ডে ফিরে আসার পর তার আনা স্বর্ণালঙ্কার একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর আওতায় বেচা-কেনার কাজকর্ম চলছিল।
মনে
করা হয় যে, চোরাই স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের পর পুলিশ যে সেগুলো আবার
হাতিয়ে নিয়েছিল এবং নকল গয়না বানিয়ে সৌদিতে পাঠিয়েছিল এই ঘটনার
একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন সেই স্বর্ণব্যবসায়ী।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তার স্ত্রী ও ছেলে নিখোঁজ হয় যায় এবং ব্যাংককের বাইরে একটা মার্সিডিজের ভেতর তাদের লাশ পাওয়া যায়।
মি.
খোঁজার কথাই সঠিক ছিল। পরবর্তী জানা যায়, চোরাই গয়না খুঁজে বের করার
দায়িত্ব পাবার পর পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে ঠিকই। কিন্তু সেখান থেকে কিছু
স্বর্ণালঙ্কার তারা নিজেরাই হাতিয়ে নেয়।
এই ঘটনা চেপে রাখতে সেই
স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে পুলিশ চাপ দেয় এবং তার স্ত্রী ও ছেলেকে হত্যা করা হয়।
এর দায়ে সেই সময়ের পুলিশ প্রধান, চেলোর কারর্থিস, যিনি ছিলেন মূল
অনুসন্ধানী দলের প্রধান অধিকর্তা তার ২০ বছরের জেল হয়।
বৌদ্ধ মন্দিরে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশ প্রধান চেলোর কারর্থিস |
ক্রিয়াংক্রাই
তেচামঙ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৮ বছর আগে। যুবরাজের স্বর্ণালঙ্কার চুরির
সেই ঘটনার প্রায় তিন দশক পর তার সন্ধান খুঁজে বের করে।
বর্তমানে তিনি থাইল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় আছেন। তার প্রথমে ৫ বছরের সাজা হলেও পরবর্তীতে তা কমিয়ে দুই বছর সাত মাস করা হয়।
তিনি
জানান, গ্রেফতার হবার পর তার দিনগুলো ছিল ভীষণ কষ্টের। তখন দিনের পর দিন
এমনকি সপ্তাহও তিনি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। তিনি খুব ভয়াক্রান্ত হয়ে
পড়েন এবং সব কিছুতেই ভীত-সন্ত্রস্ত বোধ করতেন।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি নিজের নাম পাল্টে নেন। কারণ তিনি চাননি তার জন্য নিজের ছেলে বিব্রতকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাক।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হবার সিদ্ধান্ত নেন।
এখন
তিনি ভিক্ষু হিসেবে আছেন। ভিক্ষু হিসেবে তার অভিষেক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকেও
আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে নিজের বক্তব্যে ক্রিয়াংক্রাই তেচামঙ
বলেন, 'জীবন থেকে সৌদি হীরকের শাপ মোচনের জন্যই' তিনি এই ভিক্ষুর জীবন বেছে
নিয়েছেন।
No comments