যেসব কারণে বাড়ছে ক্যানসার by মরিয়ম চম্পা
জাকিয়া
সুলতানা। পরিবারের সদস্যদের কাছে পরিচিত ছিলেন জাকি নামেই। ছোট বেলায় মাকে
হারিয়ে সংসারের হাল ধরেন। বিয়েও হয়ে যায় অল্প বয়সেই। স্বামী-সংসার
সামলিয়েছেন দুই হাতে। নিজে শিক্ষিত না হলেও সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত
করেছেন। সবে জীবনটা তার সামলে উঠেছিল। সন্তানরা সংসারের হাল ধরার চেষ্টায়
ছিলেন।
ঠিক এ সময় ৪৮ বছরের এই নারীর জীবনে হানা দেয় ঘাতক ব্যাধি ক্যানসার। শুধু একটি মানুষের জীবনই নয়, তছনছ হয়ে যায় পুরো একটি পরিবার পরিবারের স্বপ্ন।
ক্যানসার এমন এক রোগ যা ব্যক্তির পাশাপাশি পুরো পরিবারের আর্থিক সংগতিতেও আঘাত হানে। তার ছেলে জহিরুল ইসলাম চন্দন বলেন, আমরা পরিবারের সদস্যরা প্রাথমিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও মানসিকভাবে সবাই প্রস্তুত হই দ্রুতই। লড়াইটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। গত বছর আমাদের কোনো ঈদ ছিল না। আমাদের কোরবানি ছিল লঞ্চে লঞ্চে। ঢাকায় আসি। এরপর এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল। একের পর এক টেস্টের কারণে মা’কে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বিলম্ব হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সিট পেতেও পোহাতে হয় দুর্ভোগ। শেষ পর্যন্ত সিটের ব্যবস্থা হয়। চিকিৎসকরা অবশ্য তার ক্যানসারের জন্য ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করেন। এই লড়াইয়ে হেরে যান জাকিয়া সুলতানা। দুই মাস ১০ দিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ইন্তেকাল করেন তিনি। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। চিকিৎসকরা এর জন্য পরিবেশ এবং খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করেছেন।
সাঈদার বয়স মাত্র ১১ বছর। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি বগুড়া। দেড় বছর আগে তার ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেছেন বাবা মুস্তাক আলী। তার পরেও মনোবল হারাননি। ভেঙ্গে পড়েননি মানসিকভাবে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে সাহায্য তুলে মেয়ের চিকিৎসা করাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এ পর্যন্ত মেয়ের চিকিৎসাবাবদ প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কেমোথেরাপির পার্শপ্রতিক্রিয়ায় তার একটি চোখের আলো অনেকটা ফুরিয়ে এসেছে। অপর চোখটিতেও কম দেখতে পায়। তার বাবা বলেন, এখন তো আর পারি না। আগে যারা সাহায্য সহযোগিতা করতো তারাও এখন অনেকটা এড়িয়ে চলে। বাধ্য হয়ে স্কুল, কলেজ ও মসজিদ মাদ্রাসায় সাহায্য তুলি। বয়স কম হওয়াতে চিকিৎসকরা আশ্বস্ত করেছেন নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে সাঈদা হয়তো সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে। এখন দুই শতাংশ জমির ওপর নিজের বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি হাসপাতালে এসেছেন সালাম। পেশায় রিকশা চালক। তিনি বলেন, দু-বছর আগে যখন স্ত্রী জামিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন তখন পরিবারে যেন এক দুর্যোগ নেমে এলো। ক্যানসার আমাদের মতো পরিবারের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা। আমাদের তেমন পয়সা কিংবা সামর্থ্য নাই। স্ত্রীর ক্যানসার হওয়ার পর থেকে পরিবারের বাকি সব কিছুই যেন থমকে গেছে। এই যে চিকিৎসা করাতে ঢাকায় এসেছি, বাসায় তালা। আমার সংসার বলতে কিছুই নাই।
ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম মানসিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর শুরু হয় আসল সংগ্রাম। অর্থের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। শুধু আর্থিক বিষয় নয়, একজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর দীর্ঘ দিনের সেবা, ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি- অনেক পরিবারেই সকল কর্মকাণ্ডে ছেদ তৈরি করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে ক্যানসার ও কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিমাত্রায় রাসায়নিকযুক্ত ভেজাল খাদ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। রোগী অনুপাতে চিকিৎসা সুবিধা এখনও পর্যাপ্ত নয়। ক্যানসার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকি বলেন, খাদ্যাভ্যাস দায়ী পাকস্থলী ক্যানসারের জন্য। এক্ষেত্রে শুধু ভেজাল খাবার নয় শাকসবজি কম খেলে পাকস্থলী এবং খাদ্যনালীর ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাছ মাংস বেশি খেলেও ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থকে। তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখ, খাদ্যনালী, কিডনি, পায়ুপথে ক্যানসারসহ সকল ধরনের ক্যানসার হতে পারে। ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি দায়ী হচ্ছে ধূমপান। অর্থাৎ পুরুষদের ফুসফুসে, মুখগহ্বরে, খাদ্যনালী ক্যানসার এগুলোর জন্য সবটাই দায়ী ধূমপান। মেয়েদের জরায়ু, ব্রেস্ট, মুখগহ্বরে বেশি হয়ে থাকে। ঘনঘন বাচ্চা হলে, কম বয়সে বিয়ে ইত্যাদি কারণে জরায়ু ক্যানসার হয়ে থাকে। আনুপাতিক হারে পুরুষরাই আক্রান্ত বেশি হয়। মেয়েদের ব্রেস্ট ক্যানসারের জন্য স্থূলাকার, ওজন বেশি, জন্মনিয়ন্ত্রণকারী খাবার পিল, বংশগত কারণ দায়ী। ধূমপান, পান জরদা, গুল ইত্যাদি কারণে মুখগহ্বরে ক্যানসার হতে পারে। একক কোনো কারণে মানবদেহে ক্যানসার হয় না। সমষ্টিগত কারণে হয়ে থাকে। একেক দেশের আর্থসামাজিক কারণে একেক ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে। আমাদের সংগঠনের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে মোট প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় দুই থেকে তিন লাখ মানুষ নতুন আক্রান্ত হচ্ছে। যার মধ্যে ৫০ ভাগই মারা যায়।
ক্যানসার সচেতনা বৃদ্ধিতে আমরা ঢাকা এবং ঢাকার বাহিরে প্রতি সপ্তাহে দুই বার ফ্রি ক্যাম্পেইন করে থাকি। এবং প্রতি এক থেকে দুই মাস পরপর আমরা বিভিন্ন স্কুল কলেজে ‘ক্যানসার এনসার’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে আমরা প্রায় ৫০ ভাগ ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারি।
জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন বলেন, বর্তমানে ক্যানসারের জন্য আমাদের পরিবেশ সবচেয়ে বড় দায়ী। এর সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপার আছে। আমাদের দেশে যত্রতত্র এক্সরে মেশিন রয়েছে। কোথাও দেখা যাবে টিনের বেড়া দিয়ে এক্সরে শুরু করে দিয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কারণ এই এক্সরে আমাদের পরিবেশের ব্যাকগ্রাউন্ডের যে রি-অ্যাকশন সেটা আরো উসকে বা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মানুষ আরো বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া তামাকের কারণে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিদেশে প্রতি ১শ জনে তিন জন আক্রান্ত হয়। সেখানে আমাদের দেশে প্রায় ৩০ জন ব্যক্তি আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষ তামাক বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে। কাজেই আমরা এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করলে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেহেতু পরিবেশ এর জন্য দায়ী। তাই ক্যানসার অসুখটা এমন এটা এক শ্রেণির মানুষের হবেই। এভয়েড করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। কারণ, যারা শুরুর দিকে চিকিৎসা করাতে আসে তারা চিকিৎসা সেবা নিয়ে বহু বছর পর্যন্ত বেঁচে আছে।
আমাদের দেশে সাধারণ আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রথমে পানি পড়া, এরপর হুজুরের কাছে যায়। এরপর বিভিন্ন রকমের কবিরাজি করে। এই করতে করতে দুই বছর শেষ। তারপর যখন আমাদের কাছে আসে তখন শেষ পর্যায়ে। রোগীকে তিন থেকে চার জনে ধরে নিয়ে আসে। এই পর্যায়ে ক্যানসার না হয়ে আলসার হলেও তার বাঁচার কথা না। কাজেই শরীরে শক্তি থাকা অবস্থায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে আসতে হবে। অসুখ দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকলে স্থানীয় কোনো হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করিয়ে ডা. দেখালেই বোঝা যাবে তার ক্যানসার হয়েছে কি না। কারো তিন মাস ধরে কাশি হচ্ছে, কারো শরীরে বড় চাকা দেখা দিয়েছে। তারপরেও সে সচেতন না। এক্ষেত্রে আমরা চিকিৎসক, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মিডিয়া যদি বিষয়টি আরো বেশি করে প্রচার করি এবং রোগী শুরুতেই চলে আসে তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসার নিরাময় করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগে আমাদের দেশে হাসপাতালগুলোতে ক্যানসারের এত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এখন হরহামেশাই ক্যানসারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে। এখন এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রক্তের কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই ক্যানসার নিরূপণ করতে পারি। যেটা ১০ বছর আগে মানুষ করতে পারতো না। তা ছাড়া এখন মানুষ অনেক সচেতন। একজন অশিক্ষিত মানুষ শরীরে কোনো অংশে চাকা অনুভব করলে নিজে নিজেই ডায়াগনসিস করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। এখন মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে শরীরের কোথাও একটি চাকা হলেই সেটা থেকে টিউমার বা ক্যানসার হতে পারে।
সার্ভিক্যাল ক্যানসারের আক্রান্ত হয়ে একসময় আমাদের দেশের নারীরা অনেক বেশি সাফার করতো। আমাদের সার্ভিকাল ক্যানসার প্রজেক্ট বা নারীদের জরায়ুমুখে ক্যানসার এবং ব্রেস্ট ক্যানসার অ্যাওয়ার্নেস প্রোগ্রাম রয়েছে। এই দুটি ক্যানসারের সচেতনতা বেড়ে যাওয়াতে এখন প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ক্যানসার শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসটি যদি প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে লিভার সিরোসিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফাস্টফুড বা ভাজাপোড়া খাবার, ঝাল খাবার, গ্রিল চিকেন-বিফ, স্পাইসি চিকেন-বিফ এগুলো পরিহার করতে হবে। এসব খাবারের সঙ্গে আমাদের পায়খানার রাস্তায় ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভেজাল খাদ্যের জন্য শুধু মাত্র ক্যানসার নয় অন্যান্য অসুখের পাশাপাশি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ক্যানসার থেকে সুরক্ষা পেতে আমাদের সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা প্রয়োজন। বিশেষ করে আমরা যারা দায়িত্বশীল অবস্থানে আছি প্রত্যেককে সম্মিলিতভাবে সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্যানসারের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিশ্ব ক্যানসার দিবসে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কতগুলো বেসিক বিষয়ে আমরা বিভিন্ন র্যালি এবং সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে ক্যানসারের কুফল সম্পর্কে জানিয়ে থাকি। পান, সিগারেট, জরদা, সুপারি, গুল এসব তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখের ক্যানসার থেকে শুরু করে স্টোমাক, খাদ্যনালী, পায়খানার রাস্তায় পুরো জায়গাতেই ক্যানসারের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
ঠিক এ সময় ৪৮ বছরের এই নারীর জীবনে হানা দেয় ঘাতক ব্যাধি ক্যানসার। শুধু একটি মানুষের জীবনই নয়, তছনছ হয়ে যায় পুরো একটি পরিবার পরিবারের স্বপ্ন।
ক্যানসার এমন এক রোগ যা ব্যক্তির পাশাপাশি পুরো পরিবারের আর্থিক সংগতিতেও আঘাত হানে। তার ছেলে জহিরুল ইসলাম চন্দন বলেন, আমরা পরিবারের সদস্যরা প্রাথমিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও মানসিকভাবে সবাই প্রস্তুত হই দ্রুতই। লড়াইটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। গত বছর আমাদের কোনো ঈদ ছিল না। আমাদের কোরবানি ছিল লঞ্চে লঞ্চে। ঢাকায় আসি। এরপর এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতাল। একের পর এক টেস্টের কারণে মা’কে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বিলম্ব হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সিট পেতেও পোহাতে হয় দুর্ভোগ। শেষ পর্যন্ত সিটের ব্যবস্থা হয়। চিকিৎসকরা অবশ্য তার ক্যানসারের জন্য ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করেন। এই লড়াইয়ে হেরে যান জাকিয়া সুলতানা। দুই মাস ১০ দিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ইন্তেকাল করেন তিনি। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। চিকিৎসকরা এর জন্য পরিবেশ এবং খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করেছেন।
সাঈদার বয়স মাত্র ১১ বছর। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি বগুড়া। দেড় বছর আগে তার ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেছেন বাবা মুস্তাক আলী। তার পরেও মনোবল হারাননি। ভেঙ্গে পড়েননি মানসিকভাবে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে সাহায্য তুলে মেয়ের চিকিৎসা করাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এ পর্যন্ত মেয়ের চিকিৎসাবাবদ প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কেমোথেরাপির পার্শপ্রতিক্রিয়ায় তার একটি চোখের আলো অনেকটা ফুরিয়ে এসেছে। অপর চোখটিতেও কম দেখতে পায়। তার বাবা বলেন, এখন তো আর পারি না। আগে যারা সাহায্য সহযোগিতা করতো তারাও এখন অনেকটা এড়িয়ে চলে। বাধ্য হয়ে স্কুল, কলেজ ও মসজিদ মাদ্রাসায় সাহায্য তুলি। বয়স কম হওয়াতে চিকিৎসকরা আশ্বস্ত করেছেন নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে সাঈদা হয়তো সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে। এখন দুই শতাংশ জমির ওপর নিজের বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি হাসপাতালে এসেছেন সালাম। পেশায় রিকশা চালক। তিনি বলেন, দু-বছর আগে যখন স্ত্রী জামিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন তখন পরিবারে যেন এক দুর্যোগ নেমে এলো। ক্যানসার আমাদের মতো পরিবারের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা। আমাদের তেমন পয়সা কিংবা সামর্থ্য নাই। স্ত্রীর ক্যানসার হওয়ার পর থেকে পরিবারের বাকি সব কিছুই যেন থমকে গেছে। এই যে চিকিৎসা করাতে ঢাকায় এসেছি, বাসায় তালা। আমার সংসার বলতে কিছুই নাই।
ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম মানসিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর শুরু হয় আসল সংগ্রাম। অর্থের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। শুধু আর্থিক বিষয় নয়, একজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর দীর্ঘ দিনের সেবা, ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি- অনেক পরিবারেই সকল কর্মকাণ্ডে ছেদ তৈরি করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে ক্যানসার ও কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিমাত্রায় রাসায়নিকযুক্ত ভেজাল খাদ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। রোগী অনুপাতে চিকিৎসা সুবিধা এখনও পর্যাপ্ত নয়। ক্যানসার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকি বলেন, খাদ্যাভ্যাস দায়ী পাকস্থলী ক্যানসারের জন্য। এক্ষেত্রে শুধু ভেজাল খাবার নয় শাকসবজি কম খেলে পাকস্থলী এবং খাদ্যনালীর ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাছ মাংস বেশি খেলেও ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থকে। তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখ, খাদ্যনালী, কিডনি, পায়ুপথে ক্যানসারসহ সকল ধরনের ক্যানসার হতে পারে। ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি দায়ী হচ্ছে ধূমপান। অর্থাৎ পুরুষদের ফুসফুসে, মুখগহ্বরে, খাদ্যনালী ক্যানসার এগুলোর জন্য সবটাই দায়ী ধূমপান। মেয়েদের জরায়ু, ব্রেস্ট, মুখগহ্বরে বেশি হয়ে থাকে। ঘনঘন বাচ্চা হলে, কম বয়সে বিয়ে ইত্যাদি কারণে জরায়ু ক্যানসার হয়ে থাকে। আনুপাতিক হারে পুরুষরাই আক্রান্ত বেশি হয়। মেয়েদের ব্রেস্ট ক্যানসারের জন্য স্থূলাকার, ওজন বেশি, জন্মনিয়ন্ত্রণকারী খাবার পিল, বংশগত কারণ দায়ী। ধূমপান, পান জরদা, গুল ইত্যাদি কারণে মুখগহ্বরে ক্যানসার হতে পারে। একক কোনো কারণে মানবদেহে ক্যানসার হয় না। সমষ্টিগত কারণে হয়ে থাকে। একেক দেশের আর্থসামাজিক কারণে একেক ধরনের ক্যানসার হয়ে থাকে। আমাদের সংগঠনের জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে মোট প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রতিবছর প্রায় দুই থেকে তিন লাখ মানুষ নতুন আক্রান্ত হচ্ছে। যার মধ্যে ৫০ ভাগই মারা যায়।
ক্যানসার সচেতনা বৃদ্ধিতে আমরা ঢাকা এবং ঢাকার বাহিরে প্রতি সপ্তাহে দুই বার ফ্রি ক্যাম্পেইন করে থাকি। এবং প্রতি এক থেকে দুই মাস পরপর আমরা বিভিন্ন স্কুল কলেজে ‘ক্যানসার এনসার’ নামে একটি অনুষ্ঠান করি। ক্যানসার সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে আমরা প্রায় ৫০ ভাগ ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারি।
জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন বলেন, বর্তমানে ক্যানসারের জন্য আমাদের পরিবেশ সবচেয়ে বড় দায়ী। এর সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপার আছে। আমাদের দেশে যত্রতত্র এক্সরে মেশিন রয়েছে। কোথাও দেখা যাবে টিনের বেড়া দিয়ে এক্সরে শুরু করে দিয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কারণ এই এক্সরে আমাদের পরিবেশের ব্যাকগ্রাউন্ডের যে রি-অ্যাকশন সেটা আরো উসকে বা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে মানুষ আরো বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া তামাকের কারণে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিদেশে প্রতি ১শ জনে তিন জন আক্রান্ত হয়। সেখানে আমাদের দেশে প্রায় ৩০ জন ব্যক্তি আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষ তামাক বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে। কাজেই আমরা এই অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করলে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। যেহেতু পরিবেশ এর জন্য দায়ী। তাই ক্যানসার অসুখটা এমন এটা এক শ্রেণির মানুষের হবেই। এভয়েড করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। কারণ, যারা শুরুর দিকে চিকিৎসা করাতে আসে তারা চিকিৎসা সেবা নিয়ে বহু বছর পর্যন্ত বেঁচে আছে।
আমাদের দেশে সাধারণ আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রথমে পানি পড়া, এরপর হুজুরের কাছে যায়। এরপর বিভিন্ন রকমের কবিরাজি করে। এই করতে করতে দুই বছর শেষ। তারপর যখন আমাদের কাছে আসে তখন শেষ পর্যায়ে। রোগীকে তিন থেকে চার জনে ধরে নিয়ে আসে। এই পর্যায়ে ক্যানসার না হয়ে আলসার হলেও তার বাঁচার কথা না। কাজেই শরীরে শক্তি থাকা অবস্থায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে আসতে হবে। অসুখ দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকলে স্থানীয় কোনো হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করিয়ে ডা. দেখালেই বোঝা যাবে তার ক্যানসার হয়েছে কি না। কারো তিন মাস ধরে কাশি হচ্ছে, কারো শরীরে বড় চাকা দেখা দিয়েছে। তারপরেও সে সচেতন না। এক্ষেত্রে আমরা চিকিৎসক, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মিডিয়া যদি বিষয়টি আরো বেশি করে প্রচার করি এবং রোগী শুরুতেই চলে আসে তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসার নিরাময় করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগে আমাদের দেশে হাসপাতালগুলোতে ক্যানসারের এত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এখন হরহামেশাই ক্যানসারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে। এখন এমআরআই, সিটিস্ক্যান ও রক্তের কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই ক্যানসার নিরূপণ করতে পারি। যেটা ১০ বছর আগে মানুষ করতে পারতো না। তা ছাড়া এখন মানুষ অনেক সচেতন। একজন অশিক্ষিত মানুষ শরীরে কোনো অংশে চাকা অনুভব করলে নিজে নিজেই ডায়াগনসিস করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। এখন মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে শরীরের কোথাও একটি চাকা হলেই সেটা থেকে টিউমার বা ক্যানসার হতে পারে।
সার্ভিক্যাল ক্যানসারের আক্রান্ত হয়ে একসময় আমাদের দেশের নারীরা অনেক বেশি সাফার করতো। আমাদের সার্ভিকাল ক্যানসার প্রজেক্ট বা নারীদের জরায়ুমুখে ক্যানসার এবং ব্রেস্ট ক্যানসার অ্যাওয়ার্নেস প্রোগ্রাম রয়েছে। এই দুটি ক্যানসারের সচেতনতা বেড়ে যাওয়াতে এখন প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ক্যানসার শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসটি যদি প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে লিভার সিরোসিসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফাস্টফুড বা ভাজাপোড়া খাবার, ঝাল খাবার, গ্রিল চিকেন-বিফ, স্পাইসি চিকেন-বিফ এগুলো পরিহার করতে হবে। এসব খাবারের সঙ্গে আমাদের পায়খানার রাস্তায় ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভেজাল খাদ্যের জন্য শুধু মাত্র ক্যানসার নয় অন্যান্য অসুখের পাশাপাশি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ক্যানসার থেকে সুরক্ষা পেতে আমাদের সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা প্রয়োজন। বিশেষ করে আমরা যারা দায়িত্বশীল অবস্থানে আছি প্রত্যেককে সম্মিলিতভাবে সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্যানসারের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বিশ্ব ক্যানসার দিবসে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কতগুলো বেসিক বিষয়ে আমরা বিভিন্ন র্যালি এবং সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে ক্যানসারের কুফল সম্পর্কে জানিয়ে থাকি। পান, সিগারেট, জরদা, সুপারি, গুল এসব তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখের ক্যানসার থেকে শুরু করে স্টোমাক, খাদ্যনালী, পায়খানার রাস্তায় পুরো জায়গাতেই ক্যানসারের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
No comments